মাড়োয়ারির কাছে বিক্রি হল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, অভিমানে আর ফিরলেন না অবনীন্দ্রনাথ
স্বাধীনতার আগে পরে বাংলার অনেক ভূ-সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়েছে মাড়োয়ারিরা
ঘরের মেঝের ওপর সাজিয়ে রাখা হচ্ছে থরে থরে বই। দেশ-বিদেশের কত দুর্লভ বই তাতে! সাহিত্য, নাটক, শিল্প – উঁকি দিলে দেখা যাবে সব বিষয়ই। লাইব্রেরির বিশাল-বিশাল আলমারিগুলো খালি হয়ে গেল প্রায়। তারপর একদিন দালাল এল। জলের দরে বিক্রি হয়ে গেল সব বই, কলেজ স্ট্রিটের এক পুরনো বইয়ের দোকানির কাছে। শূন্য দৃষ্টিতে সে-দৃশ্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
চলে যেতে হবে তাঁকেও। যে-বাড়িতে জন্ম, বড় হওয়া, দীর্ঘ সত্তর বছরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে যে বাড়িতে, সেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে তাঁকে। বিক্রি হয়ে যাবে এই বাড়ি। দুই ভাই গগনেন্দ্রনাথ, সমরেন্দ্রনাথের পরিবার অন্যত্র চলে গেছেন আগেই। ফাঁকা বাড়িতে পরিবার নিয়ে থেকে গেছেন শুধু অবনীন্দ্রনাথ। মনে আশা, হয়তো বাড়ি বিক্রি করতে হবে না। ভাগ্যের চাকা ঘুরবে। শেষ অবধি থাকতে পারবেন এখানেই।
রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন কয়েকমাস আগে। তারপর থেকেই আলগা হতে শুরু করল ঠাকুরবাড়ির শিকড়। অবশ্য ভেতর-ভেতর ভাঙন চলছিলই। রবীন্দ্রনাথদের ছিল ৬ নম্বর বাড়ি। আর অবনীন্দ্রনাথদের ৫ নম্বর। দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের এই দুটি বাড়ি ঘিরেই তৈরি হয়েছে ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস। এটি প্রথমে ছিল দ্বারকানাথের বৈঠকখানা বাড়ি তথা বাহিরমহল। পরবর্তীকালে ঠাকুর পরিবারের একটি শাখা থাকতে শুরু করে এখানে।
কিন্তু কেন বিক্রি করে দিতে হবে ৫ নম্বর বাড়িটিকে? কারণ, দেনা। বাজারে প্রচুর ঋণ হয়ে পড়ে তিন ভাইয়ের। জমিদারির টাকাতেও সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না আর। সমাধান হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত একের পর এক বাড়ি বিক্রি করেছেন তিনভাই। তারপরেও সামাল দেওয়া গেল না। ব্যয় কমাতে পারেননি তাঁরা কিছুতেই। তথাকথিত ‘রাজকীয়’ জীবনযাপনই অন্যতম কারণ ছিল তার। শেষ পর্যন্ত বসতবাড়ি বিক্রি ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না।
কথা উঠেছিল, যদি কোর্ট অফ ওয়ার্ডস-এ নিয়ে যাওয়া যায় জমিদারিটি। তাহলে ওরাই দেনা শোধ করে দেবে এবং মাসোহারা দেবে তিন ভাইয়ের পরিবারকে। কিন্তু কোর্ট অফ ওয়ার্ডস জানায়, পুরো বাড়িটি বিক্রি না হলে, দেনা মিটবে না কিছুতেই।
শেষ পর্যন্ত ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ আর তাঁর পরিবার। বাড়িময় ভগ্নস্তূপ। ঝাড়পোঁছের বালাই নেই। বাড়ির সামনের বাগান ভরে উঠেছে আগাছায়। চাঙড় খসে পড়ছে দেওয়াল থেকে। বিখ্যাত সেই দক্ষিণের বারান্দা, যেখানে বসে একের পর এক শিল্পসৃষ্টি করেছিলেন তিনভাই, খাঁ খাঁ করছে তাও। অবনীন্দ্রনাথের দৌহিত্র মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় সে-সময়ের বর্ণনা দিচ্ছেন –
‘দাদামশায় এলেন বারান্দায়। বারান্দার বড় ফাঁকটার কাছে এসে বাগানের দিকে তাকিয়ে রইলেন খানিক। তারপর আস্তে আস্তে বসে পড়লেন পরিষ্কার ঠান্ডা মেঝের উপর। দেখলুম দু-দিকে দু-হাত বিছিয়ে মেঝেকে ছুঁয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন নক্শাকাটা রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে বাগানের পুরনো গাছগুলোর দিকে অনেকক্ষণ।’
নভেম্বর মাসে সপরিবার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ছাড়লেন অবনীন্দ্রনাথ। রওয়ানা দিলেন বেলঘরিয়ার গুপ্তনিবাসের দিকে। সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে পরিবারের অন্যান্যরাও চলে এলেন সেখানে। ১৯৫১ সালে মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই কাটিয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ। জীবদ্দশায় আর ফিরে যাননি জোড়াসাঁকোয়।
শেষ পর্যন্ত কী হল জোড়াসাঁকোর সেই পাঁচ নম্বর বাড়ির? এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী কিনে নিয়েছিল সেটি। কিনেই, শুরু করে দিয়েছিল ভাঙাভাঙি। প্রথমেই ভাঙা পড়ে বিখ্যাত সেই দক্ষিণের বারান্দা। সামনের বাগানে উঠে যায় বড়-বড় বাড়ি। তারপরই টনক নড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের। সরকার বাড়ির অবশিষ্ট অংশটি রক্ষণাবেক্ষণের ভার নেয়। অবশ্য শেষ অবধি তা বাঁচানো যায়নি পুরোপুরি। নতুন করে গড়ে তুলতে হয় আবার। রবীন্দ্রনাথের ছয় নম্বর বাড়িতে কোনো প্রভাবই পড়েনি এসবের।
আর অবনীন্দ্রনাথ? অভিমানে কোনোদিন ফেরেননি জোড়াসাঁকোয়। কিন্তু তাঁর লেখায় বারবার ফিরে এসেছে সেই বাড়ির কথা। তিনি লিখছেন –
‘জোড়াসাঁকোর দুটো স্বতন্ত্র বাড়িই তো এখন দেখছ? আসল জোড়াসাঁকোর বাড়িই এবার বুঝে দেখো। সে ছেলেবেলার জোড়াসাঁকোর বাড়ি তো আর নেই। দুটো বাড়ির একটা তো লোপাট হয়ে গেছে, একটা আছে পড়ে। আগে ছিল দু-বাড়ি মিলিয়ে এক বাড়ি, এক বাগান, এক পুকুর, এক পাঁচিলে ঘেরা, এক ফটক প্রবেশের, এক ফটক বাইরে যাবার। …এ-বাড়ি ও-বাড়ি বলতুম মুখে, কিন্তু ছেলেবুড়ো চাকরবাকর সবাই জানতুম মনে দুখান বাড়ি এক বাড়ি। কারণ, এক কর্তা ছিল; একই নম্বর ছিল, ৬ নং দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলি। একই ফটক ছিল প্রস্থান-প্রবেশের। …জোড়াসাঁকো নাম ছিল বাড়ির, দুটো বাড়িও ছিল বটে, কিন্তু ওই দুই সাঁকোর তলা দিয়ে যে এক নদীর স্রোত বইত; সেদিন আর নেই, সে বাড়িও আর নেই।’
তাঁর কলমে, শব্দে পাক খেয়ে চলেছে দীর্ঘশ্বাস। বসত হারানোর ব্যথা। ‘মানুষের সঙ্গ পেয়ে বেঁচে থাকে বসত-বাড়িটা।’ সেই বাড়িই যখন আর রইল না, কী হবে মায়া বাড়িয়ে! চলে গেলেন অবন ঠাকুর। শিল্পাচার্যের জোড়াসাঁকো-যোগ শেষ সেখানেই…
ঋণ –
অমিতকথা – অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর
দক্ষিণের বারান্দা – মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়
জোড়াসাঁকোর ধারে – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আপনকথা – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন