সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০২০

পরলোকবাদ ও পুনর্জন্ম

 পরলোকবাদ ও পুনর্জন্ম

শেয়ার করেছেন : - প্রণব কুমার কুণ্ডূ






প্রণব কুমার কুণ্ডূ



লিখেছেন গৌরব বিশ্বাস






নিউজ ফিডের পোস্টলোকবাদ ও পুনর্জন্ম









আমরা প্রত্যেকেই তো জীবনে মৃত্যুশোক পেয়েছি। অনেক কাছের মানুষকে
বড় অসময়ে চলে যেতে দেখেছি। নিজের মৃত্যু আর প্রিয়জনের মৃত্যুশোক কোনোটাই এড়ানো যায় না। মৃত্যুর পরেই কি সব শেষ তাহলে? পঞ্চভূতে বিলীন হওয়ার পর কিছুই কি আর থাকে না? জড়বাদের দৃষ্টিভঙ্গি বলে, না সত্যিই কিছু আর থাকে না। আমাদের শোকবিহ্বল মন কিছুতেই যে তা মানতে চায় না। যে মানুষটার সাথে এ জীবনে এত গল্প, এত আনন্দ, এত গান, এত রাগ অভিমান সে মৃত্যু সে মানুষটার অস্তিত্ব এক লহমায় শেষ করে দেয়! পরের মুহূর্ত থেকে আর শুনতে পাব না তার গলার স্বর। আমার ডাকে সে আর সারা দেবে না কোনোদিন! শোকতপ্ত হৃদয় মৃত্যুর কাছে বড় অসহায়। ঠিক এখানে দাঁড়িয়েই পরলোকবাদে মৃত্যু পরবর্তী মানুষের অস্তিত্ব, আত্মার অবিনশ্বরতা ইহজগতের শোকানলে শান্তি বর্ষণ করে। ' এই কথা সদা শুনি ‘গেছে চলে’ ‘গেছে চলে’।

তবু রাখি বলে
বোলো না 'সে নাই'।
সে কথাটা মিথ্যা, তাই
কিছুতেই সহে না যে,
মর্মে গিয়ে বাজে'।

রবিবাবুও তো এমনটা লিখেছিলেন। পরলোকবাদ ঠিক একই কথা বলে। আমাদের প্রিয়জন কোত্থাও যায় নি আমাদের ছেড়ে। তাঁর শুধু অবস্থান্তর ঘটেছে। তিনি এখন সূক্ষ্ম শরীরে বিরাজমান। তাই আমরা তাঁকে দেখতে পাই না। তা বলে কি তিনি নেই! তিনি আছেন। তিনি থাকবেন। তাঁর অস্তিত্বের বিনাশ নেই। আমাদের মাঝে তিনি যেমন ছিলেন, কথায় গানে গল্পে মাতিয়ে রাখতেন এখনও তিনি ঠিক তেমনটিই আছেন। বদলাননি কিচ্ছুটি। শুধু তাঁর লোকান্তর ঘটেছে। দয়াময় মৃত্যু এসে তাঁর ক্ষয়িষ্ণু জড়দেহ থেকে তাকে মুক্ত করেছে। মৃত্যুর পর নতুন করে জীবন শুরু করেছেন তিনি। এটাই প্ৰকৃত বেঁচে থাকা ( 'To die is to live the true life'- Plotinus)। ইহলোক আর পরলোক তো বিচ্ছিন্ন নয়। তবে কেন ধরি না, তিনি কোনো দূর দেশে গেছেন বেড়াতে। তাই তাঁর সাথে সহজে যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে না। রাজকৃষ্ণ মিত্র ওনার 'শোকবিজয়' গ্রন্থে খুব সুন্দর একটা কথা বলেছেন-' জন্ম ও মৃত্যু, ইহকাল ও পরকাল- এ-বাড়ি ও-বাড়ি ব্যতীত যে আর কিছুই নহে, তাহা এক্ষণে বেশ উপলদ্ধি করিতে সমর্থ হইয়াছি'।
জন্মের পর আমাদের শৈশব , তারপর আসে যৌবন শেষে বার্ধক্য। শরীরের তখন জরা জীর্ণ ক্ষয়িষ্ণু দশা। শৈশব বা যৌবনে যে দেহ অবয়বকে লোকে 'আমি' বলে চিনত, বার্ধক্যে তার কী নিদারুণ পরিবর্তন। তাহলে কোনটা 'আমি'? কে 'আমি'? আমার জড়দেহটি তবে তো আমার অস্তিত্ব নয়! সে তো ক্রম ক্ষয়িঞ্চু। আমার অস্তিত্ব তবে তো আমার আত্মায়। যার ক্ষয় নেই। জন্ম নেই। মৃত্যু‌ও নেই-'দেহী নিত্যং অবধ্যোহয়ং দেহে সর্ব্বস্য ভারত' (এ দেহের যিনি অধীশ্বর তিনি সনাতন। তার মৃত্যু নেই)। তিনি প্রাণের প্রাণ। আমার প্রত্যেকটি অনুভূতিতে তাঁরই অস্তিত্ব প্রকাশ পায়। আমাদের দেহ রথের তিনিই তো রথী। তিনিই দর্শন করেন, স্পর্শ করেন, ঘ্রাণ নেন, আস্বাদন করেন, মনন করেন, তিনিই হলেন জ্ঞান-' এষ হি দ্রষ্টা, শ্রোতা, ঘ্রাতা, রসয়িতা, মন্তা, বোদ্ধা,কর্ত্তা, বিজ্ঞানাত্মা পুরুষঃ'(প্রশ্নোপনিষৎ)
ইহজীবনে যে ব্যক্তিদের আমরা ভালোবাসি, স্নেহ করি, শ্রদ্ধা করি ভক্তি করি, সে ব্যক্তি সম্পর্কে আমাদের যে-ই হোন না কেন, আমাদের যত নিবেদন সব তাঁর আত্মার প্রতি। নিজের আত্মা দিয়ে অপর এক আত্মার প্রতি নিবেদন। দেহেন্দ্রিয়ের সাথে যতদিন এর সংযোগ ততদিন তিনি জীবাত্মা।

তৈত্তরীয় উপনিষদ বলে, আমাদের নাকি তিনটি দেহ আছে- স্থূল শরীর, সূক্ষ্মশরীর আর কারণ শরীর। আর আছে পঞ্চ কোষ ( জীব বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা খুঁজবেন না )। স্থূল থেকে সূক্ষ্ম এবং সূক্ষ্মতর পর্যায়ক্রমে- অন্নময় কোষ, প্রাণময় কোষ, মনোময় কোষ, বিজ্ঞানময় কোষ, আনন্দময় কোষ। অন্নময় কোষ হল আমাদের স্থূল শরীর। প্রাণময় কোষের উপাদান- পঞ্চ প্রাণ বায়ু (প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান) আর পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ( হস্ত, পদ, বাক, গুহ্য ও উপস্থ)। মনোময় কোষের উপাদান- পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ( চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বা, ঘ্রাণ ও ত্বক) এবং মন।
বিজ্ঞানময় কোষের উপাদান ' বুদ্ধি'।
প্রাণময়, মনোময়, আর বিজ্ঞানময় এই তিন কোষ মিলেই গঠিত হয় সূক্ষ্মদেহ( Astral/subtle body)। লক্ষ্যণীয়, সূক্ষ্মদেহের উপাদান স্বরূপ যে সপ্তদশ অবয়বের কথা বলা হয়, তা কিন্তু এই তিন কোষেরই উপাদান- পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়+ পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়+ পঞ্চ প্রাণবায়ু + মন +বুদ্ধি। এই সপ্তদশ অবয়ব থাকে বলেই জড়দেহ ত্যাগের পরেও সূক্ষ্মদেহের কার্য শক্তি, ইচ্ছা শক্তি, জ্ঞান সবই পূর্বের ন্যায় সমান ভাবে বর্তমান।

অন্নময় কোষ বা আমাদের জড়দেহে যে সমস্ত অঙ্গ গুলোকে আমরা জ্ঞানেন্দ্রিয় বা কর্মইন্দ্রিয় বলি, সেগুলো আসলে এই সূক্ষ্মদেহের জ্ঞান ও কর্ম ইন্দ্রিয় গুলোরই স্থূল বহিঃপ্রকাশ।

আর আনন্দময় কোষে অবস্থান করে কারণ দেহ(causal body) । বাকি চারটি কোষের তুলনায় এটি সূক্ষ্মতর । প্রত্যেক জন্মের অর্জিত সংস্কার এই কারণ দেহেতেই সঞ্চিত থাকে। প্রত্যেক জন্মে এই কারণ-শরীরই জীবের সাথী হয়ে ইহলোকে আসে।

যতদিন জীবিত থাকি সূক্ষ্মদেহ, কারণ দেহ আমাদের গোচরে আসে না। মৃত্যুর সময় জীবাত্মা তিন কোষ বিশিষ্ট সূক্ষ্মদেহ আর কারণ -দেহ সহযোগে ধর্ম্ম অধর্ম্মাদির সাথে জড়দেহ ত্যাগ করে বেরিয়ে আসে। ইহলোকের ভাষায় তখনই আমাদের মৃত্যু হয় । জীবাত্মা যখন দেহ ত্যাগ করে তখন সর্ব প্রথমে ত্যাগ করেন 'অন্নময়' কোষ। অর্থাৎ স্থূল দেহের মৃত্যু ঘটে। । ইহলোকে আগমনের জন্য তাঁকে নতুন শরীর আবরণ বা পরিচ্ছদ ধারণ করতে হয়। তখন জীবাত্মা এ ইহলোকে আগমনের সময় একে একে 'আনন্দ ময়', 'বিজ্ঞান ময়', ' মনোময়', 'প্রাণ ময়' এবং সব শেষে 'অন্নময়' কোষে ধারণ করে। এই কোষ পাঁচকে বলা যেতে পারে আত্মার আবরণ। এদের কারণেই আমরা 'আত্ম' এর প্ৰকৃত স্বরূপ সম্পর্কে বিস্মৃত থাকি, সংসার চক্রে বারবার পরিভ্রমণ করি। এই আবরণের দরুণই আত্মা জীবাত্মা আর পরমাত্মায় ভেদ করি। জীব ও ব্রহ্মে ভেদ হয়। আবার এই পাঁচ আবরণেও ব্রহ্মের রূপই প্রকাশ পায়। ধোঁয়ার কুন্ডলী যেমন তাপ আগুনের উপস্থিতি জানান দেয় এও তেমনি। স্থূল থেকে সূক্ষ্মতর এই পাঁচ কোষ আসলে ক্রমোন্নতির স্তর। 'আত্ম' এর স্বরূপ দর্শনের পর্যায়ক্রম ধাপ। এই পথের শেষে 'আত্ম' আত্মন বা আত্মার দর্শন, জীবাত্মার মধ্যেই পরমাত্মার অধিষ্ঠান অনুভব, আপনার মধ্যেই পরম ব্রহ্মের অবস্থান। জল আর জলের বুদ্বুদ দুই তো একই। বুদ্বুদ হয়ে কিছুক্ষণ ভেসে থেকে আবার জলেই মিলিয়ে যাওয়া। ঋগ্বেদে খুব সুন্দর একটি শ্লোক আছে- 'ওঁ দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায় সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে। /
তয়োরন্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্তি-অনশ্নন্নন্যো অভি চাকশীতি'।।
অর্থাৎ, সুন্দর পক্ষবিশিষ্ট সম সম্বন্ধ যুক্ত দুটো পাখি, মিত্র রূপে একই বৃক্ষ আশ্রয় করে আছে। তাদের মধ্যে একটি বৃক্ষের ফলকে স্বাদের জন্য ভক্ষণ করে এবং অন্যটি ফল ভক্ষণ না করে শুধু প্রত্যক্ষ করে।
এর ভাবার্থ- বৃক্ষটি হল আমাদের শরীর। আর দুটো পাখির একটি পরমাত্মা অন্যটি জীব। জীব ও ব্রহ্ম উভয়েই অনাদি, সখা স্বরূপ। একই দেহে তাদের অবস্থান। জীব সংসারের পাপ পূণ্যের ফল ভোগ করে কিন্তু ব্রহ্ম ফল ভোগ না করে সাক্ষ্মী রূপে বর্তমান থাকে।
যোগ ক্রিয়া সাতটি কুন্ডলিনী চক্রের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতম কারণ শরীরে উন্নীত হওয়া যায়। যোগের উদ্দেশ্যও তাই। কারণ শরীরে উন্নীত হতে পারলেই অপার আনন্দ, শান্তি।

এই সূক্ষ্মদেহটি আমাদের জড়দেহটিরই হবহু অনুরূপ। এমনকি জীবদ্দশার সমস্ত অনুভূতি আবেগ স্মৃতি সুখ দুঃখ বেদনা প্রেম ক্রোধ কাম ঘৃণা রিপুর তাড়না সবই রয়েছে এই সূক্ষ্ম দেহে। অর্থাৎ জীবদ্দশায় কোনো প্রিয়জনকে যেমন জানতাম, প্রিয়জনের এই নতুন শরীরটি হবহু সেই প্রিয়জনেরই প্রতিলিপি বলা যেতে পারে। শুধু দেহটি আর তার স্থূল নয়। তাঁর অবস্থান্তর ঘটেছে। এ তাঁর ছায়া শরীর - ' character is not in the slightest degree changed by death ; the man's thoughts, emotions and desires are exactly the same as before.He is in every way the same man, minus his physical body...( Charles Webster Leadbeater, A Text book of theosophy) । আমাদের স্থূল দেহখানি অগ্নি দগ্ধ আঘাত দ্বারা ছিন্ন ভিন্ন হলেও সূক্ষ্ম দেহ অটুট থাকে। জীবদ্দশায় কোনো ব্যক্তির যদি অঙ্গহানি হয়, সে তার স্থূল দেহ মাত্রের। সূক্ষ্ম দেহ পূর্ণই থাকে। পরশুরাম (রাজশেখর বসু) তাঁর গল্পে (যদু ডাক্তারের পেশেন্ট) দুর্দান্ত বুঝিয়েছেন সূক্ষ্ম শরীরের ধর্ম-'...সূক্ষ্ম শরীর ভাগ হয়না, নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি। তার অ্যানাটমি অন্য রকম। কতকটা অ্যামিবার মতন, কিন্তু ঢের বেশী ইলাস্টিক। ধড় আর মুন্ডু তফাতে থাকলে সূক্ষ্মশরীর চিটে গুড়ের মতো বেড়ে গিয়ে দুটোতেই ভর করতে পারে...'।

প্রেত তত্ত্ব বা পরলোকবাদ বলে, ইহলোকে থাকতে যে সমস্ত ব্যক্তি পরলোকের অস্তিত্ব সম্পর্কে তেমন বিশ্বাস পোষণ করেন না, তাঁদের মৃত্যুর পর সূক্ষ্ম দেহ গঠিত হলেও তাঁরা বুঝতে পারে না তাঁদের মৃত্যু হয়েছে। শেষে সেই মৃত ব্যক্তির অন্য কোনো পরিচিত আত্মা তাঁকে পথ দেখিয়ে পরলোকে নিয়ে যান। এমন ঘটনা বাংলা সাহিত্যের ভূতের গল্পে প্রচুর পড়েছি আমরা। শরদিন্দু বাবুর 'রক্ত-খদ্যোত' এর শেষ অংশটুকু মনে পড়ে? অসুস্থ সুরেশ বাবু মৃত্যুর পর প্রথমে বুঝতেই পারেনি তিনি মারা গেছেন। শুধু তাঁর শরীর তখন ঝরঝরে লাগছে। যেন ঘুম থেকে উঠেছেন। তিনি যে আসলে সূক্ষ্মদেহ প্রাপ্ত হয়েছেন তা তিনি বুঝতেই পারেননি। শেষে সুরেশবাবুর আরেক পরলোকগত বন্ধু এসে তাঁকে বুঝিয়ে দেয়।

ইহজগতে আমরা যারা সাধারণ জীবন যাপন করি, যাদের জীবনে ত্যাগ ভোগ দুইই রয়েছে, গোঁড়া নাস্তিকও নই আবার পুরোপুরি আস্তিকও নই,আমাদের জীবাত্মা বেশিরভাগই মৃত্যুর পর প্রেতলোকে গমন করে। এই প্রেতলোক অনেকটা সংশোধনাগার। জীবাত্মা ইহলোকের ইন্দ্রিয় জনিত যত বাসনা, সেগুলো আস্তে আস্তে লোপ পেতে থাকে। জীবাত্মা তখন সূক্ষ্ম দেহের। তাই তার বাসনা থাকলেও চরিতার্থ করার উপায় নেই। কারণ স্থূল শরীরের সংযোগ ছাড়া সূক্ষ্ম শরীর ভোগ সম্পন্ন নয়। তাই ইহজগতের সমস্ত অতৃপ্ত কামনা বাসনা আস্তে আস্তে লোপ পেতে থাকে। এছাড়া কিছু উচ্চ শ্রেণীর জীবাত্মাও নাকি এ ব্যাপারে নবাগত জীবাত্মাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করে। যে সমস্ত জীবাত্মা ভোগ বাসনা ত্যাগে সফল হয় তাঁরা তখন আরও উচ্চলোকে গমন করে। সূক্ষ্ম দেহ আরও সূক্ষ্মতর হয়। শেষে এমন একসময় আসে যখন এই ইহজগতের আহ্বান, আকর্ষণ ক্রমে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসে। এভাবেই তাঁরা পরমাত্মার সাথে মিলিত হয়। একমাত্র মুক্তপুরুষ যাঁরা হন, অর্থাৎ ইহলোকেই যাঁরা ভোগবাসনা কাম মোহ ইত্যাদি পুরোপুরি বিসর্জন দিয়েছেন তাঁদের জীবাত্মাই সরাসরি উচ্চলোকে গমন করেন।

যেসকল জীবাত্মা ইহজগতের ভোগ কামনা, অতৃপ্ত বাসনা সহজে কাটাতে পারে না, সেই জীবাত্মা একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর নতুন শরীর ধারণ করে আবার এই ইহজগতে ফিরে আসে। আত্মার দেহান্তর হল। এই হল পুনর্জন্ম-অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর তাঁর আত্মার নতুন দেহ ধারণ হল পুনর্জন্ম। যতদিন না ব্রহ্মজ্ঞান সঞ্চয় করে মোক্ষ লাভ করে ততদিন জন্ম-মৃত্যু চক্রে বারবার আবির্ভাব হয়। কর্মের ফলভোগের জন্যই তাঁকে বার বার আবির্ভূত হতে হয়। প্রত্যেক জন্মে সে তাঁর নির্দিষ্ট পরম লক্ষ্যের দিকেই এগোয়। পরম ব্রহ্ম লাভের এই পথই হল-'দেবযান'।
এত সব আলোচনার পর একটা সন্দেহ মনে রয়ে যায়। এমন সন্দেহ একান্তই ব্যক্তিগত। উত্তরও খুঁজেছি নিজের মতো করেই, বইপত্র ঘেঁটে। আমাদের বেদ, উপনিষদ বা সেই সম্পর্কিত বিভিন্ন গ্রন্থ গুলি 'আত্মা' বলতে যা বোঝায়- তা ওই, সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম, অবয়বহীন, নিরাকার কিছু একটা। স্পষ্ট কোনো ধারণা তো নেই। অন্তত সাধারণ মানুষের কাছে সুস্পষ্ট নয় মোটেও। অথচ, প্রেতচক্রে আত্মাদের কত বিচিত্র কার্যই না দেখা যায়! কেউ এসে টেবিল নাড়াচ্ছে , মিডিয়ামকে দিয়ে কেউ ছবি আঁকাচ্ছে, লেখাচ্ছে, গান গাওয়াচ্ছে, কোনো চক্রে এসে আত্মা পেট পুজোও করে যাচ্ছে, কেউ আবার চুমুও খাচ্ছে। এই সব ঘটনা, আত্মা সম্পর্কে যে সনাতনী ধারণা তার বিরোধী নয় কি! তবে প্রেতচক্রে যা ধরা দেয় সেটা তবে কী? এই ব্যাপারটার উপরই কিছুটা আলোকপাত করেছেন, এদেশের বিখ্যাত স্পিরিচুয়ালিস্ট ভি.ডি.ঋষি। ওনার মতে-' ... In order to understand the description of the spirit-world as given by the spirits , it would be necessary to know the exact meaning of the term "spirit". It is not the Atma which is a vague and indescribable something, without any form or limbs. In spiritualistic terminology a spirit means an etheric-bodied individual having the same ideas and tendencies and retaing his individual characteristics. The etheric body is an exact double of the physical sheath with all its limbs and features". ঋষি মহাশয়ের বক্তব্য শুনে মনে হয়, প্রেতচক্রে আমরা সম্ভবত পরলোক গত ব্যক্তির সূক্ষ্ম শরীরের সাথেই যোগাযোগ করি। সনাতনী ধারনায় 'আত্মা' বলতে যেমন ইঙ্গিত দেওয়া হয়, তার সন্ধান সম্ভবত পাই না। চলতি কথাই একেই হয়ত আত্মা বলে থাকি। এটা আমার ব্যক্তিগত ধারণা। তবে প্রেতচক্রে যা উপস্থিত হয়, সেটা যে মৃত্যু পরবর্তী এক 'অস্তিত্ব' সেটা নিয়ে সন্দেহ থাকা চলে না। আত্মা স্পিরিটের এত জটিলতায় গিয়ে কাজ নেই। পরলোক চর্চা সম্পর্কিত বাংলা বই পত্র গুলো যখন সাধারণ ভাবে 'আত্মা' বলেই সম্বোধন করেছে, আমরাও সেই পথেই এগোবো। এর ভিতরে আরও কোনো গূঢ় তত্ত্ব রয়েছে কিনা জানা নেই। ভোগবাদের জীবনাশ্রয়ী, কিঞ্চিৎ চার্বাক পন্থী এই কলমপেষকের এ ব্যাপারে তেমন উৎসাহও নেই । আমি অধ্যাত্মিক গুরু নই। পাঠক পাঠিকাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনও এ রচনার উদ্দেশ্য নয়। বরং তাঁদের অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণের দায়িত্ব কলমপেষকের থাকে। তাই এত সব তত্ত্ব কথার যাঁতাকলে বাঙালীর পরলোক চর্চা নিয়ে যেসব বিচিত্র রোমাঞ্চকর রুদ্ধশ্বাস কাহিনী সমূহ আপনাদের শোনাব বলে স্থির করেছি, সেগুলোর পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হতে দিতে আমি পারিনা।
বাঙালীর পরলোক চর্চার এসব কাহিনীর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝে এক ধূসর জগতে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে বিচার করতে গেলে এসব ঘটনার অনেক গুলোই হয়ত ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হবে। কিন্তু এসব ঘটনার সাথে জড়িয়ে থাকা সময়কাল , ব্যক্তিবর্গ তাঁরা তো ঐতিহাসিক ভাবে সত্য।
আমরা সব ইহজগতের সামান্য জীব। এ বিপুল ব্রহ্মাণ্ডের কতটুকু বা জানি! ওপারের খবর তাঁরাই ভালো দিতে পারেন, যাঁরা গত হয়েছেন। তাঁরাই বলতে পারেন-' ও হরিনাথ-আছে, আছে, সব আছে, সব সত্যি-। তা বলে পাঠক কোনো কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেবেন এমনটা আমি চাই না। ভূতের গল্প পড়তে গেলে যেমন ভূত বিশ্বাসী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এও তেমনি। আশা করব, পাঠকেরা কাহিনী পাঠের আনন্দে এইসব কাহিনী গুলোও পড়বেন।
ইহলোকের সুধী, পাঠক ও পাঠিকা গণ- পরলোকে আপনাদের স্বাগতম।
'অসতো মা সদ্‌গময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যোর্মামৃতং গময়।
আবিরাবীর্ম এধি।
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং
তেন মাং পাহি নিত্যম্‌'।
(অসত্য হইতে আমাকে সত্যে লইয়া যাও, অন্ধকার হইতে আমাকে জ্যোতিতে লইয়া যাও, মৃত্যু হইতে আমাকে অমৃতে লইয়া যাও। হে স্বপ্রকাশ, আমার নিকটে প্রকাশিত হও। রুদ্র, তোমার যে প্রসন্ন মুখ, তাহার দ্বারা আমাকে সর্বদাই রক্ষা করো- অনুবাদঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
ছবিতে থাকতে পারে: আউটডোর

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন