রবিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

হিন্দুধর্ম এবং পুরোহিত

 

হিন্দুধর্ম এবং পুরোহিত

শেয়ার করেছেন : প্রণব কুমার কুণ্ডু














From Whatsapp of TAPAN GHOSH
একটি গ্রুপে জনৈক বিশ্ব পুরোহিত শ্রী অনিমেষ মাতা মহাশয়ের একটি লেখার উপর আমার মন্তব্য:
পুরনো পুরোহিত প্রথার গুণকীর্তন করে মহিমামণ্ডিত করার দিন চলে গিয়েছে। পুরনো বলতে আমি দশ হাজার বছর আগের কথা বলছি না। আমি গত তিন হাজার বছরের কথা বলছি। এই সময়ে পুরোহিত তন্ত্রের ইতিহাস খুব গৌরবজনক নয়।
এসব কথা লিখতে ইচ্ছে করে না। তবু লিখতে হচ্ছে।
গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের পটভূমি ছিল বেদ এর নামে কর্মকাণ্ডের বাড়াবাড়ি ও তার ফলে সমাজের হৃদয়হীনতা। এই হৃদয়হীন কর্মকাণ্ডের প্রধান কুশীলব কারা ছিলেন? পুরোহিতরাই তো ছিলেন!
মনে রাখতে হবে, আমাদের ধর্মই, আমি যতদূর জানি, আদি শঙ্করাচার্য্য-ই বুদ্ধ কে বিষ্ণুর নবম অবতার স্বীকৃতি দিয়েছেন। কেন দিয়েছেন, কোন কারণ তো হবে! সেই কারণ খোঁজার ও বোঝার চেষ্টা কখনো করেছেন? করেননি। এখন করুন।
মনে রাখতে হবে, বুদ্ধ বেদ এর নির্দেশ মানতে অস্বীকার করেছেন এবং ঈশ্বর অস্বীকার করেছেন। তারপরেও তাঁকে বিষ্ণুর অবতার মানা!! খুবই অস্বাভাবিক ও আশ্চর্য্য মনে হয় না? তাই, কারণটা খোঁজার ও বোঝার চেষ্টা করুন।
আমি যতটুকু বুঝেছি, বুদ্ধ সনাতন ধর্মের নব জীবনদাতা। কর্মকাণ্ডের বাড়াবাড়িতে সমাজে হৃদয় ও হৃদয়বত্তা লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। যজ্ঞ, হবন, বলিদান, সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ, এগুলোই ধর্মের সর্বস্ব হয়ে গিয়েছিল। যজ্ঞের যে অন্য অর্থ আছে, যে কোন সৎকর্মই যজ্ঞ, একথা সমাজকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কে ভুলিয়েছিল? কেন ভুলিয়েছিল? বোঝা খুব কঠিন নয়। যাদের কায়েমী স্বার্থ ছিল তারাই ভুলিয়েছিল। অর্থাৎ ওই পুরোহিতবর্গ।
দ্বাপর যুগের একেবারে শেষ অংশে মহাভারত হয়েছিল। মনে করা হয়, কলিযুগে মানুষের পথনির্দেশের জন্যই মহাভারতের রচনা ও প্রচার।
সেই মহাভারতেই দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে দেওয়া হয়েছিল, শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ কী? যুধিষ্ঠির এর রাজসূয় যজ্ঞের সময় সেই যে নকুল টি (বেজি) এসেছিল যার শরীরের অর্ধেক অংশ স্বর্ণময়, তার মুখ দিয়েই জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ যজ্ঞের কাহিনী মহাভারতকার লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন।
এক ভীষণ দুর্ভিক্ষের সময় এক ব্রাহ্মণ পরিবারের সকল সদস্য নিজেদের সম্পূর্ণ অন্ন (খাদ্যদ্রব্য) অতিথি কে খাইয়ে দিয়ে অনাহারে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, সেটাকেই জগতের শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ বলা হয়েছিল।
সেই শিক্ষা যদি পুরোহিত, ব্রাহ্মণ ও সমাজপতিরা নিতেন, সেই আদর্শ যদি অনুসরণ করতেন, তাহলে বুদ্ধের আবির্ভাবের প্রয়োজনই হত না।
অর্থাৎ, যাগ যজ্ঞ পশুবলি হোম হবন ঘি পোড়ানো মন্ত্রপাঠ ঘণ্টাধ্বনি - এসবই ধর্মের মাপদন্ড হয়ে গিয়েছিল, যার মধ্যে হৃদয় ছিল না। ছিল না মানুষের সুখ দুঃখ ব্যথা বেদনার কোন স্থান। সমাজ পাষাণ হয়ে যাচ্ছিল। সেইসময় করুণার বাণী নিয়ে এসে এই সমাজে হৃদয় প্রতিস্থাপন করলেন গৌতম বুদ্ধ। সেই বাণী শুধু শব্দের শুকনো বাণী ছিল না। বুদ্ধের জীবনে আচরণে তা ফুটে উঠেছিল। সেই প্রেম করুণা ভালোবাসার শক্তি খুব বড় শক্তি। দুর্বার শক্তি।
সেই শক্তি সারা বিশ্বে কতদূর ছড়িয়ে পড়েছিল তা নিশ্চয় বলে দিতে হবে না। আজও পৃথিবীতে কত দেশে কত মন্দিরে গুরুগম্ভীর ঘন্টাধ্বনির সঙ্গে "বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি" মন্ত্র উচ্চারণ হচ্ছে, নিশ্চয় বলে দিতে হবে না।
এখানে বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্মের সার্বিক ও চুলচেরা বিশ্লেষণ (critical analysis) করা হচ্ছে না, তা নিশ্চয় বলে দিতে হবে না। বুদ্ধের আবির্ভাবের পটভূমি ও পুরোহিততন্ত্রের সেই সময়ের হৃদয়হীনতা বোঝানো আমার উদ্দেশ্য।
তারপর গত এক দু শো বছরের ইতিহাসও মনে করে দেখুন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও অন্য সাহিত্যিকরা কি সেই হৃদয়হীন সমাজের কথা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে যান নি?
ব্যক্তিগতভাবে পুরোহিত সম্বন্ধে আমার খুব বেশি তিক্ত অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু দীর্ঘদিন সামাজিক কাজে আছি বলে একটা সাধারণ পর্যবেক্ষণ অবশ্যই আছে। এবং সেই পর্যবেক্ষণটা খুব মধুর নয়। এককথায় বললে, পুরোহিত রা আজ সমাজে অনেকটাই করুণার পাত্র। এই অবস্থার জন্য কি তাঁদের কোন দায় নেই? তা তো হতে পারে না!
এটা তো খুব সাধারণ চোখেই দেখা যায় যে, একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে সবথেকে পড়াশোনায় অসফল সন্তানটিই পৌরহিত্য কে পেশা হিসাবে গ্রহণ করছে। অথবা গ্রহণ করানো হচ্ছে। তারপরে সমাজ থেকে শ্রদ্ধা আশা করা বোধহয় যুক্তিসঙ্গত হবে না। তবু একথা স্বীকার করতেই হবে যে, হিন্দুসমাজ মোটের উপর নাস্তিকও হয়নি, পুজাপাঠ ও পরম্পরার প্রতি খুব বেশি বিমুখও হয়নি। তাই হিন্দু সমাজে পুরোহিত এখনো যথেষ্ট প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক। তাই শ্রদ্ধা কম থাকলেও খাতির ও চাহিদা কম নেই।
যে সমাজ যত পুরনো হয় সেই সমাজে স্থিতিজাঢ্য (inertia) তত বেশি হয়। আমাদের সমাজ অনেকটা সেই দোষে দুষ্ট। তাই প্রয়োজনীয় পরিবর্তনে অনীহা। কিন্তু সমাজসচেতন ও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিরা প্রায় একটা ঐক্যমতে পৌঁছেছেন। সেটা হল, পূজাপাঠ সমাজে চালু রাখা দরকার। এবং সেটা যেন আরো অর্থবহ ও content যুক্ত হয় সেজন্য পৌরহিত্য প্রথাকে সম্পূর্ণ সমাজের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। অর্থাৎ, অব্রাহ্মণরাও যেন পুরোহিতের বৃত্তি নিতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য সকলকে পৌরহিত্য প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা বহু স্থানে বহু সংস্থার পক্ষ থেকে শুরু হয়েছে।
এর মধ্যে বিশেষ আনন্দের কথা হল, বেশ কিছু নাম করা হিন্দু সংগঠন ও মন্দিরের পক্ষ থেকে এর আয়োজন হচ্ছে। এবং খুবই স্বনামধন্য ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা সহর্ষে সেই প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। সেই রাজা রামমোহন রায়ের সময় থেকেই দেখা গিয়েছে, আমাদের সমাজ সংস্কারে ব্রাহ্মণরাই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন।
শ্রী অনিমেষ মাতা নিজের নামের আগে বিশ্ব পুরোহিত উপাধি বা বিশেষণটা কেন জুড়েছেন জানি না। কিন্তু পুরোহিত শব্দের যে অর্থ তিনি করেছেন সেটাকে আমি ভুল বলেই মনে করি। হিত কথাটির অর্থ তিনি অবস্থান ধরলেন কেন, কোন্ ভিত্তিতে?
বাংলার একজন শ্রেষ্ঠ পুরোহিত, বঙ্গীয় পুরোহিত সমাজ নামে সংস্থার অধ্যক্ষ শ্রী রামগোপাল শাস্ত্রী (নিবাস - বেহালা ঠাকুরপুকুর) আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। তিনি স্বর্গগত হয়েছেন। তিনি খুব স্পষ্ট করে বলতেন, পুরোহিত শব্দটির অর্থ যিনি পুরের হিতে রত। পুর মানে নগর বা জনপদ। হিত মানে কল্যাণ। কী বিরাট তফাৎ হয়ে গেল দেখছেন? অনিমেষ মাতা পুরোহিতকে অগ্র স্থানে বসাচ্ছেন। আর স্বর্গীয় রামগোপাল শাস্ত্রী সমাজের হিত সাধনে উদ্বুদ্ধ করতে চাইছেন। পাঠকই স্থির করুন কোন্ টা গ্রহণ করবেন।
একটা ইংরাজি কথন দিয়েই শেষ করতে হচ্ছে।
Respect cannot be demanded.
It is commanded.
পথপ্রদর্শক মাননীয় তপন ঘোষ
09/05/2020

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন