বুধবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৮

কৌলিন্য প্রথা



         কৌলিন্য প্রথা


         কৌলিন্য প্রথার ওপর, একটি ভালো প্রবন্ধ, ফেসবুক থেকে চয়ন করেছেন,   প্রণব কুমার কুণ্ডু



রানা চক্রবর্তী গোষ্ঠীটিতে একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন: ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য


কৌলীন্য প্রথা কি, কুলীন কারা, কৌলীন্য প্রথার ইতিহাস, কুলীন প্রথা বনাম শাস্ত্র ও পুরান, কুলীন প্রথার কুফল, রাজা বল্লাল সেন দ্বারা এই কুপ্রথা চালুর আসল কারণ-
(তথ্যসূত্র: অতুল সুর, বাংলার সামাজিক ইতিহাস, কলকাতা, ১৯৭৬।
নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ভারতীয় জাতি বর্ণ প্রথা, কলকাতা, ১৯৮৭।
রমেশচন্দ্র মজুমদার,
বঙ্গীয় কুলশাস্ত্র, কলকাতা, ১৯৮৯।
নগেন্দ্রনাথ বসু, বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ২ খন্ড, কলকাতা।
বিনয় ঘোষ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
বাঙ্গালার সামাজিক ইতিহাস, দুর্গাচন্দ্র সান্যাল, মডেল পাবলিসিং হাউস)।

রানা চক্রবর্তী 


পুরানো সেই দিনের কথা: নব বিবাহিত কুলীন দম্পতি (ছবি থেকেই দুইজনের বয়সের পার্থক্য অনুমেয়)। ১৮৮০ এর দশকে কলকাতার এক স্টুডিও তে তোলা ছবি।

● কি ছিল এই "কৌলীন্য প্রথা"?

সম্মানলাভার্থে প্রজারা সৎপথে চলবে, এই উদ্দেশ্যে বাংলার সেন বংশের রাজা বল্লালসেন কৌলিন্য প্রথা সৃষ্টি করেছিলেন। 

শ্রোত্রিয়দের মধ্যে যাঁরা নবগুণবিশিষ্ট ছিলেন, বল্লাল তাঁদের কুলীন উপাধি দিয়েছিলেন। 

এই নবগুণগুলো হল : আচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থ দর্শন, নিষ্ঠা, শান্তি, তপ ও দান। 
এগুলি 'কুল লক্ষণ' নামে পরিচিত।
● কুলীন ও পরামানিক উপাধি প্রাপ্তি- বৈদ্যদের মধ্যে যারা ধার্মিক ও গুণবান এবং কায়স্থদের মধ্যে যারা শ্রোত্রিয়দের পরিচারক-সন্তান ( চাকরবাকর ও তাদের সন্তানেরা ),  তারা কুলীন উপাধি পেয়েছিলেন।
এভাবে ঘোষ, বসু, গুহ ও মিত্র বংশীয়রা কায়স্থরা কুলীন হল;
তিলী, তাঁতি, কামার, কুমোর প্রভৃতি সৎশূদ্রদের গুণ ও সঙ্গতি দেখে,  বল্লাল তাদের শ্রেষ্ঠ লোকদের কুলীন করেছিলেন, এরাই মানী বা পরামানিক নামে পরিচিত হয়।
● কৌলিন্য পরিবর্তন- বল্লাল নিয়ম করেছিলেন যে,
প্রতি ছত্রিশ বছরের শেষে এক এক বার বাছাই হবে, এবং এতে গুণ ও কর্ম অনুযায়ী কুলীন ও অকুলীন নির্বাচিত হবে।

সুতরাং কুলমর্যাদা লাভার্থে সবাই ধার্মিক ও গুণবান হতে চেষ্টা করবে।
বল্লালের সেই আশা প্রথম প্রথম সফল হলেও,
লক্ষণসেনকৃত ব্যবস্থায় তা বংশানুক্রমিক হয়ে গিয়ে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
● প্রবর্তক নিয়ে মতভেদ- কৌলিন্য প্রথার সৃষ্টি সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন কুলশাস্ত্রে বিভিন্ন মত দেখা যায়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামগতি তর্করত্ন প্রভৃতি বিজ্ঞ রাঢ়ীয় পন্ডিতেরা বল্লাল সেন কেই কৌলিন্যের সৃষ্টিকর্তা বলেছেন।
অথচ কোন কোন রাঢ়ীয় কুল শাস্ত্রে ধরাধর কর্তৃক রাঢ়ীয় শ্রোত্রিয় মধ্যে কুল মর্যাদা সৃষ্টি দেখা যায়।
বাচস্পতি মিশ্র কৃত কুল শাস্ত্রের সাথে বারেন্দ্র কুল শাস্ত্রের কিছু ঐক্য আছে।
● রাঢ়ীয় কুলীন ব্রাহ্মণ- শান্ডিল্য গোত্রীয় বন্ধ্যঘাটিগ্রামবাসী, কাশ্যপ গোত্রীয় চট্টগ্রামবাসী, ভরদ্বাজ গোত্রিয় মুখুটিগ্রামী, সাবর্ণী গোত্রীয় গাঙ্গুলি ও কুন্দলাল গ্রামী এবং বাৎস্য গোত্রীয়, ঘোষাল, কাঞ্জিলাল এবং পুতিতুন্ড এই আট গ্রামীরা রাঢ়ীয় কুলীন ব্রাহ্মণ।
● কৌলিন্য প্রথার মর্যাদা-
কৌলিন্য মর্যাদা বাঙালীদের জীবনাধিক গুরুতর গণ্য ছিল।
অনেকে সর্বস্ব বিক্রয় করে কুলমর্যাদা রক্ষা করতেন।
কেউ কেউ অশীতিপর বৃদ্ধের সাথে সপ্তবর্ষীয় কন্যার বিবাহ দিয়ে কুল বাঁচাতেন।
এমনকী রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে অনেক সময় কুল মর্যাদা রক্ষায় ধর্মশাস্ত্রের বিধান লঙ্ঘিত হত এবং পঞ্চাশ বছর বয়স্কা কুমারীকে দশবর্ষীয় বালকের সাথে নামমাত্র বিবাহ দিয়ে কুলমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে হত।

পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরু থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ অবধি, সুদীর্ঘ চারশ বছর বল্লালী কুলমর্যাদাই উচ্চ শ্রেণীর বাঙালীদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল।

● কায়স্থ কুলীন-
বঙ্গরাজ দেবপাল গৌড় নগর থেকে কয়েক ঘর কায়স্থ এনে বঙ্গদেশে স্থাপন করেন। তাদের সঙ্গে তিনি বিবাহ আদান প্রদান করে নিজে তাদের সমাজে মিলিত হন। সেই বঙ্গজ কায়স্থরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে বঙ্গজ ও দক্ষিণ রাঢ়ী কায়স্থ বলে পরিগণিত হয়। এদেরকে বল্লাল সেন কৌলিন্য মর্যাদা দেন।
● রাঢ়ী ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ-
বল্লাল সেন কনৌজের ভট্টশালীগ্রাম-নিবাসী শ্রোত্রিয়দের বসবাসের অসুবিধা দূর করার জন্য নিজের প্রকান্ড রাজ্যের নানা স্থানে পাঠিয়ে তাঁদের ভরণ-পোষণের যোগ্য ব্রহ্মত্র দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে একশ ঘর গঙ্গার বাম পারে বরেন্দ্রভূমিতে বাসস্থান পেয়ে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ নামে খ্যাত হন আর ছাপ্পান্ন ঘর গঙ্গার অপর পারে রাঢ়দেশে ব্রহ্মত্র লাভ করে রাঢ়ী ব্রাহ্মণ আখ্যা প্রাপ্ত হন।রাঢ়ী ও বারেন্দ্র বিভাগ ব্রাহ্মণ ছাড়াও বৈদ্য, কায়স্থ ও অধিকাংশ অপর জাতীর মধ্যেও ছিল।
● কৌলীন্য প্রথার ইতিহাস ও তৎকালীন সমাজ: কৌলীন্য প্রথা যে কোনো জাতি বা গোষ্ঠী বা বর্ণ বা সম্ভ্রান্ত বংশ যারা সামাজিক সম্মান ভোগ করে এবং ঐতিহ্যগতভাবে নিজেদের সামাজিক অবস্থান এবং ‘কুল’ পরিচিতি ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর।
এ আকাঙ্ক্ষার পরিচয় পাওয়া যায় রামায়ণএর (খ্রিস্টপূর্ব দু শতক থেকে দুই খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) সময় থেকে।
তাই কুলীন অর্থ হলো উত্তম পরিবার বা সম্ভ্রান্ত বংশজাত।
বাচস্পতি মিশ্র-এর মতে, এটি চিহ্নিত হয় আচার (শুদ্ধতা), বিদ্যা (জ্ঞান), বিনয় (শৃঙ্খলাবোধ), প্রতিষ্ঠা (শুদ্ধতার খ্যাতি), তীর্থ-দর্শন (তীর্থযাত্রা), নিষ্ঠা (কর্তব্যনিষ্ঠা), তপস্যা (কঠোর ধ্যান), আবৃত্তি (সমবর্ণে বিবাহ) এবং দান (উদারহস্ত) দিয়ে।
সাধারণত এধরনের গুণাবলি দেখা যেত ব্রাহ্মণ পরিবারে, যদিও কায়স্থ এবং বৈদ্যগণ এসব গুণ অর্জন করে তাদের সম্পদ, শিক্ষা, উত্তম ব্যবহার সংযোজিত করে কুলীন হিসেবে গণ্য হতো।
এরূপ যোগ্য পরিবারের সাথে বৈবাহিক সূত্র স্থাপনের মাধ্যমে সাধিত হতো জাত্যৎকর্ষ এবং এর ফলে কোনো একটি বর্ণের ব্যক্তির জন্য কুলীন সমাজে প্রবেশের দ্বার উন্মোচিত হতো। সমাজে কৌলীন্য প্রথার উদ্ভব ঘটেছে সম্ভবত এ ভাবেই।
রাঢ় ও বরেন্দ্র এর ব্রাহ্মণদের মধ্যে কৌলীন্য প্রথা অধিক মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করেছিল।
তারা সম্ভবত কান্যকুব্জের পাঁচ ব্রাহ্মণ-রক্ষিতীশ, মেধতিথী, বিতরগ, সুধনিধি এবং সম্ভরি-এর উত্তরসূরি।
বলা হয়ে থাকে যে, রাজা আদিশূর-এর নিমন্ত্রণে তাঁরা এখানে আসে। তবে উল্লেখ্য, আদিশূরের ঐতিহাসিকতা তর্কের উর্ধ্বে নয়।
গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক এবং বর্মণ রাজা হরিবর্মণ উভয়েই যথাক্রমে শকদ্বীপী ও বৈদিক ব্রাহ্মণ নিয়ে এসেছিলেন বলে জানা যায়।
বলা হয়ে থাকে, এ ব্রাহ্মণদের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির ফলস্বরূপ বাংলায় সামাজিক প্রথা হিসেবে কৌলিন্য প্রথার সূত্রপাত হয়েছে।
সেন রাজা বল্লালসেনকেও কৌলিন্য প্রথার স্রষ্টা হিসেবে কৃতিত্ব দেওয়া হয়, যদিও এ দাবির সমর্থনে সেন যুগের কোনো সাহিত্যিক ও উৎকীর্ণলিপি প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তৃতীয় বিগ্রহপালের বনগাঁ তাম্রশাসনে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তাঁর কর্মকর্তা ঘন্তিস-এর প্রো-পিতামহের মাধ্যমে তাঁর পূর্বপুরুষের সাথে কোলঞ্চ (কান্যকুব্জ) ব্রাহ্মণ কচ্ছ-এর যোগসূত্র ছিল।
ফলে কৌলীন্য প্রথার উদ্ভব পাল শাসনামলে হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
ছয় ও সাত শতকের মধ্যে বৈদিক ব্রাহ্মণদের বিভিন্ন গোত্র, প্রবর এবং শাখা এবং শ্রৌত আচার-অনুষ্ঠান পালনকারী ব্রাহ্মণ ব্যাপক সংখ্যায় বাংলায় বসতি গড়ে তোলে।
উত্তর ভারত থেকে আরও কিছু নতুন অভিবাসীর কারণে তাঁদের সংখ্যা নিয়মিত হারে বাড়তে থাকে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রচুর লেখ তথ্যের মাধ্যম।
আট থেকে বারো শতক পর্যন্ত সময়ে উৎকীর্ণ বহু লিপি থেকে জানা যায়, লাট (গুজরাট), মধ্যদেশ এবং স্বতন্ত্র কিছু লোকালয় যেমন ক্রোদঞ্চি বা ক্রোদঞ্চ (কোলঞ্চ), তরকরি (শ্রাবস্তি-র), মুক্তবস্ত্ত, হস্তিপদ, মৎস-বস, কুন্তির এবং চন্দবর থেকে আগত ব্যাপক সংখ্যক ব্রাহ্মণ বাংলায় বসতি স্থাপন করে।
কালক্রমে বাংলায় ব্রাহ্মণরা রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র, বৈদিক এবং শকদ্বীপী প্রভৃতি শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে।
বাংলার ঘটকদের (বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপনকারী) কুলজি গ্রন্থে ব্রাহ্মণ আমদানির কথা উল্লেখ রয়েছে।
এই গ্রন্থগুলি বিভিন্ন নামে, যেমন কুলশাস্ত্র বা কুলগ্রন্থ বা কুলপঞ্জিকা হিসেবে পরিচিত।
যদিও গ্রন্থগুলিকে একটি আলাদা শাস্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয়, তথাপি প্রামাণিক ইতিহাসের উৎস হিসেবে পন্ডিতদের মধ্যে এগুলির প্রাচীনত্ব ও সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
বেশিরভাগ কুলশাস্ত্রে অবশ্য কনৌজ বা কোলঞ্চ থেকে আদিশূর কর্তৃক পাঁচ ব্রাহ্মণ আনার কথা উল্লিখিত আছে।
রাঢ়ীয় হিসেবে পরিচিত রাঢ়ের ব্রাহ্মণ এবং বারেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বরেন্দ্রের ব্রাহ্মণ উভয়ই সে পাঁচ অভিবাসী ব্রাহ্মণকে তাদের পূর্বপুরুষ বলে দাবি করেন।
সান্ডল্য নারায়ণ, বৎস্য ধরধর, কশ্যপ সুসেন, ভর্দ্বজ গৌতম এবং সবর্ন পরসর বেশিরভাগ কুলপঞ্জিকা-য় দাবি করা হয় এরাই বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের পূর্বপুরুষ, এবং এরা রাঢ়ীয় পাঁচ পূর্বপুরুষের সন্তান বলে মনে হয়। কিছু কিছু অভিবাসী ব্রাহ্মণের সন্তানের উত্তর বাংলায় চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ দুটি সমগোত্রীয় আলাদা গোষ্ঠীর উত্থান অবশ্য আকস্মিক ছিল না, এর পেছনে বেশকিছু কারণ কাজ করেছে। কালক্রমে বাংলার দুটি অংশে আলাদা দুটি সামাজিক রীতি ও আচার গড়ে উঠেছে এবং সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আন্তঃগোত্রীয় বিবাহ উৎসাহ পায় নি।
ঠিক কখন এ দুটি দল আলাদা শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে তা বলা কঠিন, যদিও তাদের পূর্বপুরুষ ছিল এক। লক্ষ্মণসেন এর প্রধান বিচারপতি হলায়ুধের ব্রাহ্মণ-সর্বস্ব থেকে রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র দুটি আলাদা শ্রেণির অস্তিত্ব সম্পর্কে সর্বপ্রথম নির্দিষ্ট করে জানা যায়। তিনি উভয় গোষ্ঠীর বৈদিক শাস্ত্রের মূল অর্থ সংক্রান্ত অজ্ঞতাকে তিরস্কার করেছেন।
পশ্চিম ও উত্তর বাংলায় মুসলিম আক্রমণের কারণে বহু ব্রাহ্মণ পূর্ব বাংলার জনপদগুলিতে অভিবাসী হয়ে যায়। বাংলার এ অঞ্চলে এরপরও প্রায় এক শতককালব্যাপী হিন্দু শাসন বজায় ছিল।
পাল রাজারা অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু ছিলেন, এবং তাদের শাসনকালে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতি তাদের খুব একটা উৎসাহ চোখে পড়ে না।
মুঙ্গের ও আমগাছি তাম্রশাসনে উল্লেখিত চার বর্ণের সঠিক ক্রম রক্ষার জন্য ধর্মপাল ও দ্বিতীয় বিগ্রহপালের ভূমিকা ও ব্রাহ্মণ্য সমাজের প্রতি পালরাজাদের প্রশাসনিক নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়।
বর্মণ বংশের সামলবর্মণ বৈদিক ব্রাহ্মণদের বাংলায় বসতি স্থাপনের জন্য নিয়ে আসেন।
সেন বংশের বল্লাল সেনকেও কৌলিন্য প্রথার স্রষ্টা হিসেবে কৃতিত্ব দেওয়া হয়ে থাকে।
বর্মণ ও সেন উভয় রাজবংশই বাংলার বাইরে থেকে ব্রাহ্মণ আমদানি এবং বাংলায় ব্রাহ্মণ-প্রাধান্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বর্মণ ও পাল উভয় রাজবংশই বাংলায় বহিরাগত এবং উভয় বংশই বাংলায় ব্রাহ্মণবাদের প্রসারে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, কান্যকুব্জ থেকে পাঁচ ব্রাহ্মণের আগমনের গল্প দক্ষিণ ভারতে ইতোমধ্যেই প্রচলিত ছিল।
সেন রাজবংশও দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছিল এবং পূর্ব ভারতে তাদের রাজ্য স্থাপনের পর এ গল্পটা বাংলায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, কান্যকুব্জ থেকে ব্রাহ্মণদের নিয়ে আসা হয়েছিল।
তবে উল্লেখযোগ্য যে, সেনগণ ছিলেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক এবং তাদের শাসন ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উন্নয়নে বিরাট অবদান রেখেছিল। সমাজে ব্রাহ্মণদের ক্ষমতা ও অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয় এবং প্রথম দিকে এর প্রয়োজন ছিল রাজার ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করতে, কেননা তাঁরা ছিল বাংলায় বহিরাগত।
তবে এক পর্যায়ে ব্রাহ্মণদের ক্ষমতা শাসকদের কাছে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই, জনসাধারণ্যে ঘটা করে কৌলীন্যের দোহাই দিয়ে ব্রাহ্মণদের বিভক্তি এবং এর মাধ্যমে শাসক শ্রেণিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো একটি সম্ভাব্য গোষ্ঠীর ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, এটি ছিল ব্রাহ্মণ সমাজের প্রভাবশালী অংশের সমর্থন নিয়ে রাজকীয় শক্তিকে ক্ষমতাবান করার এক কার্যকর পদ্ধতি।
রাঢ়ীয়কুল মঞ্জুরি-তে ব্রাহ্মণদের বিদ্রোহী রূপের প্রকাশ পাওয়া যায়, যেখানে একটি ব্রাহ্মণ (শ্রোত্রিয়) দলের নেতা বিকর্তন পরাক্রম সহকারে রাজার মুখোমুখি হয়েছে এবং ব্রাহ্মণদের যোগ্যতা বা অযোগ্যতার ব্যাপারে রাজার বিচার করার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
রাঢ়ীয় কুলজি অনুসারে আদিশূর কর্তৃক নিয়ে আসা পাঁচ ব্রাহ্মণের সংখ্যা ক্ষিতিশূরের সময়ে ঊনষাটে এসে দাঁড়ায়।
রাজা প্রত্যেককে বসবাসের জন্য একটি করে গ্রাম দান করেন, এর মাধ্যমেই রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের গাঞী-র উদ্ভব হয়।
অন্যভাবে বলতে গেলে, প্রত্যেক ব্রাহ্মণ ও তাঁদের উত্তরপুরুষ যে গ্রামে বসবাস করত সে নামেই পরিচিত হয়ে ওঠে।
এটাই তাঁদের গাঞী (গ্রামের অধিবাসী) হয়ে ওঠে, এবং পরবর্তীকালে এটাই হয়ে যায় পারিবারিক নাম।
উদাহরণ স্বরূপ, মুখতি গ্রামে বসবাসকারীর গাঞী ছিল মুখতি এবং তাদের পারিবারিক নাম মুখতি গ্রামের নামের সাথে উপাধ্যায় (শিক্ষক) সংযুক্ত করে মুখোপাধ্যায়।
অন্যান্য আরও সুপরিচিত পদবি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং চট্টোপাধ্যায় একইভাবে উদ্ভূত।
বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদেরও একশত গাঞী ছিল।
স্বাভাবিকভাবে, কুলজি সমূহেও তাদের গাঞী সংখ্যা ও নামের বিভিন্ন রকম উল্লেখ পাওয়া যায়।
ক্ষিতিশূরের পুত্র ধরশূর রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের ঊনষাট গাঞীকে মুখ্য-কুলীন, গৌণ-কুলীণ ও শ্রোত্রিয় তিনটি শাখায় ভাগ করে।
ধীরে ধীরে কৌলিন্য প্রথা বৈদ্য ও কায়স্থদেরও প্রভাবিত করে।
বৈদ্যগণ রাঢ় বৈদ্য, বারেন্দ্র বৈদ্য ও সিলেটি বৈদ্য এ তিন ভাগে এবং কায়স্থগণ দক্ষিণ রাঢ় কায়স্থ, উত্তর রাঢ় কায়স্থ, বারেন্দ্র কায়স্থ, সিলেটি কায়স্থ এবং গোলাম কায়স্থ (দাস) ভাগে ভাগ হয়ে যায়।
রাঢ় ব্রাহ্মণগণ কুলীন, সিদ্ধ-শ্রোত্রিয়, সদ্ধ-শ্রোত্রিয় এবং কস্থ-শ্রোত্রিয়-তে ভাগ হয়ে যায়।
বিবাহের আইন অনুযায়ী একজন কুলীন পুরুষ তার নিজের শ্রেণির কোনো নারীকে অথবা তার শ্রেণির উচ্চ কোনো শ্রোত্রিয় শ্রেণির নারীকে বিবাহ করতে পারত।
একজন সিদ্ধ-শ্রোত্রিয় পুরুষ তার নিজের শ্রেণির নারীকে বিবাহ করতে পারত।
একজন সদ্ধ-শ্রোত্রিয় নারী তার নিজের শ্রেণির মধ্যে অথবা উচ্চ দু শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত পুরুষকে বিবাহ করতে পারত।
এভাবেই কুলীন মর্যাদা বজায় রাখার লক্ষ্যে এসব রীতির উদ্ভব ঘটেছিল।
কৌলীন্য প্রথা ধীরে ধীরে সমাজপতি এবং ঘটক (পেশাজীবী ঘটক) কর্তৃক আদর্শায়িত হয়।
এই উদ্দেশ্যে তারা কুলপঞ্জিকা গ্রন্থের সূত্রপাত করে।
এই গ্রন্থগুলি মূলত তিন ভাগে বিভক্ত (ক) আদিকুলকারিকা এবং ডাক, (খ) কুলপঞ্জিকা, ধাকুরি, সমিকরণকণিকা ও কুলাকুল বিচার এবং (গ) কক্ষনির্ণয়, ভবনির্ণয়, ধাকুর ও আধুনিক কুলপঞ্জিকা।
ভরত মল্লিক-এর চন্দ্রপভা কুলপঞ্জিকা (১৬৭৫ খিষ্টাব্দ) এবং কবিকণ্ঠহার-এর সদ্বৈদ্য কুলপঞ্জিকা (১৬৫৩ খিষ্টাব্দ) দুটি গুরুত্বপূর্ণ কুলগ্রন্থ।
কৌলীন্য প্রথা কুলীন ব্রাহ্মণদের মাঝে বহুবিবাহের প্রচলন ঘটায়।
কুলীন মর্যাদা এবং সামাজিক অবস্থান টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে কুলীন পুরুষদের সাথে শ্রোত্রিয় মহিলাদের বিয়ে দেওয়া হতো। 
ফলে একই শ্রেণির মধ্যে বিবাহযোগ্য শ্রোত্রিয় মহিলার অভাব দেখা দেয়। 
এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে ঘটক ব্রাহ্মণ পণ নিয়ে তাদের বিয়ে শ্রোত্রিয় পুরুষের সাথে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করে। 
অন্যদিকে কুলীনদের মাঝে বিয়ের ব্যবস্থা একটি লাভজনক কর্মে পরিণত হয়। 
কুলীন মর্যাদা টিকিয়ে রাখতে একজন বয়স্ক পুরুষের সাথে অল্পবয়সী নারীকে যেমন বিয়ে দেওয়া হতো, তেমনি অল্প বয়স্ক একজন পুরুষের সাথে বিয়ে দেওয়া হতো বয়স্কা একজন মহিলার। 
তারপরও অনেক কুলীন নারী সারাজীবন অবিবাহিতই থেকে যেত। 
এই ঘৃণ্য প্রথা দীর্ঘ দিন পর্যন্ত চলতে থাকে। 
এমনকি, এখনও কিছু কিছু পরিবার বিয়ের মাধ্যমে এ কুলীন মর্যাদা বজায় রাখার চেষ্টা করে, যদিও এখন কৌলিন্য প্রথা তার আগের প্রাধান্য হারিয়ে ফেলেছে।
বাংলায় কৌলিন্য প্রথা কিছু নির্দিষ্ট সামাজিক-রাজনৈতিক লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, আঠারো এবং উনিশ শতকে এসে এর দীর্ঘস্থায়ী রূপ যেমন হয়ে পড়ে বিকৃত তেমনি দুর্বল। এটি সমাজের শুধু ব্যাধিতেই পরিণত হয় নি, বরং এটি বাংলার সমস্ত সামাজিক অবস্থাকে বিকৃত করে তোলে। বিদ্যাসাগরকে এ সামাজিক ব্যাধির সাথে অক্লান্ত সংগ্রাম করে যেতে হয়েছিল।
● কৌলীন্য প্রথা বনাম শাস্ত্র ও পুরান:
বাঙালি সমাজ, ইতঃপূর্বে ছিল নির্ধন; তাদের মধ্যে উঁচু-নিচু বলে কিছু ছিল না।
সেন যুগে পৌঁছে বাঙালির মধ্যে দেখা দিল স্পষ্ট দুই বর্ণ-কুলীন ও ইতর।
উৎপাদক শ্রমজীবী হল ইতর এবং শ্রমজীবীর উৎপাদন আত্মসাৎকারী হল উচ্চবর্ণ কুলীন।
বর্ণ হিসেবে কুলীনের জন্য বরাদ্দ থাকল অধ্যয়ন ও লেখাপড়াভিত্তিক সব পেশা আর নিম্নবর্ণ বা নিচুজাতের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হল কৃষি ও অন্যান্য শ্রমনির্ভর পেশা।
শুধু তাই নয়, অধ্যয়ন ও লেখাপড়া তাদের জন্য করা হল নিষিদ্ধ।
কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তন দ্বারা বাঙালি সমাজ স্পষ্ট দুদলে ভাগ হয়ে গেল।
ধর্মে ও ধর্মগ্রন্থে বর্ণ প্রথাঃ
বর্ণ প্রথা বলে ধর্মগ্রন্থ সমূহে কোন শব্দ নেই।
আছে ‘বর্ণাশ্রম’। শাব্দিক অর্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ‘বর্ণ’ শব্দটি এসেছে ‘Vrn’ থেকে; যার অর্থ ‘to choose’ বা পছন্দ করা অর্থাৎ পছন্দ অনুযায়ী আশ্রম বা পেশা নির্ধারণ করা। কালের পরিবর্তনে বর্ণাশ্রম হয়ে গেছে বর্ণ প্রথা!
এবার দেখি সনাতন সমাজে বহুল প্রচলিত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সম্পর্কে আমাদের ধর্মগ্রন্থে কি আছে—
ঋগবেদের পুরুষ সুক্তের মন্ত্রে বলা আছে,
“সেই বিরাট পুরুষের ‘ব্রাহ্মণ মুখ ছিলেন, রাজন্য বাহুস্বরূপ ছিলেন, ঊরু বৈশ্য ছিলেন, এবং পদদ্বয় হইতে শূদ্র জাত হইয়াছিলেন’ (কর, ১৯৯২ : ২০৪)।
গীতায় শ্রী ভগবানের উক্তি মতে বলা হয়েছে—
‘আমি গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে চারি বর্ণের (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) সৃষ্টি করিয়াছি’ (কর, ১৯৯২ : ২০৪)”।
ঋগবেদ ১.১১৩.৬
“একজন জ্ঞানের উচ্চ পথে (ব্রাক্ষ্মন),অপরজন বীরত্বের গৌরবে (ক্ষত্রিয়), একজন তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে (পেশাভিত্তিক), আরেকজন সেবার পরিশ্রমে( শূদ্র)।
সকলেই তার ইচ্ছামাফিক পেশায়, তবে সকলের জন্যই ঈশ্বর জাগ্রত।
ঋগবেদ ৯.১১২.১
একেকজনের কর্মক্ষমতা ও আধ্যাত্মিকতা একেক রকম আর সে অনুসারে কেউ ব্রাক্ষ্মন কেউ ক্ষত্রিয় কেউ বৈশ্য কেউ শূদ্র।
ব্রাক্ষ্মণ কে? ঋগবেদ ৭.১০৩.৮
যে ঈশ্বরের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত, অহিংস,সত্,নিষ্ঠাবান, সুশৃঙ্খল,বেদ প্রচারকারী, বেদ জ্ঞানী সে ব্রাহ্মণ।
ক্ষত্রিয় কে? ঋগবেদ ১০.৬৬.৮
দৃড়ভাবে আচার পালনকারী, সত্কর্মের দ্বারা শূদ্ধ, রাজনৈতিক জ্ঞান সম্পন্ন,অহিংস,ঈশ্বর সাধক,সত্যের ধারক,  ন্যায়পরায়ণ, বিদ্বেষমুক্ত ধর্মযোদ্ধা, অসত্ এর বিনাশকারী. সে ক্ষত্রিয়।
বৈশ্য কে? অথর্ববেদ ৩.১৫.১
দক্ষ ব্যবসায়ী, দানশীল চাকুরীরত এবং চাকুরী প্রদানকারী।
শূদ্র কে? ঋগবেদ ১০.৯৪.১১
যে অদম্য, পরিশ্রমী, অক্লান্ত জরা যাকে সহজে গ্রাস করতে পারেনা, লোভমুক্ত কষ্টসহিষ্ণু সেই শূদ্র।
এ হচ্ছে নির্ভেজাল যোগ্যতা অনুযায়ী ব্যবস্থা।

যেমনভাবে এখনকার সময়ে ডিগ্রী প্রদান করা হয়, যজ্ঞোপবীত দেয়া হতো বৈদিক নিয়ম অনুসারে।

তাছাড়া, আচরণবিধির সাথে অসম্মতি ঘটলে যজ্ঞোপবীত নিয়ে নেয়া হতো।

ডাক্তার এর ছেলে যেমন ডাক্তার হবেই এমন কোন কথা নেই।

ডাক্তার-এর ঘরে জন্ম নিলেই এম.বি.বি.এস এর সার্টিফিকেট যেমন পাওয়া যায়না, ঠিক তেমন ব্রাহ্মন এর ঘরে জন্ম নিলেই ব্রাহ্মন হওয়া যায়না।
বৈদিক বর্নাশ্রমও একই। বৈদিক ইতিহাসে অনেক উদাহরণ রয়েছে এ ধরনের-
(ক) ঋষি ঐতরেয়া ছিলেন দাস বা অপরাধীর পুত্র কিন্তু তিনি পরিণত হন শীর্ষ ব্রাহ্মণদের মধ্যে একজন এবং লেখেন ঐতরেয়া ব্রাহ্মন এবং ঐতরেয়াপোনিষদ। ঐতরেয়া ব্রাহ্মনকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হয় ঋগবেদ বোঝার জন্য।
(খ) ঋষি ঐলুশ জন্মেছিলেন দাসীর ঘরে যিনি ছিলেন জুয়াখোর এবং নিচু চরিত্রের লোক। কিন্তু এই ঋষি ঋগবেদের উপর গবেষণা করেন এবং কিছু বিষয় আবিষ্কার করেন। তিনি শুধুমাত্র ঋষিদের দ্বারা আমন্ত্রিতই হতেন না এমনকি আচার্য্য হিসেবেও অধিষ্ঠিত হন। (ঐতরেয়া ব্রহ্ম ২.১৯)
(গ) সত্যকাম জাবাল ছিলেন এক পতিতার পুত্র যিনি পরে একজন ব্রাহ্মণ হন।
(ঘ) প্রীষধ ছিলেন রাজা দক্ষের পুত্র যিনি পরে শূদ্র হন। পরবর্তীতে তিনি তপস্যা দ্বারা মোক্ষলাভ করেন। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.১.১৪) যদি তপস্যা শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ হতো যেমনভাবে উত্তর রামায়ণের নকল গল্প বলে, তাহলে প্রীষধ কিভাবে তা করল?
(ঙ) নবগ, রাজা নেদিস্থের পুত্র পরিণত হন বৈশ্যে। তার অনেক পুত্র হয়ে যান ক্ষত্রিয়। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.১.১৩)
(চ) ধৃষ্ট ছিলেন নবগের (বৈশ্য) পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন এবং তার পুত্র হন ক্ষত্রিয়। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.২.২)
(ছ) তার পরবর্তী প্রজন্মে কেউ কেউ আবার ব্রাহ্মণ হন। (বিষ্ণু পুরাণ ৯.২.২৩)
(জ) ভাগবত অনুসারে অগ্নিবেশ্য ব্রাহ্মণ হন যদিও তিনি জন্মনেন এক রাজার ঘরে।
(ঝ) রাথোটর জন্ম নেন ক্ষত্রিয় পরিবারে এবং পরে ব্রাহ্মণ হন বিষ্ণু পুরাণ ও ভাগবত অনুযায়ী।
(ঞ) হরিৎ ব্রাহ্মণ হন ক্ষত্রিয়ের ঘরে জন্ম নেয়া সত্ত্বেও। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.৩.৫)
(ট) শৌনক ব্রাহ্মণ হন যদিও ক্ষত্রিয় পরিবারে জন্ম হয়। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.৮.১) এমনকি বায়ু পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ ও হরিবংশ পুরাণ অনুযায়ী শৌনক ঋষির পুত্রেরা সকল বর্ণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। একই ধরনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় গ্রীতসমদ, বিতব্য ও বৃৎসমতির মধ্যে।
(ঠ) মাতঙ্গ ছিলেন চন্ডালের পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন।
(ড) রাবণ জন্মেছিলেন ঋষি পুলৎস্যের ঘরে কিন্তু পরে রাক্ষস হন।
(ঢ) প্রবৃদ্ধ ছিলেন রাজা রঘুর পুত্র কিন্তু পরে রাক্ষস হন।
(ণ) ত্রিশঙ্কু ছিলেন একজন রাজা যিনি পরে চন্ডাল হন।
(ত) বিশ্বামিত্রের পুত্রেরা শূদ্র হন। বিশ্বামিত্র নিজে ছিলেন ক্ষত্রিয় যিনি পরে ব্রাহ্মণ হন।
(থ) বিদুর ছিলেন এক চাকরের পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন এবং হস্তিনাপুর রাজ্যের মন্ত্রী হন।
চারটি বিশেষ গুণসম্পন্ন এবং বিভিন্ন মাত্রার সংযাগের ফলে চার বর্ণের মধ্যে গুণের তারতম্য দেখা যায়।
প্রাচীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতের গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে সে জাতির কর্ম উল্লিখিত চার বর্ণের কর্মের সঙ্গে মিল না থাকলে সে জাতি মিশ্র গুণসম্পন্ন ধরে নেয়া হতো।
তবে এক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয় তাদের বর্ণ ও সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণের ক্ষেত্রে।
মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, গৌতম প্রভৃতি স্মৃতিকার এ নিয়ে যে মতামত দেন তা প্রণিধানযোগ্য।
মনু সংহিতায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, যে প্রত্যেক জাতির নির্দিষ্ট বৃত্তি ছিল এবং স্মৃতিকাররা বৃত্তির ভিত্তিতে সে জাতির বর্ণ ও সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণ করে দিতেন।
এর থেকে প্রমাণিত হয়, প্রাচীনকালে কিছু গুণকে উত্তম এবং কিছু গুণকে অধম বলে গণ্য করা হতো।
একইভাবে কিছু বৃত্তিকে শুদ্ধ এবং কিছু বৃত্তিকে অশুদ্ধ বলে বিবেচনা করা হতো।
এভাবে গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র—এ চার বর্ণের সৃষ্টি হয়।
● কৌলীন্য প্রথার ভয়ানক কুফল: বিনয় ঘোষের লেখা “ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর” পুস্তকের ১১০ পৃষ্ঠায় লেখা আছে,”ব্রাহ্মণেরা কৌলীন্য প্রথার দোহাই দিয়ে সামাজিক সুবিধা আদায় করতে লাগলেন।
ক্রমে এই কৌলীন্য প্রথা থেকে সৃষটি হল কন্যাকে উচ্চবর্নে বিবাহ দেবার রীতি, যার অবশ্যম্ভাবী ফল হল বহুবিবাহ।
এক একজন কুলীন ব্রাহ্মণ বহু কন্যার পাণিগ্রহন করতে লাগলেন।
ঋতুমতি হবার আগে বিবাহ দেবার বাধ্যবাধকতা ও বিবাহ দিতে না পারলে পিতামাতার যে সামাজিক অসম্মান হত তা থেকে মুক্তি দেবার জন্য কুলীন ব্রাহ্মণেরা এই সব কন্যাদের বিবাহ করতেন।
অতএব বিবাহ বেশ লাভজনক ব্যাবসা হয়ে উঠল।
কুলীন ব্রাহ্মণ কন্যাদের অসহায় পিতা মাতার দু তিন ডজন স্ত্রী থাকা সত্বেও, ৭০/৮০ বছরের বৃদ্ধ কুলীন ব্রাহ্মণদের উপযুক্ত পাত্র বিবেচনা করতেন।
মৃতপ্রায় ৮০ বছরের ও অধিক বয়স্ক বৃদ্ধের সাথে নিতান্ত বালিকা কন্যাদের বিবাহ হত মৃত্যুর আগে। সে বৃদ্ধের লাভ হত সামান্য কয়েকটি টাকা।“
কুলীন ব্রাহ্মণদের মধ্যে অনেকে এ প্রথার বিরোধিতা করেছিলেন তাদের মাঝে পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশে) রাসবিহারী মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
তিনি তার জীবন চরিতে যা লিখেছেন তা থেকে সামান্য কিছু তূলে ধরা হল।
তিনি লিখেছেন, ”পিতাঠাকুর মহাশয় আমাকে অতি শৈশবাবস্থায় রাখিয়া স্বর্গারোহন করেন। তখন পিতৃব্য শ্রীযুক্ত তারক চন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয় আমার অভিভাবক ছিলেন। দারিদ্রতাবশত আমাকে অল্পকালের মাঝেই তিনি ৮টি বিবাহ করান।
বহুবিবাহে সম্মতি থাকিলে বোধহয় আমাকে শতাধিক রমণির পাণী গ্রহন করতে হত।
নিরুপায় হয়ে আরো ৬টি বিবাহ করিতে হইল, তাহাতে আমার ঋন পরিশোধ ও ভরণপোষনের সংস্থা হইলে আমি হোসেন শাহির জমিদারিতে আশ্রয় গ্রহনপূর্বক তহশিলদারি কর্মে নিযুক্ত হই।"
(রাসবিহারি মুখোপাধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত- ভারতীয় জাতীয় গ্রন্থাগারে পাওয়া যাবে)।

এছাড়া আরো অনেক দৃষ্টান্ত আছে যে, যার দ্বারা প্রমান করা যেতে পারে, যে কৌলিন্য প্রথা সমাজে ভীষন আকার ধারন করেছিল।
যেমন,
(ক) একটি ব্রাহ্মণের যদি ত্রিশটি স্ত্রী থাকে তবে প্রতি মাসে কয়েকদিনের জন্য শ্বশুরালয়ে গিয়ে থাকলে আর খেয়ে ও ঊপহার পেয়ে থাকলে, জীবিকা অর্জনের কোন চেষ্টা না করে তার সারা বৎসর কেটে যেতে পারে।
বহুবিবাহ প্রথার ফলে, কুলীন ব্রাহ্মণেরা এক নিষ্কর্মা, পরভুকশ্রেণী হয়ে উঠেছে, এবং বিবাহের মত একটি সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান কে নীতি হীনতার উৎস করে তুলেছিল।
(খ) অতএব অনেক কুলীন ব্রাহ্মণের জীবনধারণের একমাত্র উপায় ছিল বহুবিবাহ করা।
(গ) কুলীনরা বৃদ্ধ বয়সেও বিবাহ করত।
অনেক সময় স্ত্রীদের সঙ্গে তাদের দেখা সাক্ষাৎই হত না
অথবা বড়জোর ৩/৪ বছর পরে একবারের জন্য দেখা হত।
(ঘ) এমন কথা শোনা যায় যে একজন কুলীন ব্রাহ্মণ ১ দিনেই ৩/৪ টি বিয়ে করেছেন।
(ঙ) কোন কোন সময়ে একজনের সব কয়টি কন্যার ও অবিবাহিত ভগিনীদের একই সঙ্গে বিবাহ দেয়া হত।
(চ) কুলীনের ঘরের বিবাহিত বা কুমারী কন্যাদের খুব দুঃখের মাঝে দিন কাটাতে হত।
কুলীনদের এ ধরনের বহু বিবাহের ফলে ব্যাভিচার, গর্ভপাত, শিশুহত্যা ও বেশ্যাবৃত্তির মত জঘণ্য সব অপরাধ সংঘটিত হত।
উপরের (ক) থেকে (চ) পর্জন্ত উদ্ধৃতিগুলো শ্রী বিনয় ঘোষের লেখা ঐ ““ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর” নামক পুস্তক থেকে নেয়া হয়েছে।
মোট কথা কৌলিন্য প্রথা এক শ্রেণীকে একশত খণ্ডে বিভক্ত করে বিভেদের প্রাচীর রচনার ফলে মানুষের মানবিকতাকে দারুনভাবে অপমানিত করা হয়েছিল এবং মানুষের স্বাধীন অধিকারের মূলে কুঠারাঘাত করা হয়েছিল।
● বল্লাল সেন দ্বারা কৌলীন্য প্রথা সৃষ্টির আসল কারণ: কৌলীন্য শব্দটির অর্থ হচ্ছে বংশ বা কূল গৌরব। প্রত্যেকেরই বংশ-পদবী আছে এবং সেটা নিয়ে যে গৌরব, যে আভিজাত্য প্রদর্শনের প্রথা, তাই কৌলীন্য প্রথা।
প্রশ্ন আসতে পারে যে, “হিন্দু সমাজে কি সেই সত্যযুগ থেকে এ পদবী প্রচলন ছিল?”
একটু লক্ষ্য করলেই আমরা স্পষ্ট দেখতে পাবো যে, “রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম, যুধিষ্ঠির, অর্জুন, বিশ্বামিত্র, দুর্যোধন, দশরথ, শঙ্করাচার্য, শ্রীচৈতন্য প্রমুখ মহামানবের নামের পেছনে কোন পদবী বা টাইটেল ছিল না। তাহলে???
১৫১০ সালে আনন্দ ভট্ট রচিত ও ১৯০৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া কর্তৃক প্রকাশিত “বল্লাল চরিত” নামক বইয়ে হিন্দু সমাজে পদবী প্রচলন সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে (তথ্যসূত্রঃ সমাজদর্পণ ১৫ বর্ষ, সংখ্যা ১২; জুন ১৯৯৯)।
উক্ত গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, গৌড়ের বৈদ্য বংশীয় রাজা বল্লাল সেন (১১৫৮-১১৭৯ সাল) নিজ সহধর্মিণী থাকা অবস্থায় অধিক বয়সে পদ্মিনী নাম্নী এক সুন্দরী ডোম নর্তকীকে বিয়ে করেন। এতে দেশজুড়ে রাজার সুনাম বিনষ্ট হয় এবং এ কুকীর্তি নিয়ে প্রজারা সমালোচনা শুরু করে দেন।
রাজা এই কলঙ্ক থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সকল সম্প্রদায়ের প্রজাদের এক সম্মিলিত ভোজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। কিন্তু, সকল সম্প্রদায়ের লোকেরা উপস্থিত থাকলেও নমশূদ্র বিপ্রগণ এই ভোজ অনুষ্ঠানে যোগদানে বিরত থাকেন, অথ্যাৎ রাজার এই কুকীর্তিকে সমর্থন করে তারা ভোজ সভায় অংশ নেন নি। রাজা তাদের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হন এবং নমশূদ্র লোকদের চাকরীচ্যুত করেন। শুধু তাই নয়, রাজা তাদের চণ্ডাল বলে গালাগাল করে নগর বন্দর থেকে উৎখাত করে দেন। অন্যদিকে ভোজ সভায় অংশগ্রহণকারী সম্প্রদায়ভুক্তরা রাজার সকল কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়ে রাজার অনুগ্রহ লাভ করতে যত্নবান হন। রাজাও এসব সম্প্রদায়কে সাহায্য করেন এবং অনেক সম্প্রদায়কে কৌলীন্য বা টাইটেল দান করেন।
এভাবেই, বল্লালসেন পদবী বৈষম্য সৃষ্টি করে হিন্দু সমাজে বিষাক্তবীজ বপন করেছিলো যা বর্ণভেদকে আরও শক্তিশালী করে।
এই বর্ণভেদ আজও আমাদেরকে দুর্বল করে রেখেছে।
সেন রাজারা বাঙালি ছিল না। তবুও, পদবী বৈষম্য সৃষ্টি করে বাঙ্গালীদের শাসন করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য।
পরিশেষে, মানুষের সৃষ্ট এই জাত ও পদবী বৈষম্য একজন মানুষের সাথে অন্য মানুষের মধ্য দূরত্ব সৃষ্টি করেছে।
এতে হিন্দু সমাজের হয়েছে অপূরণীয় ক্ষতি। ধর্মান্তরিত হয়েছে অসংখ্য নিম্নশ্রেণী ও বর্ণের হিন্দুরা।
রাস্তায় যেমন সকল যানবাহন একই গতিতে চলতে পারে না, তেমনি সমাজের সকল মানুষও সম আর্থিক সচ্ছলতায় চলতে পারে না।
তাই সমাজের কেউ ডাক্তার, কেউ প্রকৌশলী, কেউ শিক্ষক, কেউ দারোয়ান, কেউ বা সুইপার। নিজের যোগ্যতার উৎকর্ষ সাধন করতে পারলে একজন কর্মকর্তা যেমন পদন্নোতি পান, তেমনি আমরা নিজ নিজ বর্ণ পরিবর্তন না করেও, স্ব স্ব বর্ণে দক্ষতা অর্জন করে উচ্চাসনে বসতে পারি। কোন বর্ণ উঁচু আর কোন বর্ণ নিচু, ভগবান শ্রী কৃষ্ণ গীতায় তা কোথায় উল্লেখ করে নি। সুতরাং, একজন মানুষ জন্মসূত্রে নয়; বরং, তার কর্মগুণে স্বীকৃতি লাভ করে।
(তথ্যসূত্র: অতুল সুর, বাংলার সামাজিক ইতিহাস, কলকাতা, ১৯৭৬।
নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ভারতীয় জাতি বর্ণ প্রথা, কলকাতা, ১৯৮৭।
রমেশচন্দ্র মজুমদার,
বঙ্গীয় কুলশাস্ত্র, কলকাতা, ১৯৮৯।
নগেন্দ্রনাথ বসু, বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ২ খন্ড, কলকাতা।
বিনয় ঘোষ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
বাঙ্গালার সামাজিক ইতিহাস, দুর্গাচন্দ্র সান্যাল, মডেল পাবলিসিং হাউস)


লাইক
মন্তব্য
মন্তব্যগুলি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন