মৃত্যর পরে শেয়ার করেছেন প্রণব কুমার কুণ্ডু
মৃত্যুর পরে কী হয়! কোন ভয়ঙ্কর সত্য অপেক্ষা করে ওপারে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ, দেখুন ভিডিও
‘মৃত্যু’ শব্দটাই এমন এক অর্থ বহন করে, যা সব কিছুর শেষকে ইঙ্গিত করে। কিন্তু সৃষ্টিতে কোনও কিছুরই অন্ত নেই। সৃষ্টি অনাদি এবং অনন্ত। পদার্থ বিজ্ঞান আমাদের জানিয়েছে, সবকিছুই শক্তির রূপভেদ।
মৃত্যুর পরে শুরু হয় আর এক যাত্রা। প্রতীকী ছবি। সৌজন্য: পিক্সঅ্যাবে
(এই নিবন্ধের মতামত লেখকের নিজস্ব। এ বিষয়ে এবেলা.ইন-এর সম্পাদকীয় বিভাগের কোনও দায় নেই।)
আমাদের কাছে মৃত্যু এক প্রহেলিকা। এক রহস্য। মৃত্যুর এই বিশেষ চরিত্রের পিছনে রয়েছে একটাই কারণ। সেটা হল এই যে, মৃত্যুর পরের অবস্থা জীবেনের কাছে অজ্ঞাত। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মৃ্ত্যু জীবনেরই একটি অঙ্গ। জন্মগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুও নিশ্চিত হয়ে যায়। সেদিক থেকে দেখলে মৃত্যু কোনও ‘অ-স্বাভাবিক’ বিষয়ই নয়। অথচ মৃত্যুকে ঘিরে আমাদের জল্পনা-কল্পনার অধিকাংশ জায়গা জুড়েই থাকে ভয়। মৃ্ত্যু কি আদৌ ভয়ের বিষয়?
ভেবে দেখুন, আমরা মৃ্ত্যুকে ভয় পাই। কিন্তু বেঁচে থাকতে তো পাই না! অথচ যুক্তি দিয়ে দেখলে বোঝা যায়, বেঁচে থাকারই একটা অনিবার্য ধাপ মৃত্যু। এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা মৃত্যুভয়ে ভীত হয়েই জীবন কাটান। এমন জীবনের কোনও মানে হয়? এ তো শুধু টিকে থাকা! কিন্তু মৃত্যুকে যদি জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখি, তা হলে সেই ভয়ের ভার অনেকটাই কমে যায়। জীবনকে যথাযথ স্বাদে উপভোগ করা যায়।
কিন্তু মৃত্যু কি সত্যিই অজানা? আমাদের চৈতন্যকে যদি এই প্রশ্ন করা যায়, তো সেখান থেকে উত্তর আসতেই পারে, না তেমনটা নয়। কিন্তু এই ‘সত্য’ আমাদের ‘মনে থাকে না’। আমাদের চৈতন্য যে সর্বব্যাপ্ত মহাচৈতন্যের অংশ, সেখানে কিছুই ‘অজানা’ নয়। মৃত্যুও সেই ‘জানা’-র মধ্যেই একটা বিষয়। তাই মৃত্যু-পরবর্তী অবস্থাও আপনার ‘অজানা’ নয়। আমি শুধু আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। আমার বক্তব্য আর যাই হোক, কোনও ‘নতুন’ কিছু নয়।
আত্মার অবিনশ্বরতা সম্পর্কে উপনিষদের ঋষিরা বিস্তারিত বলেছেন। কিন্তু আত্মাও কি শেষ সত্য? তার চাইতেও বড় কেনও সত্য কি নেই, যা প্রকৃতই অবিনশ্বর?
‘মৃত্যু’ শব্দটাই এমন এক অর্থ বহন করে, যা সব কিছুর শেষকে ইঙ্গিত করে। কিন্তু সৃষ্টিতে কোনও কিছুরই অন্ত নেই। সৃষ্টি অনাদি এবং অনন্ত। পদার্থ বিজ্ঞান আমাদের জানিয়েছে, সবকিছুই শক্তির রূপভেদ। এবং শক্তির কোনও ‘অন্ত’ হতে পারে না। শক্তি বা এনার্জির ফ্রিকোয়েন্সি বা তরঙ্গের হেরফের ঘটে মাত্র। আইনস্টাইনের বিখ্যাত আপেক্ষিকতাবাদ আমাদের জানায়, এনার্জিকে তৈরি করা যায় না, ধ্বংসও করা যায় না। তার রূপান্তর ঘটানো যায় মাত্র। সেই সূত্র ধরে বলা যায়, সব কিছুই বর্তমান। মহাবিশ্ব থেকে কিছুই ‘হারিয়ে’ যায় না। তাই মৃত্যুও কোনও কিছুর অন্ত নয়। সে জীবনেরই একটা রূপান্তর মাত্র। জীবন থেকে মৃত্যু যদি একটা বৃত্ত হয়ে থাকে, তা হলে মৃত্যুর পর থেকে আরম্ভ হয় আর একটা বৃত্ত।
জীবনের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে মৃত্যু-পরবর্তী বৃত্তে প্রবেশ করে কী ঘটে চৈতন্যের? সে এক যাত্রাপথকে অতিক্রম করে। যাঁরা নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স-কে প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরা এই বিষয়ের সব থেকে বড় সাক্ষী। আমার অন্বেষণে আমি তাঁদের সাক্ষ্যকেই একটা বড় সূত্র বলে মানি। তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে তিনটি ‘ফেজ’-এর কথা জানা যায়। এই তিনটি ফেজ আসলে উপলব্ধির তিনটি স্তর। এই উপলব্ধি হল বিযুক্ততার উপলব্ধি।
এই তিন স্তরে তিনটি বিচ্ছিন্নতার বিষয় ঘটে—
১. প্রথমে জানা যায়, আমাদের দেহ ‘আমি’ নয়।
২. দ্বিতীয় স্তরে জানা যায়, আমাদের মনও ‘আমি’ নয়।
৩. তৃতীয় স্তরে জানা যায়, আমাদের আত্মাও ‘আমি’ নয়।
২. দ্বিতীয় স্তরে জানা যায়, আমাদের মনও ‘আমি’ নয়।
৩. তৃতীয় স্তরে জানা যায়, আমাদের আত্মাও ‘আমি’ নয়।
তা হলে ‘আমি’ কে? কোথা থেকে আমরা আসছি এবং কোথায় চলে যাচ্ছি?— এই প্রশ্ন দু’টির উত্তর খুঁজতে বসলেই ‘মৃত্যু’-র পরের অবস্থার কথা উঠে আসে।
নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স-প্রাপ্ত ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়—
১. প্রথম স্তরে মৃত্যুর পরে আমাদের দেহ থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হই। এবং দেহের কিছুটা উপরে ভাসমান অবস্থায় বিরাজ করি। এই অবস্থায় এই বোধ জন্মায় যে, আমাদের দেহ আর ‘আমি’ এক জিনিস নয়। কোনো দুর্ঘটনায় চৈতন্য হারিয়ে অথবা কোনও কোনও অনেকই এই অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত হয়েছেন। এই জাতীয় অভিজ্ঞতা সব সময়েই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় না।
২. দ্বিতীয় স্তরে কেউ যদি দেহ ত্যাগ করেন এবং তাঁর মৃত্যু হয়, তিনি সেই ফেজ-এ প্রবেশ করেন, যেখানে চৈতন্য মন থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়। মনের প্রকাশ চিন্তায়। চিন্তাই আমাদের জগৎকে তৈরি করে। এই পর্যায়ে চৈতন্য সেই জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং নিজেকে বিযুক্ত অবস্থায় দেখতে পায়। এই স্তরে আরও একটা ঘটনা ঘটে, যিনি যে ধর্মের মানুষ, যে বিশ্বাসের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন, তিনি সেই বিশ্বাস অনুযায়ী অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত হবেন। খ্রিষ্ট-বিশ্বাসী জিশুকে, কৃষ্ণ-বিশ্বাসী কৃষ্ণকে দেখতে পাবেন। স্বর্গ বা নরকের যে ধারণা তাঁরা পোষণ করে এসেছেন, তেমন স্বর্গ বা নরক তাঁদের সামনে প্রতীয়মান হবে। যিনি নাস্তিক, তাঁর কাছে এই স্তরটি একটি পাসিং ফেজ হিসেবেই থাকবে। তিনি পরবর্তী স্তরের দিকে এগিয়ে যাবেন।
৩. এই দুই স্তরের সমান্তরালে আসবে তৃতীয় স্তর। মনে রাখতে হবে, এই স্তরগুলি ‘পর পর’ ঘটে না। এগুলি সমান্তরাল। কারণ ‘সময়’ বলে কিছুই হয় না। কোনও ঘটনা আগে বা পরে ঘটে না। আমরা জীবদ্দশায় ঘটনা দিয়ে সময়ের ক্রমিকতা তৈরি করি। সেটা একেবারেই ইলিউশন। মৃত্যু-পরবর্তী তৃতীয় স্তরে এক আলোকসম্ভব অস্তিত্বের মুখোমুখি হই আমরা। এই অস্তিত্বই মহাচৈতন্য। আমরা বুঝতে পারি, আমদের আত্মা বলে যে বিষয়কে আমরা লালন করে এসেছি, তা-ও ‘আমার’ নয়। সে সেই আলোকসম্ভব মহাঅস্তিত্বেরই অংশ। আমাদের আত্মা বলে আলাদা কিছু হয় না। তা বিশ্বাত্মা। তার আমি-তুমি-সে-তাহারা ভেদ নেই। তার ক্ষয় নেই, নাশ নেই।
ভিডিও দেখুন
এই পর্যন্ত অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত হয়ে অনেকেই ফিরে আসেন। নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স-লব্ধ মানুষের একটা বড় অংশ এমন সাক্ষ্য বহন করে। তাঁরা অনেকেই জানিয়েছেন, তৃতীয় স্তরে কোথাও একটা চয়েস রাখা হয়। চৈতন্য মহাচৈতন্যে লীন হতে পারে আবার ইচ্ছে করলে ফিরে আসতেও পারে। জীবন অথবা মৃত্যু এই ‘চয়েস’-এর উপরেই নির্ভর করে। যিনি ফিরে আসতে চান, তিনি তৎক্ষণাৎ ফিরে আসেন। যিনি আসতে চান না, তিনি ‘মৃত্যু’ প্রাপ্ত হন। এই অবস্থাকে অনেকে স্বপ্নে বা আবিষ্ট অবস্থাতেও প্রত্যক্ষ করেছেন। ধ্যানযোগেও এই যাত্রা করেছেন অনেকেই। তাঁদের প্রত্যেকের দেওয়া বিবরণেই কিন্তু এই আখ্যানটি কমন।
আমাদের সবার চৈতন্যই মহাচৈতন্যের অংশ। কিন্তু দেহ আমাদের সেই বোধ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তথাকথিত মৃত্যুর পরে সেই দূরত্ব লুপ্ত হয়। শুরু হয় আমাদের ‘নিজস্ব’ যাত্রা।
লেখক একজন মোটিভেশনাল স্পিকার, সৃজনশীল নৃত্যশিল্পী, অভিনেত্রী। এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকায় দীর্ঘ যাত্রা ও অভিজ্ঞতা। কলকাতা থেকে বর্তমানে কোস্টা রিকার বাসিন্দা। দীর্ঘদিন যুক্ত রয়েছেন স্পিরিচুয়াল গবেষণায়। নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ‘ম্যাজিকনাইন’ নামের একটি গ্রন্থ।