বৃহস্পতিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২০

বেলুড় মঠ

 বেলুড় মঠ

 

সবার সাথে প্রণব কুমার কুণ্ডুর দ্বারা শেয়ার করা হয়েছে
সবাই
বেলুড় মঠ
 
বেলুড় মঠ হল রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রধান কার্যালয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া শহরের বেলুড় অঞ্চলে হুগলি নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত বেলুড় মঠ কলকাতা-সন্নিহিত অঞ্চলের অন্যতম দ্রষ্টব্যস্থল। বেলুড় মঠের রামকৃষ্ণ মন্দির রামকৃষ্ণ ভাব-আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। এই মন্দিরটি হিন্দু, ইসলামি, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান স্থাপত্যের মিশ্রণে নির্মিত একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য নিদর্শন।
৪০ একর জমির উপর অবস্থিত মূল মঠপ্রাঙ্গনে রামকৃষ্ণ পরমহংস, সারদা দেবী, স্বামী বিবেকানন্দের দেহাবশেষের উপর অবস্থিত মন্দির ও রামকৃষ্ণ মিশনের সদর কার্যালয় অবস্থিত। এছাড়াও রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ইতিহাসকে তুলে ধরার লক্ষ্যে একটি সংগ্রহশালাও এখানে স্থাপিত হয়েছে। বেলুড় মঠ-সন্নিহিত একটি প্রাঙ্গনে গড়ে উঠেছে রামকৃষ্ণ মিশন অনুমোদিত বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্র। স্বামী বিবেকানন্দের পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে মন্দিরের নকশা নির্মাণ করেছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসের অপর সাক্ষাতশিষ্য স্বামী বিজ্ঞানানন্দ। বেলুড় মঠ ভারতের একটি প্রধান পর্যটন আকর্ষণ এবং ভক্তদের নিকট একটি পবিত্র তীর্থ।
বেলুড় মঠ বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা, নারীকল্যাণ, শ্রমিক ও অনগ্রসর শ্রেণীর স্বার্থে গ্রামোন্নয়ন, ত্রাণ, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।রামকৃষ্ণ পরমহংস, সারদা দেবী, স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম ও প্রয়াণতিথি, বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও বড়দিনউৎসব উদযাপন করে এই কেন্দ্র। দুর্গাপূজা, বিশেষত মহাষ্টমীর কুমারীপূজা দেখতে এখানে প্রতি বছর প্রচুর জনসমাগম হয়।
ইতিহাস
১৮৯৭ সালে পাশ্চাত্য থেকে কয়েকজন অনুগামী সংগ্রহ করে কলম্বো প্রত্যাবর্তন করেন স্বামী বিবেকানন্দ। এরপর ভারতে ফিরেই তিনি দুটি মঠের গোড়াপত্তন করেন। একটি আলমোড়ার নিকট হিমালয়ে অবস্থিত মায়াবতীতে অদ্বৈত আশ্রম ও অপরটি কলকাতার সন্নিকটস্থ বেলুড়ে রামকৃষ্ণ মিশন। এই মঠদুটি স্থাপনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল রামকৃষ্ণ মিশনে যোগদানে ইচ্ছুক যুবকদের গ্রহণ ও প্রশিক্ষণ এবং তাদের মিশনের কাজকর্মের উপযুক্ত করে তোলা। এই বছরেই দুর্ভিক্ষের সময় জনসেবার মাধ্যমে মিশনের কাজের সূচনা হয়।
বিশ্বধর্ম মহাসভায় ভাষণদানের আগে পরিব্রাজক জীবনে স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল পর্যটন করেছিলেন। এই সময় তাজমহল, ফতেপুর সিক্রি, দেওয়ান-ই-খাস, রাজপুতানার প্রাসাদ এবং মহারাষ্ট্র, গুজরাট, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও অন্যান্য অঞ্চলের প্রাচীন মন্দিরগুলি দর্শন করেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ ভ্রমণকালে সেই অঞ্চলের আধুনিক, মধ্যযুগীয়, গথিক ও রেনেসাঁ স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যগুলিও অবগত হন। কথিত আছে, এই সকল স্থাপত্যের সংমিশ্রণে স্বামী বিবেকানন্দই বেলুড় মঠ স্থাপত্যের পূর্বপরিকল্পনা রচনা করেছিলেন।
স্বামী বিবেকানন্দের পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁর সন্ন্যাসী-ভ্রাতা ও রামকৃষ্ণ পরমহংসের অপর সাক্ষাতশিষ্য স্বামী বিজ্ঞানানন্দ মন্দিরের নকশা প্রস্তুত করেন। বিজ্ঞানানন্দ পূর্বাশ্রমে ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ১৬ মার্চ, ১৯৩৫ মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। মার্টিন বার্ন অ্যান্ড কোম্পানি এই বিরাট মন্দিরটি নির্মাণ করেন। রামকৃষ্ণ মিশন এই মন্দিরের বর্ণনা দেন “স্থাপত্যের ঐকতান” রূপে।
স্থাপত্য
আধুনিক ধর্মস্থান বেলুড় মঠ মন্দির, মসজিদ ও গির্জার স্থাপত্যের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণে নির্মিত। রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের বিশ্বাস অনুসারে বিশ্বধর্মের আদর্শকে তুলে ধরার জন্য একাধিক ধর্মের স্থাপত্য ও প্রতীকতত্ত্ব থেকে মন্দিরের এই স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য সংকলিত হয়েছে। ধর্মের রূপতাত্ত্বিক দিকটিরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন এই মন্দির।
মন্দিরের মূল প্রবেশপথটি বৌদ্ধ আদর্শে নির্মিত। মূল প্রবেশপথের উপরের অংশটি উচ্চ স্তম্ভযুক্ত দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরের আদর্শে নির্মিত। মন্দিরের ভিতরের জানালা ও অলিন্দ উত্তর ভারতের রাজপুত ও মুঘল স্থাপত্যের আদর্শে তৈরি। কেন্দ্রীয় গম্বুজটি ইউরোপীয় রেনেসাঁ স্থাপত্যের নিদর্শন। আবার ভিতরের মেঝেটি কতটা খ্রিস্টান ক্রসের আকারে বিন্যস্ত।
মঠ প্রাঙ্গন
বেলুড় মঠের অভ্যন্তরে দ্রষ্টব্য স্থানগুলি হল শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির, পুরনো ঠাকুরঘর, স্বামী বিবেকানন্দের বাসকক্ষ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ মন্দির, শ্রীমা সারদাদেবী মন্দির, স্বামী বিবেকানন্দ মন্দির, সমাধি পীঠ, পুরনো মঠ, রামকৃষ্ণ মিউজিয়াম ইত্যাদি। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বহিরাগত দর্শক ও পূণ্যার্থীদের দর্শনের নিমিত্ত মঠ ও মন্দিরের দ্বার খোলা রাখা হয়। দেশ ও বিদেশ থেকে বহু মানুষ প্রতিদিন এই মন্দিরে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ সংগ্রহ মন্দির
'শ্রীরামকৃষ্ণ সংগ্রহ মন্দির' হল বেলুড় মঠ প্রাঙ্গনে অবস্থিত একটি জাদুঘর। এই জাদুঘরে রামকৃষ্ণ পরমহংস, সারদা দেবী, স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁদের কয়েক জন শিষ্যের ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রী রক্ষিত আছে। এগুলির মধ্যে আছে পাশ্চাত্যে বিবেকানন্দের পরিহিত লং কোট, ভগিনী নিবেদিতার টেবিল এবং শ্রীমতী সেভিয়ারের একটি অরগ্যান। জাদুঘরে রামকৃষ্ণ আন্দোলন ও সমকালীন বাংলার ইতিহাসের কালপঞ্জি রক্ষিত হয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ সংগ্রহ মন্দিরটি একটি দোতলা ভবন। এই ভবনের ভিতরে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির কাছে অবস্থিত রামকৃষ্ণ পরমহংসের সাধনস্থল 'পঞ্চবটী'র (পাঁচটি পবিত্র বৃক্ষের উদ্যান) অবিকল প্রতিকৃতি নির্মিত হয়েছে। গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত রামকৃষ্ণ পরমহংস তাঁর শেষ জীবনে যে কালো পাথরবাটিতে করে পায়েস খেতেন, এবং যে বালিশটি ব্যবহার করতেন, সেদুটিও কলকাতায় তিনি যে বাড়িতে শেষ দিনগুলি কাটিয়েছিলেন, সেই বাড়ির আদলে নির্মিত একটি কক্ষে রক্ষিত আছে। যে ঘরটিতে রামকৃষ্ণ পরমহংস তাঁর ১২ জন শিষ্যকে সন্ন্যাসীর গৈরিক বস্ত্র দান করেন এবং বিবেকানন্দকে (তখন নরেন্দ্রনাথ) তাঁর সন্ন্যাসী শিষ্যবর্গের নেতা নির্বাচিত করেন, সেই ঘরের একটি মডেলও আছে। এই ঘরে রামকৃষ্ণ পরমহংসের কল্পতরু মূর্তিও রাখা আছে। এই মূর্তির পায়ে রামকৃষ্ণ পরমহংসের ব্যবহৃত পাদুকাটি পরানো আছে। দক্ষিণেশ্বরে যে ঘরটিতে রামকৃষ্ণ পরমহংস থাকতেন, সেই ঘরটিও একটি প্রতিরূপ প্রদর্শিত হয়েছে। এই ঘরে তাঁর ব্যবহৃত কাপড় ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী আছে। সেই সঙ্গে রাখা আছে বিবেকানন্দ যে তানপুরাটি বাজিয়ে তাঁর গুরুকে গান শোনাতেন, সেই তানপুরাটি এবং রামকৃষ্ণ পরমহংস কর্তৃক চারকোল দ্বারা অঙ্কিত দুটি ছবি।
১৯১১ সালে সারদা দেবীর মাদ্রাজ (অধুনা চেন্নাই), মাদুরাই ও ব্যাঙ্গালোর (অধুনা বেঙ্গালুরু) তীর্থযাত্রার মডেলগুলিও তাঁর ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রীর সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছে। জাদুঘরের মধ্যে শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউশনের একটি মডেলের সামনে স্বামী বিবেকানন্দের একটি বৃহদাকার মূর্তি রয়েছে। উল্লেখ্য, শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউশনেই ১৮৯৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আয়োজিত বিশ্ব ধর্ম মহাসভায়বিবেকানন্দ ভাষণ দিয়েছিলেন। এই মডেলের পাশে যাত্রাপথে বিবেকানন্দের সহযাত্রী জামশেদজি টাটারএকটি চিঠি রক্ষিত আছে। এই চিঠিটি জামশেদজি টাটার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত রচনা। বিবেকানন্দের অনুপ্রেরণাতেই তিনি বেঙ্গালুরুতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স স্থাপন করেন।
চেন্নাইয়ের ভিক্টোরিয়া হলের কাঠের সিঁড়ি ও কাঠের পদ্ম এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। উল্লেখ্য, এই হলেই বিবেকানন্দ কয়েকটি জনপ্রিয় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এই মডেলের কাছেই রাখা আছে কুমারী জোসেফিন ম্যাকলাউড-সংক্রান্ত একটি প্রদর্শনী। কুমারী ম্যাকলাউডের সঙ্গে বিবেকানন্দের সাক্ষাৎ ১৮৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছিল। এরপর তিনি ৪০ বছর ভারতে কাটিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ আন্দোলনে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এই কক্ষে প্যারিসের মণিকার রেনে ল্যালিকের নির্মিত বিবেকানন্দের একটি স্ফটিকমূর্তি আছে।
1. বেলুড় মঠের প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইট
2. বেলুড় মঠের দ্রষ্টব্য স্থান - মঠের প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইট থেকে
Read Details about Belur Math
3. KolkataBrahmachari Gurudas (২০০৭)। "A Visit to the Belur Math: January 1907"। Prabuddha Bharata। আইএসএসএন 0032-6178। অজানা প্যারামিটার
সবার সাথে শেয়ার করা হয়েছে।
সবাই

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন