সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

শুকতারা আর সন্ধ্যাতারা


   



শুকতারা আর সন্ধ্যাতারা 



শুকতারা আর সন্ধ্যাতারা *                ফেসবুক থেকে        শেয়ার করেছেন         প্রণব কুমার কুণ্ডু


শুকতারা আর সন্ধ্যাতারা

এখন (অগাষ্ট ২০১৮) বর্ষাকাল। এখন শুক্রকে সন্ধ্যাতারা রূপে দেখা যাচ্ছে।প্রশ্ন: আবার কবে এমন বর্ষায় সন্ধ্যাতারা দেখবেন? উত্তর: ৮ বছর পরে। এর কারণ হল ৫x৫৮৪দিন = ৮x৩৬৫ দিন হয়। এখানে ৫৮৪ দিন হল শুক্রের যুতিকাল (এই সময়ের ব্যবধানে শুক্রকে সন্ধ্যাতারা হিসাবে দেখার মরশুম আসে), আর ৩৬৫ দিন হল দুইটি বর্ষা ঋতুর মধ্যে সময়ের ব্যবধান। প্রতি আট বছরে পাঁচ বার সন্ধ্যাতারা দেখা যায় এবং সন্ধ্যাতারা দেখার সেই মরশুমগুলি নানা বছর নানা ঋতুতে পড়ে। শুক্রকে ভোরের আকাশে শুকতারা রূপেও ৮ বছরে ৫ বার দেখবেন, তাও নানা বছর নানা ঋতুতে।
আকাশে যখন শুক্র ও সূর্য্য একই দিকে থাকে তখন গ্রহটির সংযোগ (conjunction with sun) হয়। শুক্রের সংযোগ দুই প্রকার: উচ্চতর সংযোগ বা (superior conjunction (ছবিতে C2) আর নিম্নতর সংযোগ বা inferior conjunction (ছবিতে C1)। পর পর ২টি নিম্নতর সংযোগের মধ্যে যে সময় লাগে তাকেই শুক্রের যুতিকাল বলে। আট বছরে শুক্রের পাঁচটি উচ্চতর ও পাঁচটি নিম্নতর যুতি (সংযোগ, conjunction) হয়। সংযোগের সময় গ্রহটি সূর্য্যের পাশে থাকায় তাকে দেখা যায় না। উচ্চতর সংযোগের সময় (ছবিতে C2) শুক্র ৩ মাস অদৃশ্য থাকে। তারপর তাকে সন্ধ্যায় দেখা যায় (evening star)। ধীরে ধীরে শুক্রের উজ্জ্বলতা বাড়তে থাকে। যখন শুক্র তার উজ্জ্বলতার চরমে পৌঁছায় তখন সে উজ্জ্বলতায় আকাশের উজ্জ্বলতম তারা লুব্ধককেও বহু গুণ (প্রায় ১৩গুণ) ছাড়িয়ে যায়।
তারপর গ্রহটির নিম্নতর সংযোগ (inferior conjunction) হয় (ছবিতে C1)। এই সময় গ্রহটি ২ সপ্তাহ অদৃশ্য থাকে। তারপরে তাকে ভোরে দেখা যায় শুকতারা (morning star) রূপে। তখন সন্ধ্যার আকাশে তাকে দেখা যায় না। শুকতারার উজ্জ্বলতা ক্রমে ক্রমে বাড়তে থাকে। আটমাস শুক্রকে শুকতারা রূপে দেখা যায়, তারপর পুনরায় গ্রহটি উচ্চতর সংযোগে অদৃশ্য হয়।
৮ মাস সন্ধ্যাতারা, ২ সপ্তাহ অদৃশ্য, ৮ মাস শুকতারা, ৩ মাস অদৃশ্য --- সব মিলে ১৯ মাস ২ সপ্তাহ বা প্রায় ৫৮৪ দিনে একটি চক্র হয়। এই হল শুক্রের যুতিকাল (synodic period)। পৃথিবী থেকে দেখলে মনে হয় শুক্র যেন ৫৮৪ দিনে সূর্য্যকে ১ পাক খাচ্ছে। আসলে শুক্র ২২৫ দিনে সূর্য্যকে ১ পাক খায়, তবু আমরা ঘুরন্ত পৃথিবী থেকে দেখি বলে আমাদের মনে হয় যে শুক্র বুঝি ৫৮৪ দিনে সূর্য্যকে এক পাক খাচ্ছে (সঙ্গের ছবি দেখুন)।
দূরবীণে দেখলে শুক্রকে চাঁদের মতো বাড়া-কমা করতে দেখা যায়, অর্থাৎ এই গ্রহের চাঁদের মতো নানা কলা দেখা যায়। কেন এম হয় তা সংক্ষেপে বলছি। আমি ইয়া পেরেলমানের বই থেকে এই কথা প্রথম পড়েছিলাম, এবং বিষয়টি জেনে খুব ভাল লেগেছিল।
গ্যালিলিও ১৬১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্বহস্তনির্মিত দূরবীণে শুক্রের কলা প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন। উচ্চতর সংযোগের পর শুক্রকে যখন সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশে প্রথম দেখা যায় তখন শুক্রের চাকতিটা প্রায় সম্পূর্ণ গোল (পূর্ণশুক্র)। পৃথিবী থেকে অনেক দূরে বলে তখন গ্রহটির উজ্জ্বলতা কম। রোজ সন্ধ্যায় দেখতে থাকুন। শুক্র একটু একটু ক'রে উপরে ওঠে। সূর্য থেকে কৌণিক ব্যবধান যত বাড়, শুক্রের উজ্জ্বলতাও তত বাড়ে। আর দূরবীণে দেখবেন শুক্রের চাকতির উপরের দিকটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে। শুক্র যখন সূর্য থেকে সর্বোচ্চ বিস্তৃতিতে (ছবিতে E1ও E2) তখন দূরবীণে শুক্রকে আধখানা চাঁদের মতো দেখায়। সর্বোচ্চ প্রায় ৪৬ ডিগ্রী পর্যন্ত বিস্তৃতির পর সন্ধ্যাতারা রোজ একটু একটু ক'রে সূর্যের দিকে নেমে আসতে থাকে। তখন দূরবীণে শুক্রকে কাস্তের মতো দেখায়। মজার বিষয় হল শুক্রের কলা যত কমে চাকতিটার ব্যাস তত বাডে়। সন্ধ্যার আকাশে প্রথম যখন দেখা যায় তখন শুক্রের প্রায় গোল চাকতিটার কৌণিক ব্যাস প্রায় ১০'', কিন্তু নিম্নতর সংযাগের সাত-আট দিন আগে সন্ধ্যার আকাশ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় শুক্রের কাস্তের মতো সরু ফালিটার কৌণিক ব্যাস হয় প্রায় ৫৮''।
সঙ্গের ছবি দেখুন। উচ্চতর সংযোগের সময় শুক্র সূর্যের চেয়ে দূরে। তখন (ঠিক তখন নয়, উচ্চতর সংযোগের প্রায় দেড় মাস পরে শুক্রকে প্রথম দেখা যায়) শুক্রের যে পিঠটা আমরা দেখি সূর্যের আলো পডে় সেই পিঠটাতেই, তাই শুক্রের কলা তখন প্রায় পূর্ণ। নিম্নতর সংযোগের সময় শুক্রের যে পিঠটা আমরা দেখি, আলো পড়ে তার বিপরীত পিঠটায়, তাই তখন তার কলা শূন্য। নিম্নতর সংযোগের কিছু আগে (সন্ধ্যার আকাশ থেকে বিদায় নেওয়ার সময়) এবং পরে (ভোরের আকাশে ফুটে ওঠার সময়) শুক্রকে সরু কাস্তের মতো দেখায়। শুক্র যখন সূর্য থেকে ৪০ ডিগ্রী বিস্তৃতিতে থাকে তখন তার উজ্জ্বলতা চরমে পৌঁছায়। কলা কাস্তের মতো হলেও অত উজ্জ্বলতার কারণ শুক্র তখন আমাদের অনেক কাছে। বিস্তৃতি আরও কমলে (নিম্নতর সংযোগের কিছুদিন আগে এবং পরে) শুক্রের কলা খুব কম হয়ে যায় বলে উজ্জ্বলতা কমে যায়।
আমার চার ইঞ্চি প্রতিফলক দূরবীণে আমি বহু লোককে শুক্রের কলা দেখিয়েছি। সরু কাস্তের মতো ফালিটা বাইনোকুলারেও দেখা যায়। খুব ভাল দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন মানুষ শুক্রের সরু কাস্তের মতো চেহারাটা খালি চোখেও বুঝতে পারেন বলে কেউ কেউ দাবী করেছেন। ইয়া পেরেলম্যানের 'জ্যোর্তিবিদ্যার খোশখবর' বইয়ে এ নিয়ে একটা গল্প আছে। বিখ্যাত গণিতজ্ঞ কার্ল ফ্রেডারিক গাউস একদিন তাঁর মাকে অবাক ক'রে দেবেন বলে তাঁকে দূরবীণে শুক্রের কাস্তের মতো দশাটা দেখাচ্ছিলেন। দূরবীণে তা দেখে গাউসের মা বললেন, “তা তো দেখছি, কিন্তু কাস্তেটা অমন উল্টো দেখাচ্ছে কেন?” অবাক হওয়ার পালা গাউসের ! চাঁদ এবং শুক্রের কাস্তের আলোকিত দিকটি থাকে সূর্যের দিকে এবং সরু প্রান্ত দুটি সূর্যের বিপরীত দিকে। বাইনোকুলারে প্রতিবিম্ব সোজা দেখায় বলে ওইরকমই দেখবেন, কিন্তু দূরবীণে প্রতিবিম্ব উল্টে যায়। গাউসের মা কেমন ক'রে সেসব জানবেন? আসলে তিনি শুক্রের কাস্তেটা খালি চোখেই দেখতে পেতেন এবং দূরবীণে সেটা উল্টো দেখে ছেলেকে তার কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন! এই গল্পের সত্যমিথ্যা আমি জানি না। শুক্রের কাস্তে খালি চোখে দেখা সম্ভব কিনা তা খুবই সন্দেহজনক (সম্ভবত দেখা যায় না)।
বাস্তবে গ্যালিলিও দূরবীণ আবিষ্কার করার আগে শুক্রের কলা কেউ দেখেছেন বলে কোনো নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বর্ণনা নাই। অবশ্য কোপার্নিকাস ১৫৪৩ সালে প্রকাশিত তাঁর সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে মানুষের দৃষ্টিশক্তিকে যদি কোনো ভাবে আরো বাড়ানো সম্ভব হয় তাহলে বুধ আর শুক্রেরও চাঁদের মতো নানা কলা দেখা যাবে। গ্যালিলিও শুক্রের কলাকে কোপার্নিকাসের তত্ত্বের সমর্থনে একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ যুক্তি হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। শুক্র যে সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে, সূর্যের আলোয় আলোকিত হচ্ছে — এ সবই বোঝা যায় শুক্রের চাঁদের মতো বাড়াকমা দেখে।
এখন (আগষ্ট, ২০১৮) সন্ধ্যার আকাশে শুক্রকে সন্ধ্যাতারা হিসাবে দেখা যাচ্ছে। আগ্রহী ব্যক্তিরা দূরবীণে শুক্রের কলা দেখার চেষ্টা করুন। আগামী অক্টোবরের (২০১৮) দ্বিতীয় সপ্তাহে শুক্র কাস্তের আকার ধারণ করবে, যা বাইনোকুলারেও দেখা যাবে। সবাই তৈরী থাকুন।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন