বেদের নাসদীয় সূক্ত
[‘নাসদীয়’ শব্দটা এসেছে ‘ন+অসদ্’-এর সঙ্গে ‘ষ্ণ্য’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে। ‘সূক্ত’ মানে হলো ‘ভালো উক্তি’। অতএব ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১২৯ নং মন্ত্রে ধৃত এই সূক্তকে ‘অনস্তিত্ব বিষয়ক সু-উক্তি’ও বলা যায়। এটাকে ‘সৃষ্টিসূক্ত’-ও বলা হয়ে থাকে। ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্ব বা মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্বের সঙ্গে এ সূক্ত সম্পর্কিত।
বেদে দেবতাদের স্তব-স্তূতিমূলক যেসব সূক্ত আছে, সেগুলোর তুলনায় এ সূক্তটি একটু অন্যরকমের। ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দর্শন, ভাষাতত্ত্ব ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে সূক্তটি বহুলালোচিত। অন্যদিকে নাস্তিবাদীরা এ সূক্তকে সংশয়বাদ ও অজ্ঞেয়বাদের আদিতম উদাহরণ বলে মনে করেন। কারণ, এ সূক্তে সৃষ্টির মূল রহস্য কে জানে-- প্রশ্নটি রাখা হলেও সুস্পষ্ট কোনো উত্তর দেয়া হয় নি। মহাবিশ্বের আদিমতম অবস্থার কাব্যিক বর্ণনা আছে এ সূক্তে, যা পরবর্তী কালের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সঙ্গে মিলে যায়। জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগান এটাকে “বিশাল মহাজাগতিক রহস্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানবজাতির সংশয়াকুল জিজ্ঞাসা আর নিরহঙ্কার বিনয়”-এর সর্বপ্রথম নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
মূল বৈদিক ভাষা (সংস্কৃতের আদিরূপ)-য় সূক্তটি খুবই কাব্যিক গুণসমৃদ্ধ। তার একটা বাংলা অনুবাদ করে পোস্ট করলাম, যদিও ভাষান্তরটা অতটা কাব্যিক করতে যে পারি নি, সেটা আগেই স্বীকার করে নিচ্ছি।]
.................................................................................
১.
नासदासीन्नो सदासीत्तदानीं नासीद्रजो नो व्योमा परो यत् ।
किमावरीवः कुह कस्य शर्मन्नम्भः किमासीद्गहनं गभीरम्॥
নাসদাসীন্নো সদাসীত্তদানীং নাসীদ্রজো নো ব্যোমা পরো যৎ।
কিম্ আবরীবঃ কুহ কস্য শর্মন্নম্ভঃ কিমাসীদ্গহনং গভীরম্॥
বাংলায়:
তখন ন-অসদ্ সেখানে ছিলো না, সদ্-ও না,
কোনো ধূলি কিংবা আকাশও ছিলো না সেখানে।
তাকে ঢেকে কী ছিলো? কোথায় ছিলো? কার কাছে?
মহাজাগতিক তরল কি ছিলো সেই গহন গভীরে?
২.
न मृत्युरासीदमृतं न तर्हि न रात्र्या अह्न आसीत्प्रकेतः ।
आनीदवातं स्वधया तदेकं तस्माद्धान्यन्न परः किञ्चनास॥
ন মৃত্যুরাসীদমৃতং ন তর্হি ন রাত্র্যা অহ্ন আসীৎপ্রকেতঃ।
আনীদবাতং স্বধয়া তদেকং তস্মাদ্ধান্যন্ন পরঃ কিঞ্চনাস॥
বাংলায়:
তখন সেখানে মৃত্যু ছিলো না, অমরতাও না,
রাত্রি দিনের প্রকাশও ছিলো না সেখানে।
একের অস্তিত্ব শুধু ছিলো-- বায়ুহীন প্রশ্বাসে নিঃশ্বাসে,
একই সেখানে ছিলো শুধু, আর কেউই ছিলো না।
৩.
तम आसीत्तमसा गूहळमग्रे प्रकेतं सलिलं सर्वाऽइदम् ।
तुच्छ्येनाभ्वपिहितं यदासीत्तपसस्तन्महिनाजायतैकम्॥
তম আসীৎ তমসা গুহলমগ্রে অপ্রকেতং সলিলং সর্বং আইদম্।
তুচ্ছ্যেনাভু অপিহিতং যদ্ আসীত্তপসস্তন্মহিনাজায়তৈকম্॥
বাংলায়:
প্রথমে সেখানে ছিলো অন্ধকার অন্ধকারে ঢাকা,
শুধু ছিলো নিরালোকে মহাজাগতিক জলরাশি।
যে-এক অস্তিত্ববান ছিলো, কিছুতে যে আবৃত ছিলো না,
উদ্ভূত হলো সে অবশেষে, উত্তাপজনিত শক্তি থেকে॥
৪.
कामस्तदग्रे समवर्तताधि मनसो रेतः प्रथमं यदासीत् ।
सतो बन्धुमसति निरविन्दन्हृदि प्रतीष्या कवयो मनीषा॥
কামস্তদগ্রে সমবর্তনাধি মনসো রেতঃ প্রথমং যদাসীৎ।
সতো বন্ধুমসতি নিরবিন্দন্হৃদি প্রতীষ্যা কবয়ো মনীষা॥
বাংলায়:
তার উপরে সর্বাগ্রে নেমে এলো কাম
সেটাই প্রথম মনোজাত রেতঃপাত-- আদিবীজ।
কবি মহর্ষিরা অনেক খুঁজেছে মনীষায়,
এবং জেনেছে, যা আছে তা নেই-এর অনুরূপ।
৫.
तिरश्चीनो विततो रश्मिरेषामधः स्विदासीदुपरि स्विदासीत् ।
रेतोधा आसन्महिमान आसन्त्स्वधा अवस्तात्प्रयतिः परस्तात्॥
নিরশ্চীতো বিততো রশ্মিরেষামধঃ স্বিদাসীদুপরি স্বিদাসীৎ।
রেতোধা আসন্মহিমান আসন্তস্বধা অবস্থাৎপ্রয়তিঃ পরস্তাৎ॥
বাংলায়:
তারা তাদের তন্তুকে বিছিয়ে দিলো শূন্যতায়
এবং জানলো-- কী আছে ওপরে, কী-ই বা নিচে।
বীর্যতেজ উর্বর করে তুললো প্রবলা শক্তিকে।
নিচে ছিলো ধারণক্ষমতা, ওপরে প্রেরণা ছিলো প্রদানের।
৬.
को अद्धा वेद क इह प्र वोचत्कुत आजाता कुत इयं विसृष्टिः ।
अर्वाग्देवा अस्य विसर्जनेनाथा को वेद यत आबभूव॥
কো অদ্ধা বেদ ক ইহ প্র বোচৎকুত আজাতা কুত ইয়ং বিসৃষ্টিঃ।
অর্বাগ্দেবা অস্য বিসর্জনেনাথা কো বেদ যত আবভূব॥
বাংলায়:
তবে কিনা কে জানে, কে-ই বা বলতে পারে
কখন এসব এলো, কীভাবে-বা ঘটলো সৃজন?
দেবতারাও তো এসেছেন সৃষ্টিকর্মের পর!
তা হলে কে সত্যি জানে, কী করে তা হলো?
৭.
इयं विसृष्टिर्यत आबभूव यदि वा दधे यदि वा न ।
यो अस्याध्यक्षः परमे व्योमन्त्सो अङ्ग वेद यदि वा न वेद॥
ইয়ং বিসৃষ্টির্যত আবভূব যদি বা দধে যদি বা ন।
যো অস্যাধ্যক্ষঃ পরমে ব্যোমন্ত্সো অঙ্গ বেদ যদি বা ন বেদ॥
বাংলায়:
সব সৃষ্টির মূলে কোনো স্রষ্টা আছে, নাকি নেই?
এ জগৎ বানালেন তিনি, নাকি নয়?
পরম আকাশ থেকে বিশ্বকে দেখছেন যিনি
তিনিই জানেন সব, কিংবা হয়তো জানেন না তিনিও।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন