২০ই সেপ্টেম্বর - পশ্চিমবঙ্গ মাতৃভাষা দিবস উদযাপনঃ
শুধুমাত্র ভাষার পরিপ্রেক্ষিতে একটি জাতি গড়ে উঠতে পারে কি? হয়তো না। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ভাষা এবং ভূখণ্ডের সামগ্রিক মেলবন্ধনের পরিপ্রেক্ষিতে একটি জাতি গঠিত হয় যেখানে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিসর ব্যাপক। প্রায় হাজার খ্রিস্টাব্দের পূর্বে সৃষ্টি হওয়া প্রাচীন বাংলা লিপি, কালের নিয়মে অনেক রদবদলের মধ্য দিয়ে এসেছে। সৃষ্টি হয়েছে নিজস্ব বর্ণমালা। সনাতনী ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে জন্ম ও বিকশিত হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই বাংলা ভাষায় হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য লক্ষণীয়। এই একই কারণে শুষ্ক মরু-সংস্কৃতিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা ইসলাম, বাংলা ভাষায় ততটা ঢুকতে পারেনি। বাংলা ভাষার প্রকৃত উৎস সংস্কৃত ভাষা হওয়ার কারণে সেখানে তৎসম শব্দের প্রভাব অত্যন্ত বেশি। যদিও কালের নিয়মে তদ্ভব এবং অসংখ্য বিদেশি শব্দের প্রবেশ ঘটেছে। কিন্তু সেগুলি সাবলীলভাবেই বাংলা ভাষায় আত্তীকৃত হয়েছে; কখনোই তা বলপূর্বক হয়নি। দুর্ভাগ্য যে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের অসহনীয় ভাষা জিহাদের সম্মুখীন হতে বাধ্য করা হচ্ছে শুধুমাত্র নির্লজ্জ সস্তা রাজনীতির কারণে। নিজ ঋদ্ধ ঐতিহ্যমন্ডিত শব্দগুলিকে বলপূর্বক পরিবর্তিত করে সেখানে বিজাতীয় শব্দ প্রবেশ করানো হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষের জীবনের বিনিময়ে আরব সাম্রাজ্যবাদের করাল গ্রাস থেকে ছিনিয়ে এনে বাঙালি হিন্দুদের স্বাধীন ভাবে শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়স্থল এই পশ্চিমবঙ্গে, সরকারি মদতে শুরু হয়েছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও ভাষা জিহাদ। সস্তা রাজনৈতিক স্বার্থ ও নির্লজ্জ ভোট তৃষ্ণা মেটানোর তাগিদে নিজেদের হিন্দু শিকড় কে অস্বীকার করে এক পৃথক আইডেন্টিটি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ক্রমাগত বলপূর্বক বিজাতীয় আরবি-ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে বাংলা ভাষাকে হিন্দুত্ব বর্জিত করে তার ইসলামীকরণের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কবিগুরুর ভাষায় বলতে হয়, "আজকের বাংলা ভাষা যদি বাঙালি মুসলমানদের ভাব সুস্পষ্টভাবে ও সহজ ভাবে প্রকাশ করতে অক্ষম হয়, তবে তারা বাংলা পরিত্যাগ করে উর্দু গ্রহণ করতে পারেন। সেটা বাঙালি জাতির পক্ষে যতই দুঃখকর হোক না, বাংলা ভাষার মূল স্বরূপকে দুর্ব্যবহারের দ্বারা নিপীড়িত করলে সেটা আরো বেশি শোচনীয় হবে। বাংলা ভাষায় সহজেই হাজার হাজার আরবি শব্দ চলে গেছে। তার মধ্যে আড়াআড়ি বা কৃত্রিম জেদের লক্ষণ নেই। কিন্তু যে সব ফারসি আরবি শব্দ সাধারণ্যে অপ্রচলিত অথবা হয়তো কোন এক শ্রেণীর মধ্যে বদ্ধ তাকে বাংলা ভাষার মধ্যে প্রক্ষেপ করাকে জবরদস্তি বলতেই হবে। হত্যা অর্থে খুন ব্যবহার করলে বেখাপ হয়না; বাংলার সর্বজনের ভাষায় সেটা বেমালুম চলে গেছে। কিন্তু রক্ত অর্থে খুন চলে নি, তা নিয়ে তর্ক করা নিষ্ফল।" আজকের বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে এই ভাষা জিহাদের অশুভ প্রচেষ্টা উৎকট ভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে। বাংলায় আরব সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের রাজনৈতিক মদতদাতারা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতি তত্ত্ব কে সামনে রেখে এবং মুখে জয়বাংলা স্লোগান তুলে সুকৌশলে বৃহৎ বাংলাদেশ গড়ার ষড়যন্ত্রকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মৌলানা ভাসানীর সেই কুখ্যাত উক্তিটি স্মরণীয়..... 'আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার, ত্রিপুরাও আমার। এগুলো ভারতের কবল থেকে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মানচিত্র পূর্ণতা পাবে না।'
এই আক্ষেপ থেকে সৃষ্টি হওয়া ষড়যন্ত্রের অঙ্গরূপে আমরা দেখতে পাই বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে স্কুল পাঠ্য থেকে আকাশী শব্দটি মুছে দেওয়া হয়েছে পরিবর্তে এসেছে আসমানী। রামধনুর পরিবর্তে এসেছে রংধনু। কিন্তু এই তোষণ মুলক রাজনীতির কারণে সাধারণ বাঙালিকে কেন ঐতিহ্যচ্যূত হতে হবে? কেনই বা বলপূর্বক বাংলার পরিবর্তে উর্দু শিখতে হবে?
উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুর মহকুমার দাড়িভিট গ্রামের হাইস্কুলে বাংলা ভাষা ও বিজ্ঞানের শিক্ষক নিয়োগের দাবি ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের। অদ্ভুতভাবে স্কুল শিক্ষা দপ্তর পাঠালো উর্দু ও সংস্কৃতের শিক্ষক। অবাঞ্ছিতভাবে উর্দু শিক্ষকের নিয়োগ কে একটু সহনশীল করার খাতিরে হয়তো সুচতুরভাবে সংস্কৃত শিক্ষক নিয়োগের প্রচেষ্টা, অথচ স্কুলটিতে অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীই বাঙালি হিন্দু, একই সাথে ১০ শতাংশেরও কম মুসলিম পড়ুয়া এবং তাদেরও সবাই বাংলাভাষী। স্কুলটিতে উর্দুভাষী ছাত্র একজনও ছিলনা। স্বভাবতই এই অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অযাচিতভাবে চাপিয়ে দেওয়া উর্দু-শিক্ষা ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকরা মেনে নিতে পারেননি। শুরু হয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন। বাংলা ভাষাকে অবদমিত করে বিজাতীয় উর্দু ভাষাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার অপচেষ্টাকারী আরব সাম্রাজ্যবাদের দালাল রা তাদের মিনি পাকিস্তান তৈরির প্রাথমিক ষড়যন্ত্রে গণতান্ত্রিকভাবে বাধা পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।
চক্রান্তকারীরা প্রমাদ গুনলো, তার ফলস্বরূপ ২০১৮’র ২০ই সেপ্টেম্বর প্রায় বিনা প্ররোচনায় পুলিশ গুলি চালালো। বাংলা ভাষার শিক্ষক চেয়ে এই পশ্চিমবাংলায় প্রাণ হারালেন রাজেশ সরকার ও তাপস বর্মন। পশ্চিমবঙ্গবাসী অবাক বিস্ময়ে দেখল, একটি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ও গ্রামবাসীদের সম্পূর্ণ নিরস্ত্র গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর পৈশাচিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। কিন্তু দাড়িভিট স্কুলে কি এমন হল যে পুলিশকে গুলি চালাতে হ'ল? দাড়িভিট আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের তরফ থেকে কোনো বোমা পড়েনি, পুলিশের গাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া বা জলে ফেলে দেওয়া হয়নি, তবুও রাষ্ট্রযন্ত্র গুলি চালালো! অথচ আমরা দেখেছি, ২০১৭ সালের ১৭ই জানুয়ারি মুসলিম অধ্যুষিত ভাঙ্গড়ের পাওয়ার গ্রিড নির্মাণ নিয়ে বিরোধিতায় সেখানকার মানুষ পথ অবরোধ করে। পুলিশ প্রশাসন তা সরাতে গেলে তাদের উপর আক্রমণ নেমে আসে। দশটি পুলিশভ্যান পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়, কিছু আগুন ধরিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। অনেক পুলিশ কর্মী আহত হন, অনেকে তাদের উর্দি খুলে প্রাণ রক্ষার্থে পালান। তবুও কিন্তু পুলিশ ভাঙ্গরে গুলি চালায় নি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে ছাত্রদের উর্দুর পরিবর্তে বাংলা পড়তে চেয়ে সমবেত হয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এত ভয় কেন? বিনা প্ররোচনায় এতটা অসহিষ্ণুতা কেন?
বলপূর্বক উর্দু আগ্রাসনের মাধ্যমে মিনি-পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় কি এই অসহিষ্ণুতার প্রকৃত কারণ? রাজেশ তাপসের এই পৈশাচিক হত্যা কিন্তু নিছক ছাত্র হত্যা বা আর পাঁচটা রাজনৈতিক হত্যার সমগোত্রীয় নয়। বৃহৎ বাংলাদেশ গড়তে চাওয়ার কারিগরদের এ এক সুনিপুণ চক্রান্ত; বাঙালি হিন্দু কে তার নিজ ভূমে পরবাসী করার ষড়যন্ত্রের অঙ্গ। সনাতনী ঐতিহ্য স্বরূপ শিকড় টি কে জাতির জীবন থেকে ছিন্ন করার এই অপপ্রয়াস আজ পশ্চিমবঙ্গে সর্বত্র বিরাজমান। ভোট ব্যাংকের জন্য শাসকের নির্লজ্জ তোষণের ফল ভুগতে হচ্ছে রাজ্যের আপামর বাঙালি ঐতিহ্য ও বাংলাভাষা প্রেমী নাগরিকদের। সীমাহীন জিহাদি তোষণ ও নিজ সুপ্রাচীন সনাতনী ঋদ্ধ ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বাস ঘাতকতায় অনন্য এই প্রতিকূল পরিবেশে শুধুমাত্র বাংলা ভাষার দাবীতে উত্তর দিনাজপুরের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের দুই কিশোরের আত্মবলিদান বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ স্বরূপ। মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে উঠুক এই আত্মবলিদান। দাড়িভিট আন্দোলন বাংলা ভাষা ও সনাতনী বাঙালি ঐতিহ্যকে সকলের সামনে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। দাড়িভিটে ভাষা আন্দোলনের স্মারক নির্মাণের মাধ্যমে প্রতিবাদের আওয়াজ দৃঢ়ভাবে প্রজ্জ্বলিত হউক। ২০ই সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গ মাতৃভাষা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে রাজ্যজুড়ে মাদ্রাসায় আরবি শিক্ষা বন্ধের সময়োপযোগী দাবী উঠুক কারণ বুকে মরু-সংস্কৃতি ধারণ করে আর যাই হোক বাঙালি হওয়া যায় না। বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অঙ্গ হিসেবে বয়ে চলা এই ভাষা জিহাদ পরাভূত হউক, আমাদের গর্ব বাংলা ভাষা শুদ্ধ হউক।
প্রণব কুমার কুণ্ডু
আচ্ছা বলতে পারেন, পশ্চিমবঙ্গের মাতৃভাষাটা, এই তৃণমূলের আমলে, কি ? উর্দু ? না অন্য কোন ইসলামী ?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন