বুধবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২০

কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

 কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

গণকবি
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (জন্মঃ- ২ সেপ্টেম্বর, ১৯২০ - মৃত্যুঃ- ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৫)
 
প্রেম, প্রকৃতি, চার পাশের মানুষ, সামাজিক আন্দোলন, ইত্যাদি তাঁর কবিতার মূল উপকরণ। তাঁর কাব্যকে ঘিরে আছে তীব্র সচেতনতা ও দায়বদ্ধতা। সমাজতন্ত্রের উপর বিশ্বাস এবং আস্থা তার কবিতা এবং জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ওই দৃঢ় বিশ্বাস এর জন্যই তাঁর রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগদান, জেল যাত্রা এবং কবিতা। এই বিশ্বাস থেকেই তাঁর দলের সঙ্গে মত বিরোধ এবং নিজেকে দল থেকে সরিয়ে আনা।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে - গ্রহচ্যুত (১৯৪২), রাণুর জন্য (১৯৫২), লখিন্দর (১৯৫৬), ভিসা অফিসের সামনে (১৯৬৭), মহাদেবের দুয়ার (১৯৬৭), মানুষের মুখ (১৯৬৯), ভিয়েতনাম : ভারতবর্ষ (১৯৭৪), আমার যজ্ঞের ঘোড়া : জানুয়ারি (১৯৮৫)। এ ছাড়া তিনি অনেক কাব্যগ্রন্থ অনুবাদ করেছেন। তাঁর সম্পাদিত কবিতা বুলেটিনের সংখ্যাও পঁচিশের বেশি।
কবির কবিজীবন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরনীয়, কারণ তিনি মূলত ছোট পত্রিকার কবি এবং তাঁর কোনো কবিতা কোনো বড় পত্রিকায় ছাপা হয় নি। কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকা সত্বেও তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। ক্যানসারে আক্রান্ত অবস্থায়, শেষ শয্যায় অনেক অনুরোধে, তিনি তাঁর দুটি কবিতা একটি প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায় ছাপার অনুমতি দিয়েছিলেন। তাঁর কবিতা সংক্ষিপ্ত এবং সংকেতময়।
*
আমার ভারতবর্ষ
আমার ভারতবর্ষ
পঞ্চাশ কোটি নগ্ন মানুষের
যারা সারাদিন রৌদ্রে খাটে, সারারাত ঘুমুতে পারে না
ক্ষুধার জ্বালায়, শীতে ;
কত রাজা আসে যায়, ইতিহাসে ঈর্ষা আর দ্বেষ
আকাশ বিষাক্ত করে
জল কালো করে, বাতাস ধোঁয়ায় কুয়াশায়
ক্রমে অন্ধকার হয়।
চারদিকে ষড়যন্ত্র, চারদিকে লোভীর প্রলাপ
যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ আসে পরস্পরের মুখে চুমু খেতে খেতে
মাটি কাঁপে সাপের ছোবলে, বাঘের থাবায় ;
আমার ভারতবর্ষ চেনে না তাদের
মানে না তাদের পরোয়ানা ;
তার সন্তানেরা ক্ষুধার জ্বালায়
শীতে চারিদিকের প্রচণ্ড মারের মধ্যে
আজও ঈশ্বরের শিশু, পরস্পরের সহোদর।
--------------------------------------------
রুটি দাও
হোক পোড়া বাসি ভ্যাজাল মেশানো রুটি
তবু তো জঠরে, বহ্নি নেবানো খাঁটি
এ এক মন্ত্র ! রুটি দাও, রুটি দাও ;
বদলে বন্ধু যা ইচ্ছে নিয়ে যাও :
সমরখণ্ড বা বোখারা তুচ্ছ কথা
হেসে দিতে পারি স্বদেশেরও স্বাধীনতা।
শুধু দুই বেলা দু'টুকড়ো পোড়া রুটি
পাই যদি তবে সূর্যেরও আগে উঠি,
ঝড়ো সাগরের ঝুটি ধরে দিই নাড়া
উপড়িয়ে আনি কারাকোরামের চূড়া :
হৃদয় বিষাদ চেতনা তুচ্ছ গণি
রুটি পেলে দিই প্রিয়ার চোখের মণি।
--------------------------------------------
মুখোশ
কাব্যগ্রন্থঃ "রাণুর জন্য" (১৩৫৮)
কান্নাকে শরীরে নিয়ে যারা রাত জাগে,
রাত্রির লেপের নিচে কান্নার শরীর নিয়ে করে যারা খেলা
পৃথিবীর সেই সব যুবক যুবতী
রোজ ভোর বেলা
ঘরে কিংবা রেস্তোরাঁয় চা দিয়ে বিস্কুট খেতে-খেতে
হঠাত্ আকাশে ছোঁড়ে দু-চারটি কল্পনার ঢেলা
এবং হাজারে কয় রান ক'রে আউট হ'য়ে গেছে
ভুলে গিয়ে তারা হয় হঠাত্ অদ্ভুত।
যুবতীকে মনে হয়, কোনো-এক রহস্যের দূত
কার যেন স্মৃতিমুখ পাঠায়েছে আমাদের মতো কোনো প্রণয়ীর কাছে ;
সুন্দর কি কুত্সিত জানি না, তবু জানি মার্চেন্টের মারে নেই এই সব খুত।
কান্নাকে সরিয়ে রেখে দৈনিক কাগজ খুঁজি তাই,
যুবককে ভুলে যাই, যুবতীকে দূরে-দূরে রাখি ;
তারপর কোনো দিন যদি মনে হয়
দিনগুলি বাসি বড়ো, বিবর্ণ, একাকী,
প্রেমিক কি উদ্বাস্তুর মতো এক সমস্যার নিতান্তই মূর্খ হ'য়ে গেছে
আমার কী আসে যায়, তুড়ি মেরে এগজামিনে দিয়ে যাবো ফাঁকি !
অথবা কবিতা দিয়ে সমর্থন জানাবো তোমাকে,
হে প্রেমিক, হে উদ্বাস্তু, তোমাদের দুঃখে আমি গলে হব নদী !
হে দিন, হে কালরাত্রি,
না হয় আগলাবো আমি তোমাদের দুর্দিনের গলি।
তোমরা নির্বোধ হাতে স্মৃতিমুখ খুঁজে-খুঁজে প'ড়ে যাবে যখন অসুখে,
তোমাদের দুঃখে আমি ম'রে যেতে রাজি আছি---কারো দুঃখে মরা যায় যদি।
কী আশ্চর্য ! সেই ছেলে আমার দর্শন শুনে তবু
অর্ধেক বিস্কুট ফেলে রেস্টোরেন্ট থেকে
চ'লে গেলো। সেই মেয়ে সিনেমার বিজ্ঞপনে ভিড়ে
ডুবে গেলো, তারপর কী যেন বললো সঙ্গিনীকে।
মনে হ'লো হেমিংওয়ে মম্ নিয়ে ওদের বিবাদ
আজন্ম চলছে যেন, বন্ধুত্বটা কোনোমতে আছে তবু টিকে !
হঠাত্ পড়লো চোখে কাগজের এডিটোরিয়াল,
আমেরিকা ভালো, চীন ভালো...
ষ্ট্রম্যান পাঠাবে অন্ন আমাদের কাল
হৃদয় জুড়ালো।
হে যুবক, হে যুবতী, পৃথিবাতে তোমাদের কতটুকু দাম ?
কান্নাকে শরীরে নিয়ে কার ঘরে কয় ফোঁটা দিয়ে গেলে আলো ?
--------------------------------------------
চিড়িয়াখানা
কোলা ব্যাঙের ছা
কথা বলেন না
কথা বললে ভাঙবে ধ্যান
তিনি শুধুই ভাষণ দ্যান
জাগুয়ার
খাবেন না সাগু আর
রোজই বলেন মেজদিকে
খাবেন তিনি শেঠজিকে
রাত দুপুরে তিনটে বানর,
কেবল বলে, "পকেটে পোর।"
"কাকে রে কাকে ?"
---"সূর্যটাকে।"
ভোট দিও না হাতিকে,
ভোট দিও তার নাতিকে।
ভোট দিও না গাধাকে,
ভোট দিও তার দাদাকে।
--------------------------------------------
গুলি চলছে
গুলি চলছে, গুলি চলছে, গুলি চলবে --- এই না হলে শাসন?
ভাত চাইতে গুলি, মিছিল করলে গুলি, বাংলা বন্ধ গুলির মুখে
উড়িয়ে দেওয়া চাই।
দেশের মানুষ না খেয়ে দেয় ট্যাক্স, গুলি কিনতে, পুলিশ ভাড়া
করতে, গুণ্ডা পুষতে ফুরিয়ে যায় তাই।
একেই বলে গণতন্ত্র ; এরই জন্য কবিতার সর্দার সাহিত্যের মোড়লরা
কেঁদে ভাসান ; যখন
গুলিবিদ্ধ রক্তে ভাসে আমার ঘরের বোন, আমার ভাই।
--------------------------------------------
রাজা আসে যায়
রাজা আসে যায় রাজা বদলায়
নীল জামা গায় লাল জামা গায়
এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের রং বদলায়....
. দিন বদলায় না!
গোটা পৃথিবীকে গিলে খেতে চায় সে-ই যে ন্যাংটো ছেলেটা
কুকুরের সাথে ভাত নিয়ে তার লড়াই চলছে, চলবে।
পেটের ভিতর কবে যে আগুন জ্বলেছে এখনো জ্বলবে!
রাজা আসে যায় আসে আর যায়
শুধু পোষাকের রং বদলায়
শুধু মুখোশের ঢং বদলায়
. পাগলা মেহের আলি
. দুই হাতে দিয়ে তালি
এই রাস্তায়, ওই রাস্তায়
. এই নাচে ওই গান গায় :
"সব ঝুট হায়! সব ঝুট হায়! সব ঝুট হায়! সব ঝুট হায়!"
জননী জন্মভূমি!
সব দেখে সব শুনেও অন্ধ তুমি!
সব জেনে সব বুঝেও বধির তুমি!
. তোমার ন্যাংটো ছেলেটা
. কবে যে হয়েছে মেহের আলি,
. কুকুরের ভাত কেড়ে খায়
. দেয় কুকুরকে হাততালি...
. তুমি বদলাও না ;
. সে-ও বদলায় না!
শুধু পোষাকের রং বদলায়
শুধু পোষাকের ঢং বদলায়...
-------------------------------------------
যতীন দাসের ফটো
কুৎসিত বাঁকানো মুখে জীবনের অদ্ভুত উত্সব
অফুরন্ত আলোকের উদ্ভাসিত ঐশ্বর্যে, প্লাবনে ;
ধীরে ধীরে সেই মুখ হয়ে এলো আশ্চর্য সুন্দর
অবিশ্রাম তারা-ঝরা জীবনের বর্ষণে ও গানে।
অনেক দেখেছি ছবি, দেখিনি উন্মত্ত দ্বিপ্রহর
পদ্মার কি মেঘনার নীলকণ্ঠ স্বর্ণায়ু জটায়,
সাপ-খেলানোর নেশা মৃত্যু দিয়ে কেনে বাজিকর
দেখিনি এমন ছবি মথুরায় কিম্বা অযোধ্যায়
কোনদিন! আজ দেখি রঙচটা তথাপি বিচিত্র,
অসুন্দর, তবু মুখ সূর্যের কি সমুদ্রের মিত্র।
এই ছবি দেখে দেখে স্পষ্ট হ'লো কেন মরা হাড়ে
দধীচি এখনো বজ্র। সব গ্রহ আগুন তো নয়
একথা যেমন সত্য, তবু কেউ পুড়ে যেতে চায়
পৃথিবীকে আলো দিয়ে, কী আশ্চর্য, সে-ই সূর্য হয়!
--------------------------------------------
ক্ষুদিরামের ফাঁসি
সে এক অদ্ভুত রাত্রি! থমথমে রক্তমাখা মুখগুলি জ্বরে
অকথ্য প্রলাপ বলে, দীপ-নেভা অন্ধকার বিছানায়, ঝড়ে
বুকগুলি তোলপাড়। জানালায় জল্লাদের হাতের মতন
কালো হাওয়া নড়ে চড়ে, হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে। নেকড়ের গর্জন
নগরেও শোনা যায় ; কুয়াশায় ঝাঁপ দেয় সারিবদ্ধ বাঘ---
সে এক অদ্ভুত রাত্রি ; ক্লান্তির শিয়রে ক্রান্তি লেখে পূর্বরাগ!
সেই রাত্রে ফিস্ ফিস্ রুগী আর নার্সের অস্ফুট গলায়
ভয়, শুধু ভয় কাঁপে, তারপর ধীরে ধীরে কেটে যায় ভয়---
কে যেন নির্ভীক হাসে। ভীষণ কঠিন হাসি প্রত্যেক দরজায়
বিবর্ণ রাত্রির চোখে চোখ রাখে, কথা বলে, ছড়ায় বিস্ময়।
অন্ধকারে সেই হাসি আলো যেন, জ্বেলে দিল সমস্ত বন্দর ;
ঘরে ঘরে যুবতীরা খিল তোলে, যুবকের ছেড়ে যায় জ্বর।
ধীরে রাত্রি স'রে যায়। শুদ্ধ ভোরে স্নান সেরে বাইরে এলাম...
ফাঁসির মঞ্চে কাল হেসে গেছ, গেয়ে গেছ, তুমি ক্ষুদিরাম!
--------------------------------------------
উত্তরপাড়া কলেজ : হাসপাতাল
রক্ত রক্ত শুধু রক্ত, দেখতে দেখতে দুই চোখ অন্ধ হয়ে যায়
শিক্ষক ছাত্রের রক্ত প্রতিটি সিঁড়িতে, ঘরে, চেয়ারে, চৌকাঠে বারান্দায়!
দরজা ভাঙ্গা, জানালা ভাঙ্গা, ছাতের কার্নিশ ভাঙ্গা, আহত ছাত্রের
মাথা ঠুকে ঠুকে তারা খসিয়েছে ইঁট সুরকি! রক্তাক্ত মাথায়
কেউ লাফ দিয়েছে বিশ ফুট নিচে, কাউকে ছুঁড়ে দিয়েছে পুলিশ ;
রক্তবমি ক'রে আজ হাস্পাতালে এই বাংলার কিশোর গোঙায়!
এই তোমার রাজত্ব, খুনী! তার উপর কি বাহবা চাও?
আমরাও দেখবো, তুমি কত দিন এইভাবে রাক্ষস নাচাও!
--------------------------------------------
লাল টুকটুক নিশান ছিল
লাল টুকটুক নিশান ছিল
হঠাৎ দেখি, শ্বেত কবুতর
উড়ছে ঊর্ধ্বে, আরও ঊর্ধ্বে
ভুখ মিছিলের মাথার উপর।
বিপ্লব হোক দীর্ঘজীবী,
কিন্তু এখন "শান্তি, শান্তি!"
প্রেতের মতো ধুঁকছে মিছিল
উড়ছে পায়রা নধরকান্তি।
--------------------------------------------
দেওয়ালের লেখা
দেওয়ালের লেখাগুলিকে
কারা যেন মুছে দিতে চাইছে।
কারা যেন
বত্রিশ সিংহাসনের প্রচণ্ড স্পর্ধায় চক্ষু লাল ক'রে
নির্দেশ দিচ্ছে : "এবার থামো ;
এখন থেকে বিপ্লব আমাদের হুকুম মেনে চলবে"।
একবার সিংহাসনে উঠে বসতে পারলে
তখন দেওয়ালের লেখাগুলি অশ্লীল প্রলাপের মতো মনে হয়।
তখন অপরের পোস্টার ছেঁড়াই শ্রেণী-সংগ্রামের কাজ ;
অথবা ডজন খানেক মন্ত্রী জড়ো ক'রে রাস্তায় বক্তৃতা দেওয়া :
"সাবধান! যারা দেয়ালকে কলঙ্কিত করছ! তোমাদের পেছনে
. এবার গুণ্ডা লেলিয়ে দেব।"
তারা বত্রিশ সিংহাসনের আশ্চর্য মহিমায়
এখন থেকে বাংলা দেশের তামাম দেওয়ালগুলোকে
নতুন ক'রে চুনকাম ক'রে দেবে, যেন কোথাও কোনো
. গুলি খাওয়া মানুষের রক্ত
ছিটেফোঁটাও দাগ না রাখে।
--------------------------------------------
আমার সন্তান যাক প্রত্যহ নরকে
আমার সন্তান যাক প্রত্যহ নরকে
ছিঁড়ুক সর্বাঙ্গ তার ভাড়াটে জল্লাদ ;
উপড়ে নিক চক্ষু, জিহ্বা দিবা-দ্বিপ্রহরে
নিশাচর শ্বাপদেরা ; করুক আহ্লাদ
তার শৃঙ্খলিত ছিন্নভিন্ন হাত-পা নিয়ে
শকুনেরা। কতটুকু আসে-যায় তাতে
আমার, যে-আমি করি প্রত্যহ প্রার্থনা,
"তোমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।"
যে-আমি তোমার দাস ; কানাকড়ি দিয়ে
কিনেছ আমাকে রাণী, বেঁধেছ শৃঙ্খলে
আমার বিবেক, লজ্জা ; যে-আমি বাংলার
নেতা, কবি, সাংবাদিক, রাত গভীর হ'লে
গোপনে নিজের সন্তানের ছিন্ন শির
ভেট দিই দিল্লীকে ; গঙ্গাজলে হাত ধুয়ে
ভোরবেলা বুক চাপড়ে কেঁদে উঠি, "হায়,
আত্মঘাতী শিশুগুলি রক্তে আছে শুয়ে!"
আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে আশ্চর্য চুমায়
তোমারই দাক্ষিণ্য, রাণী দিয়েছ নিভৃতে ;
এবার পাঠিয়ে দাও প্রকাশ্যে ঘাতক,
বাগানে যে-ক'টি ফুল আছে ছিঁড়ে নিতে।
প্রত্যেক কাগজে আমি লিখবো ফুলের
ভেতর পোকার নিন্দা, খুনীর বাহবা
প্রত্যহ বাংলার শিশু-গোলাপ ক'টির
সর্বনাশে সরগরম করবো আমি সভা।
আমার সন্তান যাক প্রত্যহ নরকে
ছিঁড়ুক সর্বাঙ্গ তার ভাড়াটে জল্লাদ ;
উপড়ে নিক চক্ষু, জিহ্বা দিবা-দ্বিপ্রহরে
নিশাচর শ্বাপদেরা ; করুক আহ্লাদ
তার শৃঙ্খলিত ছিন্নভিন্ন হাত-পা নিয়ে
শকুনেরা। কতটুকু আসে-যায় তাতে
আমার, যে-আমি করি প্রত্যহ প্রার্থনা,
"তোমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।"
--------------------------------------------
এই নরকে
কবিরা কোথায় আজ? উত্তরার জলসা-ঘরে এখনো কি নাচ সেখায় তারা?
এদিকে যে শমীবৃক্ষে মন্ত্রপড়া অস্ত্রগুলি কীচকের বাড়ায় আহ্লাদ!
শুনি পাড়ায় পাড়ায় জল্লাদের আস্ফালন ; দেখি ঘরে ঘরে
. নরখাদকের রক্তমাখা থাবা, পিশাচের মার...
কবিরা কোথায় আজ? সবাই কি দুর্যোধনের কেনা,
. নাকি বিরাট রাজার কৃতদাস।
--------------------------------------------
একলা জেলে বন্দী তিনি
একলা জেলে বন্দী তিনি
শোনেন, দূরে চিড়িয়াখানায়
বাঘ ডাকছে। আবার কখন
বাঘের ডাককে ছাড়িয়ে যায়
একশো গাধার জয়ধ্বনি
দিনদুপুরে---শোনেন তিনি।
শুনতে শুনতে ভাবেন তিনি
বাঘের তাতে কী আসে যায়?
মানুষের বা কী আসে যায়?
--------------------------------------------
মহান নেতৃবৃন্দ
তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত "চাচা
আপন বাঁচা"-র ধ্রুপদী চলচ্চিত্র ;
যদিও নিজেকে সে তুলতে চায় সে মাচায়,
ভুলে যায়, যারা গতকাল ছিল মিত্র
এখনো পচছে খাঁচায়...
কিন্তু সে বেপরোয়া।
"আগে নিজে বাঁচো, তবে আকাশ ছোঁয়া
পাহাড়ে উঠবে।" বলেছেন নাকি লেনিন :
বেনামে স্তালিন, স্বপ্নে মাও সে তুং :
"জাহান্নামে যে যাবে, তাকে যেতে দিন---
আবার আসবে বদলা নেবার দিন।
মহান নেতৃবৃন্দ! যে মরে মরুক, আপনারা
. সুখে বাঁচুন।|"
--------------------------------------------
ফুটপাথের কবিতা : এক
ন্যাংটো ছেলে আকাশে হাত বাড়ায়।
যদিও তার খিদেয় পুড়ছে গা
ফুটপাতে আজ লেগেছে জোছ্না---
চাঁদ হেসে তার কপালে চুমু খায়।
লুকিয়ে মোছেন চোখের জল, মা।
--------------------------------------------
সবাই চাইছে
রাজত্ব, আর
সবাই লিখেছে
দারুণ গল্প।
সেই শুধু ফুট-
পাথের ন্যাংটো
ছেলে, তাই তার
বুদ্ধি অল্প---
দূর থেকে তাই
দেখেছে দৃশ্য,
দেখছে এবং
দিচ্ছে সাবাস!
--------------------------------------------
ন্যাংটো ছেলে আকাশ দেখছে
ঘর ফুটপাথ
আহার বাতাস,
ন্যাংটো ছেলেটা
দেখছে আকাশ।
সেখানে এখন
টেক্কা সাহেব
বিবি ও গোলাম---
রাজ্যের তাস
সবাই ব্যস্ত ;
সবাই করছে
চাঁদ-সূর্য ও
তারাদের চাষ ;
*
ফুটপাথের কবিতা : দুই
পেটের আগুন খিদে
হাঁটতে শিখছে।
লার রক্ত খিদে
পৃথিবী দেখছে!
হাতদুটি তার খিদে
কেবল বলে : "দে!"
পা দুটি তার খিদে
পৃথিবী গিলছে।
--------------------------------------------
আকাল
সারাবছর অমাবস্যা, সারাবছর
"নেই বৃষ্টি"-র অন্ধকার
এ কোন্ বসুন্ধরা আমার, শোনাস্
বারমাস্যা মাটির হা---হা!
গাঁয়ের মানুষ মাঠে যায় না, শুকনো কুয়ো
জল দেয় না--- সারা বছর
হাতের মুঠোয় কান্না ছাড়া আর কিছু নেই ;
সন্ধ্যাবাতি না জ্বলতেই রাজ্যি জুড়ে
শেয়াল ডাকে!
নাকি মানুষ, দিনের আলোয় যাদের দেখলে
পুলিশ পালায়? ঘুমের মধ্যে তারা আসে,
স্বপ্নে আসে সমস্ত রাত!
ফুল্লরা। তুই বুকের জ্বালা বলবি কাকে?
কে শুনতে চায় একটার পর একটা অসুখের গল্প, যখন
রাত ফুরলে দিন আসে না---শুধু আকাল, শুধু শ্মশান---
শ্মশান জুড়ে ভুতের নৃত্য। যাকে জানতি সূর্য্যি ঠাকুর
সে এখন ডাকাতের রাজা। আকাশ খেয়ে, মাটি খেয়ে
তার খিদে মেটে নি---এবার তোদের খাবে।
--------------------------------------------
ক্রোধ যা অগ্নির মতো
ক্রোধ যা অগ্নির মতো
আমাকে দিও না আর
ঘৃণা যা অগ্নিতে ঘৃত
আমাকে দিও না আর।
আমার যজ্ঞের ঘোড়া
নিয়ে যাক যুবকেরা
বাঘের সাহস চোখে
আগুনে হাঁটুক তারা।
আমার বয়স গেছে
আমার সাহস গেছে
যে প্রেম অপ্রেমে জ্বলে
সে আমাকে ছেড়ে গেছে।
আমার পৃথিবী থেকে
যুবকেরা চলে গেছে
যেখানে জীবন আছে
যেখানে কবিতা আছে...
--------------------------------------------
এখন সন্ধ্যা নেমেছে
যাঁরা এলেন, তাঁদের আমি চিনি না
তাঁরা আমাকে স্পর্শ ক'রে বললেন, "তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।"
যাঁদের চিনি তাঁরা কেউ আজ আসেন নি।
এখন আকাশে সন্ধ্যা নেমেছে, একটি দু'টি তারা
দেখা যাচ্ছে।
আমি প্রতীক্ষা করছি যে-কোনো চেনা-মুখের জন্য!
--------------------------------------------
ঠাকুরপুকুর হাসপাতালে
এ লড়াই মৃত্যুর সঙ্গে মানুষের
আর হার-জিত দুটো কথাই যখন অভিধানে রয়েছে
বিনা যুদ্ধে কেউ কাউকে মাটি ছেড়ে দেবে না।
শুধু ডাক্তার আর নার্সরাই নন
যাদের নামের পিছনে মৃত্যুর পরোয়ানা ঝুলছে
তারাও জানে, এখানে পিছন-হটার কোনো কারন নেই।
মৃত্যুকে হটিয়ে দেবার কঠিন সংকল্প নিয়ে
তারাও এখানকার মাটিতে, ঘাসে, পায়ের ছাপ রেখে যায়।
কেউ কেউ বাড়ি ফেরে না, কিন্তু যারা ফেরে, তাদের
কণ্ঠে আমরা শুনতে পাই নবজীবনের গান।
--------------------------------------------
তারপর
পাখি উড়ে যায়,
তারপর
ফুল যায় ঘুমুতে।
সুখে থাকার পৃথিবী
পড়ে থাকে
কালো মানুষের স্বপ্ন,
ছেঁড়া কাঁথা গায় দিয়ে
ধূলোয়।
অনেক দূর থেকে
বাতাসে তখনও শব্ দ
ভেসে আসে :
"সুখে থাকো"।
আর গন্ধ ভেসে আসে,
ভাতের।
--------------------------------------------
শীত
"সুখে থাকো"!---
বলে পাখি,
বলে ফুল।
কাকে বলে?
এখন বাতাসে
শীত,
এখন মাটিতে
শীত।
ফুটপাথের ন্যাংটো ছেল,
তার শীত নেই
কিন্তু খিদে আছে ;
কিংবা খিদে তার শীতকেও
চায়
গিলে খেতে...
পাখি দূর থেকে
তাকে দেখে,
ফুল দূর থেকে
তাকে দেখে।
উলঙ্গের স্বদেশ
The proletariat has nothing to loose but his chains.
. --- Communist Manifesto
এক অদ্ভুত মাটির উপর
আমরা দাঁড়িয়ে আছি ;
অর্থাৎ দাঁড়িয়ে থাকার জন্য
প্রাণপণ চেষ্টা করছি
এ মাটির গর্ভে কী আছে
আজও আমাদের জানা নেই
যদিও কান পাতলে শুনতে পাওয়া যায়
এক লক্ষ সাপের গর্জনের চেয়েও
কোন ভয়ঙ্কর পরিণাম, যা ক্রমেই আসন্ন হচ্ছে।
কিন্তু আমরা এক পা-ও এদিক ওদিক
নড়ছি না ; যেন স্থির দাঁড়িয়ে থাকাই
আমাদের নিরাপত্তা, এবং তা সম্ভব। আমরা গির্জার গম্বুজগুলির
এবং স্টক এক্সচেঞ্জের চার দিকের বিরাট স্তম্ভগুলির দিকে
বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থেকে
এক সময় ঈশ্বরের মহিমাকে জানতে পারছি
আর এই কথা ভেবে নিশ্চিন্ত হচ্ছি---
আমাদের স্বদেশ স্বাধীন এবং তার সীমান্তে
বন্দুকধারী প্রহরীরা প্রত্যহ টহল দিচ্ছে।
যদিও পায়ের নিচে মাটি এখন অগ্নিগর্ভ ;
যদিও আমাদের মাথার উপর আকাশ বলতে কিছুই নেই।
--------------------------------------------
নীরেন, তোমার ন্যাংটো রাজা
নীরেন! তোমার ন্যাংটো রাজা
পোশাক ছেড়ে পোশাক পড়েছে!
নাকি, তোমার রাজাই বদলেছে?
সেই শিশুটি কোথায় গেল
যেই শিশুটি সেদিন ছিল?
নীরেন, তুমি বলতে পারো,
কোথায় গেল সে?
নাকি, তুমি বলবে না আর ;
তোমার যে আজ মাইনে বেড়েছে!
হেইও হো! হেইও হো!
পোষাক ছাড়া নীরেন, তুমি,
তুমিও ন্যাংটো।
কিন্তু ঘরে তেমন একটি
আয়না রাখে কে?
এই রাজা না, ঐ রাজা না।
তুমিও না ; আমিও না।
হেইও হো! হেইও হো!
পোষাক ছাড়া নীরেন, আমরা,
সবাই যে ন্যাংটো।
আমরা সবাই রাজা আমাদের এই
রাজার রাজত্বে!
কিন্তু তুমি বুঝবে কি আর ;
তোমার যে ভাই, মাইনে বেড়েছে!
-------------------------------------------
আর এক মহিষাসুর
অসুর রে। তুই যাত্রাদলে যেই লেখালি নাম,
হলি মহিষাসুর, সে কী তিড়িং নাচ তখন তোর ;
বাপ রে সে কী ভয়-দেখানো সার্কাসের খেলা !
যতই বাড়ে বেলা, ততই মেজাজ তোর চড়া ,যেন
এর মুন্ডু খসাবি, ওর চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাবি !
আমরাভাবি কোথায় পালাই,এমনি তোর হুলস্থুল কান্ডকারখানা !
তোকে করবে মানা,কারুর নেই এমন বুকের পাটা-
তুই যে বাপের ব্যাটা । পরের হাড় কড়মড় করে খাওয়াই
. ধর্ম তোর,সেই তোর ছৌ-নাচ!
সূর্য় অস্ত গেলে বুঝি এবার শান্তি-কিন্তু তুই স্বয়ং অশান্তি;
হুঙ্কারে তোর গাছগুলিও পাথর,কোলের শিশু কান্না ভুলে
. কঠিন কাঁপতে থাকে-
গাঁয়ের মানুষ যে-যার ঘরে দরজা দিয়ে সমস্ত রাত জেগে কাটায় !
যতক্ষণ না ফুরায় তোর স্পর্ধা,তোর সার্কাস,তোর মুখোস নাচের বাহাদুরি-
যতক্ষণ না পাড়ার থুথ্বুড়ে বুড়ি তোর দু’গালে চড় ক’ষিয়ে
বলে তোকে হারামজাদা! এবার ঘুমুতে যা !
--------------------------------------------
বক্তৃতা বাবু
হেই বক্তৃতা বাবু! তুই হুই শহরের সাততলা বাড়ী থেকে
নামলি মাচায়, এলি গাড়ী চড়ে মিটিং করতে
আমাদের শরীরের কালো রঙ সাবান মাখিয়ে ফর্সা করতে,আমাদের
. ছেলেমেয়েদের ভালো,সভ্যকরতে ;
এলি যেন লাটসাহেবের নাতি! বক্তৃতা দিয়ে যাবিও সেখানে---
কল টিপলেই জল পড়ে। ঘর আলো হয় ঘুটঘুটে কালো রাতে;
আবার বিজলি পাখাও ঘোরে- বক্তৃতা দিয়ে শরীরে যদি ঘাম
. লাগে তোর, বক্তৃতা বাবু!
তুই বড় ভালো ছেলে। আমাদের জন্য কত যে খাটিস-পিটিস!
কেবল ঘরের বিজলী পাখাটা বন্ধ হলেই মেজাজ গরম;
জলকে বরফ করার যন্ত্র-সেটাও বিকল!
তুই না রাজার বেটা! রেশনে চাল ছেড়ে দিয়ে খাস বাসমতী চাল-
তবু আমাদের জন্য রাত্রে ঘুমাস না তুই ; আহারে সোনার বাবু!
--------------------------------------------
প্রতিবাদ
এভাবে মানুষ নিয়ে খেলা
মানুষের স্বপ্ন সাধ বিশ্বাস সন্মান নিয়ে
মানুষের মস্তিস্ক হৃদয় নিয়ে
হৃৎপিণ্ড ধমনী রক্ত অস্থি নিয়ে খেলা
চক্ষু জঠর গর্ভ পৌরুষ মাতৃত্ব নিয়ে খেলা
গর্ভের সন্তান আর তারও পর যারা আসবে
আর যারা ইতিমধ্যে হামাগুড়ি দিচ্ছে,বইখাতা নিয়ে স্কুল কিংবা কারখানায়
যে-সব শিশু বালক-বালিকা,
স্বাধীন দেশেই যারা জন্মেছে, স্বাধীন দেশে জন্মাবে,
তাদের স্বাস্হ্য ঘরবাড়ি পড়াশুনা নিয়ে
তাদের মুখের ভাত নিয়ে এই খেলা
জন্মভূমি নিয়ে, দেশের নগর গ্রাম খামার কারখানা নিয়ে
দেশের সীমান্ত নিয়ে,দেশের ভিতর
পোস্টাপিস রেলগাড়ী রাস্তাঘাট হাসপাতাল স্কুল-কলেজ নিয়ে
দেশের ভূগোল ইতিহাস বিঞ্জান সাহিত্য নিয়ে
গান নিয়ে, ছবি নিয়ে,নুন আর রুটি নিয়ে
দেশের আকাশ জল মাটি আলো অন্ধকার নিয়ে
এই খেলা, এই ভয়ঙ্কর খেলা
এর চেয়ে আর কী নরক,স্বাধীন স্বদেশ।
--------------------------------------------
স্বদেশপ্রেমের দীপ্ত মহিমায়
কে তুমি হে! দেবদারু বীথিতেও গন্ধ পাও কালো পুলিশের ?
তোমার অসীম স্পর্ধা ! জাননা কি এখন স্বদেশ
ভিতরে বাহিরে নিস্প্রদীপ, তার বাতাসে বিষের ধোঁয়া
কে তাকে বাঁচাতে পারে যদি না পুলিশ ঢালে বৃক্ষের শিকড়ে গ্যালন
. গ্যালন রক্ত?
কার রক্ত-নির্বোধের মতো প্রশ্ন কর তুমি । দুধ-কলা দিয়ে পোষা
সাপ তার । দেবশিশু তোমার চোখের ভ্রম ! ওরা কেউ শিশু নয়,জানে
. তা পুলিশ,জানে দিল্লীর ঈশ্বরী।
তুমি অন্ধ! তাই গাছের পাতায় কালো ছায়া দেখ, গোলাপেও পুলিশের
গন্ধ পাও, যে-সুবাস পবিত্র,নিহত পশুর রক্ত। যার চোখ আছে,দ্যাখে
কলকতায় পার্কে ময়দানে রাজভবনে অথবা এঁদো গলির
. বস্তির মুখ আলো ক’রে
যেখানে যা বৃক্ষ আছে, ঈশ্বর-প্রতিম তারা,স্বদেশ-প্রেমের দীপ্ত মহিমায়
. জ্বলে যেন ত্রিবর্ণ পতাকা!
--------------------------------------------
শান্তি, ওঁ শান্তি
-
শান্তি,ওঁ শান্তি! তুমি সর্বত্র বিরাজো
পশ্চিম বাংলার পীঠস্থানে ।
আহা! সম্রাটের মহিমায় তুমি সাজো
যা অশান্তি, অবাধ্যতা তোমার চরণতলে পিষ্ট করতে যুগ সন্ধিক্ষণে !
আমাদের সন্তানের মুন্ডুহীন ধড়গুলি তোমার কল্যাণে ঘোর
. লোহিত পাহাড় ;
আমরা সেই পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে গাইব উলঙ্গের স্বদেশ-বন্দনা ;
‘শান্তি, ওঁ শান্তি! তুমি কি বাহার সেজেছ বাহার’
আ মরি পশ্চিম-বাংলা ! তোর রক্তে স্বদেশের নিরাপত্তা,ঘরে ঘরে
. সোনার আলপনা !
--------------------------------------------
রাস্তায় যে হেঁটে যায়
রাস্তায় যে হেঁটে যায়
জানে কি সে, কার এই রাস্তা ? এ শহর
কার? এই দেশ ......
নাকি ভাবে সবার ! এ রাজপথ
রাজার এবং ভিক্ষুকের । এ রাজপথ
রাজার এবং ভিক্ষুকের । এই দেশ
ইন্দিরার, এবং যে জেলখানায় রাত কাটায়,তার......
চোপ রও,উল্লুকের বাচ্চা !বাঁচতে চাও,
এই রাস্তা ছেড়ে হাঁটো !বাঁচতে চাও,
ভুলে যাও এই শহরের নাম ! এই দেশ
ফুটপাতে শুয়ে থাকা উলঙ্গের ;
কিন্তু যে উলঙ্গ আকাশের দিকে মাথা রেখে জেগে থাকে, তার নয়।
--------------------------------------------
হওয়া না-হওয়ার গল্প
কাব্যগ্রন্থঃ "আর এক আরম্ভের জন্য"
সে চেয়েছিলো
একটি সত্যিকারের প্রেমের কবিতা লিখতে।
তার তো
একটাই জীবন। মানুষের জীবনে প্রেমের চেয়ে নির্মল
পিপাসার জল আর কী থাকতে পারে?
সে আরও অনুভব করতো
প্রেমই কবিতার প্রাণ, তার শব্দ, তার ধ্বনি –
তার মন্ত্র।
কিন্তু তবু
তার কবিতা, একটার পর একটা তার নিজের লেখা কবিতা
কি প্রেম কি জল
এমনকি পায়ের নিচের শক্ত মাটি পর্যন্ত খুঁজে পেলো না।
কবিতার জন্য তার দিবস-রজনীর জাগরণ
যা ছিলো তার জীবনের কঠিনতম সত্য
প্রেম নয় – তাকে বারবার অপ্রেমের দারুণ আগুনে ছুঁড়ে দিয়ে
বলতোঃ ‘এখানেই তোর পরিশুদ্ধি। এই যে আগুন, মানুষের পৃথিবী
আগে তার খিদে মেটা। তোর সমস্ত কবিতা, তোদের সমস্ত কবিতা
সে তার ক্ষুধার্ত জিভ দিয়ে চেটে খাবে। তুই মুর্খ,
জীবনের পাঠ এখান থেকেই শুরু কর।‘
দেখতে দেখতে তার কৈশোর গেল, যৌবন গেল,
এখন তার মাথার সব চুল সাদা, হাতের পাঁচ আঙুলে মাঘের শীত!
মাঝেমধ্যেই রাতদুপুরে ঘুমুতে না-পারার যন্ত্রণায়
সে চিৎকার করে উঠতোঃ
‘আমি একটি প্রেমের কবিতা লিখতে চাই, মাত্র একটি প্রেমের কবিতা।‘
আর তখনই শোনা যেত তার মাথার ভিতর, তার বুকের মধ্যে
সেই কঠিন তিরস্কারঃ
‘বুড়ো হয়ে গেলি, এখনও স্বপ্ন দেখছিস!
দ্যাখ! ভাল করে দ্যাখ! তোর চারদিকে
এখন হলুদ হেমন্তের পৃথিবী। কিন্তু তারপর?
তারপর কী দেখছিস? – ধান কাটা হয়ে গেছে, চাষীরা ঘরে ফিরে যাচ্ছে...
কিন্তু মাঝখানে ও কে? ওরা কারা?’
দেখতে দেখতে তার পাকা ধানের হলুদ পৃথিবী খুনখারাপি লাল,
লাল থেকে আগুন! আবার আগুন! ‘আগুন! তুমি আমাকে
সারা জীবন ধরে পুড়িয়েছ। কিন্তু আমি তো
শুদ্ধ হলাম না। শুধু পুড়ে গেলাম। আমি সারা জীবন
শুধু হাজার হাজার মানুষের দীর্ঘশ্বাস, তাদের সর্বনাশ
আমার জটায় বেঁধে সরস্বতী-নদীর জলে ঝাঁপ দিতে গেলাম,
কোথাও তাকে খুঁজে পেলাম না। তুমি আমাকে কী জীবন শেখাও, আগুন? –
এই কি মানুষের জীবন!’
তার একটিমাত্র প্রেমের কবিতা? ... ‘কবিতা! তুমি এখন
তিন ভুবনের কোন্‌ অতলান্ত অপ্রেমের মধ্যে ঘুমিয়ে আছ?
ঘুমাও! তুমি ঘুমাও! আর, আমি জেগে থাকি
আর এক আরম্ভের জন্য... মৃত্যুর মুখোমুখি... আমি জেগে থাকি...
--------------------------------------------
মুখোশ ২
কাব্যগ্রন্থঃ "সভা ভেঙে গেলে" (১৩৭১)
তোমার কি কখনো এ কথা
মনে হয়নি, আসলে মুখোশ
মোটেই বাইরের নয়। বরং ভিতরে
যাকে আমরা সত্যিকারের মুখ ভাবি
তোমন কিছুই মানুষের নেই।
চেষ্টা করো মুখোশ ছিঁড়তে ;
তোমারই আঙুল বেঁকে যাবে, তবু
দৃশ্য বদলাবে না।
.................
শেয়ার করেছেন : - প্রণব কুমার কুণ্ডু

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন