সূর্যঘড়ি
ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন প্রণব কুমার কুণ্ডু
সহজেই বানাতে পারেন সূর্য্যঘড়ি
সঙ্গের ছবিতে মারবেল পাথরের তৈরী একটি সূর্য্যঘড়ি দেখতে পাচ্ছেন। এটি আমাদের বাঁকুড়া শহরের (পশ্চিমবঙ্গ) বাড়ীর ছাতের প্যারাপিটের উপর স্থাপিত।এই ঘড়ির গোল ডায়েলটা মারবেল পাথরের তৈরী। ডায়েলের কেন্দ্রে যে কালো রঙের লোহার পেরেকটিকে দেখছেন সেটিকে নোমন (gnomon), ধ্রুব বা শঙ্কু বলে। এটিকে ধ্রুবতারার দিকে রাখতে হবে, তাহলেই আকাশে সূর্য্য সানডায়েলের সমান্তরালে নোমনকে (ঐ পেরেকটিকে) অক্ষ করে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় এক পাক খাবে। সূর্য্যের আলোয় নোমনের যে ছায়া পড়বে (তাকে বাহু বলে) সেটি ডায়েলের উপর ২৪ ঘণ্টায় এক পাক (ঘণ্টায় ১৫ ডিগ্রী হারে) খাবে। ঐ ছায়াবাহু সূর্য্যঘড়ির কাঁটার (hand-এর) কাজ করবে। রাতে এই ঘড়ি কাজ করবে না সেকথা বলাই বাহুল্য। এইজন্য ডায়েলে কালো কালি দিয়ে শুধু ১২টি ঘরই আঁকা হয়েছে। সর্ব্বনিম্নের ঘরটা দুপুর ১২টার ঘর, সূর্য্য তখন আকাশের সর্ব্বোচ্চ স্থানে। পাশাপাশি ২টি ঘণ্টার ঘরের ব্যবধান সর্ব্বদা ১৫ ডিগ্রী হবে, কারণ সূর্য্য আকাশে প্রতি ঘণ্টায় ১৫ ডিগ্রী করে ঘোরে (২৪ ঘণ্টায় ৩৬০ ডিগ্রী)। সূর্য্যের এই দৃশ্য দৈনিকগতি প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর আহ্নিকগতির জন্য হয়।
মৎপ্রণীত পদ্যাভিধান 'বর্ণসঙ্গীত' গ্রন্থের 'ধ্রুব' পদাবলীতে ধ্রুব শব্দের অর্থ বলতে গিয়ে সূর্য্যঘড়ির প্রসঙ্গ এসেছে, কারণ ধ্রুব শব্দের একটি অর্থ হল সূর্য্যঘড়ির নোমন (এছাড়া ধ্রুব মানে নিশ্চল, ধ্রুবতারা, শিব ইত্যাদি হয়)। সেখান থেকে প্রাসঙ্গিক অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃত করছি :
''সূর্য্যঘড়ির নোমন অথবা শঙ্কুকে ধ্রুব কয়,
ধ্রুবতারাটির দিকে সেই ধ্রুব স্থাপন করিতে হয়।
সেই ঘড়ি দিনে বলে যে সময়, রাতের বেলায় নয়;
সূর্য্যঘড়িটি দেখিয়া স্থানীয় সময় জানিতে হয়।
ধ্রুবতারাটির দিকে সেই ধ্রুব স্থাপন করিতে হয়।
সেই ঘড়ি দিনে বলে যে সময়, রাতের বেলায় নয়;
সূর্য্যঘড়িটি দেখিয়া স্থানীয় সময় জানিতে হয়।
সূর্য্যঘড়ির ধ্রুবকে অক্ষ করিয়া সূর্য্য ঘোরে;
ডায়েলেতে পড়ে সে ধ্রুবর ছায়া, বাহু বলা হয় তারে।
সে বাহুর গতি বলে যে সময় ঘড়ির কাঁটার প্রায়,
ধ্রুব শঙ্কুকে অক্ষ করিয়া খ-গোল ঘুরিয়া যায়।'' --- 'বর্ণসঙ্গীত'।
ডায়েলেতে পড়ে সে ধ্রুবর ছায়া, বাহু বলা হয় তারে।
সে বাহুর গতি বলে যে সময় ঘড়ির কাঁটার প্রায়,
ধ্রুব শঙ্কুকে অক্ষ করিয়া খ-গোল ঘুরিয়া যায়।'' --- 'বর্ণসঙ্গীত'।
আকাশ সূর্য্য যেমন ঘুরতে থাকে (পৃথিবীর আহ্নিকগতির জন্য) তার বিপরীত দিকে নোমনের ছায়া তত সানডায়েলের উপর পাক খায়। তবে একটা কথা এখানে বলে রাখা দরকার। ছবির ডায়েলের উত্তর দিকের তলটায় নোমনের ছায়া পড়বে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬ মাস মাত্র। বাকী ৬ মাস (সূর্য্যের দক্ষিণায়নের সময়) ছায়াটা মারবেলের প্লেটটার উল্টা দিকে পড়বে। সেই দিকটাতেও দাগ কেটে নিলে এই ঘড়ি সারা বছর সময় দেবে (আমার বাড়ীর সূর্য্যঘড়িতে তাই করা হয়েছে)। কবে নোমনের ছায়াটা ডায়েলের এক দিক থেকে অন্য দিকে গেল, তাই দেখে বিষুবদিনও (equinoxes) নির্ণয় করতে পারবেন।
সূর্য্যঘড়িকে দ্রাঘিমা নির্ণয়ের কাজে ব্যবহার করতে পারবেন। আপনার হাতঘড়ির সময় ভারতীয় প্রমাণ সময় (IST) এবং সূর্য্যঘড়ির সময় আপনার স্থানের স্থানীয় সময় (local time)। দুই সময়ের ফারাক থেকে আপনার স্থানের দ্রাঘিমা (কথাটা 'দ্রাঘিমাংশ' নয়) নির্ণয় করতে পারবেন। আর ধ্রুবতারার উন্নতি কোনটা (নোমনের সঙ্গে অনুভূমিক রেখার কোণ) মাপলেই আপনার স্থানের অক্ষাংশ পাবেন।
আপনারা সবাই খুব সহজেই নিজের বাড়ীতে একটি সূর্য্যঘড়ি বানাতে ও স্থাপন করতে পারবেন। শিক্ষকশিক্ষিকারা স্কুলপ্রাঙ্গণে এইরকম সূর্য্যঘড়ি স্থাপন করতে পারেন। ইহা আনন্দদায়ক ও শিক্ষাপ্রদ।
এটা সূর্য্যঘড়ির সহজতম মডেল। আরও নানা মডেলের সূর্য্যঘড়ি হয়, যথা অনুভূমিক সূর্য্যঘড়ি। প্রসঙ্গত, হুগলীর ইমামবাড়ায় একটি অনুভূমিক সূর্য্যঘড়ি আছে। সেই ঘড়ির গাণিতিক তত্ত্ব একটু শক্ত এবং এখানে সেই আলোচনা করা সম্ভব নয়। সূর্য্যঘড়ি সম্বন্ধে আরও বিশদে জানতে হলে বর্ত্তমান লেখকের 'প্রাথমিক জ্যোতির্বিজ্ঞান' গ্রন্থ দ্রষ্টব্য। উক্ত বইয়ে অনুভূমিক সূর্য্যঘড়ির গাণিতিক তত্ত্বও পাবেন। ধন্যবাদ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন