মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০

শতবর্ষে মোহিনী চৌধুরী

 

শতবর্ষে মোহিনী চৌধুরী

 

শতবর্ষে মোহিনী চৌধুরী, ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’র গীতিকার নানা গানে শুধুই ‘প্রচলিত’

শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

তখনও দেশ স্বাধীনতা পায়নি। কলকাতায় সাহেবী আধিপত্য। বাংলার জনগণ লড়ছে দেশ স্বাধীন করার স্বপ্নে। রবীন্দ্র, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্তর স্বদেশী গানে ফুটছে বাংলা। এসব গানই হয়ে উঠছে মানুষের প্রতিবাদের কণ্ঠ।

ঠিক এই সময়কালেই বেহালা অঞ্চলের এক নবীন গীতিকার লিখছেন আগুনঝরা স্বদেশী গান। প্রেমের গানও লেখেন তিনি, সেই সঙ্গে বহির্বিশ্বকে ছোঁয়া দেশপ্রেমও তাঁর লেখা গানে উঠে আসে। সেই নবীন গীতিকারের লেখা গানের প্রথম রের্কড বেরিয়েছে চল্লিশের দশকের শুরুতেই ১৯৪৩-এ। সেই গানে পেয়েছেন অল্প জনপ্রিয়তা।

তোমার গানের খাতা দিয়ে যাও, আমি পরে দেখে রাখব

এমন সময়ে একদিন তাঁর বাড়ি এসে উপস্থিত হলেন তাঁর এক বন্ধু অশোক সরকার, যিনি আবার এক অদ্ভুত ধরনের খেয়ালি মানুষ। কাজি নজরুলের গানের ভক্ত, তাই তাঁর মতোই চুল, ম্যাজিক দেখাতে পারেন, হাতের লেখা মুক্তোর মতো। এঁর যখন মাথায় খেয়ালপোকা নড়ে তখন সেই কাজ তাঁর করা চাইই চাই। তাই অশোক সরকার বন্ধুর বেহালার বাড়িতে এসে বললেন, “তুই কি গান লিখছিস, চল এখনকার নামজাদা পরিচালক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কাছে তোকে নিয়ে যাচ্ছি। শৈলজার ছবিতে গান লিখবি।”

কথা শুনে যেন মনে হচ্ছে ওঁর সঙ্গে শৈলজানন্দ মহাশয়ের খুব বন্ধুত্ব। যদিও কোন বন্ধুত্বই ছিল না। তো অশোক সরকার তাঁর নবীন গীতিকার বন্ধুকে নিয়ে চললেন উত্তর কলকাতায় শৈলজানন্দর বাড়িতে। সেদিন আবার শৈলজানন্দর একটা ছবি হাতিবাগানের সিনেমা হলে রিলিজ করেছে এবং সে ছবি হিট। তাই দলবল নিয়ে বেশ একটু ব্যস্ত শৈলজানন্দ, বাড়িতেও ছিলেন না। তো রাস্তাতেই দেখা হয়ে গেল শৈলজানন্দর সঙ্গে, তিনি বললেন নবীন গীতিকারকে, “তোমার লেখা গানের খাতা দিয়ে যাও আমি পরে দেখে রাখব।”

সে সময়ে গিরীন চক্রবর্তী নামে এক জন সুরকার ছিলেন। যিনি কাজি নজরুলের অনেক গান সুর করেছেন। একদিন নবীন গীতিকারটির সঙ্গে গিরীনবাবুর দেখা। গিরীনবাবু তাঁকে বললেন “শৈলজানন্দ বাবু নতুন ছবি করছেন, তাতে সব গান লিখছেন কাজি নজরুল। কারণ নজরুল ছিলেন শৈলজানন্দর অভিন্নহৃদয় বন্ধু। আর সব গানে সুর দিচ্ছেন গীরিন বাবু নিজেই।”

তো এই শুনে তাঁর নিজের লেখা গান সিলেক্ট হল না, সেটা বুঝে শৈলজানন্দের বাড়ি ছুটলেন নবীন গীতিকার। খাতাটা ফেরত আনতে হবে। সে সময়ে শৈলজানন্দ নবীন ছেলেটিকে বললেন, “তুমি খুব ভাল গান লেখো ঠিকই, কিন্তু তোমার গান আমি কিছু নিতে পারব না। কাজি আমার বন্ধু, সে অসুস্থ। তাই কাজির সংসারকে চালানো, আয়ের সুযোগ করে দেওয়া আমার দায়িত্ব।”

দিন দুনিয়ার মালিক তোমার দীনকে দয়া হয় না…

খাতা বুকে করে চলে আসছেন গীতিকার ছেলেটি, এমন সময় ফিরে ডাকলেন শৈলজানন্দ। বললেন “ছবিতে একটা সিকোয়েন্সের গান আমি কাজির খাতায় খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি এই একটা গান সিনেমার দৃশ্যানুযায়ী লেখো।” সেই গান লিখল ছেলেটি। এর পরে আর সেই নবীন গীতিকাররা পেছনে ফিরে তাকাতে হল না। সেই প্রথম সিনেমার গান লিখল সে এবং ছবি হিট, তাঁর লেখা গানটাও মারকাটারি হিট। ছবির নাম ছিল ‘অভিনয় নয়’ (১৯৪৪)। আর গানটি যেটি ছিল, তা আজও কালজয়ী।

এখন বেহালার বাড়ি।

“দিন দুনিয়ার মালিক তোমার দীনকে দয়া হয় না। এ দীনকে দয়া হয় না। কাঁটার জ্বালা দাও তারে যার ফুলের আঘাত সয় না।”

কিন্তু কে ছিলেন সেই নবীন গীতিকার? তিনি হলেন লেজেন্ডারি গীতিকবি মোহিনী চৌধুরী। মোহিনী চৌধুরী বললেই তাঁর রচিত যে গান মনে আসে, তা হল ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’। শতবর্ষ পূর্ণ করলেন তিনি। তাঁর সেই বেহালার বাড়ি আজও আছে, সেটি এখন ঝাঁ-চকচকে ইউনিক পার্ক। রয়েছেন তাঁর উত্তরসূরী ছেলে মেয়েরা, বৌমারা, নাতি-নাতনিরা।

মোহিনী চৌধুরীর জন্ম ১৯২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়ায়। ছাত্রাবস্থাতেই সপরিবার কলকাতা চলে আসেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই গান লিখতেন। তাঁর গানে বঙ্গজীবনের কথা উঠে আসত বারবার। তাঁর লেখা পড়ে বাংলার মানুষের মন পবিত্র হয়ে যেত।

নাম মুছে হয়ে গেল ‘প্রচলিত’

কিন্তু সেই মোহিনী চৌধুরী আজ ঢাকা পড়েছেন আধুনিকতার আড়ালে। ‘দিন দুনিয়ার মালিক তোমার দীনকে দয়া হয় না।’ গানটি এত বিখ্যাত হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তীকালে গীতিকার হিসেবে সব জায়গায় দেওয়া হয়েছে, গানের কথা নাকি প্রচলিত। মোহিনীর নাম উধাও। এ অতি লজ্জা আমাদের বাঙালি জাতির কাছে।

আর এই লজ্জাজনক কাণ্ড যে ঘটছে, তা আবার আমেরিকায় গিয়ে আবিষ্কার করলেন সেই মোহিনীর বন্ধু অশোক সরকারই। খামখেয়ালি অশোক সরকার পূর্ণদাস বাউলের টিমের ম্যানেজার হিসেবে আমেরিকা চলে যান। সেখানে হিপিদের আশ্রমে রয়ে যান। এর পরে নব্বই দশকের শেষ ভাগে মোহিনী চৌধুরী প্রয়াত হন। অশোক সরকার তখন কানাডায় থাকেন। তাঁর জন্মদিনে কানাডায় তাঁকে একজন উপহার দেন একটি গানের সিডি, যাতে ছিল সারা বিশ্বের সেরা গানের সম্ভার। সেখানে একটি মাত্র বাংলা গান স্থান পায়। যে গানটা ছিল ‘দিন দুনিয়ার মালিক তোমার দীনকে দয়া হয় না।’ স্বভাবতই যে গানটির সৃষ্টির সঙ্গে তিনি জড়িয়ে, তাই অশোক সরকার খুব আপ্লুত হয়ে যান। কিন্তু গানটির গীতিকার হিসেবে দেখেন লেখা রয়েছে, ‘প্রচলিত’। অথচ আসলে গীতিকার মোহিনী চৌধুরী ও সুরকার গিরীন চক্রবর্তী।

মোহিনীকে এই গানের জন্য অশোকই তো নিয়ে গেছিলেন শৈলজানন্দ বাবুর বাড়ি। অথচ গীতিকার উপেক্ষিত হয়ে গেলেন প্রচলিতর আড়ালে। আশাহত অশোক সরকার চিঠি দেন সেই আমেরিকার মিউজিক কোম্পানিকে। চলতে থাকে লড়াই। কিন্তু মীমাংসা হওয়ার আগেই অশোক সরকারও মারা যান। তবে তিনি এই লড়াইয়ের কথা বলে গেছিলেন মোহিনীর পুত্রদের। তাঁদের পক্ষে অবশ্য এদেশ থেকে ওদেশে মামলা করা সম্ভব নয়।

সে সময় গানটি সিডিতে গেয়েছিলেন পবন দাস বাউল। তার পরে আরও কত জন গাইছেন আজও। অথচ বেশির ভাগ জায়গায় গীতিকারের নাম নেই। যা হয় আর কী, আমাদের দেশে লোকগানে। কয়েক দিন আগে রতন কাহারকে নিয়েও এমনই তোলপাড় হয়েছিল। তাঁর ‘বড়লোকের বিটি লো লম্বা লম্বা চুল’ গানটি অবলীলায় বেহাত হয়ে যায়। সেখানে মোহিনী চৌধুরী একজন লেজেন্ড, তবুও তিনি উপেক্ষিত। উপেক্ষা নিয়েই পেরিয়ে গেল ১০০ বছর।

সম্মান পাওয়ার লড়াই চলছে

একসময় ইটিভি বাংলায় প্রবাসী বাঙালিদের নিয়ে একটা আড্ডাচক্র মতো হতো, ‘সাগর পারে’ নামে। সে অনুষ্ঠানের সূত্রধর ছিলেন প্রয়াত রঞ্জন ঘোষাল। সেখানে সব বড় শিল্পীরা আসতেন। একদিন শ্রীকান্ত আচার্য সেখানে গাইলেন ‘দিন দুনিয়ার মালিক’। প্রবাসীরা সবাই আপ্লুত হয়ে বললেন, “গানটা কার লেখা?” শ্রীকান্ত কিছু বলার আগেই রঞ্জন ঘোষাল ম্যানেজ দিতে বলে দেন, “এটা প্রচলিত গান।”

এর ১০-১৫ বছর পরে এমনই কাণ্ড ঘটান শিলাজিৎ মজুমদারও। তিনিও জানেন গানটি ‘প্রচলিত’। কিন্তু মোহিনী চৌধুরীর মেজো ছেলে দিগ্বিজয় চৌধুরী শ্রীকান্ত, শিলাজিৎ দুজনের সঙ্গেই যোগাযোগ করে প্রমাণ-সহ বলেন তাঁর বাবা এই গানের রচয়িতা। পরে সেটাই স্বীকার করেন দুই শিল্পী। কিন্তু তার পরেও এই ‘দিন দুনিয়ার মালিক’ গানটি লাখে লাখে গায়ক ইউটিউবে গাইছেন, কেউ বলছেন না গীতিকার মোহিনী চৌধুরীর কথা।

মোহিনী চৌধুরী আজ আর নেই। নেই তাঁর স্ত্রী লীলা দেবীও। কিন্তু আজও বাবার এই গানটি-সহ বহু গানকে ‘প্রচলিত’ হয়ে ওঠার থেকে রোধ করার লড়াইতে লড়ছেন তাঁর পুত্র নাতিরা। তাঁরা প্রাপ্য সম্মানটুকু চান।

মুক্তির মন্দির সোপানতলে…

শুধু তাই নয়, বিখ্যাত গান ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ গেয়েও টাকা পাননি মোহিনী। স্বাধীনতার যুদ্ধে মানুষকে উদ্দীপ্ত করার গানের ধারা চালু করাতে রবীন্দ্র-নজরুল পরবর্তী গীতিকার হিসেবে মোহিনী চৌধুরী ছিলেন অন্যতম। তাঁর লেখা ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হল বলিদান’ ছাড়া আজও কোন স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস বা নেতাজী জয়ন্তী ভাবা যায়না। গানটি সুর করেছিলেন ও সর্বপ্রথম গেয়েছিলেন সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে।

কিন্তু এই গান লিখেও তখন কপিরাইট পাননি মোহিনী চৌধুরী। কারণ তখন রেকর্ড কোম্পানিগুলিই সব গান কিনে নিত। গান রেকর্ড করার সুযোগ দিচ্ছে এই অনেক ছিল, রয়্যালটি বলে কিছু ছিল না। মাত্র ছ’টাকা করে পেতেন পরবর্তী কালে মোহিনী চৌধুরী। তাঁর পরিবারও পরে বহু যুগ ওই ছ’টাকাই পেয়ে এসেছেন।

মোহিনীর স্ত্রী লীলা চৌধুরী বলতেন, “তোমায় রেকর্ড কোম্পানি কম টাকা দিয়ে ঠকাচ্ছে।” মোহিনী তাতে বলতেন, “টাকা তো সেপটিক ট্যাঙ্কে চলে যাবে কিন্তু সৃষ্টি রয়ে যাবে।” আন্দামানের সেলুলার জেলেও খোদিত ছিল এই গান। যদিও সেখানেও গীতিকারের নাম ছিল না। একমাত্র ডায়মন্ড হারবারে অরবিন্দ উদ্যানে মোহিনীর নাম-সহ রয়েছে এই গান।

স্ত্রী লীলা চৌধুরী।

এই গানটির সৃষ্টিকর্তা হিসেবে মোহিনীর নামও হয়তো ‘প্রচলিত’র আড়ালে চাপা পড়ে যেত যদি না সবিতাব্রত দত্ত তাঁর প্রতিটি শোতে এই গান গাওয়ার সময়ে গীতিকার মোহিনী চৌধুরীর নাম না বলতেন। সবিতাব্রতর কণ্ঠ পঞ্চাশ-ষাট দশকে গ্রাম, শহর, মাঠঘাট কাঁপিয়ে দিচ্ছে। উনি যতবার এই ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ গাইতেন, মোহিনীর নামও উল্লেখ করে করে গীতিকারকে জনমানসে পরিচয় ও খ্যাতি এনে দেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরে বিগ্রেড প্যারেড গ্রাউন্ডে একটা বিরাট সমাবেশ হয়েছিল। শেখ মুজিবর রহমান এসছিলেন। সেখানে ধারা বিবরণী দিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। সেই সমাবেশে সবিতাব্রত দত্ত গীতিকার মোহিনী চৌধুরীর নাম বলে গেয়েছিলেন ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’। গোটা অনুষ্ঠানটাই রেডিওতে সম্প্রচারিত হয়েছিল। তখন মোহিনী চৌধুরী জীবিত। তিনি অমন একটি সমাবেশে নিজের নাম শুনে আপ্লুত ও আনন্দাশ্রুসিক্ত হয়েছিলেন।

সবিতাব্রত মোহিনী চৌধুরীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলতেন, “আপনার গান গেয়ে আমি খাই, আপনি আমার অন্নদাতা, আপনার ঋণ কখনও শোধ করতে পারব না।” মোহিনী চৌধুরীর প্রয়াণের পরেও যখন তাঁর পুত্র ভবিষ্যত চৌধুরী, দিগ্বিজয় চৌধুরী মোহিনী স্মরণে অনুষ্ঠান করেছেন, সবিতাব্রত প্রফেশানাল অনুষ্ঠান এমনকি রাজীব গান্ধীর অনুষ্ঠানে অল্প সময় দিয়েও মোহিনী অনুষ্ঠানে এসেছেন।

স্বাধীনতার পরে নিষিদ্ধ দেশপ্রেমের গান!

তখন হত থালার মতো রেকর্ড। একপিঠে ছিল ‘মুক্তির মন্দির’ আর অন্য পিঠে ‘আজি কাশ্মীর হতে কন্যাকুমারী’। দ্বিতীয় গানটি ছিল যুদ্ধের স্বদেশি সঙ্গীত। এটিরও সুরকার ও গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে আর গীতিকার মোহিনী চৌধুরী। কিন্তু গানটি ব্যান করেছিল স্বাধীন দেশের সরকার। কারণ দেখানো হয়েছিল, যে গানে সিন্ধু-সহ আরও কিছু দেশবিরোধী শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ ঘটনা ছিল মোহিনীর কাছে অত্যন্ত যন্ত্রণার।

তখন মল্লিক পরিবারের ছেলে, অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিকের দাদা, অনিল মল্লিক এই ব্যান তোলার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। উনি ছিলেন হাইকোর্টের উকিল। উনি বলেছিলেন “সিন্ধু শব্দ যুক্ত একজনের গান যদি জাতীয় সঙ্গীত হয়, তাহলে আর একজনের গান নিষিদ্ধ করা হবে কেন?” এই যুক্তিতেই গানটি ফের চালু হয়। তার পর তো ‘আজি কাশ্মীর হতে কন্যাকুমারী’ বহু শিল্পী রেকর্ড করেছেন, যা জগৎ বিখ্যাত গান হয়ে যায়।

পৃথিবী আমারে চায়…

মোহিনীর লেখা গান ‘পৃথিবী আমারে চায়’ দিয়ে উত্তম কুমার ছবির নামকরণও করেছিলেন। কমল দাশগুপ্ত মোহিনীকে ফেরত দিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর লেখা ‘পৃথিবী আমারে চায়’ গানটা। এমন কথা দিয়ে নাকি গান চলবে না। পরে এইচএমভি কিছু গান চেয়েছিল মোহিনীর কাছে। তখন মোহিনী ‘পৃথিবী আমারে চায়’ গানটা আবার ঢুকিয়ে দিয়ে দেন। এবং এই গান রেকর্ড করেন সত্য চৌধুরী। বিশাল হিট করে গানটি। সত্য চৌধুরীও আলাদা করে পরিচিত হন।

সত্য চৌধুরী আর উত্তম কুমার ভবানীপুরেই থাকতেন এবং পরস্পরের বন্ধুত্ব ছিল। এই গান এতই ভাল লাগে উত্তমের, যে এই গানের প্রথম লাইন দিয়ে উত্তমকুমার-মালা সিনহার ছবির নামকরণ হয়। এমনকি গানের শুরুর লাইন উত্তম কুমার নিজের গলায় ছবিতে গেয়েওছিলেন। পরে গানটি তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠেও কালজয়ী হিট হয়।

সলিল চৌধুরী প্রণাম করতেন

মোহিনীর পুত্র দিগ্বিজয় চৌধুরী জানালেন “গণসঙ্গীতের পথিকৃৎও বলা যেতে পারে আমার বাবাকে। গণচেতনার গান, এই যে আমাকে ঘরে বেঁধে রেখো না, লড়াইতে সামিল হও– এই চেতনা বাবার গানে সব সময় ছিল। শুধু তাই নয়, সলিল চৌধুরীর মতো লোককে দেখেছি আমার বাবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে। গৌরীপ্রসন্নরা তো করতেনই কিন্তু সলিল চৌধুরী প্রায় বাবার সমবয়সি কি একটু ছোট। ওরকম মহীরুহ একজন লোক আমার বাবাকে প্রণাম করতেন, আমাদের নিজ চোখে দেখা।”

সঙ্গীতশিল্পী অজিত পাণ্ডে একসময় নকশাল করতেন, তাই কারাগার বন্দী হন। ওই সময়ে ওঁরা জেলের ভিতর নিজেদের উদীপ্ত করতে গাইতেন মোহিনীর গান, ‘জেগে আছি একা জেগে আছি কারাগারে’।

পরে অবশ্য ছবি প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছিলেন মোহিনী, যা ছিল ঐতিহাসিক ভুল। গানে সাফল্য, প্রচুর গানের অফার, ছবিতে সুর করার অফার পেয়ে জিপিওতে চাকরি করতেন তিনি। একসময়ে সেখানে সময় দিতে না পারায় ছেড়ে দিলেন চাকরি। ভাবলেন, ছবি করবেন। করলেনও। ছবির নাম ‘সাধনা’। ছায়া দেবী, চন্দ্রাবতী দেবী, পাহাড়ী সান্যাল, বীরেন চ্যাটার্জীদের নিয়ে হল ছবি। কিন্তু সাফল্য এল না।

গীতিকার মোহিনী পরিচালক বা প্রযোজক হিসেবে সফল হোন, এটা আসলে কেউ চাননি। এর পরে বহু পরিচালক ও প্রযোজকরা তাঁদের ছবিতে গীতিকার হিসেবে নিলেন না মোহিনীকে।

হতাশায় ডুবে গেলেন মোহিনী

পরিবারেও কিছু সমস্যা এল এ সময়ে। স্ত্রী, সন্তান-সহ  বেহালার বাড়ি ছাড়লেন তিনি। চেতলার বস্তি অঞ্চলে ঘর ভাড়া নিয়ে ওঠেন লেজেন্ডারি গীতিকার। মোহিনী কাজ নিয়েছিলেন বিজ্ঞানী ও সাংসদ মেঘনাদ সাহার অধীনে সংসদীয় সচিবের চাকরি। এরপর ১৯৫৪ সালে শিল্পপতি দেবেন ভট্টাচার্যের একান্ত সচিব হিসেবেও কাজ করতে থাকেন। দেবেন ভট্টাচার্য আবার ছবি প্রযোজনা করতেও এলেন। প্রথম ছবি ‘কালস্রোত’। চলল না।

অঞ্জনা ভৌমিকের লিপে গান হিট হল মোহিনীর কলমের জোরে

পরের দিকের ছবি ‘অনুষ্টুপ ছন্দ’তে নিলেন নবাগতা অভিনেত্রী অঞ্জনা ভৌমিককে। এত দিনেও মোহিনী তাঁর কর্মচারী বলে তাঁকে গান লিখতে দেননি দেবেন বাবু। পরের ছবি উত্তম কুমার ও অঞ্জনাকে নিয়ে করলেন ‘রাজদ্রোহী’। অঞ্জনা ভৌমিক ছিলেন শিল্পপতি কাম প্রযোজক দেবেন ভট্টাচার্যর কাছের মানুষ। এই ছবির পাবলিসিটির কাজের দায়িত্ব মোহিনীকে দেন, দেবেন। এই সূত্র ধরে অঞ্জনা বুঝলেন মোহিনীর গান লেখার গুণ।

অঞ্জনার সুপারিশে দেবেন ভট্টাচার্যর পরের ছবি ‘নায়িকা সংবাদ’-এর গীতিকার হওয়ার সুযোগ পেলেন মোহিনী চৌধুরী। কিন্তু দুটো গান শুধু অঞ্জনার লিপে। উত্তমের লিপের গান মোহিনী পেলেন না। কিন্তু ছবি রিলিজ হতেই উল্টো ছবি। উত্তমের লিপে গান অ্যাভারেজ হিট আর অঞ্জনার লিপের দুটো গান ‘কী মিষ্টি দেখো মিষ্টি’ এবং ‘কেন এ হৃদয়, চঞ্চল হল’– এই গান দুটিই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ফাটাফাটি হিট।

https://youtu.be/DCLdV4_ef4g

এর পরে ‘শুকসারী’ ছবিতে উত্তমকুমারের লিপে মোহিনীর লেখা গান গাইলেন মান্না দে— ‘সখি চন্দ্রবদনী, সুন্দরী ধনি।’ এত বড় বড় হিট দেবার পরও মোহিনী সে অর্থে পরপর ভালো সুযোগ কমই পেলেন। এ সময়ে মোহিনী চৌধুরীর লেখা গান গাইলেন জগন্ময় মিত্র, ‘ভালবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রানি’। পরের পর হিট জগন্ময়ের কণ্ঠেই মোহিনী গীতি, ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়, তুমি যে বহ্নিশিখা’, ভুলি নাই ভুলি নাই, নয়নে তোমারে হারায়েছি প্রিয়া’, ‘ঝরা ফুলে ভরা এই যে সমাধিতল’।

ভাঙা ঢোল থেকে বাংলাদেশের ঢোল…

এ সময়ে শচীন দেব বর্মণ মোহিনীকে বললেন, গান লিখে দিতে হবে দেশভাগের অনুভূতি নিয়ে। মোহিনীর জন্ম বাংলাদেশে, সেই দেশের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল। এ ব্যথা তাঁর থেকে ভাল আর কে বুঝবে? সারা রাত জেগে ভাবলেন গান। ভোরের আলো ফুটে উঠেছে যখন, মোহিনী লিখলেন, ‘শুনি তাকদুম তাকদুম বাজে বাজে ভাঙা ঢোল/ ও মন, যা ভুলে যা কী হারালি, ভোল রে ব্যথা ভোল।’

এই গানের ভাঙা ঢোল শব্দ বদলে পরে মীরা দেববর্মণ লিখেছিলেন বাংলাদেশের ঢোল কথাটি। অনেকেই ভাবেন মীরা দেববর্মণই এ গানের গীতিকার, তা নয়। আদতে আসল গীতিকার মোহিনী চৌধুরী। এখানেও তিনি উপেক্ষিত।

জীবনে চলার পথে একের পর এক ঘাত প্রতিঘাতের সম্মুখীন হয়েছেন। বাড়ি ছেড়েছিলেন, কিন্তু শেষ দিকে ফিরে এসেছিলেন বেহালার নিজেদের বাড়িতে। এর পরে আগুনে পুড়ে দুর্ঘটনায় মারা যায় তাঁর ছোট পুত্র। সেই শোক ভুলতে পারেননি মোহিনী চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী লীলা চৌধুরী।

সারাদিন ডিম-পাঁউরুটি খেয়ে থাকলেন, রাতটুকু পেরোল না

তবু শেষ দিন অবধি পরম সাধনায় গান লিখে গেছেন মোহিনী চৌধুরী। শেষদিন অবধি কাজও করে গেছেন। স্টুডিওতে রেকর্ডিংয়ে গান লিখতে গেছিলেন। সেদিন দিলীপ রায়, শিবাজী চট্টোপাধ্যায়, ইনা মুখোপাধ্যায় আরো কয়েকজন শিল্পী তাঁর লেখা গান গাইবে। সারা দিন শুধু টোস্ট-অমলেট খেয়ে থেকে রাতে বাড়ি ফেরেন তিনি। ১৯৮৭ সালের ২১ মে রাতে হৃদরোগে প্রয়াত হন মোহিনী চৌধুরী। কিংবদন্তির প্রয়াণে আসেননি একজনও সঙ্গীত জগতের লোক বা রাজনৈতিক জগতের লোক। এমনকি আগের দিন যাঁদের সঙ্গে গান রেকর্ডিংয়ে ছিলেন, খেটে গান বানিয়ে দিলেন, তাঁরাও এক জনও আসেননি।

প্রকৃত শিল্পীরা সরল হন বলেই বোধহয় গুছিয়ে নিতে পারেন না। সব উজাড় করে দিয়ে যান। কিছুই পাওয়া হয় না। আজও এই অকৃতজ্ঞ ইন্ডাস্ট্রির কথা ভাবলে অবাক হয় মোহিনীর পরিবার। তবে গানের সাধনায় কম পড়েনি সরস্বতীর কৃপা। এক পরিবারে তিন জন গীতিকার, সেটা বোধহয় মোহিনী চৌধুরীর পরিবারেই একমাত্র ঘটেছে।

এসব সিনেমার গীতিকার লীলা চৌধুরী।

তাঁর স্ত্রী লীলা চৌধুরী ও বড় পুত্র ভবিষ্যত চৌধুরী দুজনেই সফল গীতিকার। মেজো পুত্র দিগ্বিজয় সরকারি চাকরির পাশাপাশি কিছুদিন সাংবাদিকতা ও এখন ছবি প্রযোজনাতেও যোগ দিয়েছিলেন।

ছুটে আসেন মমতা

মোহিনীর শেষকৃত্যর কয়েকদিন পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খবর পেয়ে ছুটে আসেন বিধবা লীলা চৌধুরীর সমব্যথী হয়ে। মমতা তখন শুধু রাজীব গান্ধীর কাছের নেত্রী ছিলেন, কোনও পদে ছিলেন না। তবু আসেন, হাতে হাত রাখেন মোহিনী পত্নীর। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে জোকা বেহালা বিবাদীবাগ মেট্রো স্টেশনের একটির নাম মোহিনী চৌধুরীর নামে হবে বলে মমতা কথাও দিয়েছিলেন পরবর্তীকালে। যদিও এখনও সেটা প্রস্তাবিত মাত্র।

সে যাই হোক, মোহিনী চৌধুরীর জীবনের গ্রাফ দেখলে একটা জিনিস বোঝা যায়, যতই সমাজ সংস্কারের বাধা আসুক, তিনি কিন্তু গানকে আঁকড়ে বেঁচেছেন। গানেই সমর্পণ করে দেন নিজেকে। রুটিরুজি, সংসারের তাগিদে আপস করেননি কোথাও। মোহিনী চৌধুরী আসলে একজন কবি, একজন স্রষ্টা। সৃষ্টি ছাড়া কী করে বাঁচবেন তিনি!

তাই তিনি উপেক্ষিত, বঞ্চিত, কিন্তু তাঁর সৃষ্টিকে শেষ অবধি ধরে রেখেছিলেন নিজের ভিতরে। এটাই তো তাঁর জিত। সাধক তিনি। সবকিছুর ঊর্ধ্বে তিনি গানের ঈশ্বর হয়ে থেকে গেছেন আজ শতবর্ষ পরেও।

কৃতজ্ঞতী স্বীকার: দিগ্বিজয় চৌধুরী ও মোহিনী চৌধুরীর পরিবার।




শেয়ার করেছেন : - প্রণব কুমার কুণ্ডু


 

 

 

 

প্রণব কুমার কুণ্ডু 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন