সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

কলকাতার মার্বেল প্যালেস


      কলকাতার মার্বেল প্যালেস


       ফেসবুক থেকে       শেয়ার করেছেন       প্রণব কুমার কুণ্ডু

অতীত কলকাতার কড়চা-1
★★★★★★★★★★★★★
কেউ যদি মহাত্মা গান্ধী মেট্রো স্টেশনে নেমে মুক্তারাম বাবু স্ট্রীট ধরে এগিয়ে যান, খানিকটা পরেই বা'দিকে পড়বে - মার্বেল প্যালেস। গেট দিয়ে ঢুকে , নাম লিখিয়ে সোজাসুজি তাকালেই - ফরাসী স্টাইলে বৃহৎ থামওয়ালা একটি জমিদার বাড়ি, প্রায় দুই শতক ধরে এমন করেই দাড়িয়ে আছে। ডান দিকে রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক( মূর্তি) অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাড়িয়ে আছেন, মূর্তিতে রাজার মেজাজখানা ধরা আছে নিপূন ভাবে।
হঠাৎ করেই যেন চেপে বসলাম টাইম মেশিনে, অতলান্ত ঘটনার ঘন-ঘটার মধ্য দিয়ে পৌঁছে গেলাম কালের অন্য কোনো গ্রহে। এই অনুভবটুকু খুবই রোমাঞ্চকর--ফ্লাশব্যাকে অজস্র সাদা-কালো-রঙ্গিন ছবির পর্দা সরিয়ে আজ উনিশ শতকের প্রথমাংশ!
গাইডের সঙ্গে মূল ভবনে ঢুকে বা'দিকে এগিয়ে চললাম।
"In the year 1835, তৎকালীন কলকাতার বিখ্যাত সওদাগর" এই বলে গাইড একটু থামলেন, এক মুহূর্ত মাত্র, তারপর তার চোখ সজাগ হয়ে উঠলো, "রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক এই প্রাসাদ টি তৈরি করেছিলেন। তাঁর খুব শখ ছিল বিভিন্ন বিখ্যাত সব মূর্তি , ছবি সংগ্রহ করার।" একটি ছোট ও একটি বড় বিলিয়ার্ড বোর্ডের মাঝে দাড়িয়ে আমরা তার কথা শুনছিলাম। দেওয়াল জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন ছবি ।
প্রসঙ্গত বলি, রাজেন্দ্র মল্লিক ছিলেন জমিদার নীলমণি মল্লিকের দত্তক পুত্র। রানী ভিক্টোরিয়া , তাঁর বিপুল সম্পত্তি ও আভিজাত্যের জন্য তাঁকে 'রাজা' উপাধী দিয়েছিলেন।
বা'দিক দিয়ে অন্য একটি কক্ষে প্রবেশ করেই, চোখ পড়ল রানী ভিক্টোরিয়ার বিশাল এক মূর্তির উপর। একটি মাত্র গাছের গুঁড়ি( রোজ উড) দিয়েই নাকি এটি তৈরি! গাইডের ডাকে ঘোর ভাঙল, তিনি বললেন"স্যার,উপরের দিকে তাকিয়ে দেখুন-একে বলে কার্পেট ডিজাইনের সিলিং। ফ্লোরেও দেখুন। অদ্ভুত, কারুকার্য।"
কিছুক্ষন জন্য তিনি থামলেন, আমি সিলিং দেখতে ভীষণ ভাবে মজে গেছি। সিলিং দেখার পাশাপাশি বেশ বড় বড় ঝাড় বাতিও দেখলাম।
নিস্তব্ধতা ভেঙে আবার তিনি বললেন," ডানদিকে তাকান, স্যার, বলুনতো এটা কিসের মূর্তি?"
-ঠিক দুর্দান্ত রূপসী দেবীর মতো দেখতে, মাথায় সাপ।
"ইনি হলেন, গ্রীক দেবী -মেডুসা। দেখুন, হারকিউলিস, গল্প- গাঁথায় আমাদের মনে চিরস্থায়ী হারকিউলিস এর মুর্তিটাও পাশেই দাড়িয়ে রয়েছে--নিথর, নিশ্চুপ।"
ইতিহাস কী এমনই!
দেশ-মহাদেশ, অতীত-বর্তমান, পৌরাণিক কাহিনী, গ্রীক কাব্য, সব, সব যেন কেমন ঘোলাটে আবছায়া, সব যেন কেমন মায়ামূর্তি প্রতিকল্প!
এরপর, আমরা ডান দিকের দরজা দিয়ে বড় হল ঘরে ঢুকলাম।
গাইড বললেন, "এটা -ই ছিল রাজার সভাঘর।" বড় বড় আরাম কেদারা , চৌকো-লম্বা-টেবিল সময়ের কবরে নিঃশব্দে ঘুমিয়ে আছে।দু'পাশে দুটো ফুল রাখার লম্বা স্টান্ড। দেয়ালে অনেক পেইন্টিং। শিল্পীর কল্পনায় ঋতুরাও শারীরিক আকৃতি পায়, স্নিগ্ধ কিংবা গম্ভীর কিংবা রুদ্র, আভাস ফুটে ওঠে -Autumn, Spring, Winter ও Summer - এই ঋতুগুলোকে কল্পনা করে আঁকা ছবিগুলোতে।
সভাঘরের এক নিভৃত কোনে , আজও রাখা আছে, ভারতবর্ষের প্রথম পিয়ানো । যন্ত্রটির সুর-ক্রিয়া যথাযথ রাখার জন্য আজও নাকি বাজানো হয়- সোমবার ও বৃহস্পতিবার। কিন্তু, বাইরের দর্শনার্থীদের জন্য সেই সুর শোনার কোনও সুযোগ নেই।
পিয়ানোর কথাতেই মনে পড়ল, এই সভাঘরে -ই তো কত কত বিখ্যাত পন্ডিত বা উস্তাদের পদার্পন ধন্য হয়েছে! এখানের প্রতিটি ধূলিকণা -ও হয়তো সেই সব কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, হয়তো আগুন্তুকদের কাছে দুটো মনের কথা কইতে চায়!
যে দরজা দিয়ে ঢুকেছিলাম, অন্য দরজা দিয়ে বেরোলাম। বেড়াতে ই ডান দিকে দেখতে পেলাম, খাঁচার মধ্যে দুটো ম্যাকাও পাখি।
ভিতরের খোলা চৌহদ্দি আয়তকার, পূর্বদিকে পুজোর বেদী। উর্ধভাগে পুরোটা জাল দিয়ে ঢাকা, খন্ড আকাশের নীল-নীলিমা -ও সূতিকাজাল ভেদ করে চোখে-মনে নেশা লাগাতে ভুল করে না!
এখানে বেঞ্চিতে বসেই, কত গল্প-ঠাট্টা-হাস্যকথা হয়েছে, কত না ভোজের আয়োজন হয়েছে! পাশে বারান্দার বেঞ্চিতেই তো অতিথিদের জন্য সাজিয়ে রাখা হতো হরেক রকমের খাবার-দাবার!
কার্পেট বিছানো কাঠের চওড়া সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠবো, এক ধাপ পেরোতেই দেখলাম- বিশালাকার বেলজিয়াম আয়না। আজও যথাযথ রিফ্লেকসন দেয়। উপরে তাকাতেই চোখে পড়বে, বড় বড় হাতে আঁকা অয়েল পেইন্টিং ছবি। ইতালির বিখ্যাত শিল্পী রুবেন্স-এর কয়েকটি ছবি এখানে রয়েছে, সেগুলো সবই বিরলতম।
দোতালার দুটি কক্ষে সংস্কার চলছে, ফলে বর্তমানে সেগুলো বন্ধ আছে।
অন্য একটি কক্ষে ঢুকলাম, ঢঙ- ঢঙ করে পাশের ঘড়িটি বেজে উঠলো, নিয়ম মেনে। এতক্ষন ধরে মগ্ন হয়ে দেখছিলাম সব, শুনছিলাম কত গল্প কথা, হঠাৎ ঘড়ির শব্দে মনে হলো, দূর দেশ থেকে জাহাজ ভর্তি নাবিকেরা 'বর্তমানের' বন্দরে এসে নোঙর ফেলল, অতএব চমকে ওঠার-ই কথা।
ঘড়িটির দিকে তাকালাম, সারা শরীরে যেন কুঁচকানো চামড়া, ধীর-স্থির। ওহ, এটাই তো Grand Fathar Clock । এরই জোড়ি Grand Mother Clock রয়েছে একতলায়।
দুপাশের দুটো দেওয়ালে , অন্যান্য ছবির পাশাপাশি রয়েছে দুটো 3D ছবি। তাদের মধ্যে একটির নাম- বেলি ডান্সার। চমৎকার লাগলো, বিভিন্ন এঙ্গেলে ছবি দুটোকে দেখে। এ যেন ছবির সঙ্গে খেলা!
গাইড তাড়া দিলেন, হয়তো অন্য কাউকে আবার তাকে ধরতে হবে, তাই, অনিচ্ছা স্বত্বেও , একতলায় নেমে এলাম। খুব কম মানুষই এখানে আসেন, দুর্লভ নীরবতা ও ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ-র সংমিস্রণে যে উদ্ভাস জেগে ওঠে, তা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা যায়।
কোথাও পড়েছিলাম, এই প্রাসাদেই গড়ে উঠেছিল কলকাতার প্রথম চিড়িয়াখানা। আলিপুর চিড়িয়াখানা তখন ভবিষ্যতের গর্ভে। রাজেন্দ্র বাবুর স্ত্রীর অনুরোধে, তিনি এখানে চিড়িয়াখানা তৈরি করেছিলেন। পরবর্তী কালে, সেই সব পশু-পাখিদের বেশির ভাগই আলিপুর চিড়িয়াখানা কে দান করা হয়। যদিও, এখনও কিছু কিছু এখানে রয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে, প্রচুর বাংলা সিনেমার শুটিং-ও এই বাড়িতে হয়েছে। পুরোনো জমিদরী আমলের সময়কে সেলুলয়েডে ধরার জন্য, এই বাড়িটি তুলনাহীন।
কত ঘটনা, কত ছবি, উড়ে উড়ে আসছে মনের গহীনে! বাইরে বেড়িয়ে পায়চারি করতে করতে-ই দেখে নিলাম-- রক গার্ডেন, কৃত্রিম হ্রদ। হরেক রকমের পাখি।
হাটছিলাম বেশ, হঠাৎ-ই থমকে দাড়ালাম। বলা ভালো, দাঁড়াতে বাধ্য হলাম। শ্বেতশুভ্র ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূর্তি, মুদিত নয়নে যেন সব দেখছেন! তিন সহস্র কাল সময়ের সরলরেখা-য় গৌতম বুদ্ধ, আমি আর রাজেন্দ্র মল্লিক দাড়িয়ে আছি, তখন স্মৃতিমেদুর নিঃসঙ্গতা যে বন্দিশ রচনা করলো, তা বড়ই অন্তর্ভেদী, অপরিসীম তার বিস্তার। চোখের সামনে ভেসে উঠলো, William Faulkner এর সেই অনবদ্য কথাটি,"The past is never dead, it is not even past."
বি:দ্র: ছবি তোলা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ । শুধুমাত্র পাঠকদের সুবিধার্থে কয়েকটি ছবি দেওয়া হলো ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করে।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট, বিভিন্ন সময়ে পড়া বই, পত্রিকা।
যারা এখানে যেতে চান , তাদের জন্য বলি,বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে। অন্যান্য দিন সকাল 10 টা থেকে বিকেল 4 টা প্রযন্ত খোলা থাকে।
মার্বেল প্যালেস ভ্রমণের জন্য, ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যুরিজম থেকে (বিবাদীবাগ) পারমিশন করানো যায়। তবে, বৈধ আইডেন্টিটি কার্ড থাকলে, গেটে নাম নথিভুক্ত করে প্রবেশ করা যায়। গাইড নিতে হবে।

* দর্শনের মূল্য কত ? আর গাইডের মূল্য ? *

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন