শুক্রবার, ৭ আগস্ট, ২০২০

বৌদ্ধ বিহার ভেঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছে পুরীর মন্দির ?

  বৌদ্ধ বিহার ভেঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছে পুরীর মন্দির ?


Prashanta Ray
Jaya Barua
এবং
আরও 16
জনের সাথে।

শেয়ার করেছেন :- প্রণব কুমার কুণ্ডু


" বৌদ্ধ বিহার ভেঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছে পুরীর মন্দির"-- সেই চেপে রাখা ইতিহাসের সামান্য তুলে ধরা হলো।
ভারতবর্ষে বাবরি মসজিদ ও রামমন্দির ইষ্যুটি একটি প্রধান চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই চর্চা হয়ে এসেছে এবং এখনও বিরামহীন ভাবে এই চর্চা চলছে। একটি রাজনৈতিক দল এই ইষ্যুকে কেন্দ্র করে শূন্য থেকে একেবারে ক্ষমতার শীর্ষে পৌছে গিয়েছে।কিন্তু ব্রাহ্মন্যবাদীরা ভারতবর্ষে হাজার হাজার বৌদ্ধ বিহার ভেঙ্গে আর্য দেবদেবীর মন্দির গড়ে তুলেছে, তা নিয়ে কোন চর্চাই হয় না, কারো কোন মাথা ব্যথাও নেই। কারন কি ? মানবতাবাদী বৌদ্ধময় ভারতবর্ষকে ধ্বংস করে ব্রাহ্মন্যবাদের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে -- একথা তো সর্বজন স্বীকৃত এবং সমস্ত ঐতিহাসিক, গবেষকেরাও তা অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন।বিশ্বাসঘাতক পুষ্যমিত্র শুঙ্গের হাতে বৃহদ্রথের খুনের পর যখন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হাত থেকে ব্রাহ্মনদের হাতে ভারতের রাজক্ষমতা চলে যায় তখন থেকে চতুর্দশ শতক পর্যন্ত ভারতের ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় 1 লাখ 22 হাজার বৌদ্ধ বিহার ভেঙ্গে বা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে সেখানে বৈদিক দেবদেবীর মন্দির তৈরি করা হয়। শুধু তাই নয়, নির্মম খুন-হত্যা-ধর্ষনের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষকে বৌদ্ধ শূন্য করে দেওয়া হয়।ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য ও ভাস্কর্য-শিল্পকলাকে জানার আগ্রহে ব্রিটিশ সরকার 1921 সালে প্রত্নতাত্ত্বিক বিদদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন।স্যার জন মার্শালের নেতৃত্বে এই কমিটি বহু অর্থ ব্যয় করে দীর্ঘ 12 বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রাচীন ঐতিহ্য, স্থাপত্য-ভাস্কর্য, শিল্পকলা, মন্দির, গ্রন্থাগার ইত্যাদি নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষনা করেন।অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন দয়ারাম সাহানি, B.K. দোরাজ ইত্যাদি প্রত্নবিজ্ঞানী। এই গবেষনা থেকে বৌদ্ধময় ভারতের অতি মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ প্রচীন লুপ্তপ্রায় ইতিহাস উঠে এসেছে -- " ভারতবর্ষ বুদ্ধের দেশ। বৌদ্ধময় ভারত আর্য-বৈদিকতার হিংস্র রক্তস্রোতে ডুবে যায়। আর তার ঐতিহ্যকে ইতিহাসের পাতা থেকে সুকৌশলে মুছে দেওয়া হয়। ফলস্বরূপ আনুমানিক প্রায় 1 লক্ষ 22 হাজার বৌদ্ধ মঠ-বিহার ভেঙ্গে সেখানে গড়ে ওঠে আর্য-বৈদিক দেবদেবীর মন্দির। শুধু তাই নয়, অসংখ্য বৌদ্ধ ঐতিহ্য, ভাস্কর্য, শিল্পকলাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয় -- যা আবিস্কার করা সম্ভব হয়নি। ফলে বৌদ্ধধম্ম ও সংস্কৃতি আর্য-বৈদিক স্রোতে বিলীন হয়ে যায় " ( জন মার্শালের 'The Tradition of History' গ্রন্থ, পৃষ্ঠা-79, তৃতীয় প্রকাশ,)। অথচ খুবই দুঃখের বিষয় হলো জন মার্শালের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির এই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক-প্রত্নতাত্ত্বিক রিপোর্ট স্বাধীন ভারতে সম্পূর্ণ চেপে দেন ব্রাহ্মন্যবাদী শাসকেরা।
ঠিক এরকম একটি উদাহরন হলো পুরীর জগন্নাথ মন্দির। ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, পুরাতাত্ত্বিক গবেষনায় পরিস্কার হয়ে গিয়েছে যে, জগন্নাথরূপী কৃষ্ণের পুরুষোত্তম রূপ আসলে বৌদ্ধ বিহার দখলের চিত্র। পুরীর জগন্নাথ মন্দির যে বৌদ্ধ বিহার ছিল তার বড় প্রমান মিলেছে মন্দিরের গঠন শৈলী বা গঠন কাঠামোর মধ্যে এবং জগন্নাথ দেবের মূর্তির মধ্যে। বৌদ্ধ আদলের বিহার , মঠ ও তার শিল্পকলার পরিস্কার ছাপ রয়েছে জগন্নাথ মন্দিরে। বৌদ্ধ বিহার ও মঠের কিছু কিছু জায়গা আংশিক ধ্বংস করে সেখানে বৈদিক কাঠামো ও গঠন শৈলীতে গোড়ে তোলা হয়েছে জগন্নাথ মন্দির। আর গৌতম বুদ্ধের মূর্তিকে বিকৃত করে বা কিছু কিছু জায়গায় ভেঙ্গে দিয়ে ( হাত, মুখ) জন্ম হয়েছে জগন্নাথ দেবের। আবার মন্দিরের গায়ে নতুন কিছু ভাস্কর্যও পরবর্তীকালে তৈরি করা হয়েছে। যেমন দেয়ালে "কাম-কলার চিত্র"। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক দয়ারাম সাহানি তাঁর দীর্ঘ বার বছরের গবেষনার ফসল " প্রচীন ভারতের অজানা ইতিহাস " গ্রন্থে বলেছেন --" আর্যগন বৌদ্ধ বিহার ভাঙ্গিয়া পুরীর মন্দির নির্মান করিলেও ইতিহাসকে ফাঁকি দিতে পারে নাই। তাই মন্দিরের প্রতিটি ইট, কাঠ, পাথরে তাহার নিদর্শন রহিয়া গিয়েছে " ( 7-ম সংস্করণ,পৃষ্ঠা -- 182,)। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও পুরাতত্ত্ববিদ স্যার মর্টিমার হুইলার দীর্ঘদিন যাবৎ ভারতের প্রাচীন ভাস্কর্য শিল্পকলা নিয়ে গবেষনা করে তাঁর "History of Aryan power in India " গ্রন্থে বলেছেন --" বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ মূর্তি ভেঙ্গে জগন্নাথ দেবের নবজন্ম হয়েছে" (প্রথম প্রকাশ, পাতা- 210)। এরকম অসংখ্য উদাহরন রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, কখন পুরীর এই বৌদ্ধ বিহার ভেঙ্গে জগন্নাথ মন্দির করা হয়েছে ? এর উত্তর সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
ঐতিহাসিক গবেষকেরা সকলেই প্রায় একই সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছেন যে, চরম ব্রাহ্মন্যবাদী "সেন রাজত্বে" গৌড় বাংলায় ( বাংলা-বিহার-উড়িশা) প্রায় 7 হাজার বৌদ্ধ বিহার ও মঠ ভেঙ্গে বৈদিক দেবদেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে -- পুরীর জগন্নাথ মন্দির তারই একটি নিদর্শন। বিখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ ননীগোপাল মজুমদার দীর্ঘকাল যাবৎ গবেষনা করে তাঁর "ভারতের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পকলা " গ্রন্থে বলেছেন --- "আনুমানিক 1095 খ্রীঃ হেমন্ত সেনের পুত্র বিজয় সেন পাল রাজা কুমার পালকে গৌড় বঙ্গ হইতে সমূলে উৎপাটিত করিয়া জাঁকিয়া বসেন।প্রায় সাত হাজার বৌদ্ধ বিহার ভাঙ্গিয়া ও অগনিত নর-নারী হত্যা করিয়া তাঁহার বিজয় রথ থামে। ঠিক সেই সময়কালেই পুরীর বৌদ্ধ বিহার ভাঙ্গিয়া জগন্নাথ মন্দির গড়িয়া ওঠে" (তৃতীয় সংস্করন, পাতা- 193)। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রজনী পাম দত্ত একটু ভিন্ন মত পোষন করেছেন। তিনি তাঁর "Ancient History of India" গ্রন্থে বলেছেন ---" পুরীর বৌদ্ধ বিহার বিজয় সেনের আমলে ধ্বংস হলেও সেখানে জগন্নাথ মন্দির গড়িয়া ওঠে মূলত বল্লাল সেনের অর্থানুকুল্যে ও বদান্যতায়"(একাদশ সংস্করণ, পৃষ্ঠা-- 58)। বিজয় সেনের সভাকবি জিমূতবাহন তাঁর "দুর্গোৎসব নির্নয়" গ্রন্থে লিখেছেন --" রাজার আদেশে রাজরক্ষিরা মঠ, বিহার ধ্বংস করিল, বুদ্ধ নামাঙ্কিত ম্লেচ্ছ-অন্ত্যজদীগকে হত্যা করিয়া গৌড়-বঙ্গে বৈদিক ধর্মের বিজয় তোরন উড়াইল"( চতুর্থ অধ্যায়, 22 নং শ্লোক)। ম্লেচ্ছ, অন্ত্যজ বলতে এখানে ভারতীয় মূলনিবাসী-দলিত-বহুজনের কথা বলা হয়েছে।
এরকম অসংখ্য ইতিহাসকে ভারতের মাটিতে চাপা দেওয়া হয়েছে। এই চেপে রাখা ইতিহাস ব্রাহ্মন্যবাদী রাজশক্তি গুলি কখনো প্রকাশ্যে আনবে না। বরং চেপে রাখার জন্য সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করে যাবে। কিন্তু সেচেষ্টা আর বেশী দিন সফল হবে না।ভারতের মাটি থেকে উঠে আসতে শুরু করেছে সেই 'চেপে রাখা ইতিহাস'। আর এই চেপে রাখা ইতিহাসের আলোকে ভারতবর্ষ আবার আলোকিত হবে, বৌদ্ধময় হবে-- সাম্য ও শান্তির বাণী ছড়িয়ে পড়বে চারিদিকে।।
( প্রশান্ত রায় )।


শেয়ার করেছেন :- প্রণব কুমার কুণ্ডু
প্রণব কুমার কুণ্ডু


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন