ঋগ্বেদ-সংহিতা
বেদগুলির চারটি অংশ সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ।
বৈদিক সাহিত্যে সংহিতা ও ব্রাহ্মণ অংশদুটিকে কর্মকাণ্ড ও আরণ্যক ও উপনিষদ দুটিকে জ্ঞানকাণ্ড বলা হয়।
ভারতের আদিমতম সাহিত্য ঋগ্বেদ।
ইন্দো-ইউরোপীয়ান সংস্কৃতির ভারতে অবস্থিত এক শাখা হিসেবে ঋগ্বেদের সৃষ্টি।
পুরাকালে ঋগ্বেদ সংহিতার অনেকগুলি শাখা ছিল, এখন তাদের মধ্যে শাকল ও বাষ্কল দুটি পাওয়া যায় এবং শাকল শাখাটিই বেশি ব্যবহৃত।
ঋগ্বেদের শাকল শাখায় দশটি মণ্ডল, যাতে মোট ১০২৮টি সুক্ত বা মন্ত্র আছে।
এই সুক্তগুলি হচ্ছে ১০৮৫০ ( ? ) শ্লোক বা ঋকের সমষ্টি।
ঋগ্বেদের দশটি মণ্ডলের সবগুলি এক সময় রচিত হয় নি।
ঋগ্বেদের সবচেয়ে পুরোনো মণ্ডলগুলি হচ্ছে দ্বিতীয় থেকে সপ্তম মণ্ডল, যেগুলি সাতজন ঋষি ও তাঁদের পরিবারবর্গের লেখা বলে ‘পারিবারিক মণ্ডল’ বলা হয়।
এর পরে প্রথম মণ্ডলের শেষাংশ ও অষ্টম মণ্ডলের রচনা, তার পর নবম মণ্ডল, যার বেশীর ভাগ সুক্তই হচ্ছে সোমরসের নিষ্কাশন তার গরিমার উদ্দেশ্যে রচিত।
ঋগ্বেদের সবচেয়ে নবীন, সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হচ্ছে দশম মণ্ডল।
সুকুমারী ভট্টাচার্য ঋগ্বেদের রচনাকাল ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের দ্বারা ১২০০ – ১০০০ বা ৯০০ খ্রী পূর্বাব্দ বলে ধরেছেন। তবে এই ব্যাপারে প্রচুর মতভেদ আছে পণ্ডিতদের মধ্যে। মোটামুটি ভাবে ১৪০০ থেকে ৯০০ খ্রী পূর্বাব্দের সীমার মধ্যে বেশীর ভাগ মতামত ঘোরাফেরা করে। কিছু লোক মনে করেন ঋগ্বেদের বয়স পাঁচ হাজার বা তারও বেশী পুরোনো, যদিও এই মতের সমর্থনে খুব বেশী লোক পাওয়া যায় না।
কথিত আছে যে ঋগ্বেদ ও অন্যান্য বেদগুলি লিখিত হবার আগে মৌখিক ভাবে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত ছিল। আরো একটা গল্প আছে যে ম্যাক্সমূলার বেদের প্রথম ইংরেজী অনুবাদ করার আগে, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কয়েকজন পণ্ডিত এনে তাদের কাছে ঋগ্বেদ শুনতে চান। কথিত আছে যে সকলেই একই ঋগ্বেদ শোনান তাঁকে। তবে এটা কতদূর সত্যি সেই নিয়ে কয়েকজন বর্তমান পণ্ডিত সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
ঋগ্বেদের সুক্তগুলির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক সমস্যাগুলির থেকে দেবতার কৃপালাভ ও রক্ষা।
তাই সুক্তগুলির পেছনে নান্দনিক প্রয়াস মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না। তবু প্রচুর সুক্ত আছে যা কবি, শিল্পী ও ঐতিহাসিকদের কাছে সমান প্রিয়। এরকম কিছু সুক্ত, যেমন নাসদীয় সুক্ত যেটি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি সুক্ত হিসেবে দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের কৌতূহল উদ্রেক করে, পুরুষ সুক্ত যেখানে এক সহস্রশীর্ষ, সহস্রপাদ বিরাট পুরুষের ধারণা ও তার থেকে বিশ্বসৃষ্টির বর্ণনা করা আছে, কবিত্বময় রাত্রি সুক্ত ও অরণ্যানী সুক্ত, বিতর্কমূলক যম-যমী সুক্ত, বিয়েতে বহু ব্যবহৃত সূর্যসুক্ত অথবা চিরন্তন সমাজের এক খণ্ডচিত্র হিসেবে জুয়াড়ীর বিলাপ সুক্ত – এই সুক্তগুলির আলোচনা নিয়ে ভারতীয় ও বিদেশী পণ্ডিতদের অনেক বই বাজারে আছে। কিন্তু সেগুলির বেশীর ভাগই নিরস অনুবাদ অথবা অতিরঞ্জিত ব্যাখ্যা। এই সুক্তগুলি সম্ভবত আনুষ্ঠানিক হলেও পেছনে আছে সুন্দর চিত্রকল্প, ঋষিদের জীবনবোধ এবং সামাজিক ছবির পরিচয়। এর সাথে বিভিন্ন ইন্দো-ইরানীয়ান ও গ্রীক প্রত্নকথাগুলির সাথে জায়গায় জায়গায় সামঞ্জস্য আছে।
ঋগ্বেদের ভাষা নিয়ে খুব বেশী নিগূঢ় আলোচনা করব না, কারণ Vedic Philology একটি ভিন্ন শাখা হিসেবে বিস্তার লাভ করেছে। এর সাথে আছে ঋগ্বেদের প্রাক্-সংস্কৃত ভাষার বৈশিষ্ট্য ও বিবর্তন, ভাষার মিতব্যয়িতা, বিশেষণের ব্যবহার, উচ্চারণ ও স্বরাঘাত, বিভিন্ন ছন্দ এবং ঋগ্বেদে মহাকাব্যের লক্ষণ – এগুলি তুলে ধরতে গেলে প্রবন্ধের কলেবর বেড়ে যায় পাঠকের সংখ্যা কমতে থাকে। সেজন্য এই বিষয়গুলি এই প্রবন্ধে বাদ দেওয়া হল।
ঋগ্বেদের সমাজ মূলত কৃষিজীবী ও পশুপালক। সুবৃষ্টির জন্য দেবতাদের কাছে প্রার্থনা আর গবাদি পশুগুলিকে সম্পদস্বরূপ রক্ষণাবেক্ষণ।
তবে গবাদিপশু যে চুরি যেত তার প্রমাণ মেলে পণী ও সরমার উপাখ্যানে।
শিল্পের মধ্যে ধাতুশিল্প, রথ নির্মাণ ও বয়ন শিল্পের উল্লেখ আছে।
গ্রামকেন্দ্রিক যে সমাজের কথা ঋগ্বেদে বর্ণিত, তাতে কিন্তু কোথাও কোন নগরীর বিবরণ নেই।
ঋগ্বেদের পুরুষ সুক্তে বলা হয়েছে ব্রাহ্মণের পুরুষের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য ও পা থেকে শূদ্রের উৎপত্তি হয়েছিল।
এ থেকে কিছু লোক বলেন যে সে যুগে বর্ণভেদ প্রথা চালু ছিল।
কিন্তু বেশির ভাগ পণ্ডিতের মতে এই অংশটি অনেক পরে রচিত ও প্রক্ষিপ্ত, কারণ ঋগ্বেদে আর কোথাও বর্ণভেদের উল্লেখ নেই।
এই রকম ভাবেই ঋগ্বেদের আর একটি শ্লোকের শেষাংশ বিকৃত করে ব্রাহ্মণকুল সতীদাহের স্বপক্ষে লাগিয়েছিলেন।
ঋগ্বেদের প্রাচীন ভাষ্যকার হিসেবে সায়নাচার্যের নাম বিখ্যাত হলেও তাঁর আগেও বিভিন্ন ভাষ্যকার, যেমন স্কন্দস্বামী, নারায়ণ, উদ্গীথ প্রমুখ, ঋগ্বেদের ভাষ্য করেছেন।
আধুনিক কালে ঋগ্বেদের ধর্ম ও দর্শন নিয়ে ঋষি অরবিন্দ তাঁর ‘বেদ-রহস্য’ বইটি লিখেছেন।
অন্যান্য পণ্ডিতদের মধ্যে ওল্ডেনবার্গ, ভান্ডারকর, উইলসনের মতো মনীষীদের থেকে শুরু করে বর্তমানের ওয়েন্ডি ডনিগার, দীপক ভট্টাচার্য প্রমুখেরা বেদের দেবতা ও প্রত্নকথাগুলির বিশ্লেষণধর্মী ব্যাখ্যা করেছেন।
ইন্দ্র ও অগ্নি ঋগ্বেদের প্রধান দুই দেবতা।
নিরুক্তকার যাস্ক সম্ভবত খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ট শতকে ঋগ্বেদের দেবতাদের তিন ভাগে বিন্যস্ত করেছিলেন –
ভূলোকবাসী,
দ্যুলোকবাসী ও
অন্তরীক্ষবাসী।
এখনকার গবেষকরাও এই বিভাগ মেনে চললেও, এর সাথে কাল অনুযায়ী ভাগ করেন, যেমন দ্যৌঃ, সূর্য, মিত্র-বরুণ, ইত্যাদি প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয়ান দেবতারা বা পরের দিকে উদ্ভূত বায়ু, আদিত্য, পুরুষ ইত্যাদিরা। বিখ্যাত গায়ত্রী মন্ত্র, যা মূলত সবিতা বা সূর্যের উদ্দেশ্যে বিরচিত, ঋগ্বেদের তৃতীয় মণ্ডলে প্রথম পাওয়া যায়, যা পরে অন্যান্য বৈদিক সাহিত্যে উদ্ধৃত হয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে ঋগ্বেদে বিষ্ণু প্রধান দেবতা নন, যিনি প্রধানত ইন্দ্রের সহচর।
অনেকের মতে বেদের ধর্ম বলতে বহুদেবতা কেন্দ্রিক আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া কলাপ, নীতিবোধ, ইন্দ্রজাল (মূলত অথর্ব বেদে) ও কিছু প্রত্নকথা। এই প্রত্নকথাগুলি আখ্যান হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো ছিটানো। কিন্তু এর সাথেই আমরা দেখি বৈদিক নীতিবোধ যা দেবতা ও মানুষকে ঋত অথবা সত্যের পথগামী হতে এবং ধৈর্য, দান, দয়া, অতিথিপরায়ণতা ইত্যাদি গুণাবলীর চর্চা করতে বলা হয়েছে। এই সবেরই মাঝে নিহিত আছে ঋগ্বেদের দর্শন, যা শতাব্দীর বিবর্তনের পর পরিস্ফুট হয়েছে দশম ও প্রথম মণ্ডলের শেষাংশে। সেখানেই আমরা দেখতে পাই ঋষিরা হিরণ্যগর্ভ সুক্তে জিজ্ঞাসা করছেন ‘কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম’ (কোন দেবতাকে হবির দ্বারা পূজা করি?) বা নাসদীয় সুক্তের শেষে প্রশ্ন উঠছে কে এই জগতের সৃষ্টি করেছেন ও কেন করেছেন, স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা হয়তো জানেন অথবা ‘আঙ্গ বেদ যদি বা না বেদ’, হয়তো তিনিও জানেন না। এখানেই বহুদেবতার মাঝে একেশ্বরবাদরূপে এক নতুন দর্শনের উৎপত্তি ও উপনিষদের শুরু।
তথ্যসূত্র-
বেদ-বেদান্ত-বেদাঙ্গ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন