আর্য সুব্রত'র রবীন্দ্রনাথ
3 ঘণ্টা ·
সবাই-এর সঙ্গে শেয়ার করা হয়েছে
রবীন্দ্রনাথের ধর্ম...
"একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্ম সমাজের অনুসারণকারীদের, ‘আস্তিক হিন্দু’ বলে স্বীকৃতি দিতে অনুরোধ করেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে ব্রাহ্ম পরিবারগুলোকে হিন্দু ব্রাহ্ম বলে ঘোষণা দেয়া হয়।"
"রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর ব্রাহ্মসমাজের নন, কোনো বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীর নন, তিনি উপনিষদের উদার আকাশে স্বমহিমায় প্রকাশমান। ১৩১৫ বঙ্গাব্দের মাঘোৎসবে তিনি ঐ উৎসবকে ব্রাহ্মোৎসব বলতে চাননি, ‘ব্রহ্মোৎসব’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
"রবীন্দ্রনাথের ধর্মসাধনা ও সাহিত্য-সাধনা-পরস্পর সংযুক্ত এবং এক উৎসজাত, সে উৎস উপনিষদ। উপনিষদের বৈদিক বহ্ম রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর। উপনিষদ বাদ দিয়ে রবীন্দ্র-সাহিত্যের আলোচনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। উপনিষদ সম্পর্কে কবির মনোভাবটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে এই কথায় - ‘উপনিষদ ভারতবর্ষের ব্রহ্ম জ্ঞানের বনস্পতি। এ যে কেবল সুন্দর শ্যামল ছায়াময় তা নয়, এ বৃহৎ এবং এ কঠিন। এর মধ্যে যে কেবল সিদ্ধির প্রাচুর্য পল্লবিত তা নয়, এতে তপস্যার কঠোরতা ঊর্ধ্বগামী হয়ে রয়েছে।’
উপনিষদের শিক্ষাকে রবীন্দ্রনাথ তত্ত্বরূপে নয়, জীবনের গভীর সত্যরূপে অন্তরের মধ্যে গ্রহণ করেছিলেন এবং তা কবিকে নীরস ব্রহ্মজ্ঞানী করে তোলেনি, তাঁকে সরস ব্রহ্মোপাসক করে তুলেছিল।
"রবীন্দ্রনাথের বাবা মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন একেশ্বরবাদী, ব্রাহ্ম আন্দোলনের পুরোধা। তিনি পৌত্তলিকতা বর্জন করেও উপবীত ত্যাগ করেন নাই। পালন করেছেন অনেক হিন্দু আচার, বেদ উপনিষদ তাঁর জীবনের আদর্শ। ধর্মের বিচারে উদার হয়েও সামাজিক আচারে দেবেন্দ্রনাথ রক্ষণশীল। তিনি ছিলেন রাজা রামমোহনের অনুসারী-ভক্ত। পিতার উপনিষদিক শিক্ষা এবং বিপরীত পারিপার্শিক প্রভাব রবীন্দ্রচেতনায় যে গভীর ছাপ রেখেছিল তা তাঁর ভাবনায় ও কর্মে যে বৈপরিত্য সৃষ্টি করে পিতার মৃত্যুর (১৯০৫ খ্রি.) পরও তা থেকে মুক্তি পেতে সময় লেগেছে। এদিক থেকে রবীন্দ্রনাথের জীবনাচার বড় বিচিত্র। এ বৈপরীত্য বা স্ববিরোধীতা থেকে রবীন্দ্রনাথকে রক্ষা করেছে তাঁর গভীর মানবিক-চেতনার ভিত। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আমার ধর্ম নয়।’ তিনি আরো বলেছিলেন ‘আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন, আমি পঙক্তিহারা, আমি তোমাদেরই লোক।’
মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ প্রতিদিন প্রত্যুষে তাঁর পুত্রদের বেদ ও উপনিষদ-এর শ্লোকগুলো সুস্পষ্ট উচ্চারণে আবৃত্তি করাতেন। নৈতিক চরিত্র গঠনে এই সুন্দর শ্লোকগুলো আবৃত্তি ও প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে বালক রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তাঁর মানসিকতা গঠনে এগুলো গভীর ও অক্ষুণ্ণ রেখাপাত করেছিল। ঠাকুর পরিবারের সদস্য হিসেবে ১৮৮৪ খিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ মাত্র ২৩ বছর বয়সে ব্রাহ্ম সমাজ-এর সেক্রেটারি পদের দায়িত্ব পান। এ সময় ব্রাহ্ম সমাজ তীব্র হিন্দু সমালোচনার সম্মুখীন হয়। ব্রাহ্ম ধর্মের বিরুদ্ধে শিক্ষিত হিন্দুদের একটি গোষ্ঠী গঠন করা হয়েছিল। তারা নিজেদের আস্তিক বলে ঘোষণা করেন। এ সময় বঙ্কিমচন্দ্র হিন্দু ধর্মের পক্ষে লিখতেন আর রবীন্দ্রনাথ লিখতেন ব্রাহ্ম ধর্মের পক্ষে। দুটি পত্রিকায় এই লেখা ধারাবাহিকভাবে চলে দীর্ঘদিন। সি জে ও ডনেল (১৮৫০-১৯৩৪ খ্রি.)-কে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্ম সমাজের অনুসারণকারীদের, ‘আস্তিক হিন্দু’ বলে স্বীকৃতি দিতে অনুরোধ করেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে ব্রাহ্ম পরিবারগুলোকে হিন্দু ব্রাহ্ম বলে ঘোষণা দেয়া হয়। হিন্দুত্বের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সতেজ প্রতিবাদ করার সুযোগ রবীন্দ্রনাথ কখনো হাতছাড়া করেননি।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবিতকালে এশিয়ার শ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন। বিংশ শতকের পৃথিবীর মনীষীবৃন্দের মধ্যে প্রথম সারিতে তাঁর আসন, তিনি আধুনিক যুগের মহামানব, হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীকে তিনি শান্তি ও মৈত্রীর পথে, সত্য ও ন্যায়ের পথে আহ্বান করেছেন। আড়াই হাজার বছর আগে এই ভারতবর্ষ থেকেই করুণাঘন বুদ্ধদেব মুক্তিবাণী বিশ্বে প্রচার করেছিলেন। বুদ্ধদেবকে রবীন্দ্রনাথ ‘সর্বশ্রেষ্ঠ মানব’ বলে অভিহিত করেছেন। বুদ্ধের মুক্তি-সাধন তাঁর কাছে প্রেমসাধনা তথা মৈত্রীসাধনা বলে মনে হয়েছে। বুদ্ধদেব সম্পর্কে কবির দুটি প্রাসঙ্গিক মন্তব্য এ ক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য। এক বৈশাখী পূর্ণিমার ভাষণে কবি বলেছেন, ‘তাঁরই স্মরণ নেব যিনি আপনার মধ্যে মানুষকে প্রকাশ করেছেন। তিনি সেই মুক্তির কথা বলেছেন, যে মুক্তি নঞর্থক নয়, সদর্থক; যে মুক্তি কর্মত্যাগে নয়, সাধুকর্মের মধ্যে আত্মত্যাগে; যে মুক্তি রাগদ্বেষ বর্জনে নয়, সর্বজীবের প্রতি অপরিমেয় মৈত্রীসাধনায়।’ অপর এক ভাষণে বলেছেন, ‘(আত্মার) সেই স্বরূপটি কী? শূন্যতা নয়, নৈষ্কর্ম্য নয়। সে হচ্ছে মৈত্রী, করুণা, নিখিলের প্রতি প্রেম। বুদ্ধ কেবল বাসনা ত্যাগ করতে বলেননি, তিনি প্রেমকে বিস্তার করতে বলেছেন। কারণ, এই প্রেমকে বিস্তারের দ্বারাই আত্মা স্বরূপকে পায় - সূর্য যেমন আলোককে বিকীর্ণ করার দ্বারাই আপনার স্বভাবকে পায়।’
রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে কাব্যসাধনা ও ধর্মসাধনাকে ভিন্ন করে দেখা যায় না, এই দুই একই অলৌকিক বেদনা-জাত। রবীন্দ্র-সাহিত্যের আলোচনায় তাই কবির ধর্মজিজ্ঞাসার প্রসঙ্গ অনিবার্যরূপে মনে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের গভীর অধ্যাত্মব্যাকুলতা ও ঈশ্বরপ্রেম তাঁর সাহিত্যে বিকীর্ণ হয়ে আছে।
রবীন্দ্রনাথ যে আনন্দের অধিকারী, তা অলৌকিক আনন্দ। সেই আনন্দ-বাণীটিকে রক্ষা করার জন্য তাঁকে সমস্ত জীবন ধরে মানসক্ষেত্রে ও সংসারক্ষেত্রে যে বেদনা বহন করতে হয়েছে, মৃত্যুশোক ও দুঃখের দ্বারা পীড়িত হতে হয়েছে, তার স্বাক্ষর রয়েছে, ‘শান্তিনিকেতন’ উপদেশমালায়।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজিজ্ঞাসাকে তাঁর ধর্মজিজ্ঞাসা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না, তার প্রমাণ পাই ‘শান্তিনিকেতন’-এ। রবীন্দ্রনাথের আস্তিকতাকে বাদ দিলে রবীন্দ্র-পরিচয়-লাভের সকল প্রয়াসই যে ব্যর্থ হয়ে যেতে বাধ্য, একথা এখানে নিঃসংশয়ে উপলব্ধি করতে পারি।
নিদারুণ শোকের আঘাতে মৃত্যুর অভিঘাতে আরামের শয্যাতল-উত্থিত, কঠিনের বিচারে প্রহৃত মানবাত্মার আকুল আত্মজিজ্ঞাসা ‘শান্তিনিকেতন’-এর প্রতিটি ছত্রে ধ্বনিত হয়েছে। দুঃখ, মৃত্যু, বেদনা যেমন আছে, তেমনই আছে সুখ, আনন্দ, হর্ষ; শুধু তাই নয়, দুঃখ ও বেদনা আছে বলেই সুখ ও আনন্দ আমাদের কাছে এত মধুর এবং সর্বোপরি বিশ্বনিয়ন্তা আছেন-তিনিই উৎসবরাজ। তাঁরই উৎসবে আমরা অংশীদারমাত্র; এই গভীর আত্মবিশ্বাসে ‘শান্তিনিকেতন’ উপদেশমালা প্রোজ্জ্বল।
‘শান্তিনিকেতন’ উপদেশমালা কোনো বিচ্ছিন্ন মতবাদ নয়, তা রবীন্দ্রনাথের জীবনব্যাপী সাধনারই অঙ্গ। রবীন্দ্রনাথের এই সাধনার ভিত্তিস্থল উপনিষদ ও তাঁর ঈশ্বর উপনিষদের ব্রহ্ম। রবীন্দ্রনাথকে ও রবীন্দ্র-সাহিত্যকে জানতে হলে তাই আমাদের যেতে হয় উপনিষদের কাছে, ঋষিকণ্ঠ-উচ্চারিত মন্ত্রের ঔপনিষদিক ব্রহ্মের সমীপে।
রবীন্দ্রনাথের জীবনব্যাপী সাধনায় ধর্মজিজ্ঞাসা বারবারই দেখা দিয়েছে। তার পরিচয় পাই- রামমোহন রায়, ব্রহ্মোপনিষদ, ব্রহ্মমন্ত্র, ঔপনিষদ ব্রহ্ম, ভারতবর্ষ, শান্তিনিকেতন ১৭ খন্ড, ধর্মের অধিকার, মানুষের ধর্ম, ভারতপথিক রামমোহন রায়, আশ্রমের রূপ ও বিকাশ প্রভৃতি গদ্যগ্রন্থে এবং ব্রহ্মসঙ্গীত নৈবেদ্য গীতাঞ্জলি, গীতিমালা, গীতালি ও ধর্মসঙ্গীত, প্রভৃতি কাব্য ও গীতিসংকলনে।
রবীন্দ্রনাথের উপনিষদভিত্তিক সাধনার শ্রেষ্ঠ পরিচয় বিধৃত হয়েছে ‘শান্তিনিকেতন’ উপদেশমালায়। রবীন্দ্রনাথ যে কেবল শিল্পী ও সাহিত্যক নন, তিনি যে প্রাচীন ভারতের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ উপনিষদের ঋষি-কবিদের যোগ্য উত্তরসূরি, তার প্রমাণ এখানে পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, তাঁর ধর্ম জিজ্ঞাসা যে তাঁর সাহিত্যজিজ্ঞাসার মূলেও বর্তমান, তার প্রমাণ এখানেই রয়েছে। ধর্মজিজ্ঞাসা-বিচ্যুত রবীন্দ্র-চর্চা ব্যর্থ, এ কথা আমাদের স্বীকার করতেই হয়। উপরোক্ত গদ্যগ্রন্থ, কাব্য, গীতি-সংকলন ও নাটকের দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, রবীন্দ্রনাথ ভারত-সাধনারই ফল, নিবিশেষে ধর্ম-জিজ্ঞাসারহিত সংস্কৃতি-সাধনায় তাঁর আগ্রহ ছিল না।
আশি বছর পূর্তি উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে উপনিষদিক শিক্ষার প্রভাব স্বীকার করে বলেছিলেন, ‘আজ আমার আশি বছরের আয়ুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনের সত্যকে সমগ্রভাবে পরিচিত করে যেতে ইচ্ছা করেছি। …আমি বারবার তপোবনের কথা বলেছি। সে তপোবন… পেয়েছি কবির কাব্য থেকেই। তাই স্বভাবতই সে আদর্শকে আমি কাব্যরূপেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছি। বলতে চেয়েছি, পশ্য দেবস্য কাব্যাং, মানবরূপে দেবতার কাব্যকে দেখো। আবাল্যকাল উপনিষদ আবৃত্তি করতে করতে আমার মন বিশ্বব্যাপী পরিপূর্ণতাকে অন্তর্দৃষ্টিতে মানতে অভ্যাস করেছে। সেই পূর্ণতা বস্তুর নয়, সে আত্মার। তাই তাকে স্পষ্ট জানতে গেলে বস্তুগত আয়োজনকে লঘু করতে হয়।’
আটচল্লিশ থেকে পঞ্চান্ন বৎসর বয়সে জীবনের মধ্যবিন্দু অতিক্রম করে এসে রবীন্দ্রনাথ ‘শান্তিনিকেতন’ উপদেশমালায় যে কথা বলেছেন, শেষ জন্মদিনে উপরোক্ত কথায় তারই প্রতিধ্বনি শুনি।
রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর ব্রাহ্মসমাজের নন, কোনো বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীর নন, তিনি উপনিষদের উদার আকাশে স্বমহিমায় প্রকাশমান। ১৩১৫ বঙ্গাব্দের মাঘোৎসবে তিনি ঐ উৎসবকে ব্রাহ্মোৎসব বলতে চাননি, ‘ব্রহ্মোৎসব’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ধর্মজিজ্ঞাসায় এই সম্প্রদায় গণ্ডিমুক্ত ভাবনাটি রবীন্দ্রনাথের ধর্মজিজ্ঞাসার প্রথম বৈশিষ্ট্য। কবি বলেছেন, ‘মুখের কথায় ঈশ্বরকে স্বীকার করার মতো নিজেকে ফাঁকি দেবার আর কি কিছু আছে। আমি এই সম্প্রদায়ভুক্ত, আমাদের এই মত, আমি এই বলি-ঈশ্বরকে এইটুকুমাত্র ফাঁকির জায়গা ছেড়ে দিয়ে তারপরে বাকি সমস্ত জায়গাটা অসংকোচে নিজে জুড়ে বসবার যে স্পর্ধা, সেই স্পর্ধা আপনাকে আপনি জানে না বলেই এত ভয়ানক। এই স্পর্ধা সংশয়ের সমস্ত বেদনাকে নিঃসাড় করে রাখে। আমরা যে জানি নে এটাও জানতে দেয় না।’
আমাদের ঈশ্বর-সাধনা বা উপসনার মধ্যে যে কত ফাঁকি আছে, তার ইয়ত্তা নেই। রবীন্দ্রনাথ এই প্রতারণার তীব্র নিন্দা করেছেন। ‘মনে আছে আমার পিতার কোনো ভৃত্যের কাছে ছেলেবেলায় আমরা গল্প শুনেছি যে, সে যখন পুরীতীর্থে গিয়েছিল তার মহা ভাবনা পড়েছিল জগন্নাথকে কী দেবে। তাঁকে যা দেবে সে তা কখনো আর ভোগ করতে পারবে না। সেই জন্য সে যে জিনিসের কথাই মনে করে কোনোটাই তার দিতে মন সয় না - যাতে তার অল্পমাত্রও লোভ আছে সেটাও চিরদিনের মতো দেয়ার কথায় মন আকুল করে তুলতে লাগল। শেষকালে বিস্তর ভেবে সে জগন্নাথকে বিলিতি বেগুন দিয়ে এল। এই ফলটিতেই সে লোকের সবচেয়ে কম লোভ ছিল।
আমরা ঈশ্বরের জন্যে কেবলমাত্র সেইটুকুই হয়তো ছাড়তে চাই যেটুকুতে আমাদের সবচেয়ে কম লোভ- যেটুকু আমাদের নিতান্ত উদ্বৃত্তের উদ্বৃত্ত। ঈশ্বরের নাম-গাঁথা দুটো একটা মাত্র পাঠ করা গেল, দুটি একটি সঙ্গীত শোনা গেল, যাঁরা বেশ ভালো বক্তৃতা করতে পারেন তাদের কাছ থেকে নিয়মিত বক্তৃতা শোনা গেল। বললুম বেশ হলো, বেশ লাগল, মনটা এখন বেশ পবিত্র ঠেকছে - আমি ঈশ্বরের উপাসনা করলুম।’
রবীন্দ্রনাথের ধর্মজিজ্ঞাসা যে নিতান্তই বাস্তব, পরিচিত সংসারের মাঝেই যে কবি ঈশ্বরকে সন্ধান করেছেন, তার প্রমাণ এখানে পাই। কঠিন বাস্তবের ভিত্তিতে রবীন্দ্রনাথের ধর্মবোধ প্রতিষ্ঠিত, এই জন্যই তা আমাদের বিস্ময় ও শ্রদ্ধা দাবি করে। যখন পঞ্চাশোত্তীর্ণ কবিকে তাঁর ব্যক্তিগত সাংসারিক অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুনি, তখন আর সন্দেহ থাকে না যে এ অভিজ্ঞতা অনেক বেদনার মূল্যে ক্রীত। তাই একথায় আমাদের সায় দিতেই হয় - ‘সংসারটা যে কী জিনিস তা যে জানি। এ সংসারের অনেকটা পথ মাড়িয়ে আজ বার্ধক্যের দ্বারে এসে উত্তীর্ণ হয়েছি। জানি দুঃখ কাকে বলে, আঘাত কী প্রচণ্ড, বিপদ কেমন অভাবনীয়। যে সময়ে আশ্রয়ের প্রয়োজন সকলের চেয়ে বেশি সেই সময়ে আশ্রয় কিরূপ দুর্লভ। তিনি-হীন জীবন যে অত্যন্ত গৌরবহীন, চারদিকেই তাকে টানাটানি করে মারে। দেখতে দেখতে তার সুর নেবে যায়, তার কথা চিন্তা কাজ তুচ্ছ হয়ে আসে। সে জীবন যেন অনাবৃত - সে এবং তার বাইরের মাঝখানে কেউ যেন তাকে ঠেকাবার নেই। ক্ষতি একবারেই তার গায়ে এসে লাগে, নিন্দা একেবারেই তার মর্মে এসে আঘাত করে, দুঃখ কোনো ভাবরসের মাঝখান দিয়ে সুন্দর বা মহৎ হয়ে ওঠে না। সুখ একেবারে মত্ততা এবং শোকের কারণ একেবারে মৃত্যুসম হয়ে এসে তাকে বাজে। এ কথা যখন চিন্তা করে দেখি তখন সমস্ত সংকোচ মন হতে দূর হয়ে যায় - তখন ভীত হয়ে বলি : না, শৈথিল্য করলে চলবে না। একদিনও ভুলব না প্রতিদিনই তাঁর সামনে এসে দাঁড়াতেই হবে; প্রতিদিন কেবল সংসারকেই প্রশ্রয় দিয়ে, তাকেই কেবল বুকের সমস্ত রক্ত খাইয়ে প্রবল করে তুলে, নিজেকে এমন অসহায়ভাবে একান্তই তার হাতে আপাদমস্তক সমর্পণ করে দেব না, দিনের মধ্যে অন্তত একবার এই কথাটা প্রত্যহই বলে যেতে হবে - তুমি সংসারের চেয়ে বড়ো। তুমি সকলের চেয়ে বড়ো।’
রবীন্দ্রনাথ কেবল রসের সাধনা, ভাবের সাধনা করেছেন তা নয়, তিনি জ্ঞানের সাধনা, ও কঠিনের সাধনাও করেছেন। ‘নৈবেদ্য’ কাব্যে তার ইঙ্গিত আছে। ঈশ্বর প্রাপ্তির পথে ভাবে গদগদ হয়ে ওঠাটা ক্ষতিকারক, একথা রবীন্দ্রনাথ জোরের সঙ্গে বলেছেন ‘ভাবুকতা ও পবিত্রতা’ ভাষণটিতে। বলেছেন ‘শিকড়ের চাঞ্চল্য নেই। সে নিয়ত স্তব্ধ হয়ে, দৃঢ় হয়ে, গভীরতার মধ্যে নিজেকে বিকীর্ণ করে দেয়, নিয়ত আপনার খাদ্য নিজের একান্ত চেষ্টায় গ্রহণ করছে। শিকড়ের দিক থেকেই নেয়া হচ্ছে প্রধান ব্যাপার। এইটিই হচ্ছে চরিত্রের দিক, এটি ভাবের দিক নয়। উপাসনার মধ্যে এই চরিত্র দিয়ে যা আমরা গ্রহণ করি তাই আমাদের প্রধান খাদ্য। সেখানে চাঞ্চল্য নেই। সেখানে বৈচিত্র্যের অন্বেষণ নেই - সেইখানেই আমরা শান্ত হই, স্তব্ধ হই, ঈশ্বরের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হই।’ সেই গভীর কঠিন শান্ত সংযত ধর্মপথেই রবীন্দ্রনাথ নিজেকে চালনা করেছেন।
প্রেমের সাধনায় এই বিকারের আশঙ্কা সম্পর্কে আরেকটি ভাষণে কবি আলোচনা করেছেন। বলেছেন, ‘প্রেমের সাধনায় বিকারের আশঙ্কা আছে। প্রেমের একটা দিক আছে যেটা প্রধানত রসেরই দিক - সেইটের প্রলোভনে জড়িয়ে পড়লে কেবলমাত্র সেইখানেই ঠেকে যেতে হয় - তখন কেবল রসসম্ভোগকেই আমরা সাধনার চরম সিদ্ধি বলে জ্ঞান করি। তখন এই নেশায় আমাদের পেয়ে বসে। এই নেশাকেই দিনরাত্রি জাগিয়ে তুলে আমরা কর্মের কঠোরতা জ্ঞানের বিশুদ্ধতাকে ভুলে থাকতে চাই - কর্মতেই বিস্তৃত হই, জ্ঞানকে অমান্য করি।’
রবীন্দ্রনাথের সাধনা তাই কর্মের কঠোরতা ও জ্ঞানের বিশুদ্ধতাকে স্বীকার করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাকে বর্জন করে নয়। এইটি যদি আমরা স্বীকার করি তবে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অনেক ভ্রান্ত ধারণা হতে মুক্ত হব। ঐকান্তিক জ্ঞানের সাধনা শুষ্ক বৈরাগ্য আনে, ঐকান্তিক রসের সাধনা আনে ভাববিহ্বলতার বৈরাগ্য। রবীন্দ্রনাথ এ দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য সাধনা করতে চেয়েছেন ও বলেছেন সাধনার সার্থকতা সামঞ্জস্যে।
জীবনে দুঃখকে কেবল স্বীকার করে নয়, তার মাহাত্ম্য কীর্তন করে রবীন্দ্রনাথ দুঃখের মধ্যে ঈশ্বরের দেখা পেয়েছেন। ‘ধর্ম’ ও ‘শান্তিনিকেতন’ উপদেশমালায় বার বার তিনি এ কথা স্বীকার করেছেন।
দুঃখের মধ্য দিয়েই মঙ্গলময়ের আবির্ভাব ঘটে, এটি রবীন্দ্রনাথের জীবনে অন্যতম প্রধান বিশ্বাস। তিনি বলেছেন, ‘দুঃখ এবং আঘাত ন্যায্য হোক বা অন্যায্য হোক তার সংস্পর্শ থেকে নিজেকে নিঃশেষে বাঁচিয়ে চলবার অতি চেষ্টায় আমাদের মনুষ্যত্বকে দুর্বল ও ব্যাধিগ্রস্ত করে তোলে। …পৃথিবীর নিন্দা অবিচার দুঃখ-কষ্টকে যারা অবাধে অসংকোচে গ্রহণ করতে পারে তারা কেবল বলিষ্ঠ হয় তা নয়, তারা নির্মল হয়, অনাবৃত জীবনের ওপর দিয়ে জগতের পূর্ণসংঘাত লেগে তাদের কলুষ ক্ষয় হয়ে যেতে থাকে।’
ঈশ্বরের প্রতি প্রেম আছে বলেই দুঃখ অশান্তি আছে। দুঃখ অশান্তিতেই প্রেমের পরীক্ষা হয়-তাই দুঃখ কবির কাছে অভ্যর্থিত। ব্যাকুল বেদনায় রবীন্দ্রনাথ প্রার্থনা করেছেন, ‘যতদিন সেই প্রেমের টান না ধরে ততদিন অশান্তিকে যেন অনুভব করতে পারি। ততদিন যেন বেদনাকে নিয়ে রাত্রে শুতে যাই এবং বেদনাকে নিয়ে সকালবেলায় জেগে উঠি - চোখের জলে ভাসিয়ে দাও, স্থির থাকতে দিয়ো না।
দ্বন্দ্বের মধ্যেই যত দুঃখ, এবং এই দুঃখই সকাল উন্নতির মূলে; রবীন্দ্রনাথের ধর্মসাধনায় এই প্রত্যয়টির বিশেষ স্থান আছে। মনুষ্যত্বের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তা রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রকৃতি আত্মার দ্বন্দ্ব বলে প্রতিভাত হয়েছে। ‘স্বার্থের দিক এবং পরমার্থের দিক, বন্ধনের দিক এবং মুক্তির দিক, সীমার দিক এবং অনন্তের দিক - এই দুইকে মিলিয়ে চলতে হবে মানুষকে।’
যতদিন ভালো করে মেলাতে না পারা যায় ততদিনকার যে চেষ্টায় দুঃখ, উত্থান-পতনের দুঃখ, সে বড়ো বিষম দুঃখ। যে ধর্মের মধ্যে মানুষের এই দ্বন্দ্বের সামঞ্জস্য ঘটতে পারে সেই ধর্মের পথ মানুষের পক্ষে কত কঠিন পথ। এই ক্ষুরধারশাণিত দুর্গম পথেই মানুষের যাত্রা; এ কথা তার বলবার যো নেই যে, এই দুঃখ আমি এড়িয়ে চলব।
এই দ্বন্দ্বের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ মানুষ্যত্বের বিজয় প্রত্যক্ষ করেছেন। দুঃখ যে মানুষকে বৃহৎ করে এবং সেই বৃহত্বেই মানুষকে আনন্দের অধিকারী করে তোলে, এই ভাবটি রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র ব্যক্ত করেছেন, এখানে তারই সমর্থন পাই।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের দীক্ষাদিবস (৭ই পৌষ) ও মৃত্যুদিবস (৬ই মাঘ) উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণগুলোতে রবীন্দ্রনাথের ধর্ম-বোধের একটি স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। কবি বলেছেন, ‘সেই ৭ই পৌষে তিনি যে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন ৬ই মাঘ মৃত্যুর দিন সেই দীক্ষাকে সম্পূর্ণ করে তাঁর মহৎ জীবনের ব্রত উদযাপন করে গেছেন। শিখা থেকে শিখা জ্বালতে হয়। তাঁর সেই পরিপূর্ণ জীবন থেকে আমাদেরও অগ্নি গ্রহণ করতে হবে। এই জন্য ৭ই পৌষে তিনি একলা অমৃতজীবনের দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, সেদিনকার সংবাদ খুব অল্প লোকেই জেনেছিল। ৬ই মাঘে মৃত্যু যখন যবনিকা উদঘাটন করে দাঁড়ালো তখন কিছুই আর প্রচ্ছন্ন রইলো না।’
রবীন্দ্রনাথ আরো বলেছেন, ‘আজকের এই ৭ই পৌষের মাঝখানে তাঁর সেই সত্যদীক্ষার রুদ্রদীপ্তি এবং বরাভয়রূপ দুই-ই রয়েছে - সেটি যদি আমরা দেখতে পাই এবং লেশমাত্রও গ্রহণ করতে পারি তবে ধন্য হব। সত্যের দীক্ষা যে কাকে বলে আজ যদি ভক্তির সঙ্গে তাই স্মরণ করে যেতে পারি তাহলে ধন্য হব। এর মধ্যে ফাঁকি নেই, লুকোচুরি নেই, দ্বিধা নেই, দুইদিক বজায় রেখে চলবার চাতুরী নেই, নিজেকে ভোলাবার জন্যে সুনিপুণ মিথ্যা যুক্তি নেই, সমাজকে প্রসন্ন করবার জন্যে বুদ্ধির দুই চক্ষু অন্ধ করা নেই, মানুষের হাটে বিকিয়ে দেয়ার জন্য ভগবানের ধন চুরি করা নেই। সেই সত্যকে সমস্ত দুঃখ-পীড়নের মধ্যে স্বীকার করে নিলে তারপরে একেবারে নির্ভয়, ধূলিঘর ভেঙে দিয়ে একেবারে পিতৃভবনের অধিকার লাভ- চিরজীবনের যে গম্যস্থান, যে অমৃত-নিকেতন, সেই পথের যিনি একমাত্র বন্ধু, তাঁরই আশ্রয়প্রাপ্তি-সত্যাদীক্ষার এই অর্থ।’
নীলাকাশতলে প্রসারিত প্রান্তরের ছায়া-স্নিগ্ধ নিভৃত আশ্রমের যে দিনরাত্রির প্রাত্যহিক উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সজনে নির্জনে যে তাঁরই লীলার আসন পাতা রয়েছে, বীরভূমের রুক্ষ গৈরিক প্রান্তরে যে তাঁরই ভক্তিজীবনের দীক্ষা ও পরম বাণী লাভ করেছেন, রবীন্দ্রনাথ ৭ই পৌষ ও ৬ই মাঘের উৎসব উপলক্ষে, সেই উপনিষদিক ব্রহ্মের সত্য সমস্ত অন্তরের ব্যাকুলতা দিয়ে প্রকাশ করেছেন।
‘শান্তিনিকেতন’ উপদেশমালার রচনাস্থল বীরভূমের উদাস সন্ন্যাসী গৈরিক প্রকৃতিভূমি। তাঁর অধ্যাত্মসাধনার যোগ্য পটভূমিরূপে এই অবারিত উন্মুক্ত প্রান্তরের প্রয়োজন ছিল। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে মন্দির-তোরণে প্রত্যুষান্ধকারে ধ্যানে বসতেন। ধ্যানান্তিক ভাষণগুলিতে এই প্রকৃতির উপস্থিতি প্রকট। রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মসাধনাকে শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি সমর্থন জানিয়েছে ও সহায়তা করেছে, যেমন করেছে পদ্মাপ্রকৃতি, নির্জন বালুচর ও জনপদগুলো সোনারতরী-চিত্রা-গল্পগুচ্ছের নির্বিশেষ সৌন্দর্যসন্ধান ও সবিশেষ মর্তমমতার উদ্বোধনে। বীরভূমের কৃচ্ছ্রসাধনার ক্ষেত্রে এসে কবিতা ও গল্পের ধারা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তার স্থলে পাই যে নাটক, প্রবন্ধ, কবিতা ও গান - সেগুলোতে অধ্যাত্মজিজ্ঞাসার স্পর্শ রয়েছে। তাই ‘শান্তিনিকেতন’ উপদেশমালা পড়তে পড়তে আমরা শান্তিনিকেতনের পটভূমি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠি। জগৎ ও জীবনের আনন্দকে অস্বীকার করে নয়, স্বীকার করেই কবির সাধনা, পঞ্চেন্দ্রিয়ের জগৎকে অভ্যর্থনা করেই তাঁর ঈশ্বর-সন্ধান, তার প্রমাণ এখানে রয়েছে।
মহর্ষির দীক্ষাদিবসে এক প্রার্থনান্তিক ভাষণে রবীন্দ্রনাথ মহর্ষির সাধনার কাথা আলোচনা করতে গিয়ে প্রশ্ন করেছেন, সপ্তপর্ণ গাছের তলায় বসে যে সাধক (দেবেন্দ্রনাথ) আনন্দসৃষ্টির অমৃতময় রহস্য জীবনে উপলব্ধি করেছেন, তা কি আমরা আশ্রমবাসীরা প্রতিদিন উপলব্ধি করতে পারব না? এই প্রশ্নের উত্তর নিজেকে দিয়েছেন, বলেছেন - প্রকৃতির মধ্যে সেই অমৃতময় রহস্য পদচিহ্ন রেখে গেছে, তাই প্রকৃতি-সৌন্দর্য উপভোগের অর্থ অমৃতময়ের স্পর্শলাভ। এই ভাষণে শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি স্পষ্টরূপে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কবি বলেছেন, ‘এই যে আশ্চর্য রহস্য, জীবনের নিগূঢ় ক্রিয়া, আনন্দের নিত্যলীলা, সে কি আমরা এখানকার শালবনের মর্মরে, এখানকার আম্রবনের ছায়াতলে উপলব্ধি করতে পারব না? শরতের অপরিমেয় শুভ্রতা যখন এখানে শিউলিফুলের অজস্র বিকাশের মধ্যে আপনাকে প্রভাতের পর প্রভাত ব্যক্ত করে করে কিছুতে আর ক্লান্তি মানতে চায় না, তখন সেই অপর্যাপ্ত পুষ্পবৃষ্টির মধ্যে আরো একটি অপরূপ শুভ্রতার অমৃতবর্ষণ কি নিঃশব্দে আমাদের জীবনের মধ্যে অবতীর্ণ হতে থাকে না? এই পৌষের শীতের প্রভাতে দিকপ্রান্তের ওপর থেকে একটি শুভ্র কুহেলিকার আচ্ছাদন যখন উঠে যায়, আমলকীকুঞ্জের ফলভারপূর্ণ কম্পিত শাখাগুলোর মধ্যে উত্তরবায়ু সূর্যকিরণকে পাতায় পাতায় নৃত্য করাতে থাকে এবং সমস্ত দিন শীতের রৌদ্র এখানকার অবাধপ্রসারিত মাঠের উপরকার সূদূরতাকে একটি অনির্বচনীয় বাণীর দ্বারা ব্যাকুল করে তোলে, তখন এর ভিতর থেকে আর একটি গভীরতর আনন্দ-সাধনার স্মৃতি কি আমাদের হৃদয়ের মধ্যে ব্যক্ত হয়ে পড়ে না? একটি পবিত্র প্রভাব, একটি অপরূপ সৌন্দর্য, একটি পরম প্রেম কি ঋতুতে ঋতুতে ফলপুষ্পপল্লবের নব নব বিকাশে আমাদের সমস্ত অন্তঃকরণে তার অধিকার বিস্তার করছে না? নিশ্চয়ই করছে। কেননা এইখানেই যে একদিন সকলের চেয়ে বড়ো রহস্যনিকেতনের একটি দ্বার খুলে গিয়েছে। এখানে গাছের তলায় প্রেমের সঙ্গে প্রেম মিলেছে, দুই আনন্দ এক হয়েছে। সেই ‘এষঃ অস্য পরম আনন্দঃ’, যে ইনি ইহার পরমানন্দ সেই ইনিও কতদিন এইখানে মিলেছে - হঠাৎ কত ঊষার আলোয়, কতদিনের অবসান-বেলায়, কত নিশীথরাত্রে নিস্তব্ধ প্রহরে - প্রেমের সঙ্গে প্রেম আনন্দের সঙ্গে আনন্দ! সেদিন যে দ্বার খোলা হয়েছে সেই দ্বারের সম্মুখে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি, কিছুই কি শুনতে পাব না? কাউকে কি দেখা যাবে না? সেই মুক্ত দ্বারের সামনে আজ আমাদের উৎসবের মেলা বসেছে, ভিতর থেকে কি আনন্দ-গান বার হয়ে এসে আমাদের এই সমস্ত দিনের কলরবকে সুধাসিক্ত করে তুলবে না? না, তা কখনোই হতে পারে না। বিমুখ চিত্তও ফিরবে, পাষাণ-হৃদয়ও গলবে, শুষ্ক শাখাতেও ফুল ফুটে উঠবে। হে শান্তিনিকেতনের অধিদেবতা, পৃথিবীতে যেখানেই মানুষের চিত্ত বাধামুক্ত পরিপূর্ণ প্রেমের দ্বারা তোমাকে স্পর্শ করেছে সেখানেই অমৃত বর্ষণে একটি আশ্চর্য শক্তি সঞ্জাত হয়েছে। সে শক্তি কিছুতেই নষ্ট হয় না, সে শক্তি চারদিকের গাছপালাকে জড়িয়ে ওঠে, চারদিকের বাতাসকে পূর্ণ করে। কিন্তু তোমার এই আশ্চর্য লীলা, শক্তিকে তুমি আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ করে রেখে দিতে চাও না…তোমার শক্তির উপরে তুমি এই একটি হুকুম জারি করেছ, সে লুকিয়ে আমাদের কাজ করবে এবং দেখাবে যে সে খেলা করছে।’
‘শান্তিনিকেতন’ উপদেশমালার সর্বত্র এই পটভূমি কবির অধ্যাত্ম-সাধনার যোগ্য সঙ্গীরূপে বর্তমান। রবীন্দ্রনাথের ধর্মসাধনা তাই বীরভূমের প্রকৃতির সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত। উৎসবরাজ অলক্ষে থেকে উৎসব পরিচালনা করছেন- উপরের এই ভাবটি ‘শারদোৎসব’ ও ‘রাজা’ নাটকে প্রচ্ছন্ন রয়েছে। সেই উৎসবরাজের একান্ত ভক্ত ঠাকুরদা আর এখানকার ভাষণদাতা রবীন্দ্রনাথ কি একই ব্যক্তি নন।
ছিন্নপত্র যেমন সোনারতরী-চিত্রা-চৈতালী-গল্পগুচ্ছের পটভূমি ও উপাদানের ভাণ্ডার, ‘শান্তিনিকেতন’ উপদেশমালাও তেমনি গীতাঞ্জলী-গীতিমাল্য-গীতালি-শারদোৎসব-অচলায়তন-রাজা-ডাকঘর-প্রাচীন সাহিত্যের পটভূমি ও উপাদানস্থল। রবীন্দ্র-সাহিত্য-প্রবেশক রূপেও ‘শান্তিনিকেতন’-এর বিশেষ মূল্য আছে। বস্তুত দুঃখ, মৃত্যু, অহং, আত্মা, প্রেম, জীবন সম্পর্কে রবীন্দ্র-সাহিত্যে পরিকীর্ণ নানা অভিমতের সার এখানেই পাই। এ জন্যই এই গ্রন্থে উপরোক্ত বিষয়নিচয় সম্পর্কে কবির বক্তব্য অধিগত করার অর্থ রবীন্দ্র-সাহিত্য প্রবেশাধিকার লাভ। ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে ধৃত ‘পূর্ণ’ ভাষণটি রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ ও ‘আত্মপরিচয়’ গ্রন্থের পরিপূরক, আবার প্রথম খণ্ডে ধৃত ‘তপোবন’ ও ‘বিকারশংকা’ ভাষণ দুটি ‘প্রাচীন সাহিত্য’ গ্রন্থের পরিপূরক। পুনশ্চ, দ্বিতীয় খণ্ডে ধৃত ‘বর্ষশেষ’, ‘নববর্ষ’ ও ‘বৈশাখী ঝড়ের সন্ধ্যা’ ভাষণ তিনটি ‘কল্পনা’ কাব্যের ‘বর্ষশেষ’ কবিতার পরিপূরক।
উপনিষদের উদার আকাশতলে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘শান্তিনিকেতন’ উপদেশমালা রচনা করেছেন, এ কথা পূর্বেই বলেছি। তার সঙ্গে যুক্ত করতে পারি আরেকটি ভাবনা-রবীন্দ্র-সাহিত্যের বাতাবরণ উপনিষদের মন্ত্রগুঞ্জরিত, হোমধূমে পবিত্র ও সামগানে মুখরিত। ‘প্রাচীন-সাহিত্য’ সমকালে রচিত গ্রন্থ; তা কেবল প্রাচীন সংস্কৃত-পালি-প্রাকৃত কাব্যনিচয়ের সমালোচনা নয়, সেগুলোকে উপলক্ষ করে কবি ভারত-আবিষ্কারে বেরিয়েছেন এবং শেষে সেই উপনিষদিক সাধনক্ষেত্রে উপনীত হয়েছেন। ‘প্রাচীন সাহিত্য’ নব সৃষ্টি; ভারতের ঐতিহ্য ও শিক্ষার পুনরাবিষ্কার। মহাকবি কালিদাসের দুই অমর কাব্য অবলম্বনে রচিত ‘প্রাচীন সাহিত্য’-ধৃত দুটি প্রবন্ধ ‘শকুন্তলা’ এবং ‘কুমারসম্ভব ও শকুন্তলা’ এই ভারতদর্শনের পরিচয়স্থল। ভারতের সাধনা চিরদিনই ভোগ অপেক্ষা ত্যাগকে, কাম অপেক্ষা প্রেমকে, বিলাস অপেক্ষা তপস্যাকে বড় করে দেখেছে। এই শিক্ষাটি রবীন্দ্রনাথ তার অন্তরের গভীরে গ্রহণ করেছিলেন। ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থের ‘তপোবন’ প্রবন্ধটিতে এটি কবি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন; বলেছেন, ‘প্রবৃত্তি প্রবল হয়ে উঠলেই ত্যাগের ও ভোগের সামাঞ্জস্য ভেঙে যায়। কোনো একটি সংকীর্ণ জায়গায় যখন আমরা অহঙ্কারকে বা বাসনাকে ঘনীভূত করি তখন আমরা সমগ্রের ক্ষতি করে অংশকে বড়ো করে তুলতে চেষ্টা করি। এর থেকে ঘটে অমঙ্গল। অংশের প্রতি আসক্তি বশত সমগ্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, এই হচ্ছে পাপ। এই জন্যই ত্যাগের প্রয়োজন। এই ত্যাগ নিজেকে রিক্ত করার জন্য নয়, নিজেকে পূর্ণ করবার জন্যই। …তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ। ত্যাগের দ্বারাই ভোগ করবে, এইটি উপনিষদের অনুশাসন। এইটেই কুমারসম্ভব কাব্যের মর্মকথা, এবং এইটেই আমাদের তপোবনের সাধনা।’
পুনশ্চ, “অভিজ্ঞানশকুন্তলা নাটকে যে দুটি তপোবন আছে সে দুটিই শকুন্তলার সুখ দুঃখকে একটি বিশালতার মধ্যে সম্পূর্ণ করে দিয়েছে। …এ কথা স্বীকার করতে হবে, প্রথম তপোবনটি মর্তলোক, আর দ্বিতীয়টি অমৃতলোকে। অর্থাৎ, প্রথমটি হচ্ছে যেমন হয়ে থাকে, দ্বিতীয়টি হচ্ছে যেমন হওয়া ভালো। এই ‘যেমন-হওয়া-ভালো’র দিকে ‘যেমন-হয়ে থাকে’ চলেছে, এরই দিকে চেয়ে সে আপনাকে শোধন করেছে, পূর্ণ করেছে। ‘যেমন-হয়ে-থাকে’ হচ্ছেন সতী অর্থাৎ সত্য, আর ‘যেমন-হওয়া-ভালো’ হচ্ছেন শিব অর্থাৎ মঙ্গল। কামনা ক্ষয় করে তপস্যার মধ্য দিয়ে এই সতী ও শিবের মিলন হয়। শকুন্তলার জীবনেও ‘যেমন-হয়ে-থাকে’ তপস্যার দ্বারা অবশেষে ‘যেমন-হওয়া-ভালো’র মধ্যে এসে আপনাকে সফল করে তুলেছে। দুঃখের ভিতর মর্ত, শেষকালে স্বর্গের প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছে।”
‘প্রাচীন সাহিত্যে’র উক্ত প্রবন্ধদুটির ও রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যতত্ত্ব-প্রেমতত্ত্বের সম্পূর্ণ সমর্থন এখানে পাই। সাহিত্য ও জীবনে, চিন্তায় ও বচনে, কর্মে ও ব্যবহারে প্রেমে ও বন্ধনে রবীন্দ্রনাথ যে মুক্তির সন্ধান করেছেন, তার আভাস ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থেই পাই। উপনিষদের আনন্দরূপের মাঝেই কবি মুক্তির সন্ধান করেছেন। রূপের অন্তরালে যে আনন্দ আছে, তাহাই মুক্তি। উপনিষদের এই চিন্তাটি রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে এবং তাই রবীন্দ্রসাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে। এটি না বুঝলে রবীন্দ্র-সাহিত্যের প্রেমতত্ত্ব ও মুক্তিতত্ত্ব আমরা আয়ত্ত করতে পারব না। এই চিন্তাটি কবি স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে- ‘প্রতিদিনের এই যে অভ্যস্ত পৃথিবী আমার কাছে জীর্ণ, অভ্যস্ত প্রভাব আমার কাছে স্নান, কবে এরাই আমার কাছে নবীন ও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে? যেদিন প্রেমের দ্বারা আমার চেতনা নবশক্তিতে জাগ্রত হয়। যাকে ভালোবাসি আজ তার সঙ্গে দেখা হবে, এইকথা স্মরণ হলে কাল যা কিছু শ্রীহীন ছিল আজ সেই সমস্তই সুন্দর হয়ে ওঠে। প্রেমের দ্বারা চেতনা যে পূর্ণশক্তি লাভ করে সেই পূর্ণতার দ্বারাই সে সীমার মধ্যে অসীমকে, রূপের মধ্যে অরূপকে দেখতে পায় তাকে নূতন কোথাও যেতে হয় না। ওই অভাবটুকুর দ্বারাই অসীম সত্য তার কাছে সীমায় বদ্ধ হয়েছিল।
বিশ্ব তাঁর আনন্দরূপ, কিন্তু আমরা রূপকে দেখছি, আনন্দকে দেখছিনে, সেইজন্যে রূপ কেবল পদে পদে আমাদের আঘাত করছে। আনন্দকে যেদিন দেখব অমনি কেউ আর আমাদের কোনো বাধা দিতে পারবে না। সেই তো মুক্তি।
সেই মুক্তি বৈরাগ্যের মুক্তি নয়, সেই মুক্তি প্রেমের মুক্তি। ত্যাগের মুক্তি নয়, যোগের মুক্তি, লয়ের মুক্তি নয়, প্রকাশের মুক্তি।’
‘প্রাচীন সাহিত্য’ গ্রন্থে উমা কি একথাই বলেননি যে, এবার বসন্তসখা মদনের সহায়তায় নয়, তপঃসাধনায় মহেশ্বরকে জয় করবে? ‘রাজা’ নাটকের গানে রানীর মনের বেদনা কি একই কথায় প্রকাশ হয়নি- ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালবাসায় ভোলাব?’ মহুয়া কাব্যে এই মৃত্যুঞ্জয় প্রেমের কথাই কি ঘোষিত হয়নি? -
মৃত্যুঞ্জয় তব শিরে মৃত্যু দিলা হানি,
অমৃত সে-মৃত্যু হতে দাও তুমি আনি।
সেই দিব্য দীপ্যমান দাহ
উন্মুক্ত করুক অগ্নি-উৎসের প্রবাহ।
মিলেনেরে করুক প্রখর,
বিচ্ছেদেরে করে দিক দুঃসহ সুন্দর।
শেষের কবিতা’ উপ
সব প্রতিক্রিয়া:
2আপনি এবং Arya Subrataলাইক করুন
কমেন্ট করুন
শেয়ার করুন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন