রবিবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৯

সদগোপ বা গোয়ালা সম্প্রদায়, উৎপত্তি, ইতিহাস এবং বিভাগ:


প্রণব কুমার কুণ্ডু










সদগোপ বা গোয়ালা সম্প্রদায়, উৎপত্তি, ইতিহাস এবং বিভাগ:

ফেসবুক থেকে       শেয়ার করেছেন     প্রণব কুমার কুণ্ডু




রানা চক্রবর্তী গোষ্ঠীটিতে একটি পোস্ট শেযার করেছেন:          ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য


 সদগোপ বা গোয়ালা সম্প্রদায়, উৎপত্তি, ইতিহাস এবং বিভাগ:
● ছবিতে- ১৮৬০ এর দশকে তোলা এক সদগোপ সম্প্রদায়ের ব্যক্তির ছবি। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে বাংলার জাতিগত শ্রেণীবিভাগ নথিভুক্ত করার জন্য ছবিটি তোলা হয়েছিল।
(ছবি সৌজন্যে- ব্রিটিশ লাইব্রেরি, ইউনাইটেড কিংডোম)
(তথ্যসূত্র:
১- People of India Bihar Volume XVI Part Two edited by S Gopal.
২- বাঙালির ইতিহাস (আদিপর্ব)- নিহাররঞ্জন রায়।)


রানা চক্রবর্তী Tapash Sarkar 


ফেসবুক থেকে শেয়ার করেছেন, প্রণব কুমার কুণ্ডু



প্রণব কুমার কুণ্ডু












পুরানো সেই দিনের কথা: সদগোপ বা গোয়ালা সম্প্রদায়, উৎপত্তি, ইতিহাস এবং বিভাগ:

সংস্কৃত শব্দ সদ্ অর্থাৎ ভালো এবং গোপ অর্থাৎ গোয়ালা থেকে সদগোপ নামটি এসেছে। তাঁরা নিজেদেরকে হিন্দু দেবতা কৃষ্ণের বংশধর হিসাবে গন্য করেন। কালপঞ্জী অনুযায়ী, এদের অনেকে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর পূর্ব-গঙ্গো সাম্রাজ্যের শাসনকালে এবং বাকীরা পঞ্চদশ শতকে কামরূপ রাজাদের সময়ে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেন। গয়া ও বৃন্দাবন এদের তীর্থভূমি।
গোয়ালা বাংলাদেশে বসবাসরত একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। হিন্দু সমাজে সদগোপ নামে পরিচিত গাভীপালক সম্প্রদায়। এদের মূল জীবিকা দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার বিক্রি করা। কিছুকাল আগ পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বিশেষ পেশার গোয়ালাদের দেখা গেলেও এখন এরা পরিণত হয়েছে সাধারণ পেশার মানুষে। শহরে এদের অস্তিত্ব প্রায় লীন। গোয়ালাদের আদিনিবাস ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে। এদেরই একটি অংশ সিলেটের চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করে। আবার অনেকে রেল-শ্রমিক হিসেবেও এ অঞ্চলে আগমন করে। দেশ বিভাগ পরবর্তী সময়ে তাদের অনেকেই আবার পার্বত্য ত্রিপুরায় চলে যায়। সিলেট জেলার খাদিম, বড়জান, কালাগুল, রাখালগুল, গুল্নী, ছড়াগাং এবং বড়জান চা কারখানায় গোয়ালা নৃগোষ্ঠীর প্রায় ৮ হাজার চা শ্রমিক রয়েছে।
গোয়ালা শব্দটি সংস্কৃত গোপাল শব্দের অপভ্রংশ। মহাভারতের যুগেও তাদেরকে গোপালা এবং আহির এই দু’নামে অভিহিত করা হতো। এখনও ভারতের উত্তরাঞ্চলে তারা আহির নামে পরিচিত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য বাংলাভাষী অঞ্চলে তারা গোয়ালা নামে পরিচিত। তারা নিজেদেরকে শ্রীকৃষ্ণের স্বগোত্র বলে পরিচয় দেয়। ক্ষেত্রকুলে জন্মগ্রহণ করলেও শ্রীকৃষ্ণ শৈশবে গোপ পরিবারে পালিত হন এবং সেই পরিবেশেই আমরণ অতিবাহিত করেন। ফলে গোপবংশীয়রা (গোয়ালারা) শ্রীকৃষ্ণের আপনজন হয়ে উঠেছিল এবং গোয়ালাদের নিকট শ্রীকৃষ্ণ একান্ত আপনজন এবং আরাধ্য দেবতা।
গোয়ালারা তিনটি প্রধান অসবর্ণ গোত্রে বিভক্ত। গোত্রগুলি হচ্ছে: আলিস্মন, ভরদ্বাজ এবং সচ্চিদানন্দ। এই গোত্রগুলি আবার গোপ, ঘোষ, দাগা উপগোত্রে বিভক্ত। স্ব-স্ব উপগোত্রের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ। সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে তারা নিজেদেরকে মধ্যম শ্রেণিভুক্ত বলে মনে করে। ব্রাহ্মণকে তারা কুলীন এবং কায়স্থ, কর্মকার, বণিক, বৈদ্য প্রভুতদেরকে তারা তাদের সমপর্যায় মনে করে। অপরদিকে কায়স্থ, কর্মকার, বণিক, বৈদ্য প্রভৃতিরা গোয়ালাদেরকে নীচু শ্রেণির বলে মনে করে এবং সেভাবেই সামাজিক আচরণ করে। মালাকার, কাহার, হালুয়াদাস, জেলে কৈবর্ত, ঋষিদাস প্রভৃতিদেরকে গোয়ালারা নিচু শ্রেণির বলে মনে করে এবং তাদের সঙ্গে একত্রে কোন পংক্তিভোজে সামিল হয় না। পুত্রসন্তানেরা পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। পরিবারে নারীপুরুষ উভয়ই কায়িক শ্রমদান করে। সদগোপরা মূলত দুটি শাখায় বিভক্ত। যথা - কুলীন এবং মুলিক, পরে এরা আবার পূর্বী ও পশ্চিমী কুলীনে বিভক্ত হয়। পশ্চিমী কুলীনেরা পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত এবং ঘোষ ও সর্হসা গোষ্ঠীতে বিভক্ত। পূর্বী কুলিনেরা পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের বাসিন্দা, এবং কিছু বিহারের অধিবাসী। সদগোপরা বাংলা ভাষায় কথা বলেন কিন্তু বিহারের অধিবাসীরা কথা বলেন হিন্দীতেও। সদগোপরা কিছু উপশাখায় বিভক্ত, যেমন সুর, নিয়োগী, কুমার, ঘোষ, কুইলা, দন্ডপাট, মহাপাত্র, সরকার, মন্ডল এবং রায়। তারা স্বগামী গোষ্ঠী এবং বিপরীতগামী গোত্র অনুসরণ করেন। সদগোপরা মূলত ভূস্বামী গোষ্ঠী।
গোয়ালারা সনাতন হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী। তবে তাদের অধিকাংশই বৈষ্ণবপন্থী এবং শ্রীচৈতন্যদেবের অনুসারী। গৃহ দেবতা হিসাবে তারা লক্ষ্মীদেবীকে মানে এবং প্রতিটি পরিবারে সেভাবেই লক্ষ্মীর আসন পাতা থাকে। পুরো সমাজের নিয়ন্ত্রক দেবতা হিসেবে তারা শ্রীকৃষ্ণকে অর্চনা করে। গোয়ালাসমাজ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের চৌদ্দ দেবতার মন্দির এবং ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরকে পবিত্র স্থান বলে মান্য করে। এইসব দেবদেবী ছাড়াও তারা হিন্দুদের মতো শিব, দূর্গা, জগন্নাথ, লক্ষ্মী, নারায়ণ, কালী প্রভৃতি দেবদেবীর উপাসনা করে। শারদীয় দূর্গাপূজায় তারা প্রতিমা প্রতিষ্ঠা না করে ঘট পূজার মাধ্যমে সম্পন্ন করে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তারা শ্রুতিমধুর সংকীর্তন পরিবেশন করে।
গোয়ালারা রাধাকৃষ্ণকে তাদের গৃহদেবতা হিসাবে গণ্য করে এবং প্রায় প্রতিটি পরিবারে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে। শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন, দোলযাত্রা-হোলি উৎসব এবং রাসযাত্রা তারা গুরুত্বসহকারে পালন করে। বাংলা কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে গোয়ালারা রাসযাত্রা উৎসবের আয়োজন করে। শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে শ্রীরাধা এবং অন্যন্য গোপবালাদের গোপন অভিসার এবং তাদের নৃত্যগীত ও আনন্দ উল্লাসের কথা স্মরণে রেখেই গোয়ালাসমাজ এই আনন্দ উৎসবের আয়োজন করে।

(তথ্যসূত্র:

১- People of India Bihar Volume XVI Part Two edited by S Gopal.

২- বাঙালির ইতিহাস (আদিপর্ব)- নিহাররঞ্জন রায়।)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন