স্বামী বিবেকানন্দের জ্ঞানযোগ থেকে
অমৃতকথা
শক্তি
শরীরের ভিতর এই যে শক্তির বিকাশ দেখা যাইতেছে, ইহা কি? আমরা সকলেই ইহা সহজে বুঝিতে পারি, ঐ শক্তি যাহা হউক, উহা জড়-পরমাণুগুলি লইয়া তাহা হইতে আকৃতি-বিশেষ—মনুষ্য-দেহ গঠন করিতেছে। অন্য কেহ আসিয়া তোমার আমার জন্য শরীর গঠন করে না। কখনও দেখি নাই—অপরে আমার হইয়া খাইতেছে। আমাকেই ঐ খাদ্যের সার শরীরে গ্রহণ করিয়া তাহা হইতে রক্ত মাংস অস্থি প্রভৃতি—সব কিছুই গঠন করিতে হয়। কি এই রহস্যময় শক্তিটি? ভূত-ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কোনরূপ সিদ্ধান্ত মানুষের পক্ষে ভয়াবহ বোধ হয়; অনেকের পক্ষে উহা কেবল আনুমানিক ব্যাপারমাত্র বলিয়া প্রতীত হয়। সুতরাং বর্তমানে কি হয়, সেইটিই আমরা বুঝিতে চেষ্টা করিব।
সে শক্তিটি কি, যাহা এইক্ষণে আমার মধ্য দিয়া কার্য করিতেছে? আমরা দেখিয়াছি, সকল প্রাচীন শাস্ত্রেই এই শক্তিকে লোকে এই শরীরের মতো শরীরসম্পন্ন একটি জ্যোতির্ময় পদার্থ বলিয়া মনে করিত, তাহারা বিশ্বাস করিত—এই শরীর গেলেও উহা থাকিবে। ক্রমশঃ আমরা দেখিতে পাই, ঐ শক্তি জ্যোতির্ময় দেহমাত্র বলিয়া তৃপ্তি হইতেছে না, আর একটি উচ্চতর ভাব লোকের মন অধিকার করিতেছে—তাহা এই যে, ঐ জ্যোতির্ময় শরীর শক্তির প্রতিরূপ হইতে পারে না। যাহারই আকৃতি আছে, তাহাই কতকগুলি পরমাণুর সংযোগমাত্র, সুতরাং উহাকে পরিচালিত করিতে অন্য কিছুর প্রয়োজন। যদি এই শরীরের গঠন ও পরিচালন করিতে এই শরীরাতিরিক্ত কিছুর প্রয়োজন হয়, তবে সেই কারণেই জ্যোতির্ময় দেহের গঠন ও পরিচালনে ঐ দেহের অতিরিক্ত অন্য কিছুর প্রয়োজন হইবে। এই ‘অন্য কিছুই’ আত্মা-শব্দ দ্বারা অভিহিত হইল। আত্মাই ঐ জ্যোতির্ময় দেহের মধ্য দিয়া যেন স্থূল শরীরের উপর কার্য করিতেছেন। ঐ জ্যোতির্ময় দেহই মনের আধার বলিয়া বিবেচিত হয়, আর আত্মা উহার অতীত। আত্মা মন নহেন, তিনি মনের উপর কার্য করেন এবং মনের মধ্য দিয়া শরীরের উপর কার্য করে। তোমার একটি আত্মা আছে, আমার একটি আত্মা আছে, প্রত্যেকেরই পৃথক পৃথক এক একটি আত্মা আছে এবং এক একটি সূক্ষ্ম শরীরও আছে; ঐ সূক্ষ্ম শরীরের সাহায্যে আমরা স্থূল দেহের উপর কার্য করিয়া থাকি। এখন এই আত্মা ও উহার স্বরূপ সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠিতে লাগিল। শরীর ও মন হইতে পৃথক এই আত্মার স্বরূপ কি? অনেক বাদ-প্রতিবাদ হইতে লাগিল, নানাবিধ সিদ্ধান্ত ও অনুমান হইতে লাগিল, নানাপ্রকার দার্শনিক অনুসন্ধান চলিতে লাগিল—এই আত্মা সম্বন্ধে তাঁহারা যে-সকল সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিলেন, সেগুলি আপনাদের নিকট বর্ণনা করিতে চেষ্টা করিব। ভিন্ন ভিন্ন দর্শন এই একটি বিষয়ে একমত দেখা যায় যে, আত্মার স্বরূপ যাহাই হউক, উহার কোন আকৃতি নাই, আর যাহার আকৃতি নাই, তাহা অবশ্যই সর্বব্যাপী হইবে। কাল মনের অন্তর্গত, দেশও মনের অন্তর্গত। কাল ব্যতীত কার্যকারণ-ভাব থাকিতে পারে না। ক্রমানুবর্তিতার ভাব ব্যতীত কার্যকারণ-ভাবও থাকিতে পারে না। অতএব দেশ-কাল-নিমিত্ত মনের অন্তর্গত, আর এই আত্মা মনের অতীত ও নিরাকার বলিয়া উহাও অবশ্য দেশ-কাল-নিমিত্তের অতীত। আর যদি উহা দেশ-কাল-নিমিত্তের অতীত হয়, তাহা হইলে উহা অবশ্য অনন্ত হইবে। এইবার হিন্দুদর্শনের চূড়ান্ত বিচার আসিল। ‘অনন্ত’ কখনও দুইটি হইতে পারে না। যদি আত্মা অনন্ত হয়, তবে একটি মাত্র আত্মাই থাকিতে পারে, আর এই যে অনেক আত্মা বলিয়া বিভিন্ন ধারণা রহিয়াছে— তোমার এক আত্মা, আমার আর এক আত্মা—ইহা সত্য নহে।
স্বামী বিবেকানন্দের ‘জ্ঞানযোগ’ থেকে
স্বামী বিবেকানন্দ
( বর্তমান থেকে সংগৃহীত )
শেয়ার করেছেন : - প্রণব কুমার কুণ্ডু
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন