শাড়ি
প্রণব কুমার কুণ্ডু
শাড়ীর _উৎপত্তি_ ও _আদি _কথা॥ *************************************** <> আর্যরা ভারতবর্ষে আসার আগেই ‘শাটী’ শব্দটির অস্তিত্ব ছিল। সেই হিসেবে বলা যেতেই পারে, শাড়ির ইতিহাস বোধ হয় সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার বছর কিংবা তারও বেশি পুরানো। শাটি শব্দের অপভ্রংশ রূপ - শাড়ি । মধ্যভারতীয়- আর্যরা ‘শাড়ি’কে আরও বিভিন্ন শব্দে আখ্যায়িত করত - যেমন-‘সাটক’, ‘সাটিকা’। আবার ‘মহাভারত’এ উল্লিখিত দ্রৌপদীর ‘বস্ত্রহরণ’ করা হয়েছিল, সেটাও অনুমিত হয়, শাড়িই ছিল। গুপ্ত যুগের (আনুমানিক 300 থেকে 500 সাল পর্যন্ত) বিখ্যাত কবি কালীদাসের ‘কুমারসম্ভব’য়ে শাড়ির কথা উল্লেখ আছে। এছাড়া ইলোরা অজন্তা গুহার বহু প্রাচীন চিত্রাবলি বলে দেয়, খ্রিস্টাব্দ শুরুর সময়ে শাড়ির অস্তিত্ব ছিল। ইলোরা অজন্তার মতো পাহাড়পুর-ময়নামতির পোড়ামাটির ফলক থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, হাজার বছর আগে এই বঙ্গে শাড়ির প্রাধ্যন্য ছিল। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, আদিমকালে পূর্ব-দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার প্রচলন ছিল না। এই অখণ্ড বস্ত্রটি পুরুষের পরিধানে থাকলে হত ‘ধূতি’, আর মেয়েদের পরিধানে থাকলে ‘শাড়ি’। এছাড়া মধ্যযুগের কবিদের কাছ থেকে শুধু শাড়ির কথাই জানা যায় না, শাড়ির রংয়ের কথাও জানা যায়। চৌদ্দ শতকের কবি চণ্ডীদাস লিখেছেন— ‘নীল শাড়ি মোহনকারী/উছলিতে দেখি পাশ।’ ফ্যানি পার্কস 1851 সালে তাঁর বইয়ে লিখেছেন— ‘ধনী মহিলারাও শাড়ি পরত। আর শীতের সময় ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য বাড়তি হিসেবে ব্যবহার করত চাদর।’তবে তখনও পেটিকোট বা সায়ার প্রচলন হয়নি ॥ ভারতবর্ষের নারী তথা বাংলার নারীরা যুগ যুগ ধরে শাড়িকে তার প্রধান পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে আঁকড়ে রেখেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের নারীর পরিধেয় বস্ত্র। শাড়ি আবহমান ধরে বাংলার ইতিহাসে শাড়ির স্থান অত্যন্ত যে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো তা বোঝা যায় । যুগে যুগে শাড়ির পাড়-আঁচল, পরার ধরন আর বুনন কৌশল - পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু তার মহিমা হ্রাস পায়নি । ‘শাড়ি’ শব্দের উৎস সংস্কৃত ‘শাটী’ শব্দ থেকে এসেছে বলে মনে হয়। ‘শাটী’ শব্দের অর্থ পরিধেয় বস্ত্র। ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রাচীন ভারতের পোশাক নিয়ে বলেছেন যে তখন মেয়েরা আংটি, দুল, হার এসবের সঙ্গে পায়ের গোছা পর্যন্ত শাড়ি পরিধান করত, উপরে জড়ানো থাকত আধনা (আধখানা)। পাহাড়পুরে পাল আমলের (750 খ্রীঃ ) কিছু ভাস্কর্য দেখেই তিনি তা অনুমান করেন। এই তথ্য অনুযায়ী বলা যায় যে, অষ্টম শতাব্দীতে শাড়ি ছিল প্রচলিত পোশাক। ভারতের গোটা উপমহাদেশে " সেলাই করা কাপড়" - পরার রেওয়াজ আদিম কালে ছিল না। বয়ন শিল্পের উৎপত্তির সঙ্গে শাড়ির অনুসঙ্গ বদল হয়েছে তখন যেহেতু সেলাই করার কৌশল জানা ছিল না তাই সেলাই ছাড়া টুকরা কাপড় পরাই ছিল শাস্ত্রীয় বিধান। এ সময়ে সেলাই ছাড়া কাপড় পরার রেওয়াজ উপমহাদেশের বাইরেও প্রচলিত ছিল। পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যতায়, যেমন মিশর, রোম, গ্রিস-এ সেলাই ছাড়া বস্ত্র ঐতিহ্য হিসেবেই চালু ছিল। সেলাই করার জ্ঞান লাভ হওয়ার পর এই অখন্ড বস্ত্রই নানা এলাকায় বিচিত্ররূপে ও বিভিন্ন নামে রূপান্তরিত ও আদৃত হয়, যেমন ঘাগরা, সালোয়ার, কুর্তা, কামিজ প্রভৃতি। কিন্তু কয়েকটি এলাকায় ওই বসনখন্ড সেলাই ছাড়াই টিকে থাকে। এসব এলাকা হচ্ছে আজকের বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, আসাম, কেরালা, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র প্রদেশ, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, বিহার, পাঞ্জাব এবং পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ ও পাঞ্জাব। তাই বলা যায়, শাড়ি আর একমাত্র বাঙালি নারীর পরিধেয় বস্তু নয়, বর্তমান যুগে বাঙালি রমণীর পোশাক হিসেবেই শাড়ির অধিক পরিচিতি। . আজকের শাড়ি অখন্ড হলেও তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও বস্ত্র যা সেলাই করা অর্থাৎ অখন্ড শাড়ি নয়। শুধু শাড়ি পরার প্রথা আজ আর নেই,- শাড়ি” বাঙালির পরিচয়ের সাথে মিশে আছে বাংলার অহংকার হয়ে। সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীনতম পরিধেয় বস্ত্র এই শাড়ি॥
দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের নারীরা শাড়িকেই নিজেদের পরিধানের প্রধান বস্ত্র হিসেবে আঁকড়ে ধরেছে। মোগলদের মধ্যে সম্রাট আকবরই ভারতবর্ষের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা শুরু করেন। সেই ধারাবাহিকতায় শাড়িতেও মোগলাই আভিজাত্যের সংযোজন। মোগলদের আগ্রহের জন্য মসলিনের শাড়ির উপস্থিতিও থাকত জেনানা মহলে। মোগলদের জন্য মসলিন কাপড় সংগ্রহের জন্য সরকারি লোক নিয়োগ দেওয়া হত। আর সম্ভবত মোগল আমলে শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ পরিধানের রীতি চালু হয়। তবে সেসময় শাড়ি পড়া হত এক প্যাঁচে।
উনিশ শতকের চল্লিশ দশক থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কে বলা হয়ে থাকে ‘ভিক্টোরিয়ান যুগ’। এ যুগে ফ্যাশনের মূল কথাই ছিল কাপড়ে সারা শরীর ঢাকা থাকতে হবে। ব্রিটিশদের সংস্পর্শে থাকা জমিদার ও স্থানীয় ধনীদের পোশাক-পরিচ্ছেদেও ভিক্টোরিয়ান ফ্যাশনের স্টাইল যোগ হয়। এ সময়ে শাড়ির সঙ্গে ফুলহাতা ব্লাউজ এবং পেটিকোট পরার চল শুরু হয়। এই রীতিতে শাড়ি পরাটা বাঙালি নারীর চিরায়ত এক প্যাঁচে শাড়ি পরার ধারণাকে সম্পূর্ণ পালটে দেয়।
ভারত বিভাগের পূর্বে এদেশে নারীরা আধুনিক শাড়ি পরার চলন-বলন শিখেছেন মূলত ঠাকুর বাড়ির কল্যাণে৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীর অবদানের কথা এ ক্ষেত্রে স্মরণ করতে হয়৷ শাড়ির স্টাইলিশ রূপটি আমরা দেখতে পাই 60 ’এর দশকে৷ কারণ ফ্যাশন বা লুক যাই হোক না কেন - সাজ-পোশাক নিয়ে বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট এ দশকেই দেখা যায়৷
সুতির পাশাপাশি সিল্কের শাড়িও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে ॥ সত্তর দশকে বিপুল পরিবর্তন হয় - শাড়ির সাথে কনট্রাস্ট এবং গোল গলা আর লম্বা হাতের ব্লাউজ ফ্যাশনটিও চালু হয় এ সময়৷ তবে প্রাক আশির দশক থেকে শাড়ির ফেব্রিক্স ও বুননে ভিন্নতার ছোঁয়া পরিলক্ষিত হয়৷ মসলিন, জামদানী, জর্জেট, কাতানের পাশাপাশি সুতির উপর এক্সপেরিমেন্টাল কাজের ট্রেন্ডও চালু হয়৷ নব্বই দশক থেকে পরবর্তী দেড় দশকের শাড়ির ডিজাইনে হ্যান্ডপেইন্ট, স্প্রে, বাটিক, সিকোয়েন্স, ডলারব্যবহৃত হতে থাকে৷ পরবর্তীতে এ ডিজাইনগুলোর সঙ্গে আরো যুক্ত হয় অপ্রেলিক্স করচুপি, ফ্লোরাল মোটিভ ইত্যাদি ॥ আজ থেকে 100 বছর আগে শাড়ির সঙ্গে অনিবার্য হিসেবে সব শ্রেনীর জন্য এসেছে ব্লাউজ ও পেটিকোট বা সায়া নামের অন্তর্বাস- পরিধান॥ যা শুরু হয়েছিলো সম্ভবত আকবরের সময়ে - যা আমি আগেই জানিয়েছি ॥ তবে এই দশক থেকে শাড়ি কে ভারত বাসী মহিলা রা ধীরে ধীরে বিদায় জানাচ্ছে । সুবিধা ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বিদেশী পোশাক বাঙ্গালী তথা ভারত বাসীর মহিলা দের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠ্চ্ছে ॥- একদিন হয়তো ধুতি ও শাড়ি মিউজিয়াম এ রাখা থাকবে - যে বঙ্গের পুরুষরা ধুতি পরতেন আর ভারতীয় ও বঙ্গের নারীরা শাড়ি পরতেন । @ বাকি মত পাঠক পাঠিকা দেবেন । আজ এখানেই শেষ করি ॥ ......নমস্কার । ভবেশ রুদ্র ।
এই দিনে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন