সোমবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২০

 ফেসবুক-এ আমার স্মৃতিগুলি



প্রণব কুমার কুণ্ডূ






প্রণব কুমার কুণ্ডূ



'Pranab Kumar, আমরা আপনার এবং এখানে আপনার শেয়ার করা স্মৃতিগুলোর পরোয়া করি।...'

'পরোয়া' এর বদলে, 'ব্যাপারে যত্নশীল' লিখলে ভালো হয় !

भारत में बलपूर्वक धर्मान्तरण हेतु ईसाई चर्च द्वारा नरसंहार | Church Sanc...

বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২০

 আসাম



প্রণব কুমার কুণ্ডূ






প্রণব কুমার কুণ্ডূ



আসাম

পর্বতসংকুলবশত

ভূমি অসমতল হওয়াতে রাজ্যটি অসম।


অসম-এর অপভ্রংশ আসাম।


আবার 'অসম' প্রতাপবিশিষ্ট 'অহম' জাতি কর্তৃক একসময়ে অধিকৃত হওয়া প্রদেশটির নাম 'আসাম'।


আসাম।

উত্তর-পূর্ব ভারতের অসম রাজ্যটি, হিমালয় পর্বতমালার দক্ষিণে অবস্থিত, এবং রাজ্যটির অভ্যন্তরে রয়েছে, ব্রহ্মপুত্র নদ, বরাক উপত্যকা, কাছাড়ের উত্তরে ও পূর্বে,  পর্বতমালা।


উত্তর-পূর্ব ভারতের ছয়টি রাজ্য, যথা, অরুণাচল প্রদেশ,  নাগাল্যান্ড, মণিপুর,  মিজোরাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয় দ্বারা আসাম পরিবেষ্টিত।




রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে রাজনীতি || রাজকাহন || Rajkahon 2 || DBC NEWS 09/05/17

001 Vaisheshik Darshan Bhumika ..By.Acharya Satyajit Arya | वैशेषिक दर्श...

পর্ব-১৫ আনন্দমার্গ যোগ সাধনাবিজ্ঞান- যোগাসন ১

বুধবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২০

মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২০

শরৎ চ্যাটুর্যে

শরৎ চ্যাটুর্যে

শেয়ার করেছেন : - প্রণব কুমার কুণ্ডূ










লিখেছেন
Debabrata Sarkar

রবীন্দ্র রসিকতা - ১১৫
জীবনের ভালো-মন্দ:
কবিগুরু রবীন্দ্ৰনাথ ঠাকুরের সাথে শরৎচন্দ্ৰের সম্পর্ক স্নেহের। শরৎচন্দ্ৰ নিয়মিত যান গুরুদেবের কাছে। তিনি রবীন্দ্রনাথকে বিশেষ সম্মান করেন। তাদের দুজনের মধ্যেই সাহিত্য সংস্কৃতি সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়েই আলাপ আলোচনা হয়।
কবির আত্মজীবনী “জীবন স্মৃতি”র প্রথম খণ্ড তখন প্রকাশিত হবে। সম্পাদনার কাজ চলছে। ঠিক তেমন এক সময়ে একদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎচন্দ্ৰকে ডেকে হাসতে হাসতে বললেন, - “শরৎ, তোমার জীবন সম্পর্কে পাঠকদের বড় কৌতূহল। আমার জীবন স্মৃতির মত তুমিও তোমার জীবনের কথা লেখো। সেই লেখা পড়ে বাংলার পাঠকসমাজ তোমার জীবন সম্বন্ধে জানতে পারবে”।
শরৎচন্দ্র উত্তরে হেসে বললেন, - “গুরুদেব সেটা বোধহয় সম্ভব নয়। কারণ আমার জীবন তো আপনার মতো নয়। আগে থেকে বুঝতে পারিনি এত বড় হবো, তবে না হয় একটু বুঝে সমঝে ভালো হয়ে চলতাম। তা তো হয়নি। তাই এই জীবনে আমার আর জীবনী লেখা ঠিক হবে না।
শরৎচন্দ্রের উত্তর শুনে রবীন্দ্ৰনাথ মুচকি হাসলেন।
পুনশ্চ:
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়:
(ক)
‘‘দেবের আনন্দ ধাম দেবানন্দপুর গ্রাম/
তাহে অধিকারী রাম রামচন্দ্র মুনসী।/
ভারতে নরেন্দ্র রায় দেশে যার যশ গায়/
হয়ে মোর কৃপাদায় পড়াইল পারসী।।’’
— হুগলী জেলার দেবানন্দপুর গ্রামকে নিয়ে এই পঙ্‌ক্তি লিখেছিলেন রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র। স্বভাবতই, সে গ্রাম জড়িয়ে ছিল মহাকবির নামের সঙ্গেই। তবে তার পরে বাংলা সাহিত্যের মহাকাশে আর এক নক্ষত্র জন্ম নিলেন এই দেবানন্দ পুরেই। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৫-সেপ্টেম্বর-১৮৭৬ – ১৬-জানুয়ারি-১৯৩৮) এক গরিব ব্রাহ্মণ পরিবারে এই কথা সাহিত্যিকের জন্ম।বাবার নাম ছিল মতিলাল চট্টোপাধ্যায় আর মায়ের নাম ছিল ভুবনমোহিনী দেবী।
পাঁচ ভাই আর বোনের মধ্যে শরৎচন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর দিদি অনিলা দেবী ছাড়াও প্রভাসচন্দ্র ও প্রকাশচন্দ্র নামে তার দুই ভাই ও সুশীলা দেবী নামে তার এক বোন ছিল। শরৎচন্দ্রের ডাকনাম ছিল ন্যাঁড়া। দারিদ্র্যের কারণে মতিলাল স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন বলে শরৎচন্দ্রের শৈশবের অধিকাংশ সময় কেটেছিল বিহারের এই শহরে।
(খ)
ছেলের সাড়াশব্দ না পেয়ে আদরের সুরে মা ডাকলেন— ‘‘ন্যাড়া, ও ন্যাড়া, খাবি আয় বাবা!’’ তবু উত্তর নেই। রান্নাঘরে ন্যাড়াকে পাওয়া গেল না। গোয়ালঘরেও না। রেগে গিয়ে স্বামীকে বললেন, ‘‘হ্যাঁগা, নিজে তো বেশ খেয়েদেয়ে এখন ঐ ছাইপাঁশ নভেলগুলো পড়ছো! আর ওদিকে ছেলেটা না খেয়ে পাড়ায় টো-টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেদিকে কি খেয়াল আছে?’’
বাবা অবশ্য হাসিমুখে বললেন, ‘‘যাবে আর কোথায় ভুবন! দেখ, ও হয়তো ঐ রায়েদের আমবাগানে ফড়িং ধরছে।’’
সত্যিই তাই। আমবাগানে সুন্দর একটা ফড়িং ধরতে গিয়ে পাখা ভেঙে ফেলেছে ‘বাউন্ডুলে’ ছেলে। তাই তার মন খারাপ। অবশেষে বাবার কথায় ফড়িংটাকে বাগানে রেখেই বাড়ির পথে ফেরে ন্যাড়া। আর প্রতিজ্ঞা করে, ‘‘আমি একটাও ফড়িং বাক্সে রাখবো না। সব উড়িয়ে দেবো।’’ বাবা অবাক হন— ‘‘সামান্য একটা ফড়িংয়ের জন্যে কি কাঁদতে আছে রে?’’
তবে, বালক ন্যাড়া ওরফে শরৎচন্দ্রের লেখাপড়ার প্রতি প্রায় কোনও আগ্রহ ছিল না। গ্রামের পিয়ারী পণ্ডিতের পাঠশালায় ছেলেকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন বাবা মতিলাল। ছেলের সেখানে না যাওয়ার কারণটা যে ঠিক কী, সেটা বুঝতে পারতেন না তিনি। এক দিন বাপ ও ছেলের কথোপকথন প্রায় এ রকম:
বাবা —ন্যাড়া, পাঠশালায় যাস না কেন?
শরৎ —ভাল লাগে না যে।
বাবা —না পড়লে বড় হবি কি করে?
শরৎ —পড়লে বুঝি বড় হওয়া যায়?
বাবা —হ্যাঁ রে, হ্যাঁ।
তার পরে শরৎ পাঠশালায় গেল। তাতে গোল বাড়ল। দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ করে তুলল পিয়ারী পণ্ডিতকে। এক দিন পাঠশালায় নতুন ছেলে ভর্তি হয়েছে। শরৎ তার কাছে জানতে চাইল, সে লিখতে পারে কি না। জবাবে ‘না’ শুনে ‘তবে দে, তোর লেখা লিখে দিই’ বলে স্লেটে বড় বড় অক্ষরে লিখল ‘তুই একটা গাধা’। তার পর হঠাৎ হেঁচে তন্দ্রাচ্ছন্ন পণ্ডিতকে জাগিয়ে তুলল। তাঁর চোখ পড়ল নতুন ছেলেটির উপরে, ‘‘কী ছাঁদের আঁক কচ্ছিস দেখি।’’ স্লেট হাতে নিয়েই চিল-চিৎকার, ‘‘বলি, হ্যাঁ রে ছুঁচোমুখো—‘‘তুই একটা গাধা’’ তার মানে কি রে উল্লুক? কেন লিখেছিস জবাব দে।’’ ছেলেটি কাঁপতে কাঁপতে শরতের দিকে তাকায়। আমবাগানে পলায়ন বিনা শরতের আর কোনও উপায় রইল না।
সন্ধেয় বাড়ি ফিরে বই নিয়ে বসত না শরৎ। ভাল লাগত না। ঠাকুমার কাছে রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শুনতে পছন্দ করত। আর এক এক সময়ে আশ্চর্য হয়ে বাবার লেখার ঘরে গিয়ে বসত। মোটা খাতায় মতিলালের সুন্দর হস্তাক্ষর দেখে জানতে চাইত, সেগুলো কী। মতিলাল বলতেন, ‘‘আগে বড় হ’ তারপর ওসব বুঝবি।’’ অবশেষে সে বাবার কাছ থেকে উত্তর আদায় করেই ছাড়ে। ওগুলো নাটক। আসলে মতিলালের পরিবারের আর্থিক অবস্থা একেবারেই ভাল ছিল না। তার মধ্যেই যাত্রাপালা লেখার কাজ চলত। কাজেই পাড়া-প্রতিবেশীর ব্যঙ্গ জুটত।
পিয়ারী পণ্ডিতের পাঠশালা থেকে ছাড়িয়ে শরৎকে ভর্তি করা হল সিদ্ধেশ্বর ভট্টাচার্যের নতুন বাংলা-স্কুলে। কিন্তু অর্থকষ্ট বাড়তে থাকায় অবশেষে হুগলির পাট চুকিয়ে ১৮৮৬ সালে সপরিবার ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলেন মতিলাল। সেখানে সবাই জানে, শরৎ খুব ভাল ছেলে। ছাত্রবৃত্তি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তিও করে দেওয়া হল তাকে। কিন্তু এত দিন সে এতই কম শিখেছে যে অকূলপাথারে পড়ল। শরতের একটা গুণ— জেদ ছিল ষোলো আনা। সহপাঠীদের চেয়ে পিছিয়ে থাকার ‘অগৌরব’ সহ্য হল না। লেখাপড়ায় ভাল হয়ে উঠল দুরন্ত বালক। মামাবাড়িতে দারুণ গল্পের আসর বসত। তাতেও আগ্রহভরে যোগ দিল সে। এক দিন শরতের মাসিমা কুসুমকামিনী দেবী ‘কপালকুণ্ডলা’ পড়ছেন। হঠাৎ শরতের প্রশ্ন, ‘নবকুমারকে কাপালিক কেটে ফেলবে?’ তার পরে নিজেই বলে, ‘কেটে ফেললেই তো গল্প শেষ হয়ে যাবে। ও কাটবে না।’
দেবানন্দপুরের সঙ্গ ছাড়ার পর অনেকটাই বদলে যায় শরৎ। সেটা বুঝতে পেরে খুশি হয়ে মা ভুবনমোহিনীও স্বামীকে বলেন, “শোরো আজকাল কী শান্ত হয়েছে!” ১৮৮৭ সালে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় পাশ করে স্থানীয় ইংরেজি স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হয় সে। প্রথম বছর বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান তো পায়ই, পেয়ে যায় একেবারে ডাব্‌ল প্রোমোশন! খেলাধুলো আর দুষ্টুমির বদলে মন আকৃষ্ট হয় স্বাস্থ্যচর্চার দিকে। যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। কয়েক জন সঙ্গীকে নিয়ে তৈরি করে ফেলে স্বাস্থ্যচর্চার দল।
বেশ কিছু দিন শ্বশুরবাড়িতে কাটানোর পরে আত্মীয়দের মধ্যে গোলযোগ বাধতে শুরু করায় সপরিবারে পৈতৃক ভিটেতে ফিরতে হয় মতিলালকে। ১৮৮৯ সালে শরৎ ফেরে দেবানন্দপুরে। লেখাপড়া চলতে থাকে হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলে। পুরনো বন্ধুবান্ধব ফের জুটে যেতেই থিয়েটারের নেশা চেপে বসে। গ্রামের জমিদার নবগোপাল দত্ত মুন্সীর পুত্র অতুলচন্দ্র খুব ভালবাসতেন শরৎকে। তাকে মাঝে মাঝে কলকাতায় এনে থিয়েটার দেখিয়ে বলতেন, অভিনয়ের বিষয়বস্তু গল্পের মতো করে লিখতে পারলে পুরস্কার দেবে। শরৎ লিখত এবং পুরস্কারও আদায় করত।
শরতের কাব্যপ্রীতির সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে সাংসারিক অনটন। ১৮৯৪-এ ফের ভাগলপুরেই ফিরতে হয় মতিলালদের। শরতের সাহিত্যপ্রেম নিয়ে ‘বাল্যস্মৃতি’তে পাওয়া যায় দু’টি ঘটনা। লিখছেন, “এই সময় বাবার দেরাজ থেকে বের করলাম ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ আর বেরুলো ‘ভবানী পাঠক’। গুরুজনদের দোষ দিতে পারিনে। স্কুলের পাঠ্য তো নয়, ওগুলো বদ-ছেলের পাঠ্য পুস্তক। তাই পড়বার ঠাঁই নিতে হলো আমাকে বাড়ীর গোয়ালঘরে। সেখানে আমি পড়ি, তারা শোনে।” আর এক জায়গায়, “পিতার নিকট হইতে অস্থির স্বভাব ও গভীর সাহিত্যানুরাগ ব্যতীত আমি উত্তরাধিকারসূত্রে আর কিছুই পাইনি।... কিন্তু এখনো মনে আছে ছোটবেলায় তাঁর অসমাপ্ত লেখাগুলি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছিলাম। কেন তিনি এইগুলি শেষ করে যাননি— এই বলে কত দুঃখই না করেছি। অসমাপ্ত অংশগুলি কি হতে পারে ভাবতে-ভাবতে আমার অনেক বিনিদ্র রজনী কেটে গেছে।”
এ বার তেজনারায়ণ জুবিলী কলেজিয়েট স্কুল। আবার ভাগলপুরের পুরনো বন্ধুরা। শরৎ যে পরিবারে বড় হচ্ছিল, সেখানে উকিল হওয়াটাই জীবনের লক্ষ্য। অতএব প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এফএ পড়া শুরু হল। আলাপ হল রাজেন্দ্রনাথ মজুমদারের সঙ্গে। এই রাজুই হল ‘শ্রীকান্ত’র ইন্দ্রনাথ। নির্জন গড়ের ধারে বসে মনের আনন্দে বাঁশি বাজাত রাজু— আকৃষ্ট হয়েছিল শরৎ। ঘুড়ি ওড়ানো, তামাক খাওয়া, গান-বাজনা, রাজুর সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া, আবার ফিরে আসা, একসঙ্গে নৈশ-অভিযানে জেলেডিঙিতে মাছ-চুরি, যাত্রা-থিয়েটারের মহড়া— চলতে লাগল বন্ধুত্ব যাপন।
১৮৯৫ সালে প্রয়াত হলেন শরতের মা ভুবনমোহিনী। বিহ্বল মতিলাল শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাসা বাঁধলেন খঞ্জরপুর গ্রামে। সেখানেই আবার সমবয়সিদের নিয়ে ‘সাহিত্য-চক্র’ গড়ে তুলল শরৎ। চলতে লাগল লেখালেখি। সেখানেই এক দিন পঠিত হল ‘অভিমান’ গল্পটি। বন্ধুমহলে লেখক হিসেবে পরিচিতি তৈরি হতে লাগল। সাহিত্যের ভূত এমন ভাবেই ঘাড়ে চেপে বসল যে, এফএ পরীক্ষায় ফল ভাল হল না। পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়েও চিরদিনের মতো কলেজের পাট চুকিয়ে সাহিত্য জগতেই আশ্রয় নিল সে।
শুরু হল ‘কুঁড়ি সাহিত্যিক’ নামে এক সাহিত্য-সভা। বার হতে লাগল হাতে লেখা পত্রিকা ‘ছায়া’। তবে সাহিত্য করে সংসার চলে না। চললও না। জমিদার শিবশঙ্কর সাউকে ধরে তাঁর রাজবনেলী স্টেটে একটা চাকরি জোটানো গেল। তবে টেকানো গেল না। বাবার সঙ্গে মন কষাকষি হল। বাড়ি ছাড়ল ছেলে।
ঘুরতে ঘুরতে হাজির মুজফ্‌ফরপুরে। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার অন্যতম কর্ণধার প্রমথনাথ ভট্টাচার্যের কলমে— “একদিন সন্ধ্যার সময় ক্লাবে তাঁদের দলবল মিলিত হলেন— এমন সময় গেরুয়া-বসনধারী এক তরুণ সন্ন্যাসী এসে পরিষ্কার হিন্দী ভাষায় সবিনয়ে লিখবার সরঞ্জাম প্রার্থনা করলেন।” দেহাতি ছদ্মবেশ ধরা পড়ল। পরিচয় মিলল শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
এ দিকে অনুরূপা দেবীর লেখা থেকে জানা যায়, এ সময়ে নিরুদ্দিষ্ট শরতের খাতা থেকে একের পর এক গল্প উদ্ধার হয়েছে— ‘বোঝা’, ‘অনুপমার প্রেম’, ‘বামুনঠাকুর’, ‘কোরেল গ্রাম’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘বড়দিদি’। মুজফ্‌ফরপুরে বসেই ‘ব্রহ্মদৈত্য’ নামে এক উপন্যাস লেখা শুরু করে শরৎ। এখানে আলাপ হয় মহাদেব সাউ নামে এক জমিদারের সঙ্গে। ‘শ্রীকান্ত’র কুমার সাহেব তিনিই। অবশেষে ১৯০৩-এ পিতৃবিয়োগের খবর শুনে খঞ্জরপুর ফেরে শরৎ।
তখন একটা কাজের বড়ই দরকার। কলকাতায় মামা উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে হাজির হয় শরৎ। উপেন্দ্রনাথের ভাই লালমোহনের কোর্টের কাগজপত্র ও দলিলের অনুবাদের কাজ মেলে। সাথে সেখানে হিন্দি বইয়ের ইংরেজি তর্জমা করার জন্য মাসে মোট ত্রিশ টাকা বেতনের চাকরি পান শরৎচন্দ্র। তবে কলম কি আর থামে?
ভাগলপুরের যোগেশচন্দ্র মজুমদারের লেখা থেকে জানা যায়— “তিনি ১৩০৯ সালে একবার ‘কুন্তলীন পুরস্কার প্রতিযোগিতা’য় তাঁহার মাতুল সুরেন্দ্রনাথের নামে রচনা পাঠাইয়া প্রথম স্থান অধিকার করেন।” গল্পটির নাম ‘মন্দির’। আসলে শরৎ নিজ নামে কিছু প্রকাশ করিতে একান্ত অনিচ্ছুক ছিল।
(গ)
এ দিকে মাত্র তিরিশ টাকা বেতনে কাজ করতে শরতের তখন আপত্তি। উপেন্দ্রনাথের কাছে কিছু টাকা ‘কর্জ’ চায় সে। বলে, “এখানে থাকতে আমার মন চাইছে না, উপীন। রেঙ্গুনে নাকি ভাগ্য ফেরে।” রেঙ্গুন তার ঠিক অচেনাও নয়। মাসিমা সেখানে থাকতেন। ১৯০৩ সালে ২৭ বছর বয়সে জাহাজে করে বর্মায় গিয়ে হাজির হন শরৎ।
কিন্তু জাহাজ বর্মার রাজধানী রেঙ্গুনে ঢোকার আগেই তাঁকে যেতে হল ‘কোয়ারান্টিন’-এ। সেই সময় কোনও বন্দরে সংক্রামক ব্যাধি দেখা দিলে সেখান থেকে জাহাজ অন্য বন্দরে প্রবেশের আগে জাহাজকে বন্দর থেকে কিছুটা দূরে অন্য এক জায়গায় কয়েক দিন রাখা হত। একেই বলা হয় কোয়ারান্টিন। রেঙ্গুন তখন প্লেগে ভয়ংকর বিপর্যস্ত। বর্মার সাহেবসুবোরা ধরেই নিয়েছিল, প্লেগ ছড়িয়েছে তৎকালীন বম্বের বন্দরে জাহাজে জাহাজে যে কুলিরা কাজ করে, তাদের থেকে। রেঙ্গুন ঢোকার আগেই কুলি আর ডেকের অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে শরৎচন্দ্রও গেলেন আটকে। এক জঙ্গলঘেরা জায়গায় কাটালেন নয় নয় করে সাত দিন।
অবশেষে ঢোকা গেল রেঙ্গুন শহরে। হাত একেবারে খালি। সে সময় রেঙ্গুন শহরে একটিমাত্র বাঙালি হোটেল—‘দাদাঠাকুরের হোটেল’। সেখানে থেকেই শরৎচন্দ্র তাঁর মেসোমশাই অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ঠিকানা জেনে শেষমেশ পৌঁছলেন তাঁর কাছে। অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন রেঙ্গুনের নামকরা উকিল। শরৎচন্দ্র সাত দিন আটকে ছিলেন শুনে মেসোমশাই বললেন, ‘‘তুই আমার নাম করতে পারলি না? আমার নাম করে কত লোক পার হয়ে যায়, আর তুই পড়ে ছিলিস কোরনটিনে!’’
মাসিমারা খুবই বড়লোক। মেশোমশাই অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় রেঙ্গুনের নামবকরা উকিল। সেখানে তাঁদের ঘরের ছেলে হয়ে থাকতে শুরু করেন তিনি। সুতরাং জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আসে। কিছু দিনের মধ্যে বর্মী ভাষাটাও শিখে নেন।
বর্মি ভাষা শিখে শরৎচন্দ্র যদি বর্মায় ওকালতি করে তা হলে তাকে আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে না, এ কথা শরতের পিতা মতিলাল চট্টোপাধ্যায়কে অঘোরবাবু আগেই জানিয়েছিলেন। কিন্তু শরতের আর উকিল হওয়া হল না। কারণ, তিনি বর্মি ভাষার পরীক্ষাতেই পাশ করতে পারলেন না।
কিন্তু সেখানে কাজের ব্যবস্থা হল। অঘোরনাথ তাকে বর্মা রেলওয়ের অডিট অফিসে একটি অস্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করে দেন।
বস্তুত, বর্মাবাসের আগে পর্যন্ত খানিকটা দুর্ভাগ্যের কবলে পড়েই এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত কেবল অনিশ্চয়তার মধ্যে ছুটে বেড়াতে হত শরৎকে। রেঙ্গুন তাঁকে কিছুটা সুস্থিতি দেয়।
উকিল না হয়েও প্রায় তেরো বছর তিন মাস বর্মায় কাটিয়ে ফেললেন শরৎচন্দ্র। বৌদ্ধ ভিক্ষুর বেশে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন উত্তর বর্মার অলিতে-গলিতে। মিশেছিলেন চোর, ডাকাত, খুনি... হাজারও মানুষের সঙ্গে। বিচিত্র সেই সব অভিজ্ঞতা!
বর্মার নানান জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল সরকারি কন্ট্রাক্টর গিরীন্দ্রনাথ সরকারের। পেশায় সরকারি চাকুরে, কিন্তু তাঁর নেশা ছিল ভ্রমণ। শরৎচন্দ্র বর্মি ভাষা একেবারেই বুঝতে পারতেন না। গিরীনবাবুই তাঁর দোভাষীর কাজ করতেন। এক দিন দু’জনে ঘুরতে বেরিয়েছেন। রাস্তায় দেখলেন, মাছ কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে এক দল বর্মি মেয়ের সঙ্গে কিছু লোকের ঝগড়া হচ্ছে। গিরীনবাবুকে জিজ্ঞেস করে শরৎচন্দ্র জানলেন, বর্মায় মরা মাছের খুব কদর। জ্যান্ত মাছ মেরে খাওয়া নাকি ওদের কাছে অধর্ম। ব্যাপারটা জেনে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘তা হলে দেখছি একদিন গুচ্ছের মাছ মেরে ওদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হবে।’’ উত্তরে গিরীনবাবু বললেন, ‘‘উহুঁ, ওরা এমনি এমনি নেওয়ার পাত্র নয়, যা নেবে পয়সা দিয়ে নেবে। আর যদি বোঝে মতলব খারাপ, সঙ্গে সঙ্গে ফনানে-ছা। মানে জুতোপেটা!’’
শোনা যায়, প্রণয়ঘটিত ব্যর্থতার যন্ত্রণা ভুলতে প্রথম জীবনে হাতে পয়সা পেলেই শরৎচন্দ্র বেজায় মদ্যপান করতেন। মাঝে মাঝে মদ খেয়ে বেহুঁশও হয়ে পড়তেন। এক দিন শরৎচন্দ্রের বাড়িতে মদ শেষ। কী করা যায়? গভীর রাতে এক বাঙালি বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে চললেন তাদেরই পরিচিত এক বর্মি বন্ধুর বাড়ি মদ আনতে। বর্মি বন্ধুটির হার্টের অসুখ থাকায় তাঁর মদ খাওয়া নিষেধ ছিল। অনেক অনুরোধের পর বন্ধুর স্ত্রী মদের বোতল বের করে দিলেন। এ দিকে শরৎ ও অন্য বন্ধুদের কী খেয়াল হল, তাঁরা মদ খেতে বসে পড়লেন ওই বর্মি বন্ধুর বাড়ির বারান্দাতেই। মদ খাবে না, এই শর্তে সেও আসরে যোগ দিল। স্ত্রীর নজরদারিতে গোড়ায় মদ না খেলেও, স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়লে বন্ধুদের অনুরোধে যথারীতি মদের গ্লাসে চুমুকও দিয়ে ফেলল। তার কিছু ক্ষণ পরেই হঠাৎ বুক চেপে ধরে বিকট আর্তনাদ, এবং মৃত্যু!
এর পর শরৎচন্দ্র মদ ছে়ড়ে আফিম ধরেছিলেন। যে নেশা তাঁর জীবনের শেষ দিন অবধি ছিল। ভাল গান গাইতেন, শরতের গানে মুগ্ধ হয়ে কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁকে ‘রেঙ্গুন রত্ন’ উপাধি দিয়েছিলেন।
রেঙ্গুনের যৌনপল্লিতেও নাকি শরৎচন্দ্রের যাতায়াত ছিল। এক বার একটি মেয়ের কাছে গিয়ে দেখলেন, তার বসন্ত রোগ হয়েছে। তা দেখে বন্ধুরা সকলে ভয়ে পালিয়ে গেলেও শরৎচন্দ্র কিন্তু পালালেন না। পয়সা খরচ করে ডাক্তার ডাকলেন, মেয়েটির চিকিৎসা করলেন। এত কিছু করা সত্ত্বেও মেয়েটি বাঁচল না। শরৎচন্দ্র মেয়েটির সৎকারও করেছিলেন।
রেঙ্গুনে বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন লোয়ার পোজনডং-এর এক মিস্ত্রিপল্লিতে। সেখানকার মানুষজনের আপদে-বিপদে সাহায্য করা, অসুখে হোমিয়োপ্যাথি ওষুধ দেওয়া, সব মিলিয়ে শরৎচন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন মূর্তিমান মুশকিল আসান। শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তা দেখে বন্ধু গিরীন মিস্ত্রিপল্লিকে মজা করে বলতেন ‘শরৎপল্লি’।
এই মিস্ত্রিপল্লিতেই এক অসহায় মেয়েকে সাহায্য করতে গিয়ে শরৎচন্দ্র বিপদে পড়েছিলেন। ওই পল্লিতে থাকত এক দম্পতি। বছরখানেক পর মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়লে যুবকটি তাকে ছেড়ে পালায়। মেয়েটির প্রসব বেদনা উঠলে স্থানীয় লোকজন গেলেন শরৎচন্দ্রের সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করতে। শরৎচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার ডাকলেন। সন্তান প্রসবের পর মেয়েটির দুঃখের কাহিনি শুনলেন ও যুবকটির খোঁজে লোক লাগালেন। খোঁজ পাওয়ার পর শরৎচন্দ্র লোক মারফত যুবকটিকে বলে পাঠালেন, সে যেন তার স্ত্রী ও সন্তানকে গ্রহণ করে। যুবকটি কিন্তু মেয়েটিকে তাঁর স্ত্রী হিসেবে অস্বীকার করল। তারা যে বিবাহিত ছিল না সেটাও জানা গেল। ছেলেটি তখন অন্য এক জায়গায় সংসার পেতেছে।
শুনে বেজায় চটলেন শরৎচন্দ্র। অসহায় মেয়েটিকে বললেন, যুবকের বিরুদ্ধে খোরপোশের মামলা করতে। মামলা কোর্টে উঠলে যুবকটি বলল, মেয়েটির সঙ্গে শরৎচন্দ্রের সম্পর্ক আছে। সদ্যোজাত সন্তানটি তার নয়, শরৎচন্দ্রের। আর সন্তান প্রসবের সময় সে কারণেই নাকি শরৎচন্দ্র খরচাপাতি করে ডাক্তার আনিয়েছিলেন। বিচারক সব শুনে ডাক্তারের বয়ান নিলেন। ডাক্তার জানালেন, শরৎচন্দ্র তাঁকে ডাকলেও প্রসবের সময় মেয়েটি তার স্বামীর নাম, মানে ওই যুবকটির নামই করেছিল। যে নাম তার ডায়েরিতে লেখা আছে। বিচারক সিদ্ধান্ত শোনালেন। যুবকটি খোরপোশ দিতে বাধ্য হল।
শরৎচন্দ্রের ছিল মাছ ধরার নেশা। বর্মার পেগুতে থাকাকালীন তিনি প্রায়ই যেতেন মাছ ধরতে। এক দিন পুকুরঘাটে গিয়ে দেখলেন, এক সাহেব বেশ তরিবত করে মাছ ধরতে বসেছেন। এ দিকে অল্প সময়ের মধ্যেই শরৎচন্দ্র ধরে ফেললেন একখানা বড় মাছ। তা দেখে ওই সাহেব স্পষ্ট বাংলায় শরৎচন্দ্রের মাছ ধরার তারিফ করে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করতে লাগলেন। সুদূর পেগুতে সাহেবের মুখে বাংলা শুনে শরৎচন্দ্র তো অবাক। পরে জেনেছিলেন, সাহেব অনেক দিন কলকাতায় ছিলেন, সেখানেই বাংলা শেখেন। কথায় কথায় সাহেব জানালেন, আজ মাছ নিয়ে বাড়ি না ঢুকলে মেমসাহেব তাঁকে আস্ত রাখবেন না। কারণ, প্রচুর টাকা খরচ করে তিনি রেঙ্গুন থেকে পেগু এসেছেন স্রেফ মাছ ধরার নেশায়। এখন যদি একটাও মাছ নিয়ে যেতে না পারেন, তা হলে লজ্জার কথা। সব শুনে শরৎচন্দ্র হেসে বললেন, ‘‘আপনি কিছু মনে করবেন না, আমার মাছটি নিয়ে যান।’’
পেগুর বিখ্যাত শিকারি মিস্টার প্যাখামের সঙ্গে শরৎচন্দ্র মাঝে মাঝেই শিকারে বের হতেন। এক বার সবাই শিকারের আশায় ঝোপের মধ্যে অপেক্ষা করছেন। এমন সময় হঠাৎ গুড়ুম শব্দ। দেখা গেল, শরৎচন্দ্র একটা চিল শিকার করে ফিরছেন। সবাই অবাক। শরৎচন্দ্র বললেন, ‘‘ঝোপের মধ্যে জড়ভরতের মত বসেছিলাম। একদল বককে দেখে গুলি ছুঁড়লাম। মরল চিল।’’ তার পর মৃত চিলের ডানা ধরে দেখিয়ে সবাইকে বললেন, ‘‘দেখো। চিলের গায়ে কোথাও গুলি লাগেনি, এ তো গুলির শব্দে হার্টফেল করেছে।’’
প্রবাসকালে মনের বৈরাগ্যও কিছুটা ক্ষীণ হয়ে আসে। সংসারী হওয়ার সাধ জাগে। বিয়েও করেন।
শরৎচন্দ্র বার্মা রেলের হিসাব পরীক্ষক হিসেবে পচাত্তর টাকা মাইনের কেরেনিগিরির চাকরি লাভ করেন ১৯০৫ সালে।
রেঙ্গুনের উপকণ্ঠে বোটাটং পোজনডং অঞ্চলে কলকারখানার মিস্ত্রিদের পল্লিতে যেখানে শরৎচন্দ্র বসবাস করতেন। তার বাসার নিচে শান্তি দেবী নামে এক ব্রাহ্মণ মিস্ত্রির কন্যা বসবাস করতেন। তার পিতা তার সঙ্গে এক মদ্যপের বিয়ের ঠিক করলে শান্তি দেবী শরৎচন্দ্রকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে অনুরোধ করায় শরৎচন্দ্র তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হন। তাদের এক পুত্র সন্তানেরও জন্ম হয়, কিন্তু রেঙ্গুনের প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শান্তি দেবী ও তার এক বছরের সন্তান মৃত্যুবরণ করেন। এর অনেক কাল পরে শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে কৃষ্ণদাস অধিকারী নামে এক ভাগ্যান্বেষী ব্যক্তির অনুরোধে তার ১৪ বছরের কন্যা মোক্ষদাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তিনি মোক্ষদার নাম রাখেন হিরন্ময়ী দেবী। তারা নিঃসন্তান ছিলেন।
রেঙ্গুনের বাড়িতে ছিল তাঁর নিজস্ব একটি লাইব্রেরি। কাঠের এই বাড়িটি তিনি কিনেছিলেন এক ইউরোপীয় সাহেবের কাছ থেকে। এক বার আগুন লাগল সেই বাড়িতে। পুড়ে ছাই হয়ে গেল সব কিছু। তার মধ্যেই ছিল ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি এবং তাঁর নিজের আঁকা বেশ কিছু পেন্টিংও। সব খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে শরৎচন্দ্র পথে এসে দাঁড়ালেন, কুকুর ‘ভেলি’ আর পোষা কাকাতুয়া ‘বাটুবাবু’র সঙ্গে।
আক্রান্ত হলেন রোগে। হাত-পা ফুলে যাচ্ছে, যন্ত্রণা। অবস্থা এমন, প্রায়-পঙ্গু পা নিয়ে চলাফেরাই করতে পারেন না। ডাক্তার জানালেন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের কারণেই এই দশা, বর্মা ছাড়লে তবেই এ রোগ সারবে। এ দিকে চিকিৎসার জন্য ছুটি চাওয়া নিয়ে অফিসে বড়সাহেবের সঙ্গে বচসা বাধল। শরৎচন্দ্র খুব উত্তেজিত হয়ে তেড়ে গেলেন সাহেবের দিকে। বাঙালি কেরানির ঔদ্ধত্য দেখে সাহেব স্তম্ভিত!
সে দিনই কাজে ইস্তফা দিলেন শরৎচন্দ্র। ফিরলেন দেশে। দেশে ফিরে চেহারায় বদল আনলেন। রেঙ্গুনে থাকার সময় দাড়ি রেখেছিলেন। ঘন ঘন সিগারেট খেতেন। খেলতেন দাবা। জীবনচর্চায় ছিল ফরাসি বোহেমিয়ানিজমের প্রভাব। তখন তাঁর গুরু ফরাসি সাহিত্যিক এমিল জোলা। বর্মা থেকে ফেরার কয়েক বছর পর দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে ফেললেন। শুরু হল আর এক নতুন জীবন।
(ঘ)
‘‘একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ যখন সাহিত্য সেবার ডাক এলো, তখন যৌবনের দাবী শেষ ক’রে প্রৌঢ়ত্বের এলাকায় পা দিয়েছি। দেহ শ্রান্ত, উদ্যম সীমাবদ্ধ— শেখবার বয়স পার হয়ে গেছে। থাকি প্রবাসে, সব থেকে বিচ্ছিন্ন, সকলের কাছে অপরিচিত, কিন্তু আহ্বানে সাড়া দিলাম, ভয়ের কথা মনেই হোলোনা।’’
প্রায় ১৮ বছর পরে, ১৯১৩ সালে, বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে নিজের পুনরাগমনকে এ ভাবেই দেখেছিলেন শরৎচন্দ্র। নবপ্রকাশিত ছোট পত্রিকা ‘যমুনা’তে এ সব লেখা ছাপা হতে শুরু করে।
গল্পের শুরুটা অবশ্য বেশ কয়েক বছর আগেই। ১৩১৪ বঙ্গাব্দ। সরলা দেবী তখন ‘ভারতী’র সম্পাদক এবং সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় কলকাতা থেকে তাঁর নামে কাগজ চালান। সৌরীন্দ্রমোহন জানতেন, রেঙ্গুন যাওয়ার আগে নিজের লেখাগুলি সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে রেখে গিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। সেখান থেকে ছোট উপন্যাস ‘বড়দিদি’ আনিয়ে তিন কিস্তিতে ‘ভারতী’তে ছাপিয়েও দেন। লেখকের অনুমতি নেননি, কারণ নেওয়ার চেষ্টা করলে মিলত না! লেখা নিয়ে হইচই পড়ে। শরৎচন্দ্রের অজ্ঞাতেই রসজ্ঞ পাঠক ও সমালোচক মহলে তাঁকে নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিস্মৃতি অনিবার্য। কাজেই কালের নিয়মে হারিয়ে যান শরৎচন্দ্র। এর পর কী ভাবে ফিরলেন, তাঁর বয়ানেই জানা যায়।
শুধু ফেরা নয়, অবিশ্বাস্য দ্রুততায় পাঠকমহলে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। কয়েক বছরের মধ্যে চাকরি ছেড়ে পাকাপাকি সাহিত্যিক। ‘চরিত্রহীন’ যখন বই আকারে বেরোল, দাম সাড়ে তিন টাকা। প্রথম দিনই বিক্রি হয়েছিল সাড়ে চারশো কপি। বাংলা সাহিত্যে এই রেকর্ড আর কারও ছিল না। পরে তা ভাঙে শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’র সৌজন্যে। রেঙ্গুনে অজ্ঞাতবাসের জন্য গেলেও সেখানেই আত্মপ্রকাশ করেন সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ‘রামের সুমতি’, ‘পথনির্দ্দেশ’, ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘নারীর মূল্য’, ‘চরিত্রহীন’-এর জন্ম সেখানেই।
‘যমুনা’ থেকে ‘ভারতবর্ষ’। এ বার কলম চালিয়ে অর্থলাভও হতে লাগল। তবে কেবল ‘ভারতবর্ষ’ নয়, শরৎচন্দ্র ছড়িয়ে পড়লেন ‘বঙ্গবাণী’, ‘নারায়ণ’, ‘বিচিত্রা’য়। কোনও কোনও উপন্যাস সরাসরি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল, যেমন ‘বামুনের মেয়ে’। এ পর্বে লিখলেন ‘বিরাজ-বৌ’, ‘পণ্ডিত-মশাই’, ‘বৈকুণ্ঠের উইল’, ‘মেজদিদি’, ‘দত্তা’, ‘পল্লীসমাজ’, ‘অরক্ষণীয়া’, ‘নিষ্কৃতি’, ‘গৃহদাহ’, ‘দেনা-পাওনা’, ‘নববিধান’, ‘মহেশ’, ‘পথের দাবী’, ‘শেষ প্রশ্ন’... স্বল্প কালপর্বে পরপর এতগুলি জনপ্রিয় ও অমর সৃষ্টি করে যেতে পারেন কেউ?
সত্যিই বিস্ময়কর!
‘নারায়ণ’ পত্রিকার গল্পের জন্য শরৎচন্দ্রকে একটা সই করা চেক পাঠিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, সঙ্গে লিখেছিলেন, ‘আপনার মতন শিল্পীর অমূল্য লেখার মূল্য স্থির করবার স্পর্দ্ধা আমার নেই, টাকার ঘর শূন্য রেখে চেক পাঠালুম, এতে নিজের খুসি-মত অঙ্ক বসিয়ে নিতে পারেন!’ এবং নিজের অসাধারণতার মূল্যও নির্ধারণ করেছিলেন শরৎচন্দ্র— একশো টাকা! দেশবন্ধুর পদক্ষেপেই সাহিত্যিকের জনপ্রিয়তা অনুমেয়।
বাংলা রঙ্গালয়ে শরৎ-সাহিত্যের চাহিদা তৈরি হয়েছিল। সর্বাগ্রে অভিনীত হয়েছিল ‘বিরাজ-বৌ’। নাট্যরূপ দিয়েছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিনীত হয় স্টার থিয়েটারে। তার পর শিশিরকুমার ভাদুড়ী। ‘ভারতী’তে ‘দেনা-পাওনা’র নাট্যরূপ দিয়েছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী, নাম ‘ষোড়শী’। অভিনয় করালেন শিশিরকুমার। সাফল্যের পরে অভিনীত হল ‘রমা’, ‘চরিত্রহীন’, ‘অচলা’, ‘বিজয়া’।
নাটকের পরে চলচ্চিত্র। এবং শিশিরকুমার। নির্মিত হল ‘আঁধারে আলো’র চিত্ররূপ। তার পরে ‘দেবদাস’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘বিজয়া’, ‘পণ্ডিত মশাই’ ইত্যাদি। তাঁর লেখা দেশি-বিদেশি ভাষায় অনূদিত হতে থাকল। এক কথায়, সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের উত্তরণ ও উত্থান রূপকথার মতো।
হেমেন্দ্রকুমার রায় বর্ণনা করেছিলেন, ‘যৌবনে যে-শরৎচন্দ্রের দেশে মাথা রাখবার ছোট্ট একটুখানি ঠাঁই জোটে নি, ট্যাঁকে দুটি টাকা সম্বল ক’রে যিনি মরিয়া হয়ে মগের মুল্লুকে গিয়ে পড়েছিলেন, প্রৌঢ় বয়সে তিনিই যে দেশে ফিরে এসে বালিগঞ্জে সুন্দর বাড়ী, রূপনারায়ণের তটে চমৎকার পল্লী-আবাস তৈরি করবেন, মোটরে চ’ড়ে কলকাতার পথে বেড়াতে বেরুবেন...’ সত্যিই, তাঁর দূর বা নিকটজনেরা ভাবতেও পারেননি।
রেঙ্গুন থেকে ফিরে শিবপুরে বাড়ি ভাড়া নিলেও ভিড় আর ভাল লাগছিল না শরৎচন্দ্রের। তাই পাণিত্রাসে (বা সামতাবেড়) নিরালায় বাড়ি বানান। বাগানঘেরা দোতলা বাড়ি, লেখার ঘরে বসে রূপনারায়ণ দেখা যায়। কখনও লিখতেন, পড়তেন, ভাবতেন। বাগানে গাছেদের সেবা করতেন, পুকুরে মাছেদের খেতে দিতেন।
তবে আদর্শ জীবনে জরা আসে, রোগব্যাধি বাসা বাঁধে। শরৎচন্দ্রের অসুখ ছিলই। এক সময়ে প্রত্যেক দিন জ্বর আর শরীরময় যন্ত্রণা হতে থাকল।
চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি স্বাস্থ্য উদ্ধারের উদ্দেশ্যে দেওঘরে তিন চার মাস কাটিয়ে কলকাতা ফিরে এলে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সময় তার যকৃতের ক্যান্সার ধরা পড়ে, যা তার পাকস্থলী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়, কুমুদশঙ্কর রায় প্রমুখ চিকিৎসক তার অস্ত্রোপচারের পক্ষে মত দেন।
চিকিৎসার জন্য তাকে প্রথমে দক্ষিণ কলকাতার সাবার্বান হসপিটাল রোডের একটি ইউরোপীয় নার্সিং হোমে ও পরে ৪ নম্বর ভিক্টোরিয়া টেরাসে অবস্থিত পার্ক নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারি প্রখ্যাত শল্য চিকিৎসক ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তার দেহে অস্ত্রোপচার করেন, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। চার দিন পর ১৬ জানুয়ারি সকাল দশটায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মাত্র ৬১ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
বিরাট শোভাযাত্রায় কেওড়াতলা মহাশ্মশানে জনপ্রিয় সাহিত্যিকের শেষকৃত্য হয়েছিল।
(ঙ)
তার সক্ষিপ্ত সাহিত্য জীবনে তিনি লিখেছেন ২৭ টি উপন্যাস, ৪ টি নাটক, ২২ টি গল্প, ১২ টির মতো প্রবন্ধ।
বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে শিবনাথ শাস্ত্রী লেখেন, “আমাদের দেশের প্রতিভাশালী ব্যক্তিদিগের সাধারণ নিয়মানুসারে বঙ্কিমের প্রতিভার শক্তি পঁয়তাল্লিশ বৎসরের পর মন্দীভূত হইয়া আসিল।” শরৎচন্দ্রকে দেখলে কি সে কথা বলতেন?
তাঁর প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ চল্লিশের কোঠায় গিয়ে প্রকাশিত হয়। তাঁর জীবনকে মোটামুটি চার ভাগে ভাগ করা যায়— দেবানন্দপুর-ভাগলপুর, ব্রহ্মদেশ, হাওড়া-শিবপুর, সামতাবেড়-কলকাতা। সাহিত্যসাধনাও চার পর্বে। ভাগলপুরে ছোট সাহিত্যগোষ্ঠী। ব্রহ্মদেশে ‘বড়দিদি’ প্রকাশের পরে খ্যাতির সূচনা। দেশে প্রত্যাবর্তন। অবশেষে সাহিত্য সাধনার সূত্র ধরেই শিখরে আরোহণ।
এই গগনচুম্বী জনপ্রিয়তার ব্যাখ্যা করেন অজিতকুমার ঘোষ, “শরৎচন্দ্র সোজাভাবে, স্পষ্ট ভাষায় ও দুঃখ বেদনার কারুণ্যে সিক্ত করিয়া সমাজের সমস্যা তুলিয়া ধরিলেন এবং আমাদের প্রচলিত সংস্কার, নীতিবোধ ও ধর্মবোধের অন্যায় ও জবরদস্তি চোখে আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া দিলেন। ইহার ফলে আমাদের বদ্ধ অচলায়তনের দ্বার যেন হঠাৎ খুলিয়া গেল, এবং সেই মুক্ত দ্বার দিয়া যত আলো ও বাতাস আসিয়া মুক্তির আনন্দে আমাদিগকে চঞ্চল করিয়া তুলিল।”
বাংলা সাহিত্য কোনও গরিবকে ধনী করে তুলেছে, এমন বোধ হয় শরৎচন্দ্রের আগে সে ভাবে কল্পনা করা যেত না। দীনবন্ধু মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। রবীন্দ্রনাথ জমিদার। শরৎচন্দ্র এক এবং একমাত্র সাহিত্যেরই জোরে দু’পায়ে ভর দিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পেরেছিলেন।
ছবিঃ
বাঁদিকের ছবিতে বাঁদিক হতে স্যার যদুনাথ সরকার, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যন্সেলর। ছবিটি ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্টানে তোলা। এই অনুষ্টানে উপস্থিত প্রত্যেককে ডি লিট দেওয়া হয়েছিল। এই অনুষ্টানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও ডি লিট দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু তিনি শারিরীক অসুস্থতার কারনে উপস্থিত থাকতে পারেন নি।
ডানদিকের ছবিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
তথ্যসূত্রঃ
১) ভাগলপুর থেকে ব্রহ্মদেশ। আবাহন দত্ত। আনন্দবাজার পত্রিকা। ২৬-জানুয়ারি-২০১৯ (পুরো লেখাটাই তুলে দেওয়া হয়েছে।)
২) উইকিপিডিয়া।
৩) মুখভর্তি দাড়ি, ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট। অনিরুদ্ধ সরকার। আনন্দবাজার পত্রিকা। ০৭-জানুয়ারি-২০১৮ (পুরো লেখাটাই তুলে দেওয়া হয়েছে।)
ছবিতে থাকতে পারে: এক বা আরও বেশি ব্যক্তি, লোকেরা দাঁড়িয়ে আছে এবং আউটডোর

কমেন্ট