শুক্রবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০

আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় তে শামিম আহমেদ শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে লিখেছেন

 আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় তে শামিম আহমেদ শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে লিখেছেন

 

 
সবার সাথে একসাথে শেয়ার করা হয়েছে
সবাই
Arkajit Dasgupta
 
আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় তে শামিম আহমেদ শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে লিখেছেন। খুব অবাক হলাম লেখাটা পড়ে। যদি আমি শামিম সাহেবের নামের সঙ্গে সুপরিচিত না হতাম তো হয়তো বলে বসতাম যে জন্মাষ্টমীর প্রাক্কালে শ্রীকৃষ্ণকে বদনাম করার কু-উদ্দেশ্যে এটা লেখা, কিন্তু শামিম সাহেবের জ্ঞান নিয়ে আমার সন্দেহ নেই। সেই কারণেই আরো অবাক হচ্ছি এত ভুলে এবং বিকৃত তথ্যে ভরা একটা লেখা উনি পরিবেশন করলেন। আর সেটা পত্রিকায় স্থানও পেয়ে গেল।
যাই হোক, শামীম সাহেব অনেক বড় পণ্ডিত। আমার মত সীমিত সাধারণ পাঠকের চোখে যে ভুল গুলো পড়ল সেগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
 
১। প্রথম ভুল। জরাসন্ধ। কংসের জামাই নয়, শ্বশুর। অস্তি আর প্রাপ্তি, জরাসন্ধের বৌ নয়, মেয়ে। কংসের বৌ।
 
২। দ্বিতীয় ভুল, একনায়ক হতে গিয়ে প্রতিবাদীদের ছল করে হত্যা করা। কৃষ্ণ কোনকালেই একনায়ক হবার চেষ্টা করেননি। যাদব বংশে একনায়কতা বলে কিছু হত না। যাদবরা রাজাদের মধ্যে democracy follow করত। কংসের বাবা উগ্রসেন তাদের প্রধান নেতা ছিলেন কিন্তু decision হত আলোচনার ভিত্তিতে। সেখানে অনেক রাজা/ অধিপতি থাকতেন। যেমন বৃষ্ণিরাজ সুরসেন, রাজকুমার বসুদেব, রাজা কুন্তীভোজ। কংস উগ্রসেন কে বন্দী করে সেখানে একনায়কতন্ত্র চালু করেন। তাই কংস কে হত্যা করা জরুরী ছিল,  যদুবংশের সব রাজা কে স্বাধীন করার জন্য। আর কংসের এত সামর্থ্য ছিল না যে তিনি উগ্রসেন কে বন্দী করবেন। সেই সৈন্যবল জুগিয়েছিলেন স্বয়ং জরাসন্ধ। এখানে উল্লেখ্য কংস উগ্রসেনের আপন সন্তান ছিলেন না। উগ্রসেনের অপরূপা সুন্দরী স্ত্রীকে দেখে মোহিত হয়ে এক দৈত্য উগ্রসেনের বেশে তাঁকে ছলনা করে। তার ফল কংসের জন্ম। সত্যি জানতে পেরে উগ্রসেন-পত্নী দৈত্যকে অভিশাপ দেন যে কোন যাদব কূলজাতের হাতেই তার সন্তানের মৃত্যু হবে। কৃষ্ণ কেবল সেই অভিশাপের মর্যাদা রক্ষাকারী।
 
৩। তৃতীয় ভুল। "উপবাসক্লিষ্ট" জরাসন্ধকে গুপ্ত উপায়ে হত্যা করলেন, তাও গুপ্তপথে যজ্ঞগৃহে প্রবেশ করে। ভুল নয়। সর্বৈব মিথ্যা। পড়ে মনে হল লেখক মধুসূদনের মেঘনাদবধকাব্য আর মহাভারত গুলিয়ে ফেলেছেন। জরাসন্ধ কে সরাসরি সর্বসমক্ষে মল্লযুদ্ধে আহবান করা হয়েছিল। কারণ জরাসন্ধ বরপ্রদত্ত ছিলেন যে কোন অস্ত্রে তাঁকে মারা যাবে না। এবং জরাসন্ধ কোন যে সে মল্লযোদ্ধা ছিলেন না। গোটা ভুভারতে তাঁকে মল্লযুদ্ধে হারাতে পারে এরম একজনই ছিল, সেটা ভীম। এবং ভীম কে বিপক্ষ হিসেবে স্বয়ং জরাসন্ধই বেছেছিলেন। কৃষ্ণ choice দিয়েছিলেন- তিনি নিজে, ভীম বা অর্জুনের মধ্যে যে কেউ। কিন্তু জরাসন্ধ কৃষ্ণ বা অর্জুনের মত "দুর্বল" দের সঙ্গে লড়া টা নিজের অপমান মনে করেছিলেন। আর জরাসন্ধ জানতেন যে তিনি মধ্যম পাণ্ডবের সঙ্গে লড়ছেন। কারণ যুদ্ধের আগেই তাঁকে তিন যোদ্ধা নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন। যাই হোক, যুদ্ধের সময় জরাসন্ধ মোটেই উপবাসক্লিষ্ট ছিলেন না।
জরাসন্ধ-ভীমের মল্লযুদ্ধ হয়েছিল অনেক দিন ধরে। কোথাও বলা ২৭ দিন, কোথাও বলা ১৪ দিন। প্রথমদিকে কেউ কাউকে হারাতে পারে নি। শেষ দিকে জরাসন্ধ ক্লান্ত হয়ে পড়েন। উপবাসের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই।
 
৪। চতুর্থ ভুল। আচ্ছা এবার হল জরাসন্ধ প্রজাহিতৈষী আর সমৃদ্ধশালী। তা ছিলেন। প্রচুর দান করতেন গরীবদের। তবে রাজাহিতৈষী মোটেই ছিলেন না। ৯৫ জন রাজাকে বন্দী করেছিলেন। আর পাঁচজন কে বন্দী করে মা চন্ডীর কাছে শত রাজার বলি দিয়ে অমরত্ব পাওয়ার চক্করে ছিলেন। সেটার মধ্যে একটা নাম হতে পারত যুধিষ্ঠিরের। কারণ জরাসন্ধ ইন্দ্রপ্রস্থ আক্রমণ করলে পাণ্ডবরা নিশ্চিত হারত সৈন্যবলে। সেটা আটকাতে হলে এবং ওই ৯৫ রাজা কে বাঁচাতে হলে জরাসন্ধকে মার্কেট থেকে সরাতেই হত। এতে অন্যায় কিছু দেখি না।
 
৫। পঞ্চম ভুল। শিশুপাল। পাতি ছিঁচকাঁদুনে পণ করছিলেন রুক্মিণী হাতছাড়া হওয়ায়। কৃষ্ণ রাজা না হলেও দ্বারকার junior crowned prince. স্বয়ং জরাসন্ধ, যাকে সম্মুখ সমরে হারানোর ক্ষমতা কুরু-পাণ্ডব রাষ্ট্রেরও ছিল না, তাঁকে ১৭ বার সম্মুখ সমরে জিততে দেন নি। অশ্বত্থামার ই মত সর্বশাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর নিজের হাতে প্রশিক্ষিত নারায়ণী সেনা অপরাজেয় এবং গোটা ভারতের সবচেয়ে ভয়ংকর সেনা ছিল। এবং কৃষ্ণ নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে সেই নারায়ণী সেনার চেয়েও ভয়ংকর ছিলেন। অনেকে (যারা মহাভারত টা মন দিয়ে পড়েন না) তাঁরা মনে করেন সে যুগের শ্রেষ্ঠ গদাযোদ্ধা ভীম বা দুর্যোধন। একেবারেই নয়। সে কালের শ্রেষ্ঠ গদাযোদ্ধা ছিলেন বলরাম আর কৃষ্ণ। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে বলরাম গদার চেয়ে হাল ঘোরানো বেশী পছন্দ করতেন বলে শিরোপা টা কৃষ্ণকে দেওয়াই যায়। ওনার কৌমুদীর সামনে কেউ কোনদিন টিকেছে বলে শোনা যায় না। কৌমুদীর কপাল খারাপ, তাই সুদর্শনের সহনায়ক হিসেবেই থেকে যেতে হল। এছাড়া পাণ্ডব হিতৈষী হিসেবে শ্রীকৃষ্ণের চেয়ে বড় কে ছিল? তাই পুরুষোত্তম হিসেবে ওনার পুজো হয়েছিল। আর শিশুপালের সাহস হত না ওনাকে গালমন্দ করার যদি না কৃষ্ণ শিশুপালের মা কে শত অপরাধ ক্ষমা করার বর দিয়ে ফেলতেন। এবার তিনি যে এতটাই চালু যে সেই গালাগালি গুলোকে এক দুই করে ১০০ গুনবেন সে আর কে বুঝবে।
 
৬। ষষ্ঠ ভুল। জরাসন্ধের অনুগত হংস আর ডিম্বককে কৃষ্ণ হত্যা করেন নি। ১৭ বার মথুরা আক্রমণ করতে এসে বলরামের হাতে উত্তম মধ্যম খেয়ে হংসের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছিল। সেই শোকে তার ভাই ডিম্বক নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
 
৭। সপ্তম ভুল। ছলনার আশ্রয়ে দুর্যোধনের হত্যা। প্রথম ছলটা কে করেছিল? গান্ধারী যদি ছলনা না করতেন, ঠিকঠাক নিয়মে গদাযুদ্ধ হত,  দুর্যোধনের ক্ষমতা ছিল ভীমের সামনে দাঁড়াবার? ভীম অনেক পরের কথা, আমাদের যে মহাভারত সিরিয়াল দেখানো হয় তাতে অর্জুনের ওপর ফোকাস করতে গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে ভাঁড় হিসেবে দেখানো হয়। ভদ্রলোক আদতে (মানে লিখিত মহাভারতে) আদৌ তা ছিলেন না। "যুধিষ্ঠির" নাম টা তাঁর মুখ দেখে হয় নি। তিনি প্রকৃতই যুদ্ধে স্থির ছিলেন। কথিত আছে যুধিষ্ঠিরের হস্তনিক্ষিপ্ত বর্শা পর্বত ভেদ করার ক্ষমতা রাখত। আর তিনি একবার সেই বর্শা হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়ালে তাঁকে একচুল নড়ানোর ক্ষমতা খুব কম যোদ্ধারই ছিল। গুরুগৃহ থেকে ফেরার পর যখন কুরু-পাণ্ডবের শক্তি পরীক্ষা হয়েছিল, তখন দুর্যোধন যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন কাউকেই সরাসরি পরাজিত করতে পারেন নি। আর গান্ধারী এসব জানতেন বলেই দুর্যোধনের শরীরের উর্ধবাংশ অভেদ্য করে ছেলের প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছিলেন। আর তা ছাড়া কুরুক্ষেত্রে ছলনা তো অনেক আগেই হয়েছে। রাজকুমারী শিখণ্ডিনী কে যুদ্ধক্ষেত্রে ঢুকতে দেওয়া হয় নি। যুদ্ধের নিয়ম ভেঙে রাত্রে যুদ্ধঘোষণা করেছিল কৌরবরা। অভিমন্যু কে খুন করা হয়েছিল ছল করে। পাণ্ডব পক্ষ তো অনেক পরে ছলনার পথে গিয়েছিল।
 
আপাততঃ এখানেই শেষ করলাম, আর কত লিখবো? কোন সহৃদয় ব্যাক্তি একটু শামিম সাহেব কে বলবেন মহাভারতটা আরেক বার তাক থেকে নামিয়ে পড়তে। আর আমাদের প্রতিটা অনুষ্ঠানের দিনই এভাবে পরিকল্পিত ভাবে শ্রীকৃষ্ণের কুৎসা না করলেই নয়? কাউকে তো মাথার দিব্যি দেওয়া হয় নি যে তাকে কৃষ্ণকে মানতে হবে। কিন্তু প্রতিবার বিভিন্ন রূপে একই নোংরামিটা খুব জরুরী কি? আমাদের একটু শান্তিতে থাকতে দেওয়া যায় না?


 
 
 
 
 
 
প্রণব কুমার কুণ্ডু

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন