সোমবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৮

চিপকো আন্দোলন


    চিপকো আন্দোলনে


    ফেসবুক থেকে    শেয়ার করেছেন     প্রণব কুমার কুণ্ডু

■ চিপকো আন্দোলনের গল্প ।
__________________________________
এই ১৭৩০ সালের দিকটায়… কথিত আছে যোধপুরের মহারাজা অলোক সিং ঠিক করেছিলেন নতুন একটা প্রাসাদ তৈরি করবেন। তো রসদ তো লাগবে.. তাই না? ব্যাস…. রাজকাঠুরেদের পাঠিয়ে দিলেন রাজস্থানের খেজরালি গ্রামের বনে। গ্রামে বাস করতো বিশনাই মতান্তরে বিষ্ণু নামের একটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী।
খেজরি গাছ ছিলো তাদের কাছে অনেকটা সন্তানের মতো। এছাড়াও এই গাছের সাথে মিশে ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস। তাই গাছ কেটে নেওয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন না অমৃতা দেবী। রাজকুঠারদের সাথে তার বাকবিতন্ডা শুরু হয়। তারা অমৃতা দেবীকে লোভ দেখিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করে কিন্তু অমৃতা দেবী গাছকে জড়িয়ে রাখলেন দুহাতে আর বললেন.. ‘একজনের জীবনের বিনিময়ে যদি বন বাঁচে, তবে তাই হোক।’ রাজকাঠুরেরাও দয়ার অবতার! চালিয়ে দিলেন কুঠার…. খেজরালি গ্রামে বইলো রক্তগঙ্গা।। একে একে অমৃতা দেবীর ৩ মেয়ে এবং পার্শবর্তী ৮৩ টি গ্রামের আরো ৩৬৩ জন গ্রামবাসী প্রাণ বিসর্জন দিলেন। মহারাজা এই খবর পাওয়ার পর তার আজ্ঞা ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। অমৃতা দেবীর কথা এখনো শোনা যায় রাজস্থানের লোকগীতিতে। আরো ২৬০ বছর পরের কথা। ভারতের হিমালয়ের পার্শ্ববর্তী অলকানন্দা নদীর পাড়ের আরেকটা গ্রাম রেনি। ভারতের উত্তরখান্ড প্রদেশের পাহাড়ি গ্রামটার প্রধান পেশা কৃষি। ১৯৭৪ সালের ২৬ মার্চ ওখানকার বনবিভাগের অনুমতি সাপেক্ষে গাছ কাটতে হাজির হয় ঠিকাদার কোম্পানি সাইমন এর লোকজন। টেনিস র্যাকেট বানানোর জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে তারা ৩০০ গাছ কাটার অনুমতি পেয়েছিল। সেদিন গ্রামের পুরুষেরা কেউ ছিলেন না। এগিয়ে এলেন বিধবা গৌরা দেবী। সাথে গ্রামের কৃষিজীবী আরো ২৭ জন নারী। প্রথমে তারা কোম্পানির লোকদের বোঝানোর চেষ্টা করেন এবং ফিরে যেতে বলেন। কোম্পানির লোকজন উল্টো গুলি করার ভয় দেখায়। কিন্তু দমানো যায় নি গৌরা দেবীদের। তারা জড়িয়ে রইলেন গাছগুলো। সাফ জানিয়ে দেন গাছ কাটার আগে কাটতে হবে তাদের। সারারাত তারা এভাবেই পাহারা দেন গাছগুলোকে। পরের দিন পুরুষ নারী নির্বিশেষে যোগ দেন এই অভিনব প্রতিবাদে। তিনদিন পর কোম্পানি বাধ্য হয়ে ফিরে যায়। ইতিহাসে এটি চিপকো আন্দোলন নামে পরিচিতি পায়। চিপকো গাড়োয়ালি শব্দ এর অর্থ জড়িয়ে রাখা বা আলিঙ্গন। এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে রাজস্থান কর্ণাটকসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে। এ আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা হিসেবে ছিলেন বাচনী দেবী, সুদেষ্ণা দেবী,চন্ডীপ্রসাদ ভাট প্রমুখ। চন্ডীপ্রসাদ মূলত গান্ধীবাদী অসহযোগ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৬৮ সাল থেকে পরিবেশবাদী আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে যার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন চন্ডীপ্রসাদ ভাট। যিনি পরবর্তীতে চিপকো আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭০ সালে অলকানন্দা নদীর বানে ভেসে যায় তীরবর্তী গ্রামগুলো। গ্রামবাসীরা বনাঞ্চলের গুরুত্ব অনুধাবন করতে শুরু করেন। তাদের জীবন-জীবিকার সাথে জড়িয়ে ছিল এই বন। ১৯৭৩ সালে তারা সরকারি সিদ্ধান্তগুলোর প্রতিবাদ করতে শুরু করেন। বিভিন্ন গ্রামে চলতে থাকে র্যালী-সমাবেশ-মিটিং। নারীরাও পিছিয়ে ছিলেন না। ছোট ছোট দলে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকেন। এমন একটা নারী দলের প্রধান ছিলেন গৌরা দেবী। এরই একটি সামগ্রিক প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই সেদিনের রেনি গ্রামে। পুরুষরা ছিলেন পার্শবর্তী গ্রামের প্রতিবাদসভায়। তাই বলে মেয়েরা চুপ করে থাকেনি বরং গড়ে তোলে শক্ত প্রতিরোধবূহ্য। রেনি গ্রামের ধারাবাহিকতায় সুন্দরলাল বহুগুনা তেহরি’র গাড়োয়াল অঞ্চলে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। আন্দোলনে যোগ হয় নতুন মাত্রা। ১৯৭৮ সালে আরো বেশি বিস্তৃত হয় পরিসর বরং বলা যায় চূড়ান্ত রূপ ধারন করে। ১৯৭৯ সালে ৯ ই জানুয়ারি গাছ না কাটার দাবিতে অনশন শুরু করেন সুন্দরলাল এবং গ্রেফতার হন। ৩১ জানুয়ারি জেল থেকে ছাড়া পান।পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে হিমালয়ের ১০০০ মিটারের ওপরে সম্পূর্ণ গাছকাটা বন্ধের দাবিতে অনশন শুরু করলে বিষয়টি ইন্দিরা গান্ধীর দৃষ্টিগোচর হয়। তারই ফলশ্রুতিতে আইনত বন্ধ করে দেওয়া হয় গাছকাটা। সফলতার মুখ দেখে চিপকো আন্দোলন। ‘माटू हमरू, पाणी हमरू, हमरा ही छन यी बौण भी… पितरों न लगाई बौण, हमुनही त बचौण भी। আমাদের মাটি, আমাদের জল, এই বনাঞ্চল আমাদের। আমাদের পূর্বপুরুষেরা এগুলি পালন করেছেন, আমরাই এগুলিকে রক্ষা করব।
– প্রাচীন চিপকো গান (গাড়োয়ালি ভাষা) “ মূলত এটাই ছিল চিপকো আন্দোলনের প্রতিপাদ্য । কালক্রমে গৌরা দেবীর কথা সবাই ভুলে গেলেও সুন্দরলাল প্রথমে জাতীয় ও পরে আনর্জাতিকভাবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি কংগ্রেস নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষন করে চিপকো আন্দোলনকে বড় পরিসরে পরিবেশবাদী আন্দোলনে পরিণত করতে সক্ষম হন।১৯৮৭ সালে চিপকো আন্দোলন ‘Right livelihood Award ‘ লাভ করে। কিন্তুু হলে কি হবে! সেই চিপকো আন্দোলনের সূতিকাগার রেনি গ্রামেই উন্নয়নের দোহাই তৈরি হয়েছে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। একটা দেশে অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকাটা জরুরি। আর আমাদের দেশে তার তিন ভাগের একভাগও নেই। দেশের উন্নয়ন যেমন জরুরি তেমনি দেশটাকে বাঁচিয়ে রাখাটাও মুখ্য। সেদিন রেনি গ্রামের মানুষগুলো কিন্তু ঠিকই নিজেদের ভালোটা বুঝে নিয়েছিল। এবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা আমাদের।
*****তথ্যসূত্রঃ সংগৃহিত প্রবন্ধ ***************

লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
মন্তব্য
মন্তব্যগুলি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন