শেয়ার করেছেন : - প্রণব কুমার কুণ্ডূ
◆ ১৮৯ বছর আগের এক ভাইফোঁটা...
-------------------------------
কালীপুজো-দীপাবলির রেশ মেটার আগেই চলে আসে ভাইফোঁটা। ১৮৩১ সালের ভাইফোঁটার দিনটা ছিল ৬ ই নভেম্বর। অধুনা উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বাদুড়িয়ার পুঁড়োর বাজারে ৫০০ জেহাদী নিয়ে তিতুমীরের প্রধান সেনাপতি গোলাম মাসুম এলাকার সম্ভ্রান্ত বাসিন্দা মহেশ চন্দ্র ঘোষের একটা গরু ছিনিয়ে নিয়ে মন্দিরের সামনে কেটে বিগ্রহে গো-রক্ত মাখায়। গরুটিকে চার টুকরো করে পুঁড়োর বাজারের চার কোণে টাঙ্গিয়ে দেয়।
দীপাবলি-ভাইফোঁটায় মেতে থাকা বাঙালির এই ধরণের আক্রমণের অভিজ্ঞতা সেই অঞ্চলে আগে ছিল না। কিন্তু আরও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় বাকি ছিল। আরবে শিক্ষাপ্রাপ্ত তিতুমীর বাঙালির সংস্কৃতিকে শেষ করতে ছিল বদ্ধপরিকর।
পরের দিন ইচ্ছামতীর অপর পারে পৌঁছায় জেহাদীরা। দুটি ষাঁড় মেরে ভোজ হয়। তারপর তাদের আক্রমণে লাউঘাট্টি বাজারে নিহত হন জমিদার তনয় দেবনাথ রায়। ফকির মিস্কিন শাহ এই জয়কে আল্লাহর জয় বলে ঘোষণা করে। তিতুমীর ঘোষণা করে, সে দার-উল-ইসলামের ঈমাম, তাকেই খাজনা দিতে হবে। জোর করে তোলা আদায় শুরু হয়।
◆ তিতুমীর :: জেহাদী থেকে মহাপুরুষ
-----------------------------------------------------
বাংলায় বাম-জেহাদীদের পছন্দমত মহাপুরুষের আকাল পড়েছে বহুদিন ধরেই। তারা তাদের বশংবদ ঐতিহাসিক-বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি-পরামর্শে আদ্যপান্ত জেহাদী তিতুমিঞাকে স্বাধীনতা সংগ্রামী বানিয়ে বাচ্চাদের মগজে পাকাপোক্তভাবেই তা ঢুকিয়ে দিয়েছে। তিতুমীরকে মহাপুরুষ বানাবার তোড়জোড়ও চলছে।
রাজ্যের সরকার পোষিত গ্রন্থাগারগুলিকে ১০০০.০০ টাকা করে অনুদান দেওয়া হয় প্রতি বছর ২৭ শে জানুয়ারী তিতুমীরের জন্মদিন পালনের জন্য।
তিতুমীর ইংরেজ তাড়াতে বাঁশের কেল্লা বানিয়ে লড়তে যায়নি। যেটা করতে চেয়েছিল, সেটা হল ওয়াহাবি আন্দোলনের আদর্শে, ইংরেজ ও হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে, এই নাপাক (অপবিত্র) বাংলার দার-উল-হারবকে সহি পাকস্থান (পবিত্র স্থান) দার-উল-ইসলামে পরিণত করতে।
এই জেহাদেই তার মৃত্যু। সুতরাং তাকে তো 'শহীদ' বলতেই হবে!
আর তাই তার স্মৃতিতে 'বাঁশের কেল্লা' নামে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে জামাত গোষ্ঠীর একটি পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয়, যার পাঠক সংখ্যাও যথেষ্ট ঈর্ষণীয়।
◆ কে এই তিতুমীর?
----------------------------
সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে শায়খ আহম্মদ শিরহিন্দি নামের এক ইসলামি কট্টরপন্থীর উদ্ভাস ঘটে, যিনি নিজেকে ‘মুজাদ্দিদে আলফে সানি’ বলে দাবি করেছিলেন। ভারতে আগত ইসলাম বহু ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মের সঙ্গে মিশে তার আদি রূপ ধরে রাখতে পারেনি। বহু হিন্দুয়ানি সংস্কৃতিকেও গ্রহণ করে নিতে হয়েছিল ইসলামকে। ফলে মরু-আরবের ইসলাম ও গঙ্গা-ভারতের ইসলামের মধ্যে একটা বড় ধরণের ফারাক তৈরি হয়। প্রচণ্ড হিন্দু বিদ্বেষী শায়খ আহম্মদ শিরহিন্দি ভারতের এই ইসলামকে ইসলাম বলে স্বীকার করতেন না।
তার মৃত্যুর পর, মোঘল সাম্রাজ্যের পতনকালে উদ্ভাস ঘটল আরেক কট্টরপন্থীর, তার নাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি। হিন্দুদের দমন করে দেহলভি ভারতকে পরিণত করতে চাইলো ‘দারুল ইসলামে', কিন্তু তার আশা পূরণ হলো না। তার মৃত্যুর পর এই দায়িত্ব গ্রহণ করলো সায়িদ আহমদ নামের আরেক কট্টরপন্থী। জেহাদি সংগঠন গঠন করে হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বিশ্বজুড়ে আল্লার রাজত্ব কায়েম করার তত্ত্বে পরম বিশ্বাসী ছিলেন এই ইসলামি পণ্ডিত। সে ‘তরিকায়ে মুহম্মদিয়া’ নামে একটি আন্দোলন শুরু করলো, যা ইতিহাসে 'ভারতীয় ওয়াহাবি আন্দোলন' নামে পরিচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, উপমহাদেশে ‘দারুল ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বালাকোটের যুদ্ধে মর্মান্তিকভাবে তার মৃত্যু হয়।
এই সায়িদ আহমদ বেরলবি যখন হজ্বযাত্রার উদ্দেশে কলকাতায় আসেন, তখন বহু বঙ্গবাসী তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এসব শিষ্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন বারাসাতের মীর নিসার আলি ওরফে তিতুমীর। পেশাদার কুস্তিগীর ছিল তিতুমীর। যৌবনে নদীয়ায় এক হিন্দু জমিদারের অধীনে লাঠিয়ালদের সর্দারি করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয় এবং বিচারে কারাদণ্ড ভোগ করে। কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষে যশোহর জেল থেকে বেরিয়ে সে ‘তরিকায়ে মুহম্মদিয়া’-য় যোগ দেয়।
তিতুমীরের উদ্ভাসের আগে ঊনিশ শতকের প্রারম্ভে বাংলাদেশে একটি মিশ্র সামাজিক এবং ধর্মীয় সংস্কৃতি বিরাজ করত। হিন্দু-মুসলমানের জীবনযাত্রার মধ্যে কিছু কিছু বৈসাদৃশ্য থাকলেও তার উগ্রতা অপেক্ষাকৃত কম ছিল বহু ক্ষেত্রে। গ্রামীণ মুসলমানদের মধ্যে জেহাদি তত্ত্ব তখনো প্রবলভাবে প্রবেশ করেনি। ফলে তাদের আচার-আচরণ ছিল সম্পূর্ণ মানবিক। বঙ্গদেশের মুসলমানরা চেহারায় ও বেশভূষায় হিন্দুদের থেকে পৃথক ছিল না। খাটো ধুতি, কাঁধে গামছা এই ছিল গ্রামের সাধারণ মুসলমানদের পোষাক। দাড়ি রাখা বা না রাখার বাছবিচার ছিল না। নামও ছিল তাদের হিন্দুঘেঁষা। যেমন পুরুষদের নাম দায়েম, কায়েম, সাজন, দানেশ, শেহেজান, শিহান, মধু এবং মেয়েদের নাম বাতাসী, কুড়ানী, শারী, শোভানী ইত্যাদি। এই মুসলমানরা নামাজ পড়ত ঠিকই, তবে একটিও আরবি শব্দের অর্থ না জেনেই।
তিতুমীর তার এলাকায় ওয়াহাবিদের নিয়ে দল গঠন করে স্থানীয় মুসলমানদের বাধ্য করে নাম পরিবর্তন করতে, আরবিয়দের মতো জোব্বা পরতে, দাড়ি রাখতে। ধুতির বদলে 'তাহ্বান্দ' নামে এক ধরনের বস্ত্র পরিধান শুরু করে। স্থানীয় মুসলমানরা মহরমের দিনে স্থানীয় দরগাতে ‘নজর’ দিত। তিতুমীরের অনুসারীরা এসবের বিরোধিতা করত। তারাগুনিয়া গ্রামে একবার তিতুমীরের অনুসারীরা মহরম অনুষ্ঠানে বাধা দেয় এবং দরগায় লাথি মারে। এ ঘটনায় স্থানীয় মুসলমানরা নালিশ করল জমিদারের কাছে। এই শুরু হলো জমিদারের সঙ্গে তিতুমীরের বিবাদ, শুরু হলো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সূত্রপাত। সংঘর্ষ থামাতে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হলো ইংরেজ সরকার। মামলা হলো তিতুমীর ও তার দলবলের বিরুদ্ধে। ফলে হিন্দুদের মতো ইংরেজ সরকারও তিতুমীরের বিরোধী পক্ষ হয়ে গেল। তিতুমীরের শত্রু ছিল পুঁড়োর জমিদার কৃষ্ণদেব রায়, গোবরডাঙার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, তারাগোনিয়ার রাজনারায়ণ, নাগপুরের গৌরীপ্রসাদ চৌধুরী এবং গোবরা-গোবিন্দপুরের দেবনাথ রায়।
১) সেপ্টেম্বর মাস, ১৮৩১ সাল: বারাসাত জেলার বাদুড়িয়ার অন্তর্গত নারকেলবেড়িয়া গ্রাম। পঞ্চাশ বিঘা নিস্কর জমির মালিক মৈজুদ্দিন বিশ্বাসের জমিতে অজস্র বাঁশ দিয়ে বুরুজ তৈরী হল।
২) ২৩/১০/১৮৩১: এক বিরাট ওয়াজে জিহাদ ঘোষণা হল। প্রাথমিক লক্ষ্য বৃটিশ শাসন ও হিন্দু জমিদারদের উচ্ছেদ, কারণ শরিয়ৎ বিপন্ন। ২৩/১০/১৮৩১ থেকে ০৬/১১/১৮৩১ পর্যন্ত মৌলবীরা কেল্লাতেই আটকে থেকে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করল।
৩) ২৮/১০/১৮৩১: বসিরহাটের দারোগা বারাসতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জানালেন জমিদার কৃষ্ণদেবের ওখানে তিতুমীরের অনুগামীরা গোহত্যা করতে চলেছে।
৪) ০৬/১১/১৮৩১: পুঁড়োর বাজারে ৫০০ জন জেহাদী তিতুমীরের প্রধান সেনাপতি গোলাম মাসুমের নেতৃত্বে মহেশ চন্দ্র ঘোষের একটা গরু ছিনিয়ে নিয়ে মন্দিরের সামনে কেটে বিগ্রহে গো-রক্ত মাখায়। গরুটিকে চার টুকরো করে পুঁড়োর বাজারের চার কোণে টাঙ্গিয়ে দিল।
৫) ০৭/১১/১৮৩১: ইচ্ছামতীর অপর পারে পৌঁছাল জেহাদীরা। দুটি ষাঁড় মেরে ভোজ হল। তারপর তাদের আক্রমণে লাউঘাট্টি বাজারে নিহত হলেন জমিদার তনয় দেবনাথ রায়। ফকির মিস্কিন শাহ এই জয়কে 'আল্লাহর জয়' বলে ঘোষণা করল। তিতুমীর ঘোষণা করল সে দার-উল-ইসলামের ঈমাম, তাকেই খাজনা দিতে হবে। জোর করে তোলা আদায় শুরু হল।
৬) ১৪/১১/১৮৩১: শেরপুর গ্রামে ইয়ার মহম্মদের বাড়ি আক্রমণ করল তিতু বাহিনী। ইয়ার মহম্মদের বিধবা কন্যা মুক্তবকে জোর করে নিকাহ করল তিতুর অনুগামী মহীবুল্লা। কনিষ্ঠা কন্যা কুমারী খুরমাকে অপহরণ ও নিকাহ করল কালু মিঞা।
৭) ১৬/১১/১৮৩১: ইন্ডিয়া গেজেট লিখল, রামচন্দ্রপুর গ্রামে হিন্দুদের মুখে জোর করে গোমাংস গুঁজে দেওয়া হচ্ছে।
এবার আলেকজান্ডার সাহেব তিতুর বিরুদ্ধে যাত্রা করলেন। বসিরহাট থানার দারোগা রামরাম চক্রবর্তীকে অপহরণ করল গোলাম মাসুম। বাঁশের কেল্লার মধ্যে হত্যা করা হল তাকে ইসলাম গ্রহণে অনিচ্ছুক হওয়ায়।
প্রথম দফার যুদ্ধে আলেকজান্ডার পরাজিত হয়ে পালালেন।
৮) ১৯/১১/১৮৩১: আলেকজান্ডার, সাদারল্যান্ড ও ম্যাকডোনাল্ডের নেতৃত্বে বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করল ইংরেজ সৈন্য। এক ইংরেজ সৈন্য মেক্কানকে হত্যা করে তার দেহ বল্লমে গেঁথে সামনে রেখে গোলাম মাসুমের নেতৃত্বে প্রতিরোধ করল তিতু বাহিনী।
যুদ্ধ ..... যুদ্ধ ..... যুদ্ধ ......
তিতু সমেত জনা পঞ্চাশ জেহাদী নিহত, আহত জনা ত্রিশ, ২৫০ জন প্রায় ইংরেজদের হাতে বন্দী। ইংরেজ পক্ষে হতাহত ১৭।
জেহাদীদের বিচারের পর গোলাম মাসুমের মৃত্যুদন্ড হল, একুশ জনের যাবজ্জীবন কারাবাস, নয় জনের সাত বছরের, নয় জনের ছয় বছরের, ষোল জনের পাঁচ বছরের, চৌত্রিশ জনের তিন বছরের, বাইশ জনের দুই বছরের কারাদন্ড। বাকিদের নির্দোষ বলে ছেড়ে দেওয়া হল। ফটিক নামক এক হিন্দুকেও কেল্লা থেকে ধরা হয়েছিল, মানসিক ভারসাম্যহীন বলে সে মুক্তি পেল।
গোলাম মাসুমকে জনসমক্ষে বাঁশের কেল্লার সামনে ফাঁসি দেওয়া হল।
এই ভাবে বাংলার বুকে শরিয়ত চালু করার চক্রান্ত নির্মূল করা হল। অথচ বিশেষ বিশেষ ঐতিহাসিকদের বদান্যতায় এই জেহাদী জঙ্গী তিতুমীর আজ বীরের মর্যাদা পায়!
ভাইফোঁটার দিন আমরা যেন না ভুলি সেই রক্তাক্ত ইতিকথা।
-----------
পশ্চিমবঙ্গের জন্য পেজ থেকে সংগৃহীত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন