শুক্রবার, ৭ আগস্ট, ২০২০

ধাপে ধাপে #সুপরিকল্পিতভাবে #ভারতের #ইতিহাসের #বিকৃতি।


উমাশংকর মন্ডল এতে হিন্দুরাষ্ট্র চাই💥 MODI SUPPORTERS 2024

 
 
শেয়ার করেছেন :- প্রণব কুমার কুণ্ডু
 

ভারতের ইতিহাসে সুলতানী যুগের যেসব অসংখ্য অনুরাগী ছিলেন, তাদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে আগে থাকবেন জওহরলাল নেহেরু। তিনি ঠিক এই কারণেই মুসলিম যুগের অপশাসনের বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার থাকা কুলপতি কানহাইলাল মানেকলাল মুনশিকে কোনও দিনই ক্ষমা করতে পারেন নি। বস্তুত যারাই ভারতের ইতিহাসে ‘অন্ধকার যুগের’ সমালোচনা করেছেন; তারাই নেহেরুর রাজরোষে পড়েছেন। মুনশির ‘অপরাধ’ ছিল – তিনি সোমনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে সাহায্য করেছিলেন। এছাড়া তিনি ‘সোমনাথ : অ্যান এটারনাল শ্রাইন’ গ্রন্থে সোমনাথ মন্দিরের ধ্বংসের ইতিবৃত্ত লেখার পাশাপাশি বইটার প্রতি পৃষ্ঠায় হিন্দু ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন; যেটা নেহেরু পছন্দ করেন নি। নিচে কিছু নমুনা দেওয়া হল, মুনশির একটি চিঠির; যা তিনি নেহেরুকে বিদ্রূপ করে লিখেছেন।
“অতীতের ঐতিহ্যের প্রতি আমার আস্থা আমাকে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে লড়াই করার প্রেরণা দেয়। আমি স্বাধীনতাকে মূল্য দেব না, তা যদি শ্রীমদ্ভাগবৎগীতাকে অশ্রদ্ধা করে কিংবা আমার মত লক্ষাধিক মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে নষ্ট করে। ঠিক এই ভাবেই তারা আমাদের মন্দিরের দিকে তাকিয়েছে এবং তা ধ্বংস করেছে। এই পবিত্র তীর্থস্থান আমাদের জীবনে বাঁচার গুরুত্ব নিয়েই আবার পুনর্নির্মিত হয়েছে। এবং তীর্থস্থান আমাদের মনোবলকে আরও উচ্চতর স্থানে পৌঁছে দেবে।”
এই চিঠি পেয়ে নেহেরু সন্তুষ্ট হন নি। ভারতের রাজনীতিতে নেহেরুর প্রভাব যত বাড়তে লাগল, মুনশি বুঝতে পারলেন যে, ভারতের বিপদ আসন্ন। তিনি নেহেরুর ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে ভয়াবহ হিন্দু বিদ্বেষী ইসলামিক চিন্তাধারাকে প্রতিহত করতে শেষ চেষ্টা করতে লিখলেন –
“ধর্মনিরপেক্ষতার নামে, ধর্ম বিরোধী শক্তি যা আজকাল কমিউনিজম বা মানবতার নামে চালানো হচ্ছে; তা আসলে হিন্দু ধর্মের ক্ষতি করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা সংখ্যাগুরুকে সব ব্যাপারে দোষ দিয়ে এমন একটা অবস্থা তৈরি করেছে যে, তথাকথিত সংখ্যালঘুরা সব রকমের দোষ থেকে মুক্ত হতে চলেছে; এতেই না থেমে তারা এমন সব দাবি তুলতে শুরু করেছে; যা মানা যায় না। অথচ তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীরা সেটাকে ন্যায্য মনে করছেন!”
কিন্তু কে এম মুনশি শুধু তিক্ত মন্তব্যেই থেমে থাকলেন না। তিনি স্থির করলেন, তিনি এমন একটা সত্যিকারের ইতিহাস লিখবেন, যা সবার কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এরপর তিনি আরেক প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদারের সাথে হাত মেলালেন। দুজনের যুগলবন্দীর ফলস্বরূপ এগারোটি অসাধারণ পুস্তক প্রকাশিত হল, যা ভারতের ইতিহাসে ‘দ্য হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার অফ দ্য ইন্ডিয়ান পিপল’ নামে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। যা মুনশির সবচেয়ে অমর কৃতিত্ব হিসাবে অদ্যাবধি খ্যাতি পেয়ে এসেছে। প্রথম খণ্ডে মুনশির এই গ্রন্থাবলীর মুখবন্ধ হিসাবে যা লিখেছিলেন তার একটি অংশ তুলে ধরা হল।
“আমি অনুভব করেছি যে, আমাদের তথাকথিত ভারতের ইতিহাস রচনা ত্রুটিহীন নয় এবং সত্যের পথেও হাঁটেনি। ঠিক এই কারণে আমি বহু বছর ধরে পরিকল্পনা করেছি এবং একটি ভারতের ইতিহাসের ওপর রচনা করব, যা থেকে বিশ্ব এক নজরে ভারতের আত্মা পর্যন্ত দেখতে পাবে। তারা দেখবে ভারতের ইতিহাস শুধু একের পর এক বিদেশী শক্তির অনুপ্রবেশের ইতিহাস নয় – সাথে কিভাবে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সাফল্যের সাথে জিতেছেও… তাও দেখানো হবে। এইভাবে সত্যিকারের অর্থে ভারতের ইতিহাস রচিত হবে। এইভাবে ভারতের বাসিন্দাদের ওপর সত্যিকারের ইতিহাস রচিত হবে। এতে যুগ যুগ ধরে ভারতীয়দের জীবনযাত্রার সঠিক বিবরণের পাশাপাশি তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতার ইতিহাসও অবশ্যই রচিত হবে। এটাই হবে আমাদের দ্বারা রচিত সঠিক ইতিহাসের একমাত্র উদ্দেশ্য। আমরা প্রচুর গবেষণা করে তারপর প্রাচীন ভারতীয় মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে কিভাবে ভারতের আদি বাসিন্দারা চলত, তার ইতিহাস লিখব। আমি হলফ করে বলতে পারি, এরকম ইতিহাস রচনা এর আগে কখনও লেখা হয়নি।”
স্বাধীনতার বাহাত্তর বছর বাদেও তথাকথিত ভারতীয় ইতিহাসবিদদের সম্পর্কে কে এম মুনশির বক্তব্য আজও একই রকম প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে। আমরা যখন ভারতের সত্যিকারের ইতিহাস সম্পর্কে বিতর্কে জড়াই, তখন বোঝা যায় পুরো ব্যাপারটাই এখন রাজনীতির একটা খেলায় পরিণত হয়েছে। ভারতের ইতিহাস রচনা এখন ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ তৈরি করা হয়। এ থেকে বোঝা যায় যে, মুনশির দূরদৃষ্টি কতদূর প্রসারিত ছিল এবং তার সঙ্কল্প আজও পুরোপুরি সফল হয় নি।
তার দ্বারা রচিত হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার অফ দ্য ইন্ডিয়ান পিপল, কালচারাল হেরিটেজ অফ ইন্ডিয়া, এবং বেশ কিছু অনবদ্য রচনা থেকে তার পাণ্ডিত্য ও সততার বহর অনুমান করা যেতে পারে। বলা চলে যে, ভারতের ইতিহাস রচনায় এর চেয়ে ভাল কিছু আজ পর্যন্ত লেখা হয় নি। কিন্তু একইসাথে দুঃখের বিষয় হল যে, তার রচনা ভারতের মূলস্রোতের ইতিহাস পাঠ থেকে অনেকটাই সরে গেছে। তার বদলে ভারতের ইতিহাস রচনা নামে যেটা চলছে, সেটা হল আত্মঘৃণা ও নিজের অতীত গৌরবকে অপছন্দ করতে শেখানো ইত্যাদি। ভারতের ইতিহাস রচনার নামে যে জিনিসটা আমরা দেখতে পাই, তার মত ন্যক্কারজনক, প্রতারণামূলক জিনিস সম্ভবত বিশ্বে একটাও নেই। কোথাও এইভাবে কোনও জাতিকে নিজের অতীতকে ঘৃণা করতে শেখানো হয় না; লজ্জিত হতে শেখানো হয় না।
একবার ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করুন। একবার উলটো জগতের কথা ভাবুন। এবার পাকিস্তানের ইতিহাস গ্রন্থের প্রসঙ্গে আসুন। পাকিস্তানের সরকারিভাবে স্বীকৃত যে ইতিহাস গ্রন্থগুলো পাওয়া যায়, সেখানে কোথাও ‘হিন্দু পাকিস্তানের’ কোনও অস্তিত্ব পাবেন না। তারা নিজেদের হিন্দুদের বংশধর হিসাবে স্বীকার করতেই চায় না। এই হিন্দু বিদ্বেষকে কেন্দ্র করে তারা এমন একটা ‘স্বাধীন পাকিস্তানী’ পরিচয় গড়তে চায়, বাস্তবে যার কোনও অস্তিত্বই নেই।
এবার ভারতের ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক। শেষ বাহাত্তর বছরে ভারতে ইতিহাস রচনার নামে কি করা হয়েছে? যা হয়েছে তার সাথে ‘পাকিস্তানী ইতিহাসের’ কোনও পার্থক্য আপনি খুঁজে পাবেন না। সেখানে হিন্দু শিকড়কে যত রকম ভাবে পারা যায়, অসম্মানিত, অপমানিত, অস্বীকৃতি ইত্যাদি ঘৃণ্য জিনিসের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। যারা এসব করেছেন তারা এমনকি নিজেদের ‘হিন্দু’ পরিচয় দিতে লজ্জা পান, যেমনটা পাকিস্তানীরা এখন পান। এখন আমরা দেখব কিভাবে ভারতের ইতিহাসের বিকৃতি সাধন করা হয়েছে।

ঐতিহাসিক ভারতীয় পাণ্ডিত্য : তখন ও এখন
এই প্রসঙ্গে আমরা দেখে নিতে পারি উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পাণ্ডিত্যের প্রকৃতি ও ধরণ কেমন ছিল। তাতে আমাদের বুঝতে হবে ঐ সময়ের পাণ্ডিত্যের সাথে বর্তমান সময়ের পার্থক্য কেমন ছিল। যে সময়ের কথা বলছিলাম, সে সময়কে ভারতের নবজাগরণের সময় বলা হয়। সে সময়ে কতশত পণ্ডিতের জন্ম হয়েছিল ভাবলেও বিস্ময় জাগে। সেই সময়ে ভারতীয় পাণ্ডিত্য ছায়াপথে মুনশির মত অনেক নক্ষত্র ছিলেন। বাকি বিশ্বেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। যদি ভারতকে একটি মাটি হিসাবে ধরি, তবে দেখা যাবে ঐ সময়কে স্বচ্ছন্দে সেরা উৎপাদনের যুগ বলা যেতে পারে। এই সময়ের উজ্জ্বল পণ্ডিতদের মধ্যে যারা উল্লেখযোগ্য, তারা হলেন – পাণ্ডুরং বামন কানে, মহীশূর হিরণ্য, যদুনাথ সরকার, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, পরশুরাম কৃষ্ণ গোড়ে, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, আনন্দ কুমারস্বামী, শ্যাম শাস্ত্রী, দেবুড়ু নৃসিংহ শাস্ত্রী, গঙ্গানাথ ঝা, গোবিন্দ চন্দ্র পাণ্ডে, এস. শ্রীকান্ত শাস্ত্রী, রাধা কুমুদ মুখার্জি, কাশি প্রসাদ জয়সওয়াল এবং আরও অনেকেই। যারা তাদের রচনা দিয়ে আজও সমান প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন।
প্রত্যেক পণ্ডিতই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর ছিলেন। তারা এক একটি বিষয় বেছে নিয়ে ইতিহাস রচনায় মগ্ন ছিলেন। যেমন পাণ্ডুরং বামন কানের কথাই ধরা যাক। তিনি অবিশ্বাস্য পরিশ্রম করে অনেক খণ্ডের হিস্ট্রি অফ ধর্মশাস্ত্রস, যদুনাথ সরকার যেমন অনেক খণ্ডে ঔরঙ্গজেব, সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত যেমন পাঁচ খণ্ডের হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান ফিলোজফি, অন্যান্য পণ্ডিতরাও অনুরূপ ভাবে বেশ কয়েক খণ্ডে ভারতের ইতিহাসের এক একটি অধ্যায় তুলে ধরেছিলেন। তারা একাধিক ভাষা জানতেন বলে ইতিহাস রচনার ভঙ্গি আরও মনোগ্রাহী হয়ে উঠেছিল। তাদের এই একাধিক ভাষা (ভারতীয় ও বিদেশী) জানাটা অনেক কাজে লেগেছিল – যেমন লিপি উৎকীর্ণবিদ্যা (এপিগ্রাফী), প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য, মুদ্রাবিজ্ঞান (নুমিসম্যাটিক্স), ভাস্কর্য থেকে ইতিহাস উদ্ধার করা, এবং আরও অনেক বিষয়ে খুবই কাজ দিয়েছিল। তাদের এই ‘অ্যাচিভমেন্ট’ ভারতের যে কোনও ইতিহাস শাখার পক্ষেই সত্যিই বিস্ময়কর বললেও কম বলা হবে। নিম্নলিখিত পত্রপত্রিকা পাঠ করলে তাদের পাণ্ডিত্যের নমুনা দেখে বিস্ময়ে হতবাক না হয়ে থাকা যাবে না – গেজেটিয়ারস, ইন্ডিয়ান অ্যান্টিকোয়ারি, এপিগ্রাফিকা ইন্ডিকা, বোম্বে এশিয়াটিক সোসাইটি এবং আরও অনেক স্বাধীন পত্রপত্রিকার নামোল্লেখ করা যেতে পারে। এস. শ্রীকান্ত শাস্ত্রীর নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি জনপ্রিয় কন্নড় সংবাদপত্র ‘প্রজামাতা’তে অসংখ্য স্মরণীয় রচনা লিখেছেন ভারতের ইতিহাসের ওপর।
দুঃখের বিষয় এইসব অসাধারণ পণ্ডিতদের সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না বললেই চলে। এবং আমাদের এই অজ্ঞানতার মূলে রয়েছে একটি রাজনৈতিক দল এবং তার মদতপুষ্ট কিছু ধান্দাবাজ ইতিহাসবিদদের দল। আজকের ইন্টারনেটের যুগে যেখানে সব কিছুই জানা যায়, সেখানেও কজন শিক্ষিত ভারতীয় জানেন এদের অস্তিত্ব মাত্র চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেও ছিল? উদাহরণ হিসাবে রমেশ চন্দ্র মজুমদারের কথাই ধরা যাক। ভদ্রলোক আজ থেকে মাত্র উনচল্লিশ বছর আগে – ১৯৮০ সালে মারা গেছেন। আমি আজ পর্যন্ত যতটুকু ‘মূলস্রোতের’ পত্রিকা পড়েছি, কয়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া মিস্টার মজুমদারের নাম নাম পাইনি বললেই চলে। এমনকি ইতিহাসের সাথে সম্বন্ধিত প্রবন্ধেও তার অবদান নিয়ে কোন কথাই হয় না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তিনি এমন কি ‘অপরাধ’ করেছেন যে, এভাবে জনসাধারণের স্মৃতি থেকে তাকে মুছে দেওয়া হচ্ছে?
১৯৮০ থেকেই এই অবনতির শুরু হয়েছে। তারপর থেকে যত সময় গেছে সারা বিশ্ব জুড়েই প্রকৃত পণ্ডিতের অভাব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যারা নিজেদের ‘ইতিহাসবিদ’ বলে দাবি করেন তারা কি ধরণের আত্মপ্রচারসর্বস্ব, অর্থহীন রাজনৈতিক প্রোপ্যাগান্ডা নিয়ে ইতিহাস রচনা করেন; তা আমরা সবাই কমবেশি জানি। এই কারণে ভারতের ইতিহাস রচনা এখন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনাপ্রসূত একটি প্রোপ্যাগান্ডার বেশী কিছু হচ্ছে না[২]। আর যখন ইতিহাস প্রোপ্যাগান্ডা মেশিনে পরিণত হয়, তখন সেই মেশিনের প্রথম শিকার হয় তারাই, যারা প্রোপ্যাগান্ডা না মেনে সত্যিকারের ইতিহাস তুলে ধরতে চান। রাজনৈতিক অপশক্তি যেনতেন প্রকারেন সেই প্রোপ্যাগান্ডা বিরোধী ইতিহাসকে নির্মম ভাবে ধামাচাপা দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। উদাহরণ হিসাবে ১৯৬০ সাল থেকে শুরু হওয়া ‘সাবঅল্টার্ন হিস্ট্রি’র ক্রেজের কথাই ধরা যাক। এই সময় থেকে রাজরাজড়ার ইতিহাসের বদলে জনসাধারণের ইতিহাস রচনার নামে যেটা হতে শুরু করে, তা প্রকৃতপক্ষে একটি অশ্লীল আত্মঘৃণাপ্রসূত টিপিক্যাল বামপন্থী প্রোপ্যাগান্ডা ময় ইতিহাস ব্যতীত আর কিছুই নয়। অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে সাবঅল্টার্ন ইতিহাস রচনার নামে আসলে আব্রাহামিক শাসনের ইতিহাস মুছে দেওয়ার অপপ্রয়াস চলছে।
এবার আমরা দেখাব পাঁচটা ধাপে ভারতের ইতিহাস রচনার নামে কিরকম সুপরিকল্পিত ভাবে ভারতীয়দের মন থেকে সত্যিকারের ইতিহাস জানার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
প্রথমত : সেই ভারতের আধুনিক নবজাগরণের জন্মলগ্ন থেকেই ভারতের পাণ্ডিত্য শুধু অত্যন্ত উঁচুদরের ছিল তা নয়, সাথে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভারতীয়রা জানতে পারে তাদের পূর্বপুরুষ তাদের জন্য কি কি সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক অবদান রেখে গেছেন। কিন্তু এই প্রবণতা পরের দিকে কমতে থাকে।
দ্বিতীয়ত : শেষ সাত দশক থেকে সেই একই পাণ্ডিত্যের চর্চা ধীরে ধীরে কমতে থাকে, তার বদলে অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে অযোগ্য, সরকারের পেটোয়া লোকজনই কেবল ভারতের ইতিহাস রচনা করার সুযোগ পেতে থাকে।
তৃতীয়ত : স্বাধীনতার পর থেকেই বৌদ্ধিক চর্চার জায়গায় প্রোপ্যাগান্ডাময় ইতিহাস রচনার একটা প্রয়াস চলতে থাকে। এই সময় থেকেই নিম্নলিখিত অজুহাত তুলে ভারতের ইতিহাস রচনার পরিবেশকে ধ্বংস করার কাজ চলতে থাকে – ‘এইসব জ্ঞানচর্চা সেকেলে ও আজকের যুগে অপ্রয়োজনীয়’, ‘এগুলো সবই হিন্দুত্ববাদীদের ষড়যন্ত্র’ ‘ইতিহাস রচনার নামে হিন্দু জাতীয়তাবাদ তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে’, ‘এগুলো জেনে কি হবে, কেউই এগুলো জেনে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে না’ ইত্যাদি। কিভাবে ভারতের ইতিহাসকে বিকৃতি সাধন করার প্রচেষ্টা করা হয়েছিল, সেটা জানতে হলে নিম্নলিখিত বইগুলি পড়া আবশ্যক – পারভারশন অফ ইন্ডিয়া’জ পলিটিকাল প্যারলান্স, জেনেসিস অ্যান্ড গ্রোথ অফ নেহেরুইজম, ডিকলোনাইজিং দ্য হিন্দু মাইন্ড এবং নেগেশনিজম ইন ইন্ডিয়া : কন্সিলিং দ্য রেকর্ড অফ ইসলাম।
চতুর্থত : তৃতীয় ধাপ থেকে চতুর্থ ধাপে নবজাগরণের সময়ে যেসব ইতিহাসবিদ ছিলেন, তাদের পদে পদে কর্মক্ষেত্রে হেনস্থা করা থেকে শুরু করে সব রকম অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে তাদের ব্র্যাত্য করার অপচেষ্টা শুর হয়। এর ফলস্বরূপ আমাদের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ বন্ধ হয়ে যায়; যা আর খোলেনি। এই বিভাগগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়াটা ভারতের ইতিহাসের একটি দুর্ভাগ্যজনক ও কলঙ্কিত অধ্যায়।
পঞ্চমত : এইভাবে ধাপে ধাপে পাণ্ডিত্য ও মনীষাকে অগ্রাহ্য করে মার্ক্সিস্ট ইতিহাসবিদরা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যেটা শুরু করেন, সেটা সংক্ষেপে মগজধোলাই করা ও আত্মঘৃণার পাঠ শেখানো ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। বলাই বাহুল্য মার্ক্সিস্ট ইতিহাসবিদরা তাদের আদর্শ মেনেই যে ইতিহাস বিকৃতি সাধন করেছেন, যার মূল সুর ছিল একটাই – প্রচণ্ড হিন্দু বিদ্বেষ। তাদের লেখা ইতিহাস পাঠ করলেই যে কোনও বুদ্ধিমান মানুষ বুঝবেন সেগুলো প্রোপ্যাগান্ডা ছাড়া আর কোনও ভাবনা থেকে প্রেরিত হয়নি।
এই ইতিহাস বিকৃতি সাধনের ব্যাপারে যাকে পথিকৃৎ বলে মানা হয়, সেই রোমিলা থাপার বিখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর দিলিপ কে চক্রবর্তীর একটি রচনায় বেশ কয়েকবার উল্লেখিত হয়েছেন। বিষয়বস্তু কি ছিল? একবিংশ শতকে ভারতের অবস্থা কি হবে, সে সম্বন্ধে থাপারের বিচ্ছিন্নতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।
“একবিংশ শতকের শেষদিক থেকেই ভারত বেশ কয়েকটা ছোট রাষ্ট্রে বিভাজিত হবে। এর ফলে উপমহাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে নিঃসন্দেহে।”
আমরা এটাকে নিছক রোমিলা থাপারের দৃষ্টিভঙ্গি ভেবে থেমে যেতে পারি না। বরং বলতে পারি তিনি কোনও দেশপ্রেম থেকে একথা বলেন নি; বরং কয়েকটা ভাগে ভারতকে বিচ্ছিন্ন করাকে তার জীবনের লক্ষ্য হিসাবে বেছে নিয়েছেন। তার এই বিষাক্ত চিন্তাধারা চার দশক ধরে ভারতীয়দের মানস জুড়ে রয়েছে; যার ফলাফল হিসাবে জেএনইউ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তৈরি হওয়া একদল বিচ্ছিন্নতাবাদী ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকের ‘ফৌজ’। এইভাবে একটি রাজনৈতিক দলের মদতে থাপার ক্রমশ ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ভাগ্যনিয়ন্ত্রকে পরিণত হয়েছেন। রমিলা থাপার ও তার সহযোগীরা যে এই কাজে বেশ সফল তা দুঃখের সাথে স্বীকার করছি। তারা ইতিহাস রচনার নামে শৈল্পিক ভাবে সুলতানিয়ত যুগে হিন্দু মন্দিরকে অপবিত্র করা, ধ্বংস করা, বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ ইত্যাদি স্পর্শকাতর বিষয়গুলি এমনভাবে পাশ কাটিয়ে গেছেন, যেন এরকম কিছুই কস্মিন কালেও হয় নি। কিন্তু এভাবে মিথ্যাচার করাটা যে একদিন ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে তা এরা বোঝেন নি।

তথ্যসূত্র
[1] The Subtle Subversion: The State of Curricula and Textbooks in Pakistan: A. H. Nayyar and Ahmed Salim, Sustainable Development Policy Institute, 2003. [2] Partition of History in Textbooks in Pakistan: Implications of Selective Memory and Forgetting: Ashok K. Behuria and Mohammad Shehzad, 2013
[2] Ibid, Pg 3
ধর্ম ডিসপ্যাচ পত্রিকায় প্রকাশিত। মূল প্রবন্ধ থেকে অনুবাদ করেছেন সদানন্দ গৌড়াপ্পা।
সৌজন্যে সম্পাদক বঙ্গদেশ পত্রিকা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন