মহম্মদ রফি ও কিশোর কুমার
ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন প্রণব কুমার কুণ্ডু
হৃদয়ের রাজা মহম্মদ রফি কি প্রতিদ্বন্দ্বী কিশোর কুমারকে হিংসে করতেন ?
সময়টা সত্তরের দশক | মহম্মদ রফির জনপ্রিয়তা কমছে | কিশোর কুমার উঠে আসছেন | শচীন দেব বর্মনের জমানা শেষ | ছেলে রাহুল দেব বর্মন জাকিয়ে বসেছেন | তিনি নরম গলার রফিকে খুব একটা পছন্দ করতেন না | তার পছন্দ রাফ এন্ড টাফ গলার কিশোর কুমারকে | সব দেখেও শচীন কর্তা কিচ্ছু বলতে পারছেন না | এদিকে মনে মনে গুমরাচ্ছেন রফি | ‘আরধনা’ হিট করতেই সবাই রাজেশ খান্নাকে মাথায় নিয়ে নাচছে | সুপার স্টার-এর সিংহাসনে বসেই রাজেশের ফতোয়া, রফি নয় তার লিপের সব গান কিশোর গাইবেন | শুনে কষ্ট পেলেন বর্মন কর্তা | মন খারাপ রফির | শেষে আর থাকতে না পেরে বর্মন সাহাব ছেলেকে বললেন, ‘একবার রফিকে গান দিয়ে দেখ-ই না | ও পারবে.’ বাবার কথা ফেলতে না পেরে পঞ্চম, রফি সাহাবকে ডেকে ‘শান’ ছবির ‘ইয়াম্মা ইয়াম্মা’ গান দিয়ে বললেন, ‘গাইতে পারবেন?’ চুপচাপ বাড়ি ফিরে এলেন রফি | গোটা দিন ভাবলেন | পরের দিন ষ্টুডিও এসে গান রেকর্ডিং করলেন | গান সুনে রাহুল চুপ |‘ইয়াম্মা ইয়াম্মা’ সুপার হিট | এই ছিলেন মহম্মদ রফি | কম কথার মানুষ | ভীষণ নরম, ভদ্র |নিজের কাজ দিয়ে যা জবাব দেওয়ার, দিতেন |
ব্যক্তি মহম্মদ রফি কেমন ছিলেন? নিতান্ত ছাপোষা,আটপৌরে | একই সঙ্গে সামান্য রক্ষনশীল | রফির আমলে পাপারাৎজিদের হামলা ছিল না | তাই, ব্যক্তি জীবনে রফি কেমন ছিলেন, খুব কম লোকেই তা জানত | রফির মৃত্যুর পর জেসমিন, রফির দ্বিতীয় পুত্রবধু শ্বশুরমশাইকে নিয়ে লিখেছিলেন ‘মাই আব্বা মহম্মদ রফি ’ সেখানে ছোট ছোট ঘটনায় জেসমিন ছবি আঁকার চেষ্টা করেছেন শিল্পীর অন্তর্মুখী সত্তার |
জেসমিনকে মহম্মদ রফি যখন প্রথম দেখেছিলেন তখন জেসমিনের বয়স কত হবে? এই পনেরো কি ষোল! বলিউড-এর সেলিম-জাভেদ জুটির সেলিম খান ওই পুচকে মেয়ের চাচা | রফি সাহেবের ছেলের জন্য বিয়ের সম্বন্ধ এনে ছিলেন উনি | তখন অল্প বয়সেই শাদী হত অনেকেরই | তাই জেসমিনের বাড়ির লোক খুব একটা অবাক হননি | পাত্র আর তার বাড়ির লোকের কথা শোনার পর চোখ কপালে মেয়ের! চাচা কার বাড়িতে পাঠাচ্ছেন তাকে? মহম্মদ রফির বাড়ি! যার গান শুনে সে বড় হয়েছে! যার গলার রোম্যান্টিশিজম তাকে প্রেম করতে শিখিয়েছে! সে কিনা যার অন্ধ ভক্ত!
খবরটা কানে আসার পর থেকেই কেমন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে কাটল জেসমিনের | তার মত সামান্য মেয়েকে রফি সাহাবের পছন্দ হবে? তারপর হঠাৎ চাচা একদিন হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বললেন, ‘শিগগির তৈরী হয়ে নে জেসমিন | রফি সাহাব আসছেন তোকে দেখতে |’ ষোলো বছরের ছোট মেয়েটা ঘেমে-নেয়ে অস্থির | একে স্বপ্নের মানুষের মুখোমুখি এই প্রথম | কেমন সাজলে তার পছন্দ হবে! এত রোমান্টিক গলা যার, তিনি নিশ্চয় মারাত্মক সুন্দর হবেন | তার মন পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা? জেসমিন ভুলেই গেছিলেন, বিয়েটা রফি সাহাবের দ্বিতীয় ছেলে খালিদের সঙ্গে হচ্ছে | রফি সাহাবের সঙ্গে নয়!
যাই হোক, নির্দিষ্ট দিনে জেসমিন মনের মত করে সাজলো | অনেক বেছে নরম গোলাপী শিফনের শাড়ি পড়ল | গলায়, কানে, হাতে মুক্তর হালকা গয়না | রফি এলেন খালিদ আর বাড়ির অন্য লোকেদের নিয়ে | প্রথমে বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা সারলেন | তারপর ডাক পড়ল জেসমিনের | গোলাপী শাড়ি-গয়নায় জেসমিন যেন সদ্য ফোটা জুই! রফি-র মুখোমুখি হতেই আতকে উঠলো বছর ষোলোর মেয়ে | কোথায় কার্তিকের মত চেহারা? এ তো একদম পাশের বাড়ির কাকু! জেসমিন ততক্ষণে ঠিক করে ফেলেছে খালেদকে কিছুতেই বিয়ে করবে না | এমন সময় সেই রোমান্টিক গলা প্রশ্ন করলো, আমাদের বাড়িতে শাড়ির সঙ্গে লম্বা হাতার ব্লাউজ পরা হয় | তুমি তেমনটা পরবে তো? সাপের মাথায় যেন ধুলো পড়ল | এই গলাকে অগ্রাহ্য করে কি করে জেসমিন? পুতুলের মত ঘাড় নেড়ে জানালো, পারবে | সঙ্গে সঙ্গে মায়াবী গলার মালিক মৃদু হেসে জানালেন, আমরা রাজি | এবার আপনাদের পালা!
এ তো গেল বিয়ের আগে শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে বৌমার পয়লা মোলাকাতের গপ্পো | বিয়ের পর কি হলো? অনেক স্বপ্ন নিয়ে জেসমিন শ্বশুর ঘরে এসেছেন | যত না আগ্রহ নিজের স্বামীকে নিয়ে তার ডাবল শ্বশুরকে ঘিরে | বিয়ের আগে শুনেছিলেন, কত ফিল্ম স্টার নাকি দুবেলা আসেন বাড়িতে | যাদের পর্দায় দেখতেন তাদের এবার বাড়ি বসে জ্যান্ত দেখতে পাবেন, ভাবতেই আল্হাদে আঠখানা জেসমিনের মন| কনে বউ হয়ে পা রাখতেই সেই স্বপ্নে জল ঢেলে দিলেন রফি | খুব মৃদু কিন্তু দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিলেন, বাইরের মানুষের সামনে হুটহাট বেরোনো চলবে না | বিশেষ করে ফিল্মি দুনিয়ার লোকজনের সামনে | জেসমিনের মাথায় হাত | হায় হায়! এ কোন ঘরে এসে পড়লেন! যিনি সারাক্ষণ প্রেমের গান গাইছেন তিনি আদতে এতটাই প্রাচীনপন্থী! জেসমিনের আশা, একদিন গান রেকর্ডিং দেখতে যাবেন | তাতেও জল ঢাললেন রফি জেসমিনের বাবার বাড়ির লোককে রেকর্ডিং দেখিয়ে আনলেন | তবু বৌমাকে নিয়ে গেলেন না!
শ্বশুরবাড়িতে আসতে আসতে পুরনো হলেন জেসমিন | রফি সাহাব তখন শ্বশুর কম, বাবা বেশি | জেসমিনকে ‘বহু’-র বদলে ‘বিটিয়া’ বলে ডাকছেন | একদিন বিকেলে জেসমিন বাড়ির সামনের রাস্তায় পায়চারী করছেন | দেখলেন, ক্লান্ত পায়ে রফি গাড়ি থেকে নামলেন | জেসমিন পায়ে পায়ে গিয়ে দাড়ালেন শ্বশুর-এর সামনে | তাকে দেখে রফির গলা থেকে একরাশ ব্যথা ঝরলো, ‘বিটিয়া, ওরা বড্ড খারাপ | এক তো আমায় দিয়ে উল্টোপাল্টা গান গাওয়াচ্ছে | তার ওপর বলে কিনা আমি কিশোরকে হিংসে করি! সত্যি আমি এত ছোট মনের?’
কি বলবেন জেসমিন! তিনি নিজের চোখে দেখেছেন, কিশোরজিকে ডেকে তার আব্বা কত প্রসংসা করেছেন! বলেছেন, ‘তুমি গায়ক-নায়ক | তুমি স্টেজ-এ গাইলে আরো নাম করবে |’ এদিকে খবরের কাগজে ফলাও করে ছাপছে দুজনের মিথ্যে ঝগড়ার কথা! সেদিন রফি তার বিটিয়া-কে বলেছিলেন, ‘এবার বুঝতে পারছ, কেন ফিল্মি দুনিয়ার আশপাশে তোমায় যেতে দিইনি!’ রেকর্ডিং-এ না নিয়ে যাওয়ার অনেকটা ক্ষোভ অনেকটা অভিমান জমে ছিল জেসমিনের মনে | রফির সেদিনের কথা শোনার পর জেসমিন বুঝেছিলেন, মহম্মদ রফি আগে ‘আব্বা’ পরে ‘তারকা’| তাই সংবেদনশীল মানুষটি পরিবাব্রের গায়ে যাতে আঁচ না লাগে তার জন্যই সারাক্ষণ আগলাতেন ওরকম করে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন