শুক্রবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

 হিন্দুসংহতি

শেয়ার করেছেন : প্রণব কুমার কুণ্ডু













বাঙালির শক্তি নমঃশূদ্র জাতির সঠিক মূল্যায়ন এখনও হয় নি
লেখক পথপ্রদর্শক মাননীয় তপন ঘোষ
বর্তমানে মতুয়া সম্প্রদায় ও নমঃশূদ্র জাতি বিশেষ আলােচনার বিষয় হয়ে উঠেছে । কারণ তাদের রাজনৈতিক ব্লক বা ভােটব্যাঙ্ক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা । কিন্তু আলােচনা প্রায়শঃই নিরপেক্ষ ও তথ্যানুগ হয় না । বিশেষ করে দেশভাগের সময় নমঃশূদ্র জাতির বিখ্যাত নেতা যােগেন্দ্রনাথ মন্ডলের আচরণ ও পাকিস্তানের সমর্থনকারী ভূমিকা নিয়ে অনেকের মধ্যেই তীব্র ক্ষোভ আছে । এই ক্ষোভ অনেক সময় পুরাে নমঃশূদ্র জাতির উপর গিয়েই পড়ে । ফলে তা অনেকসময় সমাজে সম্প্রীতি ও সংহতি নষ্টের কারণ হয় । তাই এ বিষয় একটু বিস্তারিত আলােচনার অপেক্ষা রাখে । প্রথমত , ১৯৪৭ - পূর্ব পূর্ববঙ্গের সামাজিক বাস্তবতাটা কিরকম ছিল , কিরকম ছিল বিভিন্ন জাতের ( caste ) মধ্যে সম্পর্ক , একদিকে কতটা তাচ্ছিল্য , আর একদিকে কতটা অভিমান ও অপমানবােধের ভাব , এগুলাে জানা খুবই দরকার । আমি জানিনা আপনারা কতটা জানেন । পূর্ববঙ্গের দক্ষিণভাগের একটা বিরাট এলাকায় ( মূলতঃ যশাের , খুলনা , বরিশাল , ফরিদপুর জেলা ) একটা বিরাট জাতি , প্রচণ্ড পরিশ্রমী , প্রচণ্ড সাহসী , অসম্ভব ধর্মপ্রাণ , তারা কিরকম ব্যবহার পেয়েছিল বাকিদের কাছ থেকে — আপনারা কতটা জানেন ? আমি জানি । পূর্বতন ফরিদপুর জেলা , বর্তমান গােপালগঞ্জ জেলার ভেন্নাবাড়ি গ্রাম আমার দ্বিতীয় বাড়ি । ১০০ % নমঃশূদ্র অধ্যুষিত । আপনারা কি জানেন এই ‘ নমঃশূদ্র ’ শব্দটা কবে সৃষ্টি , কার সৃষ্টি , কেন সৃষ্টি ? তার আগে ওই নমঃশূদ্রদের কী নাম ছিল , কী নামে তাদেরকে উল্লেখ করতাে ভদ্রলােকরা ?
ভদ্রলােকদেরকে কী বলে সম্বােধন করতাে নমঃশূদ্ররা ? এখনাে করে । বাবু বলে ।
আমাকে যখন ওড়াকান্দি ঠাকুরবাড়িতে হরিচাদ ঠাকুরের বংশধর বৃদ্ধ শ্রীপতি ঠাকুর বাবু ’ বলে ডাকলেন , লজ্জায় আমার মাথা নীচু হয়ে গেল । লজ্জায় আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল । নিজের পরাজয় বলে মনে হয়েছিল । এত করেও ওদের সমান হতে পারলাম না ! সেই পর থেকে গেলাম ! আমি সবিনয়ে তাঁকে অনুরােধ করলাম , আমাকে
বাবু না বলতে । আমি জানি ‘ বাবু ’- তে ভাল মন্দ অনেক কিছু আছে । কিন্তু নিশ্চিতভাবে আছে বিভেদ , পার্থক্য , distinction , difference । আছে ‘ আমরা ’ , ‘ ওরা । এই পার্থক্য এই বিভেদের ভূমিতেই জন্ম নিয়েছে যােগেন মন্ডল । যােগেন বাবু ব্যক্তিগত ভাবে শিক্ষিত হলে কি হবে , তার বিরাট স্বজাতির লােকেরা যে অশিক্ষিত । যদিনা জেনে থাকেন তা হলে জানা খুবই দরকার যে “ নমঃশূদ্র ” শব্দটার জন্ম ১৯২১ সালে । তার আগে আপনাদের পূর্বপুরুষরা ওদেরকে বলতেন চাঁড়াল । হ্যা , ওদেরকে আপনারা চাঁড়াল । বলতেন । অনেকেবাড়ির পতিতপাবন ঠা ভিতরে এখনাে বলেন । কি প্রচণ্ড তাচ্ছিল্য , অপমান , অবজ্ঞা মিশে ছিল / আছে এই শব্দটাতে — তা অনুভব করা অ - নমঃশূদ্রদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব । অথচ এটা ওদের প্রাপ্য ছিল না । আপনাদের জমির চাষ ওরা করেছে , আপনাদের গােসম্পদ ওরা দেখাশােনা করেছে , বাড়ির জিনিস ওরা বয়ে দিয়েছে , ধান ভেনে চাল করে দিয়েছে । আর তার থেকেও বড় কী জানেন ? আপনাদের মন্দির , দেবমূর্তি , নারী ও সম্পদ শুধু ওদের জন্যই মুসলমানদের হাত থেকে নিরাপদে থেকেছে । আপনাদের জমিতে , সম্পদে ওরা লােভ করেনি । সারাদিন পরিশ্রম করে মূল্য হিসাবে যেটুকু ধান দিয়েছেন সেই চালের ভাত , আর পূর্ববঙ্গে অঢেল পাওয়া যায় শাপলা ডাঁটা আর মাছ — এতেই এরা সন্তুষ্ট ছিল ।
কিন্তু জানেন তাে , মহাকাল নামে এক প্রচণ্ড শক্তিশালী দেবতা আছে । তার প্রভাবের বাইরে কেউ নয় । বাবুরাও নয় । আর ওই চাঁড়ালরাও নয় । সেই দেবতার প্রভাবে ওই চাঁড়ালরাও পাল্টাতে লাগল। তাদেরও মান-অপমানের বােধ জাগা শুরু হল । খুব আস্তে আস্তে তারাও তাদের শ্রমের মূল্য ও সামান্য সম্মানের প্রত্যাশা করতে লাগল । কিন্তু বাবুরা তা দিতে নারাজ । একেবারেই নারাজ।তখন থেকেই শুরু হল ফারাক , গ্যাপ । এই গ্যাপ আগেও ছিল । সেটা ছিল মেনে নেওয়া গ্যাপ । এবার হল — না মেনে নেওয়া গ্যাপ । ইতিমধ্যে আবির্ভাব হয়েছে যুগপুরুষ হরিচাঁদ ঠাকুরের ১৮১২ সালে । হ্যাঁ , আমি তাঁকে যুগপুরুষবলেই মনে করি । তাঁর ভক্তরা তাঁকে ভগবান , পূর্ণব্রহ্ম মনে করেন । তিনি এবং তাঁর সুযােগ্য পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর এক বিরাট ঐতিহাসিক কর্তব্য পালন করেছেন । তাঁদের অবদান সংক্ষেপে লেখার চেষ্টা করলে বড়ই অন্যায় হবে । তাই আমি বড় বিভ্রান্ত কী করব ? তাও বলি — হরিচাঁদ দিলেন ধর্ম , গুরুচাঁদ দিলেন কর্ম । এটা যে কতবড় কথা কি করে বােঝাবাে ? আগে ধর্ম , পরে কর্ম । ভিতে ধর্ম , উপরে কর্ম । কর্ম তাে ওরা আগে থেকেই করতাে । গুরুচাঁদ ওদেরকে দিলেন কর্মের বাঁধুনি , কর্মের মূল্যের জ্ঞান । আর তার জন্য প্রথাগত শিক্ষা । অনেকে জানলে অবাক হয়ে যাবেন , বিদ্যাসাগর মশায় শিক্ষাবিস্তারে যত স্কুল খুলেছেন , সম্ভবত গুরুচাঁদ ঠাকুর তার থেকেও বেশি স্কুল পূর্ববঙ্গে খুলেছেন । তিনি ইংল্যান্ড ফেরত ব্যারিস্টার ছিলেন । কিন্তু আমরা বিদ্যাসাগরের নাম জানি , গুরুচাঁদের নাম জানি না । কারণ , ওই ‘গ্যাপ’ । ওই ‘আমরা ওরা’ । গুরুচাঁদ তাে আমাদের নন । তিনি ওদের। তাই জানি না ।
হে আমার সবর্ণের ( General caste ) লােকেরা , নিজের বুকে হাত দিয়ে একবার ভাবুন তাে — যে হরিচাঁদ এত মানুষকে ধর্ম দিলেন , তাঁর প্রতি আপনার মনে ভক্তি আসে কিনা ? যে গুরুচাঁদ এত স্কুল খুললেন , তাঁর এই অবদানের কথা ভেবে মনে গর্ব হয় কি ? এর উত্তর আপনি নিজে ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না ।
ইতিহাসে সামান্য জ্ঞান যাদের আছে তারা জানেন একসময় পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের একটা বিশাল সংখ্যায় মানুষ বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছিল । এটাই ছিল সর্বনাশের মূল । তারপর বিধর্মী ইসলামিক আক্রমণে ওই বৌদ্ধরাই মুসলিম হয়ে গেল । কারণ যখনই তারা সনাতন ধর্ম ছেড়ে বৌদ্ধ হয়েছিল তখনই তাদের ধর্মবিশ্বাসের গােড়াটা আলগা হয়ে গিয়েছিল । বৌদ্ধধর্মের আগমন ও ইসলামের আক্রমণ — দুটোই ছিল প্রায় প্লাবনের মত । বন্যাতে যেমন ঘরবাড়ি ফসল সব কিছু নষ্ট হয়ে যায় , বৌদ্ধধর্ম ও ইসলামের প্লাবনে আমাদের সনাতন ধর্মেরও অনেক তত্ত্ব , দর্শন , প্রথা ও পরম্পরা ধ্বংস হয়ে গেল । সুতরাং যারা ইসলামের তরবারির সামনে মাথা নত করল না , তারা প্রায় ধর্মহীন হয়ে গেল । তাদেরই মধ্যে যারা সমাজের উচ্চশ্রেণী , বাকি ভারতের সঙ্গে তাদের যােগাযােগ একটু বেশি থাকার ফলে সনাতন ধর্মের রসদ তারা আবার সংগ্রহ করে নিল । কিন্তু ভীষণভাবে নদীনালা বেষ্টিত দুর্গম গ্রামাঞ্চলে থাকা জনগােষ্ঠীর মধ্যে যারা মূলতঃ কৃষিশ্রমিক , যাদের শহরের সঙ্গে যােগাযােগ কম , তারা প্রায় ধর্মহীন হয়ে গেল।শিক্ষার অভাব , সারাদিনের শ্রম , তারপর নেশা — তাদেরকে সামাজিকভাবে চরমভাবে পিছিয়ে দিল । বাঙালি হিন্দুসমাজের উচ্চশ্রেণী তাে ইংরাজের সঙ্গে সমঝােতা করে নিয়ে তাদের শাসনের / সাম্রাজ্যের দোসর হয়ে গিয়েছিল । ফলে ইংরাজ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথায় জমিদারী তারাই পেল । তারাই হল ‘ বাবু ' । কিন্তু চাষ করবে কে ? বাবুরা তাে চাষ করতে পারে না । বাবুদের হয়ে যারা চাষ করল , বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের এই অংশের নিবাসী সেই মানুষদেরকেই বাবুরা ‘ চাঁড়াল’আখ্যা দিল । অত্যন্ত অপমানজনক এই শব্দটির পিছনে আর্থিক সামাজিক অনগ্রসরতা ছাড়া আর কোন যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাইনি ।
পূর্ববঙ্গের দক্ষিণ অঞ্চলের বিরাট এক জনগােষ্ঠী । উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকেও দেখি প্রথাগত শিক্ষায় অত্যন্ত পিছিয়ে । প্রায় ১০০ শতাংশ কৃষিকার্য ও গ্রামীণ দ্রব্য উৎপাদনে নিযুক্ত । দারিদ্র এতটাই নিত্য সঙ্গী যে তা তাদের অনুভবই হয়না । তার সঙ্গে উচ্চবর্ণের অবজ্ঞা অবহেলা ও তাদের শ্রমের শােষণ । নাম তাদের চাঁড়াল । শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের আবির্ভাবের আগে তাদের মধ্যে ধর্মকর্ম বা ধর্মচারণ কিছুই প্রচলিত ছিল না - পূর্বে তার কারণ ব্যাখ্যা করেছি । সেই সময়ে হরিচাঁদ ঠাকুর ( জন্ম ১৮১২ ) এই জনগােষ্ঠীতে আবির্ভূত হলেন তাদেরকে ধর্মদান করতে । হরিচাঁদ ছিলেন আধ্যাত্মিক সাধনায় সিদ্ধ । তিনি ঐ পিছিয়ে পড়া জনগােষ্ঠীকে যেভাবে ধর্মদান করেছেন , তা যখন আমি বিশ্লেষণ করি তখন মনে হয় যে তিনি প্রাচীন বৈদিক ঋষিদের পরম্পরা চালু করেছেন । শুধু তাই নয় , মানব ও সমাজ সম্বন্ধে বৈদিক ঋষিদের অন্তর্দষ্টি ও দূরদৃষ্টির অধিকারী ছিলেন হরিচাঁদ । এসব জিনিসকে আমি আমার মতাে করে দেখি , অন্যের দৃষ্টি দিয়ে নয় । আজকালকার গুরুরা তাদের শিষ্যদেরকে মােক্ষ ধর্ম শেখান , সংসার ও সাংসারিক কর্তব্য বিমুখ করে তােলেন । এর দ্বারা সমাজের প্রচন্ড ক্ষতি হয় বলে আমি মনে করি । সেই অবাস্তব ও অবিবেচক কাজ হরিচাঁদ করেন নি । তিনি ঐ জনগােষ্ঠীকে উপদেশ দিয়েছেন সৎ থাকতে , কর্তব্যপরায়ণ হতে , মা-বাবাকে দেবতা জ্ঞান করতে এবং হরিনাম সংকীর্তন করতে । অতি সহজ তাঁর উপদেশ - ‘ হাতে কাজ , মুখে নাম ’ । ঐ বিশাল জনগােষ্ঠীর মধ্যে হরিচাঁদের দেওয়া এই ধর্মভাবকে অবলম্বন করে একটা ছন্দ আসতে লাগল । সমাজ ব্যবস্থিত হতে লাগল । হরিচাঁদের আধ্যাত্মিক সাধনা ও তার উন্নত চরিত্র মানুষকে আকর্ষণ করল । ফরিদপুরের গােপালগঞ্জের ওড়াকান্দি গ্রামের ঠাকুরবাড়ি ঐ সমগ্র জনগােষ্ঠীর তীর্থস্থান হয়ে গেল । সহজ কথায় ঐ বিশাল জনগােষ্ঠী যেন একটা কেন্দ্র খুঁজে পেল । হরিচাঁদ ও তাঁর পত্নী শান্তিদেবী যেন সমগ্র জাতির পিতা ও মাতার ভূমিকা পালন করতে লাগলেন ।
পূর্ববঙ্গের দক্ষিণাঞ্চল হরিবােল ধ্বনিতে যেন জেগে উঠল । তার দেওয়া হরিনামে মাতােয়ারা হয়ে উঠল বহুজন । হরিনামের সঙ্গে সঙ্গে গান বাঁধতে লাগলেন হরিভক্ত অশ্বিনী গোঁসায় , তারক সরকার এবং আরও অনেক গ্রামীণ কবি । ঐ জাতির মধ্যে একটা ভক্তিপ্রবাহ তৈরি হল । শ্রীচৈতন্যদেবের পর একেবারে সাধারণ মানুষের মধ্যে এরকম একটা ভক্তিপ্রবাহ সেই প্রথম । তাঁদের একটা পতাকা তৈরি হল । গাঢ় লাল তেকোনা কাপড়ের উপর সাদা বর্ডার দেওয়া । লম্বা লম্বা লাঠির ডগায় এই পতাকাগুলাে বাঁধা থাকে । ওগুলাে দেখে আমার প্রায়ই মনে হয় যে আগে ওগুলাে বােধ হয় । সড়কির ডগায় বাঁধা হত । সড়কি বাংলার গ্রাম অঞ্চলে ব্যবহৃত একটি তীক্ষ্ণ অস্ত্র । ঐ সড়কি দিয়ে আমি ওড়াকান্দির পদ্মের বিলে রাত্রি বেলায় নৌকায় করে মাছ ধরতে দেখেছি । গ্রামে গ্রামে হরিভক্ত মতুয়াদের দল তৈরি হল । চৈত্রমাসের বারুণীর স্নানের সময় হাজার হাজার হরিভক্ত দলে দলে ওড়াকান্দির ঠাকুরবাড়িতে যাওয়া শুরু করল । মহামিলন ক্ষেত্র হয়ে ওঠে ঐ সময় ঠাকুরবাড়ি । দুর্গম পূর্ববঙ্গে ওড়াকান্দি পৌঁছাতে বহু নদী - নালা পার হয়ে যেতে হয় । যাওয়ার পথে হরিভক্তরা তাঁদের বাড়িতে বাড়িতে সাধ্যমত খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেন । বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গৃহকর্তা মতুয়াদের দলকে ডেকে নিয়ে ভক্তি সহকারে ভােজন করান । আবার তারা নাচতে নাচতে এগিয়ে চলে ওড়াকান্দির দিকে । হাতে তাদের লাল - সাদা পতাকা , মুখে হরিধ্বনি । সঙ্গে জয়ডঙ্কা , একরকমের ঢাক।ওড়াকান্দির সেবারুণী মেলারইমতাে এখন বনগাঁর কাছে ঠাকুনগরে তা চালু হয়েছে ।
১৮৭৭ সালে হরিচাদ ঠাকুরের দেহাবসানের পর ঐ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন তাঁর সুযােগ্য পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর । হরিচাঁদ তাঁকে লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পড়িয়ে এনেছেন । হরিচাঁদের দেওয়া ধর্মভাবকে সম্পূর্ণ বজায় রেখে গুরুচাঁদ তার জাতির মানুষকে পরবর্তী পর্যায়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন । তাঁর কার্য এবং অবদান নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা এখনও হয়নি , যা হওয়া দরকার । তার তিনটি অবদান চোখে পড়বেই । ( ১ ) তিনি তাঁর জাতির মানুষকে শিক্ষিত করে তােলার প্রচন্ড চেষ্টা করেছেন । ( ২ ) তাদের শ্রমের মূল্য বুঝতে শিখিয়েছেনও তাদেরদাবি আদায়ের জন্য সচেতন ও সংগঠিত করেছেন । ( ৩ ) তাঁর জনগােষ্ঠীর মানুষের জন্য সম্মান আদায় করেছেন ।
১৮৮১ সালে । গুরুচাঁদ ঠাকুর খুলনার দত্তডাঙাতে ‘ সারা বাংলা নমঃশূদ্র সম্মেলন ’ করেছেন । সেই সম্মেলন থেকে তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন ঐ নমঃশূদ্র জাতির প্রতি স্থানে স্থানে স্কুল শুরু করতে । তিনি তাঁর জাতির লােকদেরকে আগ্রহ করেছিলেন , ‘ খেতে পাও বা না পাও , কিন্তু সন্তানকে শিক্ষা দেওয়া চাই । তিনি নিজেও বহু স্কুল স্থাপন করেছেন । তখনও সরকারি খাতায় এই জাতির মানুষদের কাস্ট হিসাবে লেখা হত চন্ডাল । একজন ব্রিটিশ অধিকারী সি.এস.মীড সাহেবের সঙ্গে আলােচনা করে এবং তাঁর সাহায্য নিয়ে ১৯১১ সালের জনগণনায় সরকারি খাতায় এই কাস্টের নাম চন্ডালের পরিবর্তে নমঃশূদ্র লেখালেন । এইখানটা আমার কাছে অস্পষ্ট এবং আমি কিছুটা বিভ্রান্ত । চন্ডাল বা চাড়াল - এই অপমান বা অবজ্ঞাসূচক শব্দটা পাল্টিয়ে যখন নতুন শব্দ নিলেন , তখন তার মধ্যে আবার এই শূদ্র শব্দ কেন যােগ করলেন ? শূদ্র শব্দটাও তাে সমাজে খুব উঁচু নজরে দেখা হয়না । স্বামী বিবেকানন্দের মতাে সিংহপুরুষকেও এই শূদ্র জাতিভুক্ত হওয়ার কারণে আমেরিকায় বসে চোখের জল ফেলতে হয়েছিল । এবং তাঁকে সাফাই দিতে হয়েছিল যে । তিনি শূদ্র নন , ক্ষত্রিয় পরিবারে তাঁর জন্ম । স্বামী বিবেকানন্দের অতি উজ্জ্বল জীবনে এই একটিমাত্র ঘটনাকে আমি ব্ল্যাকস্পট বলে মনে করি -- তার শূদ্রত্বকে অস্বীকার করা ও উচ্চবর্ণের দাবি করা ।
১৯১১ থেকে এখন একশাে বছর পার হয়ে গেছে । তাই কোন্ সামাজিক পটভূমিকায় ও কোন মনস্থিতিতে গুরুচাঁদ ঠাকুর নিজের জাতির নামের মধ্যে এই শূদ্র শব্দটিকে গ্রহণ করলেন , নাকি করতে বাধ্য হয়েছিলেন , তা আমার বােঝার ক্ষমতা নেই ।
সুতরাং গুরুচাঁদ ঠাকুরনমঃশূদ্র জাতিকে শিক্ষায় এগিয়ে নিয়ে গেলেন , অসম্মান দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন ও অধিকার সচেতন করে সংগঠিত করে তুললেন । তাঁর প্রচেষ্টাতেই মতুয়া দল বা গােষ্ঠীগুলি সুসংগঠিত হল । ঠাকুরবাড়ি ও ঠাকুর পরিবার এই বিরাট জাতির একটা আধারশিলা হয়ে উঠল । কিন্তু তাই বলে উচ্চবর্ণের বাবুরা তাদের এই আত্মসম্মানবােধ ও অধিকার সচেতনতাকে । সহজে মেনে নেয়নি । মেনে নেবে কি করে ? এ তাে আমাদের হাজার বছরের অচলায়তন । তার মধ্যে আবার বৃটিশ প্রভুরা আমাদের কিছু মানুষকে জমিদারি প্রথার মাধ্যমে বিশেষ অধিকার দিয়ে কৃষি শ্রমিকদেরকে (এরাই আসল কৃষক ) শােষণের সুযােগ করে দিয়ে একটা নতুন শ্রেণি করে দিল । অবস্থাটা এরকম দাঁড়াল , ইংরাজের অনুগ্রহপুষ্ট ক্ষুদ্র শােষক শ্রেণি , তাদেরকেই আদর্শ ধরে নিয়ে তাদের মতাে হওয়ার চেষ্টা করা সমাজের বাকি উচ্চবর্ণ ও মধ্যম শ্রেণির মানুষরা এবং সবথেকে নীচে পড়ে থাকা জমিতে ফসল উৎপাদনকারী ঐ শােষিত শ্রেণি । এই তৃতীয় শ্রেণির হাতে কোনাে অধিকার দিতে , তাদেরকে শ্রমের মূল্য দিতে ও সম্মান দিতে বাকি দুটি শ্রেণি একেবারে রাজি নয় । সুতরাং একটা বিশাল গ্যাপ । এই গ্যাপের কথা আগেই উল্লেখ করেছি । নবজাগ্রত নমঃশূদ্র জাতির পক্ষ থেকে এ হল মেনে না নেওয়া গ্যাপ । এই গ্যাপই ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল ।
বহু যুগ ধরে শােষিত বঞ্চিত এই নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের জন্য ধর্মের একটি ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুর । তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ এই জাতির মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে সংগঠিত করে তুলে বৃহত্তর সমাজে সম্মানের স্থানে বসাতে অনেক দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছেন ও সবরকম প্রয়াস করেছেন । গুরুচাঁদ জানতেন মিল হয় সমানে সমানে । তাই তার অনগ্রসর পিছিয়ে পড়া জাতিকে উন্নত করে তুলতে না পারলে কোনদিনই তাঁরা তাদের অধিকার ও সম্মান পাবে না এবং শ্রমের মূল্য পাবে না । আর সামাজিক মিল তাে হবেই না ।
সারা বাংলায় হিন্দু সমাজের উচ্চশ্রেণির বেশিরভাগই যখন ইংরাজ শাসনের অংশীদার হয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করছিল এবং তাদের একটি ছােট অংশ স্বাধীনতা আন্দোলনে পা বাড়িয়েছিল , তখন হরি-গুরুচাঁদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় এই বিশাল নমঃশূদ্র জাতি নিজেদের আত্মবলের সাধনা করছিল । এবং তা ধর্ম ও ধর্মভাবকে কেন্দ্রে রেখে । উঁচু নীচু ভেদযুক্ত হিন্দু সমাজে সামাজিক ঐক্যের একটা পটভূমি তৈরি হচ্ছিল । কিন্তু ১৯০৫ সালে ব্রিটিশের দ্বারা বঙ্গভঙ্গ ঘােষণা যেন একটা ঘুমন্ত সাপকে খুঁচিয়ে জাগিয়ে তুলল । সারা বাংলার হিন্দুসমাজ ব্রিটিশের অসৎ উদ্দেশ্য প্রণােদিত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গর্জে উঠল । নেতৃত্ব দিলেন । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মতাে সামাজিক বিশিষ্টজনেরা এবং একইসঙ্গে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর মতাে রাজনৈতিক নেতারাও । রবীন্দ্রনাথের সহজ সরল কবিতা এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করল ঃ বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল এক হােক এক হােক এক হােক হে ভগবান । কিন্তু বাংলার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক , মুসলিম সমাজ এই আন্দোলনকে আপন । করেনিল না । বরং তারা এই আন্দোলনকে মুসলিমের বিরুদ্ধে চক্রান্ত মনে করল । ১৯০৬ সালেই ঢাকায় নবাব সলিমুল্লা খায়ের প্রাসাদে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল । ওদিকে বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলনের পাশাপাশি শুরু হয়ে গেছে ব্রিটিশ বিরােধী সশস্ত্র আন্দোলন । এটা থেকেও মুসলমানরা দূরে সরে থাকল । এই দুটি আন্দোলনে হিন্দু ও মুসলমানের দূরত্ব খুবই স্পষ্ট হয়ে দেখা দিল ।
তারপর এই দূরত্ব শুধু দূরত্ব হয়ে থাকল না , শীঘ্রই তা বিভেদ ও হানাহানিতে পরিণত হল । সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প সারা বাংলা ও সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল । তৎকালীন জাতীয় নেতৃত্ব এই বিষবাষ্পকে রুখতে ১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌ চুক্তি ( লােকমান্য বালগঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে ) এবং ১৯২৩ সালে বেঙ্গল প্যাক্ট ( দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে ) করলেন । শুরু হয়ে গেল মুসলিম তােষণের পরম্পরা । কিন্তু এতে মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক মনােবৃত্তি একটুও না কমে আরও বাড়তে থাকল । তার প্রভাব পূর্ববঙ্গে মুসলিমবহুল জেলাগুলিতে আরও বেশি করে পড়ল।বহু জায়গায় । ছােট বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতে থাকল । নেতৃবর্গ দেখেও না দেখার ভান করতে থাকলেন । এর প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হল হিন্দু মহাসভা । ইতিমধ্যে ১৯১৯ সাল থেকে গান্ধীজীর নেতৃত্বে কংগ্রেস খিলাফৎ আন্দোলনের সঙ্গী হয়ে মুসলমানদেরকে আরও বেশি উদ্ধত করে দিল । পরিণামে ১৯২১ সালে কেরলের মালাবারে ও ১৯২৩ সালে । উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কোহাটে মুসলমানদের দ্বারা হিন্দু গণহত্যা হল । কংগ্রেস নেতৃত্ব অসহায় হয়ে শুধু দেখল । ব্রিটিশ পুলিশ ও সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত দাঙ্গা রােধ করল । কিন্তু হিন্দু কচুকাটা হওয়ার পর । এই সময়ে পূর্ববঙ্গে ওড়াকান্দির কাছে পদ্মবিলেও প্রচণ্ড হিন্দু - মুসলিম দাঙ্গা হল । তখন গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁর নমঃশূদ্র জাতিকে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন দাঙ্গাবাজ মুসলমানদের শক্ত হাতে মােকাবিলা করতে এবং সেই দাঙ্গায় মুসলমানরা উচিৎ শিক্ষা পেয়েছিল ।
ওদিকে পশ্চিমভারতে তৎকালীন বােম্বে প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত রাজ্যগুলিতে দলিত আন্দোলন দানা বেঁধেছে । সেখানে নেতৃত্বে ডঃ বাবাসাহেব আম্বেদকর । তিনি নতুন সংগঠন শুরু করেছেন সিডিউল কাস্ট ফেডারেশন , যা পরে রাজনীতিতে অংশ নিয়েছে । এই দলিতদের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে ১৯৩২ সালে পুনা ইয়ারবেদা জেলে গান্ধীজী আম্বেদকরের সঙ্গে ঐতিহাসিক পুণা চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছেন ।
ফিরে আসি বাংলায় । বাংলা তাে রাজনীতি সচেতন ও রাজনীতি প্রিয় । কিন্তু প্রধান রাজনীতিক দল জাতীয় কংগ্রেস বাংলার হিন্দুদের মধ্যে অনগ্রসর জাতিগুলির থেকে প্রতিনিধি নিয়ে ঐ জাতিগুলির মানুষদেরকে কাছে টানার কোন চেষ্টাই করছিল না । অথচ সংখ্যায় তারাইতাে অনেক বেশি । কিন্তু কংগ্রেসী বাবু নেতৃত্বের কাছে তারা সব সময়ে টেকেন ফর গ্র্যান্টেড । বাংলার পশ্চিম দিকের অনগ্রসর জাতিগুলির মধ্যে এরজন্য কোন হেলদোল নেই , কোন প্রতিক্রিয়াও নেই । কিন্তু পূর্ববঙ্গের নবজাগ্রত নমঃশূদ্র জাতির বেশ কিছু মানুষ এই অবহেলা মেনে নিতে পারল না । এই পরিস্থিতির মধ্যে উঠে এলেন আর একটি ব্যক্তিত্ব , বরিশালের গৌরনদী থেকে যােগেন্দ্রনাথ মন্ডল । ইনি শিক্ষায় ব্যরিস্টার এবং জাতিতে নমঃশূদ্র । ইনি ডঃ আম্বেদকরের সিডিউল কাস্ট ফেডারেশনে যােগ দিলেন । কিন্তু সমগ্রভাবে নমঃশূদ্র জাতিটা তাে রাজনীতি সচেতন নয় । রাজনীতি তারা বােঝেও না । তাদের মন পড়ে থাকে ধর্মে আর ওড়াকান্দি ঠাকুরবাড়িতে । সেই ঠাকুরবাড়ির কেউ রাজনীতিতে আসলেন না । গুরুচাঁদ ঠাকুরের মৃত্যু ( ১৯৩৭ ) হয়েছে , উঠে এসেছেন একজন যােগ্য বংশধর , ব্যারিস্টার প্রথমরঞ্জন ঠাকুর , যিনি পি.আর.ঠাকুরনামে বেশি পরিচিত । বাংলার আকাশে তখন ঘটনার ঘনঘটা । ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক প্রজা পার্টির উত্থান , তার সঙ্গে যােগ দিতে কংগ্রেসের অস্বীকার , শ্যামাপ্রসাদের হিন্দু মহাসভার সঙ্গে যােগ দিয়ে শ্যামা - হক মন্ত্রীসভা , সেই মন্ত্রীসভা ভেঙে গিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের মন্ত্রীসভা , দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধ শুরু , সুভাষচন্দ্র বসুকে কংগ্রেস থেকে তাড়িয়ে দেওয়া , সুভাষের দেশত্যাগ , বিয়াল্লিশের ভারত ছাড় আন্দোলন , তেতাল্লিশের মন্বন্তর । এর মাঝখানে আর একটি ঘটনা ঘটে গেল যার সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য তখন কেউ অনুধাবন করতে পারেনি । ১৯৪০ সালে লাহােরে মুসলিম লীগের অধিবেশনে মহম্মদ আলী জিন্নার নেতৃত্বে ভারত ভেঙে মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান তৈরি করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হল । ইংরেজ এই দাবির পিছনে হাওয়া দিতে লাগল । এবং আশ্চর্যের বিষয় , ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিও খুব জোরের সঙ্গে এই পাকিস্তানের দাবিকে সমর্থন করল । দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেস এই দাবিকে প্রথমে গুরুত্বই দিল না , এবং পরে এই দাবির বিরােধিতা করল । অর্থাৎ কংগ্রেস দেশভাগের বিরুদ্ধে অখণ্ড ভারতের পক্ষে রায় দিল । কিন্তু এইসব রাজনৈতিক কচকচির মধ্যে সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারল না যে সত্যি দেশভাগ হতে পারে । দেশভাগ ব্যাপারটা যে কী , দেশভাগের পরিণাম কী , সাধারণ মানুষ তা বুঝবেই বা কিভাবে । মুসলিম লীগ শুধু পাকিস্তানের দাবি করে চুপ করে বসে থাকলাে না । তারা সাধারণ মুসলমানকে গরম করতে লাগল । সারা ভারতে দাঙ্গা ছড়াতে থাকল । আর কমিউনিস্টরা আরও এক পা এগিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে বৌদ্ধিক যুক্তি সাপ্লাই দিতে থাকল । কিন্তু কংগ্রেসের নেতৃত্ব পাকিস্তানের দাবি মানল না । তাদের দুটো যুক্তি । প্রথম , হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক জাতি নয় । তারা উভয়েই ভারতমাতার সন্তান , দুই ভাই । তাই তারা জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্ব মানে না । দ্বিতীয় , মুসলিম লীগ সারা ভারতের অধিকাংশ মুসলমানেরই প্রতিনিধিত্ব করে না । দেশের অধিকাংশ মুসলমান কংগ্রেসের সঙ্গে আছে , তাই মুসলিম লীগের দাবি সব মুসলমানের দাবি নয় ।
ইতিমধ্যে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে । যুদ্ধে জিতেও হিটলারের মার খেয়ে ইংলন্ডের খুব খারাপ অবস্থা । যুদ্ধ চলাকালীনই ভারতীয়দের কাছে সাহায্য চেয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে যুদ্ধের পর তারা ভারতকে স্বাধীনতা দেবে । কিন্তু হিন্দু - মুসলমান এক হতে পারছে না , কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মত মিলছে না । পাকিস্তান না পেলে মুসলিম লীগ সেই স্বাধীনতাকে গ্রহণ করবে না — এই পরিস্থিতিতে ইংরেজ কী করে স্বাধীনতা দেবে ? কার হাতেই বা ভারতের দায়িত্ব দিয়ে যাবে ? অর্থাৎ হিন্দু - মুসলিম বিভেদই হল স্বাধীনতার পথে প্রধান বাধা । এইরকম এক পরিস্থিতিতে ১৯৪৬ সালে আবার সারা ভারতে নির্বাচন হল । পরাধীন ভারতে দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচন । স্বাধীনতা দিতে ইংরেজের আপত্তি নেই অথচ হিন্দু - মুসলমান একমত হতে পারছে না । তাই উক্ত নির্বাচনে প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়ালাে দেশভাগ হবে কিনা এবং পাকিস্তান হবে কিনা । নির্বাচনে আর কোন ইস্যু ছিল না ।
এবার একটি কথা মনে রাখা খুব দরকার , তখন ছিল পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী বা সেপারেট ইলেকটরেট । হিন্দু ভােটার তালিকা আলাদা , মুসলিম ভােটার তালিকা আলাদা । এই উভয়ই তালিকার ভিত্তিতে আলাদা আলাদা নির্বাচনী কেন্দ্র বা সীট । সব দলই সকল কেন্দ্রেই প্রার্থী দিতে পারে । মুসলিম কেন্দ্রগুলিতে স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম লীগ প্রার্থী দিল । আর কংগ্রেস খুব উৎসাহের সঙ্গে ঐ কেন্দ্রগুলিতে কংগ্রেসী ছাপ মারা মুসলিম প্রার্থী দিল । আর অমুসলিম কেন্দ্রগুলিতে ( তখন হিন্দুরা সরকারি খাতায় অমুসলিম বলেই অভিহিত হত ) কংগ্রেসের প্রার্থী তাে আছেই । সেখানে আরও দুটি ছােট প্লেয়ার ছিল , হিন্দু মহাসভা ও কমিউনিস্ট পার্টি । এছাড়া নমঃশূদ্র অধ্যুষিত জেলাগুলিতে যােগেন্দ্রনাথ মন্ডলের গঠিত দল সিডিউলকাস্ট ফেডারেশনের প্রার্থী দেওয়া হল । কংগ্রেসের ধারণা ছিল যে মুসলিম নির্বাচনী কেন্দ্রগুলিতে তাদের প্রার্থীরা জিতবে । কিন্তু নির্বাচনের ফল প্রকাশ হলে দেখা গেল যে অমুসলিম কেন্দ্রগুলিতে বিপুলভাবে জিতেছে কংগ্রেস । অথচ মুসলিম নির্বাচনী কেন্দ্রগুলিতে কংগ্রেসের কোন মুসলিম প্রার্থীই জিততে পারল না । সেই কেন্দ্রগুলিতে একচেটিয়াভাবে মুসলিম লীগের প্রার্থীরা জিতল । দুধ কা দুধ পানি কা পানি হয়ে গেল । প্রমাণিত হল যে ভারতের মুসলমানরা গান্ধী-নেহেরুর কংগ্রেসের সঙ্গে নেই , তারা আছে জিন্নার মুসলিম লীগের সঙ্গে । আরও প্রমাণিত যে ভারতের মুসলমানরা পাকিস্তান চায় , আর হিন্দুরা অখণ্ড ভারত চায় । কারণ সেই নির্বচনের একমাত্র ইস্যুই ছিল দেশভাগ ।
আর পূর্ববঙ্গে নমঃশূদ্র অধ্যুষিত জেলাগুলিতে যােগেন মন্ডলের সিডিউল কাস্ট ফেডারেশনের প্রার্থীদের জয় হল ।
এরপর জিন্না সঠিকভাবেই দাবি করলেন যে ভারতের মুসলমানরা তাঁর পিছনে আছে এবং তারা পাকিস্তান চায় । কংগ্রেসের পক্ষে এই দাবি অস্বীকার করার আর কোন যুক্তি থাকল না । তখন যুক্তির জোড়াতালি চলতে লাগলাে । হিসাব মতাে গােটা পাঞ্জাব ও গােটা বাংলা পাকিস্তানে যাবার কথা । শ্যামাপ্রসাদের হস্তক্ষেপে বাংলার পশ্চিমদিকের যােলােটা জেলা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হল । কিন্তু পূৰ্ববঙ্গে যে বিশাল সংখ্যায় হিন্দু আছে তাদের কী হবে ? তারা যদি তাদের জন্য আলাদা জায়গা চায় তার কী হবে ? তাই জিন্না ও বাংলার নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দী যােগেন মন্ডলকে টোপ দিলেন — আপনি পাকিস্তানকে সমর্থন করুন , আমরা আপনাকে বড় মন্ত্রী করব এবং নমঃশূদ্র জাতি নিরাপত্তা রক্ষা করব ।
ইতিমধ্যে কমিউনিস্টরা তাে বাঙালি হিন্দুর ব্রেনওয়াশ আগে থেকেই করে চলেছে । হিন্দু মুসলমান কোন আলাদা শ্রেণি নয় , আসল শ্রেণি হল বড়লােক ও গরীব । গরীব হিন্দু ও গরীব মুসলমানরা একই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত । তাই দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু জমিদারদের শােষণের অবসান হলে গরীব হিন্দু ও গরীব মুসলমানরা একসঙ্গে মিলেমিশে থাকবে । গরীব হিন্দুদের , নমঃশূদ্রদের নিরাপত্তার কোন অভাব হবে না ইত্যাদি । যােগেন মন্ডল টোপটা খেয়ে গেলেন । তাঁরই ঠাকুমা-দিদিমারা যে শিখিয়েছিলেন , “ তেঁতুল হয় না মিষ্টি , শেখ হয় না ইষ্টি ”- একথা ভুলে গেলেন । ১৯৪৬ - এর আগস্টে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং এবং অক্টোবরে নােয়াখালির হিন্দু গণহত্যা থেকেও কোন শিক্ষা নিতে পারলেন না । সংস্কৃতে একটা শ্লোক আছে , “ কামাতুরানাং ন ভয়ং ন লজ্জা ” । পদলােভে যােগেন মন্ডল বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিলেন । তিনি যােগ দিলেন জিন্নার সঙ্গে । পাকিস্তানের দাবিকে সমর্থন করলেন এবং তাঁর নমঃশূদ্র জাতির মানুষদেরকে বােঝালেন এখানে তারা ভালাে থাকবে । আর বােধহয় লােভও দেখালেন যে , বাবুদের ছেড়ে যাওয়া জমিদারিগুলাে থেকে তারা জমির ভাগ পাবে । সরল মনােভাবের নমঃশূদ্র জাতির সাধারণ মানুষ সেই ফাঁদে পা দিল ।
১৯৪৭ সালের ১২ ই জুন কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে দেশভাগ মেনে নিল । কংগ্রেস ওয়ার্কিং সভায় দেশভাগের পক্ষে সবচেয়ে বড় ওকালতি করলেন গান্ধীজী নিজে । অথচ তিনিই আগে ঘােষণা করেছিলেন যে কংগ্রেস দেশভাগ মানবে না এবং দেশভাগ করতে হলে তাঁর দেহকে দু টুকরাে করে তবেই করা যাবে । এই হল সত্যের পূজারীর কীর্তি- প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে দেশভাগের পক্ষে ওকালতি করা ।
ইংরেজ আগে বলেছিল , ১৯৪৮ - এর জুন মাসে তারা ভারতকে স্বাধীনতা দিয়ে ভারত ছেড়ে চলে যাবে । কিন্তু কংগ্রেসের দেশভাগ মেনে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা । বিশেষ করে পশ্চিম পাঞ্জাব ও সিন্ধপ্রদেশে হিন্দুদের উপর নেমে এল প্রচন্ড আক্রমণ । পৃথিবীর ইতিহাসে এত রক্তাক্ত ব্যাপক দাঙ্গার উদাহরণ বিরল । ইংরেজ দেখল যে ১৯৪৮ - এর জুন পর্যন্ত দেরি করলে পরিস্থিতি তাে হাতের বাইরে যাবেই , তার সঙ্গে তাদের এজেন্ট নেহেরুর হাতেও আর ক্ষমতা তুলে দিয়ে যেতে পারবে না । ভবিষ্যতে ভারতে ব্রিটিশের স্বার্থ রক্ষা করা যাবে না । তাই তারা স্বাধীনতার দিন অনেকটা এগিয়ে এনে ১৯৪৭ - এর ১৪ ও ১৫ আগষ্ট ঠিক করল ।১৪ ই আগষ্ট ভারত ভাগ করে পাকিস্তান গঠন এবং ১৫ ই আগষ্ট ভারতের স্বাধীনতা ।
যাদের সামান্য বুদ্ধি আছে তারা বুঝতে পারল যে মুসলিম দেশে হিন্দু থাকতে পারবে না । তাই উচ্চবর্ণ ও উচ্চ শ্রেণির হিন্দুরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে ভারতে চলে আসা শুরু করে দিল । পশ্চিম পাকিস্তান অংশে যে প্রচন্ড রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা চলতে থাকল , সম্পত্তি লুঠও হিন্দু শিখ নারীর ইজ্জত নষ্ট করা চলতে থাকল , তার পরিণামে লাখে লাখে হিন্দু ও শিখ ভারতে চলে আসতে লাগল । এর প্রতিক্রিয়ায় উত্তর - পশ্চিম ভারতেও মুসলিম বিরােধী দাঙ্গা শুরু হল এবং বহু সংখ্যায় মুসলমানও পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য হল । তখন কিন্তু আমাদের এই পূর্ব ভারতে সেই পরিমাণে রক্তাক্ত দাঙ্গা হয়নি । তার প্রধান কারণ দুটি । এক , গান্ধীজীর কলকাতায় অবস্থান । ফলে পূর্ববঙ্গে হিন্দুর উপরে যেটুকু অত্যাচার হচ্ছিল কলকাতায় তার প্রতিক্রিয়া না হওয়ার ফলে পূর্ববঙ্গেও দাঙ্গাটা আর বাড়ল না । দুই , বিনা দাঙ্গাতেই পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দু বাবুরা জমি জায়গা সম্পত্তি ছেড়ে ভারতে চলে আসছিল , মুসলমানরা সেগুলাে দখল করতেই বেশি ব্যস্ত ছিল । এবং তারা কৌশলগত কারণে নমশূদ্রঃ ও অন্যান্য নিম্নজাতির উপর ঐ সময়ে আক্রমণ করলো না ।
দেশভাগ হতে চলেছে । পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য একটি সংবিধান সভা গঠিত হবে । সেই সভার প্রথম বৈঠকে ( করাচি ) সভাপতিত্ব করার জন্য জিন্না দায়িত্ব দিলেন যােগেন মন্ডলকে । সেটা যােগেনবাবু এক মহা গৌরবের বিষয় বলে মনে করলেন । এই বৈঠকের প্রধান কাজ ছিল পাকিস্তানের সংবিধান সভার সভাপতি নির্বাচন করা । এই বৈঠকের সভাপতির ভাষণে যােগেন মন্ডল মহম্মদ আলী জিন্নার ভূয়সী , বাঁধভাঙা প্রশংসা করলেন । যােগেনবাবু জিন্নাকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা বলে ঘােষণা করলেন । এই নির্লজ্জ চাটুকারিতার প্রতিদানে তিনি পাকিস্তানের প্রথম আইনমন্ত্রী রূপে মনােনীত হলেন ।
আবার ফিরে আসি পূর্ব বাংলায় । যােগেন মন্ডল নমঃশুদ্রের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নিরাপত্তা রক্ষার । তাই একাংশের মনে ওড়াকান্দি ঠাকুরবাড়ির প্রতি আস্থা বােধ হয় একটু টলে গিয়েছিল । আর বাবুদের তাে আত্মীয়স্বজন আছে কলকাতা , হাওড়া বর্ধমানে । তাদের তাে কেউ নেই । কোথায় যাবে , কার কাছে গিয়ে উঠবে ? কিন্তু ব্যারিস্টার পি.আর. ঠাকুর তাঁর দূরদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন এই মুসলমানের দেশে হিন্দুরা টিকতে পারবে না , সে ধনী হােক আর গরীব - ই হােক । উচু জাতই হােক বানীচু জাতই হােক । তাই তিনি দেশ ভাগের অব্যবহিত পরেই তার স্বজাতিকে আহ্বান জানালেন তাঁর সঙ্গে মাতৃভূমি ত্যাগ করে ভারতে চলে আসার । চলে আসার আগেই নড়াইলের জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গণে আয়ােজিত পূর্ববঙ্গে তাঁর শেষ সভায় তিনি স্বজাতিদের আহ্বান জানিয়ে বললেন যে সমগ্র হিন্দুজাতির সামনে এখন মহাসংকট । এই সময়ে আমরা যেন নিজেদের মধ্যে । উঁচুনীচু বােধ না রাখি এবং আমরা যেন সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে পারি । পূর্ববঙ্গের মাটিতে সেই ছিল তাঁর শেষ আহ্বান ও সাবধানবাণী । তারপর তাঁর অনুগামীদের নিয়ে রওনা দিলেন ভারতের উদ্দেশ্যে । সবাই এল না তার সঙ্গে । যােগেন মন্ডলের দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে ভরসা রেখে অধিকাংশ নমঃশুদ্রই থেকে গেল নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তানে । প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে এপারে এসে বনগাঁর কাছে গাইঘাটায় আশ্রয় নিলেন । ধীরে ধীরে সেখানেইগড়ে উঠল নমঃশূদ্র জাতির নতুন কেন্দ্র । নাম দেওয়া হল ঠাকুরনগর । সম্পূর্ণ অবহেলা ও তাচ্ছিল্প নিয়ে শুধু নিজেদের অসম্ভব পরিশ্রমকে সম্বল করে একটা জাতি সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থা থেকে নতুন করে তাদের জীবন শুরু করল । আজকের ঠাকুরনগর দেখে আজ থেকে ৫০ বছরের আগের ঠাকুরনগরের কথা কেউ কল্পনাও করতে পারবেন না ।
ওদিকে পূর্ব পাকিস্তানে বিরাট সংখ্যক নমঃশূদ্র থেকে গেল । যােগেন্দ্রনাথ মন্ডল বিশাল পাকিস্তান রাষ্ট্রের একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী , আইনমন্ত্রী । মন্ত্রীত্ব উপভােগ করছেন , বােধ হয় ভাবছেন , ইন্ডিয়ায় গেলে তাে বাবুদের সমান মর্যাদা পেতাম না , এখানে মুসলমানদের কাছে কত মর্যাদা পাচ্ছি । আর পি.আর.ঠাকুর চলে যাওয়ার পর তার স্বজাতির লােকেদের মধ্যে তিনি তাে রাজা । কিন্তু ওই যে বলে , গরীবের কথা বাসি হলে দাম হয় । তাঁর ঠাকুমা দিদিমা তাে বলে গিয়েছিলেন , তেঁতুল হয় না মিষ্টি , শেখ হয় না ইষ্টি । সে কথা শােনেননি । ভাই সাহেবদের আর কতদিন ধৈৰ্য্য থাকবে ? বাবুগুলােকে তাড়িয়েছি , আর এই নমাে - রা বাকি থাকবে ? এরাও তাে বাবুদের মতােই গুণাহ মূর্তি পূজা করে , কাঁসর ঘন্টা বাজায় , শঙ্খধ্বনি করে , শাঁখা - সিঁদুর পড়ে । আবার হরিবােল হরিবােল করে কান ঝালাপালা করে দেয় । বাবুদের মতাে এরাও তাে মুশরিক । এবার এদের পালা ।
শুরু হল মার । প্রচন্ড মার । ১৯৫০ সালে নমঃশূদ্রদের উপর বিদ্যুতের চাবুকের মতাে নেমে এল সেই অত্যাচার । সে অত্যাচারের বর্ণনা করা অসম্ভব । বহু মাইল চওড়া পদ্মা - মেঘনা পার হয়ে । সেই আর্তনাদের আওয়াজ পশ্চিম পাকিস্তানের তখনকার রাজধানী করাচি পর্যন্ত পৌঁছাবে কি করে ? তাও পৌঁছাল । যােগেন মন্ডল বিমানে উড়ে চলে এলেন ঢাকা । শুনলেন সব কথা । বেড়িয়ে পড়লেন জেলাগুলিতে নিজের চোখে পরিস্থিতি দেখার জন্য । তাঁর স্বজাতির উপর আক্রমণের চিহ্নগুলাে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলেন । দেশের কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী হিসাবে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপার-দেরকে ডেকে পাঠালেন কৈফিয়ত চাওয়ার জন্য । অনেকে দেখা করতে এলেনই না । যারাও বা এলেন তারা কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীর একটুও মর্যাদা দিলেন না । যােগেন মন্ডল তাঁর নিজের আসল অবস্থাটা বুঝতে পারলেন । মুসলমানের দেশে একটা হিন্দুর বাচ্চা , একটা কাফেরের বাচ্চার দাম কতটা তা বুঝতে পারলেন , সে যতবড় মন্ত্রীই হােক না কেন । কিন্তু তাঁর এইটুকু বােঝার জন্য তাঁর স্বজাতিকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে ।
আমার ব্যক্তিগত ধারণায় এই লােকটি ডিগ্রিধারী হলেও অন্তঃসারশূন্য ছিলেন । তাই নমঃশূদ্র জাতির এই প্রচন্ড দুর্গতির এবং তাঁর নিজের ক্ষমতার তুচ্ছতা দেখার পরেও তিনি জায়গায় জায়গায় ছােট বড় সভা করে নমঃশূদ্র জাতিকে অভয় দিতে থাকলেন এবং বলতে থাকলেন যে তােমরা কেউ বাড়ি ছেড়াে না , এখানেই থাকো , আমরা এখানেই থাকবাে । আর এরকমই একটি সভা করার পর রাত্রির অন্ধকারে তিনি নিজেই লুকিয়ে ভারতে পালিয়ে এলেন ।
বহুজনের মুখে শােনা যায় মেঘনা নদীর ব্রীজের উপর দিয়ে আসা রিফিউজি বােঝাই ট্রেনগুলাে থামিয়ে সমস্ত লােককে কেটে হত্যা করে ঐ মেঘনার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল । ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় বর্ডারে যে ভিড় হয়নি তার থেকে অনেক বেশি শরণার্থীদের ভিড় জমতে থাকলাে ১৯৫০ সালে । শুরু হয় নমঃশূদ্রের দ্বিতীয় দফার দেশত্যাগ , এবার আরও বড় আকারে । এদিকে যােগেন মন্ডল ভারতে এসে এখান থেকে তার পদত্যাগ পত্র লিখে পাঠালেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলী খানকে । আর সেই দীর্ঘ পদ্যতাগ পত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জেলা ধরে ধরে হিন্দুর উপর মুসলমানের অত্যাচারের বিশদ বিবরণ তিনি দিয়েছিলেন । তাঁর জীবনের এটা একটা ভালাে কাজ বলে আমি মনে করি । সেই পদত্যাগপত্র হাতে পেয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্যরা হা হা করে হাসছেন এটা আমি যেন মনঃশ্চক্ষে দেখতে পাই ।
১৯৫০ সালে সেই যে আসা শুরু হল এখনাে সেই আসা চলছে । তাদেরকে সাহায্যর জন্য ভারত সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে । ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তাদের পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে , যদিও তারমধ্যে অনেক জায়গাই ছিল অনুর্বর ও পাথুরে জমি । কিন্তু আন্দামান তাে অনুৰ্বজায়গা ছিলনা । সেখানে অনেকশরণার্থীকে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে । আরও অনেককে দেওয়া যেত । কিন্তু জাত বেইমান কমিউনিস্টরা ঐ রিফিউজিদের আন্দামানে পাঠানাের পথে বাধা সৃষ্টি করল । তারা বলল , বাঙালিদেরকে কালাপানিতে দ্বীপান্তরে কেন পাঠানাে হবে । তাদেরকে এই পশ্চিমবাংলাতেই পুনর্বাসন দিতে হবে । তাই আজ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ভরে গিয়েছে তামিল , তেলেগু ও ওড়িয়া মানুষে । আর বাঙালি হাত কামড়াচ্ছে । কমিউনিষ্টদের উস্কানিতে যারা আন্দামান গেল না , পশ্চিমবঙ্গেও তাদের অনেককেই পুনর্বাসন দেওয়া গেল না । তারা বাধ্য হয়ে বসে পড়ল রেল লাইনের দুধারে , সরকারি জায়গায় , ভেস্ট জমিতে ও কোথাও কোথাও স্থানীয়দের জমি জায়গা অবৈধভাবে দখল করে । উদাহরণ টালিগঞ্জ । ভারতের বহুস্থানে আজ নমঃশূদ্র জাতির মানুষরা একসঙ্গে আছেন , তার মধ্যে অন্যতম মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর ও গড়চিরুলি , উত্তরাখন্ডের রুদ্রপুর , ওড়িষ্যার কালাহান্ডি , ঢেংকানল ইত্যাদি । সেখানেও অসম্ভব পরিশ্রম করে পাথুরে মাটিতে লাঙল চালিয়ে তারা জীবন যাপন শুরু করেছিল । আজ তাদের মধ্যে । অনেকেই এখন শিক্ষাদীক্ষার সুযােগ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ভারত সরকার এদেরকে সাহায্য করেছে । কিন্তু বাংলাদেশ তৈরি হয়ে যাওয়ার পর নতুন করে আর কোন শরণার্থীকে ভারত সরকার সাহায্য করছে না । তার থেকেও বড় সমস্যা হল ১৯৭১ - এর ৩০ শে মার্সে পর যারা ভারতে এসেছে তাদেরকে নাগরিকত্বই দিচ্ছে না ভারত সরকার । এই সংখ্যাটাও বহু লক্ষ । পূর্ববঙ্গ , পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আগত যে শরণার্থীরা আজও আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি এক নাগরিকত্বের সমস্যায় ভুগছে তাদের অধিকাংশই নমঃশূদ্র । প্রচন্ড পরিশ্রমী ও সাহসী বিশাল একটা জাতি আজ পরিচয়ের সংকটে ভুগছে । কী তাদের পরিচয় , কতটুকু তাদের অধিকার , কোথায় তাদের ঠাই ?
ভারতের যে যেখানেই থাকুন না কেন চৈত্র মাসে বারুনী স্নানের তিথিতে লক্ষ লক্ষ নমঃশূদ্র মানুষরা একত্রিত হন বনগাঁর কাছে ঠাকুরনগরে । হরিচাঁদ , গুরুচাঁদ ও পি আর ঠাকুরকে শ্রদ্ধা নিবেদনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা খুঁজতে আসেন তাঁদের শিকড়কে । ওই তীর্থস্থানে আমিও বহুবার গেছি । দেখেছি তাদের ভক্তি , নিষ্ঠা ও শিকড় খোঁজার আকুতিকে । লক্ষ লক্ষ মানুষের জনস্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছি এরা ভারতের উপর বােঝা নয় । এরা সম্পদ । বােঝা হল সুনীল গাঙ্গুলী , বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য , বিমল বসু , সুজন চক্রবর্তী , তড়িৎ তােপদারের মতাে রিফিউজিরা । এই শ্রেণির লােকেরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয় নিয়ে নিজেদেরটা গুছিয়ে নিয়ে ভারতের শুধু ক্ষতিই করেছে ।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ যে জাতির ভিত নির্মাণ করে গিয়েছেন সে জাতি নষ্ট হবে না । তারা আবার মাথা তুলে দাঁড়াবেই । কিন্তু তাদের বর্তমান সমস্যাগুলির আশু সমাধান কি তা আমার জানা নেই । কিন্তু এই সমস্যাগুলির কারণ কি তা আমি জানি । যে কারণগুলির জন্য বেশিরভাগটাই তারা দায়ী নয় । দায়ী সমাজের নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব । প্রত্যক্ষভাবে দায়ী দেশভাগ । মাতৃভূমির অঙ্গচ্ছেদ , মাতৃভূমিকে খন্ডিত হতে দেওয়া - এর বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়াইনি , মুসলমানরূপী দুৰ্বত্তের অন্যায় দাবির কাছে আমরা মাথা নত করেছি । তার সঙ্গে আপস করেছি - এগুলাে পাপ । এই পাপের পায়শ্চিত্ত শেষ করে আমাদের মুক্তি নেই । আর এই পরাজয় গ্লানি অপমানের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা যেন আগামী দিনের চলার পথের রসদ সংগ্রহ করতে পারি - সেটাই আমার একমাত্র কামনা ।
শেষ কথা , নমঃশূদ্র জাতির ইতিহাস হরিচাঁদ গুরুচাঁদের অবদান , সংকটকালে পি.আর.ঠাকুরের অসীম ধৈর্য্য ও যােগেন্দ্রনাথ মন্ডলের ঐতিহাসিক ভুল- এগুলাে সম্বন্ধে আমি উপর উপর কিছুটা আলােচনা করলাম । কিন্তু এগুলি সম্বন্ধে আরও গভীর গবেষণার প্রয়ােজন আছে । এখন তাে ভারতে ১০০০ - এর উপর বিশ্ববিদ্যালয় । কমপক্ষে ২০ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ টি বিষয় বেছে নিয়ে এ সকল বিষয়ে গভীর গবেষণা হওয়া উচিৎ।আমাদের মনের অবচেতনে লুকিয়ে থাকা ভেদভাব থেকে মুক্ত হয়ে এই জাতির ইতিহাস সম্বন্ধে নিরপেক্ষ গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধান শুধু বাংলার নয় , শুধু ভারতের নয় , সমগ্র মানবতার জন্য লাভজনক হবে বলে আমি মনে করি ।
সংকলন শুভঙ্কর নাগ
সংগৃহীত স্বদেশ সংহতি সংবাদ জানুয়ারী ফেব্রুয়ারি মার্চ এপ্রিল সংখ্যা থেকে।
#suparhumanTAPANGHOSH
30
1 বার শেয়ার করা হয়েছে
লাইক করুন
কমেন্ট করুন
শেয়ার করুন
+++++++++++++++++++++++

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন