শনিবার, ১ আগস্ট, ২০২০

স্বামী যতীশ্বরানন্দের ‘ধ্যান ও আনন্দময়’ জীবন’ থেকে অমৃতকথা

অমৃতকথা ধর্মের যথার্থ সংস্কৃত শব্দ ‘দর্শন’। এই ‘দর্শন’ শব্দটির দুটি অর্থ আছে। এর অর্থ দর্শন বা অনুভূতি—যে পথে অনুভূতি লাভ করা যায়, সাধনা এর আর একটি অর্থ। ধর্ম বলতে এদের উভয়কেই বুঝতে হবে। ‘দর্শনের’ অর্থ আবার দর্শনশাস্ত্রও হতে পারে। হিন্দুধর্মে যে ছয় প্রকার দর্শনশাস্ত্র আছে তাদেরও ‘দর্শন’ বলা হয়ে থাকে। হিন্দুধর্মে ধর্ম ও দর্শন একই অর্থে প্রযুক্ত হয়। এদের পৃথক করে ভাবা যায় না। সত্য ভাবোপলব্ধি উভয়েরই লক্ষ্য, এরা একে অপরের পরিপূরক। Prof. MaxMuller যথার্থই বলেছেন একমাত্র ভারতেই ধর্ম ও দর্শন এক সমন্বয়ের রূপ নিয়েছে; ধর্ম যেমন দর্শনশাস্ত্রের উদার প্রজ্ঞা লাভ করেছে, দর্শনশাস্ত্রও তেমনি ধর্মের কাছ থেকে পেয়েছে আধ্যাত্মিকতা। ধর্ম হল দর্শনশাস্ত্রের কার্যে পরিণত রূপ এবং দর্শনশাস্ত্র ধর্মের যুক্তিবাদী বিন্যাস। হিন্দু দার্শনিকেরা মুখ্যতঃ আধ্যাত্মিক অনুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। তাই তাঁদের দর্শন সম্প্রদায়গুলির ভিত্তি তুরীয় অবস্থার অভিজ্ঞতার উপর। আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সহিত যে কোন সম্প্রদায়ের পদ্ধতি মেনে চললে ঐ এক অভিজ্ঞতার অধিকারী হওয়া যায়। জীবনে ব্যক্তিত্ব ও পরিবেশের মধ্যে প্রভাব বিনিময় সব সময় চলে। ব্যক্তিত্বের যেমন বিভিন্ন স্তর আছে পরিবেশেরও তেমনি বিভিন্ন স্তর আছে। জড় শরীরের সঙ্গে জড় জগতের সংস্পর্শ আছে। তেমনি মনোময় শরীরের সঙ্গে মনোজগতের এবং অধ্যাত্ম শরীর বা জীবাত্মার সঙ্গে বিশ্বাত্মার বা ঈশ্বরের সম্পর্ক বিদ্যমান। ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন স্তর থেকেই অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে। আমরা যখন যে স্তরে বা যে জগতে বাস করি তখন সেই স্তরের অভিজ্ঞতাকেই সত্য বলে মনে করি। জাগ্রত অবস্থায় আমরা যা কিছু দেখি শুনি তাই আমাদের মনকে সম্পূর্ণভাবে ব্যাপৃত করে রাখে। স্বপ্নাবস্থায় আমরা যা দেখি স্বপ্ন চলা কালে আমাদের কাছে তা সত্য বলে মনে হয়। এ সবই অনুভূতি বা ‘দর্শন’, তবে সেগুলি সবই সত্য বলে যেন মনে না করি। তাই সমস্যা হচ্ছে ভ্রান্ত ও যথার্থ অনুভূতির পার্থক্য নির্ণয় করা। ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রে বৈধ অনুভূতির ব্যাপারে বিচারের আদর্শ কি হবে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করা হয়েছে। জড় বিজ্ঞানী বস্তুজগতে নিহিত সত্যের সন্ধানে আগ্রহী। তিনিও যে সকল ঘটনা অনুভব করেন তা পরীক্ষা নিরীক্ষার দ্বারা যাচাই করেন। মনোবিজ্ঞানীরও নিজস্ব ‘দর্শন’ আছে। তিনি অন্তর্দৃষ্টির সহায়ে চিন্তাধারা যে নিয়মে চলে তা প্রকাশ করতে সমর্থ হন। অধ্যাত্ম-জিজ্ঞাসু চান ঈশ্বর বা চরম সত্যকে সরাসরি অনুভব করতে, একেই বলে অপরোক্ষানুভূতি। ইন্দ্রিয়জ্ঞানের বিষয়ে আমরা অত্যধিক চিন্তা করি। আমরা মনে করি এই বাহ্য জগৎকে প্রত্যক্ষভাবেই উপলব্ধি করছি। তা কখনই নয়। বাইরের বস্তু থেকে উদ্দীপনা আসে আমাদের চোখে। সেখান থেকে খবর বাহিত হয় মনে, শেষে আত্মায়, যিনি প্রকৃত জ্ঞাতা। কেমন এক পরোক্ষ পদ্ধতি! অথচ একেই আমরা অপরোক্ষ অনুভূতি বলে মেনে নিতে অভ্যস্ত। প্রকৃত সরাসরি অনুভূতি বা অপরোক্ষানুভূতিতে সরাসরি প্রকাশ পায় আত্মজ্যোতিতে। এই অন্তর্জ্যোতিঃ মন ও ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই প্রকাশিত হন। ইনি স্বয়ং প্রকাশও বটে। ইহাই জ্ঞানাতীত অবস্থা। কখনো একে ‘তুরীয়’ বলে অভিহিত করা হয়। আমাদের অভিজ্ঞতা সাধারণতঃ ‘জাগ্রৎ’, ‘স্বপ্ন’ ও ‘সুষুপ্তি’—এই তিন অবস্থার জ্ঞানের মাধ্যমে লাভ হয়। এই তিন অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, চতুর্থ অবস্থা একটি আছে, যাকে বলা হয় ‘তুরীয়’। অন্য তিন অবস্থার মতো এটি অবশ্য একটি অবস্থা নয়। এ হলো অতীন্দ্রিয় জ্ঞান বা চৈতন্য স্বরূপ! স্বামী যতীশ্বরানন্দের ‘ধ্যান ও আনন্দময়’ জীবন’ থেকে অমৃতকথা

শেয়ার করেছেন :- প্রণব কুমার কুণ্ডু

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন