পুনঃলিখন -#জলি সাহা(ঠাকুর)
পুণ্যভূমি ভারতে রয়েছে ভগবান শিবের অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত মন্দিরের নাম ও শিবলিঙ্গের মাহাত্ম্য। তেমনি একটি শিবধামের লিঙ্গরূপী দেবতার অত্যাশ্চর্য কাহিনী জানাব।যা সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একটিই মাত্র রয়েছেন।এই শিবলিঙ্গ রয়েছে হিমাচলপ্রদেশের কুলু উপত্যকায়। এই শিবধামের অত্যাশ্চর্য ব্যাপারটি এই যে, যেখানে মন্দিরটি আছে সেখানে শিবলিঙ্গের শিরে আকাশ থেকে বাজ পড়ে চূর্ণ -বিচূর্ণ হন লিঙ্গরূপী পাথরের দেবতা।আরও অবাক করা ব্যপার হল প্রতি বারো বছর পর এই অত্যাশ্চর্য ঘটনা পুনরায় ঘটে।এখানেই শেষ নয়,কয়েকদিনের মধ্যে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া পাথরের শিবলিঙ্গ এক অবিশ্বাস্য পক্রিয়ায় জুড়ে যায় এবং স্বরূপে ফিরেও আসেন।তখন সেই লিঙ্গ দেখে এতটুকুও বোঝার উপায় থাকে না যে এটি চূর্ণ হয়েছিল কি না। এই অদ্ভুত অলৌকিক ঘটনা অতীতের কোন যুগে প্রথম কবে থেকে হয়েছিল কেউ জানেন না।
এই বিজলেশ্বর মহাদেব মন্দিরের চূড়ায় রয়েছে ২০মিটার উঁচু ত্রিশূল দণ্ড।মন্দিরের পাদদেশ থেকে শীর্ষদেশ ছড়িয়ে এই ত্রিশূলের বিস্তার।আকাশ থেকে বিদ্যুৎ হানা দিয়ে এই ত্রিশূলদণ্ড ধরে মন্দিরের গর্ভগৃহে শিবিলিঙ্গের মাথায় নেমে আসে।তাতেই চূর্ণ -বিচূর্ণ হন লিঙ্গরূপী বিগ্রহ। বলা হয়,এরপর বিজলেশ্বর মহাদেবের নির্দেশে মন্দিরের পূজারি বিশেষ এক পক্রিয়ায় শিবলিঙ্গের পুরাতন রূপ ফিরিয়ে আনেন।একে বিজলেশ্বরের পুনর্জন্ম পক্রিয়া সাধন বলা হয়।আদিকাল থেকেই এই মন্দিরের পূজারিদের উপর দেবতা কর্তৃক তার পুনর্জন্ম পক্রিয়া সাধনের নির্দেশ দেওয়া আছে।এখানকার পুজারি বাজ পড়ে খণ্ডিত শিবলিঙ্গের পাথরের টুকরোগুলোকে কুড়িয়ে মূল শিবলিঙ্গ স্তম্ভে সযত্নে ছাতু ও মাখনের প্রলেপ দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দেন।এর কয়েকমাসের মধ্যেই শিবিলিঙ্গ পূর্বের রূপে ফিরে আসেন।
*এই শিবলিঙ্গের মাথায় কেন বাজ পড়ে এবং জায়গার নাম কুলু কীভাবে হল তার পিছনে একটা পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে.......
অনেক আগে এখানে কুলাত নামে এক রাক্ষসের বাস ছিল।তার মৃত্যু সময়ে মতিভ্রম ঘটেছিল।রাক্ষস দূরভিসন্ধি নিয়ে বিরাট এক অজগরের রূপ ধরে কুণ্ডলী পাকিয়ে এখানকার ব্যাস নদীর মুখে পড়ে রইল।এতে নদীপ্রবাহ আটকে যায়।নদীপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জায়গাটি বন্যা হয়ে ডুবে যায়। রাক্ষসতো এটাই চেয়েছিল।তার উদ্দেশ্যে ছিল বন্যায় এখানকার সব জীবজন্তুকে ডুবিয়ে মারার।এটা রাক্ষসের কাছে ছিল একপ্রকার খেলা সে এই প্রাণীকুলকে ডুবিয়ে মেরে মজা পেতে চেয়েছিল।নদীপ্রবাহ আটকানো ছিল তার কাছে ছিল খেলা তার মজার ছলে করায় খেলায় ব্যাস নদীর জলে ডুবে যাওয়া উপত্যকা জুড়ে শুরু হল ত্রাহি ত্রাহি রব। প্রাণীকূল আর্তরব শুরু করে দিল।সেই আর্তরব ভগবান শিবের আকুলকে বিগলিত করল।শিব তখন ধ্যানে ছিলেন। ধ্যান ভেঙে সব বুঝতে তাঁর দেরি হলনা।কুলাত রাক্ষসের এ হেন আচরণে ভগবান শিব যারপরনাই অপ্রসন্ন ও ক্ষুদ্ধ হলেন।ক্ষুদ্ধ্ মহেশ্বর নিজের মনেই বললেন,কুলাতের দিন শেষ হয়ে গিয়েছে।বেঁচে থাকার অধিকার সে হারিয়েছে। সেই সঙ্গে প্রাণীকুলকে আগে রক্ষা করা দরকার।কিন্তু রাক্ষসের সঙ্গে সরাসরি লড়াই করতে গিয়ে যদি প্রাণীকুল আরও বিপদে পড়ে যায়।প্রাণীদের হিত চেয়েই শিব একপ্রকার বাধ্য হয়েই স্বভাব বিরুদ্ধ পথে সমস্যা সমাধানের রাস্তা খুঁজলেন।ভক্তের ভগবান সরাসরি কুলাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে না নেমে মিথ্যে ছলনার আশ্রয় নিলেন।
প্রথমে অনেক যত্নের দ্বারা শিব নিজেকে সেই অজগররূপি রাক্ষসের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুললেন।পরে শিব অজগরের কানের কাছে মুখ নামিয়ে আস্তে আস্তে করে বললেন, তোমার লেজে আগুন লেগে গ্যাছে গো অজগর! শিবের কথা বিশ্বাস করে বোধবুদ্ধি সব হারিয়ে কুলাত পিছন ফিরে নিজের লেজের দিকে তাকাতে গেল।যখনই কুলাত পিছন ফিরে তাকাতে গেল, তখনই সময় নষ্ট না করে শিব কুলাতের মাথায় ত্রিশূল ভেদ করে দিলেন।ত্রিশূলের আঘাতে অজগররূপী কুলাত ওখানেই দেহ রাখল। কুলাত দেহ রাখার সঙ্গে সঙ্গেই তার অজগররূপী বিশাল শরীর এক বিশাল পর্বতে বদলে গেল।কুলাতের শরীর যতটা শরীর যতটা স্থান নিয়ে পড়েছিল পুরো ক্ষেত্রটাই পর্বতের রূপ পেয়ে গেল।এখানকার অধিবাসীদের বিশ্বাস পুরো কুলু উপত্যকায় রাক্ষস কুলাতের শরীর দিয়ে তৈরী। এই উপত্যকা এক বিশাল সাপের রূপ।এই রাক্ষস কুলাতের নাম থেকেই কুলুন্ত,পরে কুলুত এবং আরও পরে কুলু নাম হয়েছে।
কুলাত নিহত হলে ব্যাস নদী পুনরায় তার স্বাবাভিকতা ফিরে পায়।প্রাণীকুলও মরতে মরতে জীবন ফিরে পায়।
কুলাত রাক্ষসকে ছলনার দ্বারা নিধন করার পর শিবের নিজের ওপর খুব গ্লানি হল।নিজের মাথাতেই বাড়ি মারতে ইচ্ছে করল।গ্লানিমুক্ত হবার জন্য শিব ইন্দ্রকে অনুরোধ করলেন।শিব ইন্দ্রকে নির্দেশ দিলেন দেবরাজ যেন, প্রতি বার বছর অন্তর এই জাইগায় তাঁর শিবলিঙ্গ রূপী বিগ্রহের মাথায় বিদ্যুৎ হানেন।তখন থেকেই প্রতি বার বছর অন্তর এখানে শিবলিঙ্গের শিরে আকাশ থেকে বিদ্যুৎ এসে পড়ে।এই বিদ্যুতের আঘাতে শিবলিঙ্গ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।
কুলু উপত্যকাবাসীরা আকাশ থেকে বিদ্যুৎ শিবলিঙ্গে পড়ার কারণ হিসেবে বলে থাকেন যে,ভগবান শিব চান না বিদ্যুৎ এখানকার জনবসতি, জীবজন্তু, গাছপালা ও ঘর-বাড়ির ক্ষতি হোক।ভগবান ভোলানাথ এই ক্ষতি থেকে সবকিছু বাঁচানোর জন্যই বিদ্যুৎ নিজের মাথায় টেনে নেন।এই কারণই এখানের শিবলিঙ্গরূপী বিগ্রহকে বিজলি মহাদেব বা বিজলেশ্বর মহাদেব আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে।
রামায়ণ -মহাভারতের কালেও কুলুকে কুলন্ত পীঠ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।কাশ্মীর যেমন ভারতের 'ভূ-স্বর্গ' নামে পরিচিত,প্রাচীনকালে কুলুকেও 'দেবভূমি' বলা হত।কারণ ইংরেজদের সময়কাল থেকে লোকে কুলুকে 'ভ্যালি অফ গডস' নামে ডাকেন।এখানকার সহয-সরল সমাজ জীবনে অভ্যস্ত মানুষেরা দৃড়ভাবে বিশ্বাস করেন যে অতীতকালে দেবতাদের নিত্য আনাগোনা ছিল এই কুলন্ত পীঠে। এই দেবভূমিতেই বাস করেছেন বেদব্যাস, বশিষ্ঠ, গৌতম,জমদগ্নি,পরাশর,ভৃগু,মনু,ঘোষা ছাড়াও নানা মুনি-ঋষিরা।এখানকার মানুষজন অনেকে আজও মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন তারা কেউ কেউ সেইসব দেবতা-মুনি-ঋষিদের উত্তরপুরুষ।
কুলু শহরের মূল বাসস্ট্যান্ড থেকে আট কিলোমিটার পায়ে হাঁটা পথে দুরারোহ পাহাড়ে চড়ে ২৪৬০ মিটার উচ্চে বিজলেশ্বর মহাদেবের অবস্থান।নিকটেই ব্যাস ও পার্বতী নদীর সঙ্গম।কুলুবাসীদের এটি প্রিয় দেবতা।(জল)
*শ্রী বশিষ্ঠর সঙ্কলন থেকে
ওঁ নমোঃ শিবায়
শেয়ার করেছেন : - প্রণব কুমার কুণ্ডূ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন