রবিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৮

Snehashis Mukherjee'র তারেই খুঁজে বেড়াই : দশম পর্ব শ্রীচৈতন্যের রহস্যজনক অন্তর্ধান


Snehashis Mukherjee'র   তারেই খুঁজে বেড়াই :  দশম পর্ব র্শ্রীচৈতন্যের  রহস্যজনক অন্তর্ধান

ফেসবুক থেকে     শেয়ার করেছেন               প্রণব কুমার কুণ্ডু

তারেই খুঁজে বেড়াই : দশম পর্ব
শ্রীচৈতন্যের রহস্যজনক অন্তর্ধানের পরবর্তী জীবন সম্পর্কে কয়েকটি বিবরণ থেকে জানা যায় যে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুকে সশরীরে শেষ বার দেখা গিয়েছিল তোটা গোপীনাথের মন্দিরে। তারপর ওখান থেকে জটাজুটধারী সন্ন্যাসীর বেশে তিনি চলে যান তৎকালীন উড়িষ্যার আনোরপুর পরগনার ঘোলা দুবলি নামক গ্রামে।সেখান তিনি থেকে যান বেশ কয়েক বছর। আমাদের অনুসন্ধানে যেটুকু জানতে পেরেছি, এই ঘোলা দুবলি গ্রামটি হল বর্তমান রঘুরাজপুর যা পুরী থেকে 14 কিলোমিটার দূরে ভার্গবী নদীর তীরে অবস্থিত। রঘুনাথপুর গ্রামটি তার পটচিত্র, চারুশিল্প এবং অন্যান্য শিল্পকলার জন্য বর্তমানে বিখ্যাত হলেও এর কিছু রহস্যময় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই গ্রামটিতে অনেকগুলি ছোট ছোট মন্দির আছে যাদের মধ্যে একটি গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর। মন্দিরগুলি ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায় এগুলির বেশীরভাগই বৈষ্ণবদের সমাধিমন্দির। এরকমই তিনটি সমাধি মন্দিরের সন্ধান আমরা পেয়েছি পুরীর টোটা গোপীনাথ মন্দির থেকে একটু দূরে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের বসতি অঞ্চলে। যদিও সেখানকার অধিবাসীরা এই সমাধি মন্দিরগুলি সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানেন না। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রসঙ্গে আমরা পরে অবশ্যই বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করব।
রঘুরাজপুর গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই দেয়ালে বিভিন্ন চিত্র আঁকা রয়েছে যার মধ্যে পাওয়া যায় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নৃত্যরত চিত্রও। প্রবাদপ্রতিম ওড়িয়া নৃত‍্যশিল্পী কেলুচরণ মহাপাত্রের জন্মভূমি এই রঘুরাজপুরের আরেকটি বিখ্যাত ব্যাপার হল 'গতিপুয়া' নৃত‍্যশৈলী যেখানে 7 থেকে 16 বছর বয়সী ছেলেরা মেয়ে সেজে নৃত্য পরিবেশন করে। আশ্চর্যের ব্যাপার, পটচিত্র বা এই নৃত‍্যকলার অন্যতম প্রধান বিষয় হলো কৃষ্ণলীলা বা রাধা কৃষ্ণের প্রেমবিলাস। এই গ্রামের শিল্পচর্চার সমৃদ্ধি শুরু হয় মোটামুটি 500 বছর আগে কোন এক কৃষ্ণভক্তের প্রভাবে। এখানকার অধিবাসীদের অনেকেই তাদের সেই কৃষ্ণভক্তের বা কোনো এক চৈতন্যভক্তের বংশধর বলে দাবী করেন। সেই সময়ে ওড়িশার এক অখ্যাত অজ্ঞাত গ্রামে হঠাৎ গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মন্দির তৈরি হলো কেন বা সেখানকার শিল্প ও সংস্কৃতির ওপর ওনার এই রকম প্রভাব থাকা কিভাবে সম্ভব হলো, এটা যথেষ্ট ভাববার বিষয়।
এর আগের পর্বে আউলচাঁদ প্রসঙ্গে সামান্য কয়েকটি কথা উল্লেখ করেছিলাম। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই বিষয়টি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে জয়দেব মুখোপাধ্যায় বা মালিবুড়োর মতো চৈতন্য গবেষককেও বেশ কয়েক পাতা লিখতে হয়েছে এই আউলচাঁদের সঙ্গে মহাপ্রভুর অন্তর্ধান এর বিষয়টি নিয়ে। প্রজ্ঞাপ্রাণা অধ্যাপিকা শান্তা মায়ির মতে ঘোলা দুবলিতে বেশ কয়েক বছর কাটিয়ে চৈতন্য মহাপ্রভু এসে হাজির হন উলাগ্রামে। সেখানে তাকে সন্তানস্নেহে লালন পালন করেন মহাদেব বারুই। এর পরে বহু জায়গা পরিভ্রমণ করার পর পূর্ববঙ্গের বেজড়া গ্রামে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন 22 জন সদগোপ, রুইদাস, কাঁসারি ইত্যাদি তথাকথিত নিচু জাতির মানুষ। তখন তিনি কিন্তু পরিচিত হয়েছেন আউলচাঁদ নামে যার সঠিক পূর্ব ইতিহাস আজও অজ্ঞাত। সমাজের নিপীড়িত, অস্পৃশ্য, অবহেলিত মানুষকে অকাতরে কোল দেওয়া, সেই বাহুতুলে প্রেমে ঢলঢল নৃত্য, দীর্ঘকায় আজানুলম্বিত বাহু ইত্যাদি অনেক কিছুই হুবহু মিলে যায় চৈতন্যদেবের সঙ্গে। আউল চাঁদের প্রবর্তিত কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মূল সাধন পদ্ধতিরও অনেকটাই মিল রয়েছে। ওনারা আউল চাঁদের জন্ম তিথিও পালন করেন দোল পূর্ণিমাতেই। ভক্তেরা আউলচাঁদকে আউল মহাপ্রভু, কাঙ্গালী মহাপ্রভু ইত্যাদি নামেও ডাকতেন। তবে এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো আউলচাঁদের নিজের হাতে প্রাচীন বাংলা ভাষায় তালপাতায় লেখা দুটি লাইন,
"গত ঈশান গতা মাতা গত স্বরূপ-রায়। একেলা মুই পুড়িয়া কান্দি জগন্নাথের পায়।।"
এর অর্থ হল ওনার (শ্রীচৈতন্যের) বাড়ীর বৃদ্ধ চাকর ঈশান, মাতা শচীদেবী এবং ওনার অন্তরঙ্গ পার্ষদ স্বরূপ দামোদর কেউই আজ আর বেঁচে নেই। শুধু তিনিই এখনও পড়ে আছেন আর কাঁদছেন জগন্নাথের পায়ে।
তবে একটাই বড়োসড়ো গরমিল থেকে যাচ্ছে তা হল ইতিহাস অনুযায়ী প্রায় দেড়শ বছরের সময়ের ব্যবধান রয়েছে চৈতন্য মহাপ্রভু আর আউল চাঁদের মধ্যে। যদিও আমাদের তথাকথিত ইতিহাসেও অনেক ফাঁক থেকে যায় তা আমরা নিজেরাও বারবার প্রমাণ পেয়েছি। যেমন আমাদের মণিমার সাম্প্রতিক বিষ্ণুপুর ভ্রমণ, সেখানে ওনার আশ্চর্য রহস্যময় অনুভূতি, এবং সেই সংক্রান্ত তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে পাওয়া ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় 1545 খ্রিস্টাব্দের পরেও চৈতন‍্য মহাপ্রভুর জীবিত থাকার প্রমাণ রয়েছে। অথচ প্রায় সকলেই মোটামুটি 1533-34 খ্রিস্টাব্দকেই মহাপ্রভুর অন্তর্ধান বা তথাকথিত মৃত্যুর সময়কাল বলেই ধরে এসেছেন এতদিন পর্যন্ত।
স্নেহাশিস
পারুল আশ্রম

লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
মন্তব্য
মন্তব্যগুলি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন