সরস্বতী ও ব্রহ্মা সম্পর্কে মুসলমানদের কটুক্তির জবাব দিতে এবং এ সম্পর্কে প্রকৃত সত্য জানতে হলে পড়ুন নিচের এই প্রবন্ধটি-
(এই প্রবন্ধটি পড়লে বুঝতে পারবেন হিন্দু ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্বে কিভাবে বিবর্তনবাদের ইঙ্গিত দেওয়া আছে।)
হিন্দু শাস্ত্র ঋগ বেদ অনুসারে ভগবান বাপ আর কন্যার যৌন সঙ্গমের ফলে মনুষ্য তৈরী হয়েছিল ! হায় রুদ্র। হায় রুদ্র !!-
উপরের এই মন্তব্যটি সরস্বতী ও ব্রহ্মা সম্পর্কে করেছে Mufassil Islam, যে প্রথম জীবনে ছিলো বাংলাদেশের সন্ত্রাসী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর একজন কর্মী এবং একনিষ্ঠ ইসলাম প্রচারক। সম্প্রতি সে ইসলাম ত্যাগ করে ইসলামের গোপন ইতিহাসের উপর একের পর এক নিজের ছবিসহ ভিডিও প্রকাশ করেনেট দুনিয়ায় বেশ আলোচিত। প্রথমে ভেবেছিলাম এই লোকটার কিছু বুদ্ধি সুদ্ধি আছে; কারণ, যে লোক ৭২ হুরের লোভ ছেড়ে দোযখের রিস্ক নিতে পারে, সে সাধারণ নয় এবং সে যখন কোনো কথা বলবে বা কোনো কমেন্ট করবে, তখন তার কথায় বেশ ওয়েট থাকবে, শুধু তাই নয়, তার কথায় এতটাই যুক্তি-তথ্য ও সত্যতা থাকবে, যাতে কেউ তার কথার উপর কোনো কথা বলতে না পারে। এই যে তার কমেন্টের জবাব আমি দিচ্ছি বা দেওয়ার সাহস করেছি, এটা তার একটা ব্যর্থতা; কিন্তু বাংলা নেট দুনিয়ায় এখনও এমন নারী বা পুরুষের জন্ম হয় নি, যে আমার কথার কোনো ভুল ধরে আমার কোনো পোস্টের জবাবে আরেকটি পোস্ট লিখার সাহস বা ক্ষমতা দেখাতে পারে। যদি কেউ এমনটা করতে পারে, আমি তার শিষ্যত্ব গ্রহন করবো।
বর্তমানে অল্পবিদ্যা ভয়ংকরীদের দারুন আগ্রহের বিষয় হলো হিন্দু ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে ব্রহ্মা ও সরস্বতীর ভূমিকা।
এদের কারো কারো কাছে সরস্বতী- ব্রহ্মার কন্যা; কারো কাছে আবার সরস্বতী ব্রহ্মার নাতনী। আগে তো ঠিক কর সরস্বতী- ব্রহ্মারকে, তারপর তাদের সম্পর্কে কাহিনী বানা। কেউ কেউ আবার বলে, স্বর্গের নর্তকী উর্বশীকে দেখে ব্রহ্মা নাকি এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়তো যে, সে হস্তমৈথুন করতোএবং সেই হস্তমৈথুন জাত বীর্য নাকি সে আবার একটা পাত্রে সংরক্ষণ করতো, সেই পাত্র থেকেই নাকি জন্ম ঋষি অগস্ত্যর । এরা কখনো ব্রহ্মাকে মানুষ বানাচ্ছে, যে মানুষ সুন্দরী নারীকে দেখে উত্তেজিত হয়, কাম সামলাতে না পেরে হস্তমৈথুন করে; আবার এরাই ব্রহ্মাকে মহাশক্তিশালী দেবতা বানাচ্ছে, যে দেবতা পাত্রে জড়ো করে রাখা বীর্য থেকে কারো জন্ম দিতে পারে। আগে তো ঠিক কর ব্রহ্মা- মানুষ না দেবতা, তারপর তার সম্পর্কে গল্প বানা।
বেদ পুরানে যা ই থাক, হিন্দু ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্বকে উপলব্ধি করার বা ব্যাখ্যাকরার ক্ষমতা তাদের থাক বা না থাক মুসলমানরা বিশ্বাস করে সরস্বতী ব্রহ্মার কন্যা এবং এই ব্রহ্মা ও সরস্বতীর যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। গল্পটা বেশ রসালো আর আকর্ষণীয়ও, তাই বোধহয় এটা নিয়ে এত চর্চা।
মানুষ দুটো কারণে কোনো কিছুর চর্চা করে; প্রথম কারণ হলো বিষয়টা তার কাছে খুব ভালো লেগেছে, তাই সে সেটা নিয়ে আলোচনা ক’রে অন্যের সাথে তার সেই আনন্দকে ভাগ করতে চায়; আর দ্বিতীয় কারণ হলো ঈর্ষা, ওর আছে ও পাচ্ছে; আমার নেই, আমি পাচ্ছি না কেনো- এই ঈর্ষা। বেদ এর ভুল ব্যাখ্যায় পুরানের এই বিকৃত গল্প নিয়ে হিন্দুদের কোনো মাথা ব্যাথা বা আগ্রহ না থাকলেও এর প্রতি মুসলমানদের এই প্রবল আগ্রহের কারণ হলো এই ঈর্ষা। তাদের মতে, ব্রহ্মা তার কন্যা সরস্বতীর সাথে সেক্স করতে পেরেছে, তাহলে আমরা পারছি না কেনো ? ঈর্ষার কারণ মূলত এটাই।
কিন্তু এটা নিয়ে এত হতাশায় ভোগার কী আছে ? ইসলামে তো দত্তক নেওয়া কন্যাকে বিয়ে করার পারমিশন আছে, কন্যাসমরা তো কন্যাই, সেটা দত্তক হোক আর নিজের হোক। তো সেই দত্তক নেওয়া কন্যাকে বিয়ে করতে পারলে নিজের কন্যাকে বিয়ে করতে দোষ কোথায় ? ইসলামের স্বীকৃত নবী হযরত লুত এর উদাহরণ তো আছেই; কারণ বাইবেলের অংশ জেনেসিস এর ১৯/৩৩-৩৬ তে বলা আছে, “স্ত্রী মারা গেলে হযরত লুত তার বয়স্ক দুই কন্যার গর্ভে পুত্র উৎপাদন করেছিলো”- তাই, এত হায় হুতাশ না করে হযরত লুত এর উদাহরণটা নিজেদের জীবনে প্রয়োগ কর না ?
ব্রহ্মা, সরস্বতী এরা তো মুনি-ঋষিদের কল্পনা, বিশ্ব সৃষ্টি ব্যাখ্যা করার জন্য মুনি-ঋষিরা এদেরকে কল্পনা করে নিয়েছিলেন, কিন্তু হযরত লুত কিন্তু পৃথিবীর বাস্তব মানুষ। ব্রহ্মা সরস্বতী যদি মুনি-ঋষিদের কল্পনা না হয়ে পৃথিবীর বাস্তব মানুষের মতো হতো, তাহলে এতদিনে তাদের মৃত্যু হতো, কিন্তু তাদের মৃত্যুর কি কোনো ইতিহাস আছে ? না, নেই। তাদের মৃত্যু যদি না হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয় এখনও তাদের সন্তান সন্তুতি জন্ম নিচ্ছে ? কী বলেন, মুমিনগন ? এ পর্যন্ত ব্রহ্মা ও সরস্বতীর কতজন ছেলে মেয়ে জন্ম নিয়েছে এবং বর্তমানে কততম সন্তানের জন্ম হতে চলেছে, সেই হিসেবটা দিয়ে যাবেন। জানি, আপনারা সেই হিসেব দিতে পারবেন না; কারণ, একজনের কমেন্টও যখন অপর জন কপি পেস্ট করে চালিয়ে দেন, তখন আপনারা এই হিসেব পাবেন কোথায় ? তাড়াতাড়ি জাকির নায়েকের বক্তৃতার ভিডিও বা বই সার্চ করা শুরু করেন, দেখেন এ ব্যাপারে জাকির কোথাও কিছু বলে গেছে কিনা ? কারণ আপনাদের বিদ্যার দৌড় তো জাকির পর্যন্তই।
বেদ এর সূত্রকে অবলম্বন করে পুরানের গল্পগুলো রচিত। কিন্তু যারা পুরানের গল্পগুলো লিখেছিলো, তারা যে বেদ এর ভাষ্যকে ঠিক মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিলো, এই বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। আবার এটাও হতে পারে দীর্ঘদিন মুসলিম দুঃশাসনের অধীনে থাকার কারণে পুরানের গল্পগুলো বিকৃত হয়েছে; কারণ, মুসলমান শাসকদের লক্ষ্যই ছিলো হিন্দুধর্ম ও জাতিকে ধ্বংস করা, এজন্য তারা শুধু হিন্দু ধর্মের গ্রন্থগুলোকে বিকৃতই করে নি, নতুন নতুন পুরান নিজেদের পৃষ্ঠপোষকতায় রচনা করিয়ে হিন্দুধর্মের গ্রন্থ বলে চালিয়ে দিয়েছে। এরকম কয়েকটি গ্রন্থহলো- ভবিষ্যপুরান, আল্যাউপনিষদ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান এবং এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানের উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে মুসলমান শাসকদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত হয় জয়দেব এর গীত গোবিন্দ, বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যএবং বৈষ্ণব পদাবলী।
ভারতে ছাপাখানা আসার আগে প্রয়োজনীয় সমস্ত গ্রন্থ হাতে লিখে নতুন কপি বানানো হতো। যাদের হাতের লেখা ভালো ছিলো তারা এই কাজটা করতো, অনেকের এটা পেশাও ছিলো। এরা কখনো কখনো মূলবই লিখতে লিখতে তাতে নিজের কথা ঢুকিয়ে দিতো, এভাবেও হিন্দুধর্মের গ্রন্থগুলো বিকৃত হয়েছে। কিন্তু এই লিপিকারদের হাতে বেদ এর বিকৃতি তেমন হয় নি, কোলকাতার ব্রাহ্ম সমাজ এর বুদ্ধি ও সহযোগিতায় বেদ এর বিকৃতি ঘটিয়ে প্রিন্ট করে ইংরেজরা। কিন্তু লিপিকারদরে হাতে ব্যাপকভাবে বিকৃতি ঘটেছে পুরানের গল্পগুলির, শুধু তাই নয়, তাতে যোগ হয়েছে নতুন গল্প এবং গল্পের শাখা প্রশাখা। আজকের প্রসঙ্গ যেহেতু ব্রহ্মা ও সরস্বতী, সেহেতু এই প্রসঙ্গেই পুরানের গল্পগুলির যে কী হাল, তার কিছু উদাহরণ দিচ্ছি-
পুরাণের একটি কাহিনী অনুযায়ী, স্বর্গের নর্তকী ঊর্বশীকে দেখে স্বমেহন মানে হস্তমৈথুন করতেন ব্রহ্মা। ব্রহ্মার শুক্রাণু জমা হতো একটি পাত্রে। সেই পাত্রেই জন্ম হয় ঋষি অগস্ত্যর এবং পরবর্তীতে অগস্ত্য জন্ম দেন সরস্বতীর। এই সূত্র অনুযায়ী - সরস্বতী ব্রহ্মার নাতনী।
এখন আপনি ই বলুন, ব্রহ্মা কি মানুষ, যে সুন্দরী কোনো নারীকে দেখে তার কাম জাগ্রত হবে আর সেই কামকে প্রশমিত করার জন্য সে স্বমেহন করবে ? এরপর বলা হচ্ছে ব্রহ্মার শুক্রানু জমা হতো একটি পাত্রে, সেই পাত্র থেকে জন্ম হয় ঋষি অগস্ত্যের। কিন্তু হিন্দু শাস্ত্র মতে মূল তত্ত্ব হচ্ছে, ব্রহ্মা তার মনের শক্তি দ্বারাই তার পুত্রদের সৃষ্টি করতে পারতেন, এজন্যই তাদেরকে বলা হয় ব্রহ্মার মানসপুত্র। ব্রহ্মার চরিত্রে আরোপিত এই যে বিপরীত ধর্মী ঘটনা, এটা কিভাবে সম্ভব ? কারো মধ্যে যদি এই ক্ষমতা থাকে যে, সে তার চিন্তা শক্তির দ্বারাই কাউকে হত্যা করতে পারে, তাহলে সেম্যানুয়ালি চাপাতি নিয়ে কাউকে হত্যা করতে যাবে কেনো ?
এই কাহিনী অনুযায়ী পাত্র থেকে উদ্ভূতঋষি অগস্ত্য জন্ম দেয় সরস্বতীর। তাহলে নিশ্চয় সরস্বতীর একজন মা থাকা চাই, কিন্তু সরস্বতীর মায়ের খবর কেউ কি জানেন ? কিন্তু ঋষি অগস্ত্যের একজন স্ত্রী ছিলো, নাম লোপামুদ্রা। সেই হিসেবে লোপামুদ্রা সরস্বতীর মা হওয়ার কথা। কিন্তু এমন কথা কেউ কখনো কি শুনেছেন ? আরেকটি কাহিনী অনুযায়ী অপ্সরা উর্বশীকে দেখে কোনো এক যজ্ঞকুম্ভে বীর্যপাত হয় আদিত্য ও বরুনের। সেই যজ্ঞকুম্ভ থেকে অগস্ত্য ও বশিষ্ঠের জন্ম হয়। মূল কাহিনী অনুযায়ী এই বশিষ্ঠ কিন্তু আবার ব্রহ্মার মানসপুত্রদের একজন। চিন্তা করুন অবস্থা!
এইভাবে পুরানের গল্পগুলোর গরু শুধু গাছেই নয়, আকাশেও চড়ে বেরিয়েছে। এজন্যই পুরানের গল্পগুলো শুধুই গল্প, এগুলোর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই এবং এই গল্পগুলোর উপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্তেও আসা যায় না। কিন্তু এই পুরানগুলো আবার মহর্ষি বেদব্যাসের নামেই বাজারে প্রচলিত, এখন আপনিই চিন্তা করুন, যে বেদব্যাস মহাভারতের মতো একটি বিশুদ্ধ মহাকাব্যের রচয়িতা, যে মহাকাব্যে একটিও ভুল না থাকার কারণে ছোটখাটো কোনো ত্রুটি বিচ্যুতিতে- “মহাভারত কি অশুদ্ধ হয়ে যাবে” ব’লে প্রবাদ বাক্যের উৎপত্তি, সেই মহাভারত রচয়িতা কি এমন সব গাঁজাখোরি পুরানের গল্প লিখতে পারে ? এসব বিচারে স্পষ্ট যে, বর্তমানে বাজারে প্রচলিত সব পুরাণ হিন্দুধর্মের প্রামান্য গ্রন্থ নয়।
আবার অন্য একটি কাহিনী মতে, ব্রহ্মার শুক্রাণু থেকে সরাসরি জন্ম হয় সরস্বতীর। কিন্তু নিজের মেয়ের রূপ দেখে মুগ্ধ হন পিতা প্রজাপতি ব্রহ্মা। সরস্বতী বড় হলে তাঁর সঙ্গে সে যৌনসঙ্গম করতে চায়। জন্মদাতার কামনা থেকে বাঁচতে পালিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করে সরস্বতী।সরস্বতী ব্রহ্মার চোখের আড়াল হওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। তার উপর নজর রাখতে নিজের ঘাড়ের উপর পাঁচদিকে পাঁচটি মাথা তৈরি হয়ে যায় ব্রহ্মার।সরস্বতী তখন ব্রহ্মার কামাবেগ থেকে নিজেকে বাঁচাতে নানা পশুর ছদ্মবেশ ধরে পালাতে থাকে।ব্রহ্মাও একে একে সেইসব পশুর পুরুষ রূপ ধারণ করে সরস্বতীর পিছু নেয়। বলা হয়, এইভাবেই তৈরি হয় জীবকূল। সরস্বতী বাঁচতে একটি গুহার ভিতর আশ্রয় নেয়।ব্রহ্মা সেই গুহাতেই মিলিত হন সরস্বতীর সঙ্গে।সরস্বতী ছিলো ব্রহ্মার কন্যা।কিন্তু তার সঙ্গেই মিলিত হন ব্রহ্মা।এই অবৈধ যৌনাচারের অপরাধে শিব ব্রহ্মার পঞ্চম মাথাটি কেটে দেন এবং অভিশাপ দেন যে, ধরাধামে কেউ ব্রহ্মার পূজা করবে না।
এই জন্যই নাকি পৃথিবীতে শিব ও বিষ্ণুর পূজার প্রচলন থাকলেও ব্রহ্মার পূজার প্রচলন নেই। যেমন ঘটনা, তেমনি সেই ঘটনার পেছনের কাহিনীর ব্যাখ্যা!
এই কাহিনীতে বলা হচ্ছে, ব্রহ্মার শুক্রানু থেকে জন্ম হয় সরস্বতীর। তাহলে শুক্রানুর সাথে তো ডিম্বানুরও প্রয়োজন হবে, তাহলে সেই ডিম্বানুটা কার ? পরে বলা হলো, সরস্বতী বড় হলে তার রূপ মুগ্ধ হয়ে ব্রহ্মা তার সাথে সেক্স করতে চায়। এখানে বোঝা যাচ্ছে, মানব সন্তানের মতো শিশু রূপেই সরস্বতীর জন্ম হয়েছে, তাহলে তার মা কে ? সরস্বতী শিশু ছিলো, বড় হলে তার প্রতি তার পিতা ব্রহ্মা আকৃষ্ট হয়, তার মানে সরস্বতী এক পর্যায়ে বৃদ্ধা হয় এবং মারাও যায়, তাহলে তার মৃত্যুর ইতিহাসটা কোথায় ?
আরো বলা হচ্ছে, ব্রহ্মার চোখের আড়াল হওয়ার জন্য সরস্বতী লুকানোর চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু তার উপর নজর রাখার জন্য ব্রহ্মার পাঁচদিকে পাঁচটি মাথা তৈরি হয়। যে ব্রহ্মা মন থেকেই সব সৃষ্টি করতে পারে, যার মনের এত ক্ষমতা, তার চোখের আড়াল হওয়া কি সম্ভব ? সরস্বতী যাতে চোখের আড়াল না হতে পারে, সেজন্যই নাকি ব্রহ্মার ঘাড়ের উপর পাঁচটি মাথা তৈরি হয়, কিন্তু দিক তো চারটি, তাহলে পাঁচটি মাথার প্রয়োজন হলো কেনো ? নাকি পৃথিবীতে ব্রহ্মার পূজার প্রচলন কেনো নেই, সেই ব্যাখ্যা দেবার জন্য ব্রহ্মার উপর একটি অভিশাপের গল্পের প্রয়োজন ছিলো, সেজন্য ব্রহ্মার পাঁচটি মাথার গল্প বানিয়ে তা থেকে শিবের মাধ্যমে একটি মাথা কেটে ফেলা হয়েছে এবং ব্রহ্মার উপর শিবের অভিশাপকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই আষাঢ়ে গল্পকাররা বোধহয় জানতো না যে, উৎপত্তির দিক থেকেশিবের চেয়ে সিনিয়র হলো ব্রহ্মা। যদিও শিব এবং ব্রহ্মা একই লেভেলের দেবতা, কিন্তু মন্ত্রীসভার-বয়সে জুনিয়র কোনো পূর্ণমন্ত্রী কি, তার চেয়ে সিনিয়র কোনো পূর্ণমন্ত্রীর উপর ক্ষমতা খাটাতে পারে ? দুজনই তো পূর্ণমন্ত্রী, তাদের ক্ষমতাও এক ?
এরপর বলা হচ্ছে, সরস্বতী তখন ব্রহ্মার কামাবেগ থেকে নিজেকে বাঁচাতে নানা পশুর ছদ্মবেশ ধরে পালাতে থাকে, ব্রহ্মাও একে একে সেইসব পশুর পুরুষ রূপ ধারণ করে সরস্বতীর পিছু নেয় এবং এইভাবেই তৈরি হয় জীবকূল বা প্রাণীজগৎ।
পুরান রচয়িতারা যেহেতু আগেই বলে দিয়েছে যে, ব্রহ্মার কামাবেগ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছিলো সরস্বতী, তাই তাদেরকে সরস্বতীর এই নানা ছদ্মবেশ ধারণের সাথে সাথে তাকে পালানোর ভূমিকায় দেখাতে হয়েছে। কিন্তু আমি যখন এর মূলকাহিনী এই পোস্টের শেষের দিকে বর্ণনা করবো, তখন বুঝতে পারবেন আসলে প্রকৃত ঘটনাটা কী ?
এরপর বলা হচ্ছে, সরস্বতী বাঁচতে একটি গুহার ভিতর আশ্রয় নেয়।ব্রহ্মা সেই গুহাতেই মিলিত হন সরস্বতীর সঙ্গে। যে মন থেকেই সব কিছু সৃষ্টি করতে পারে, যে চাওয়া মাত্রই তার মাথার পাশে আরও চার/পাঁচটি মাথার গজিয়ে যায়, তার হাত থেকে পালিয়ে গুহার ভেতর আশ্রয় নিয়ে বাঁচার চেষ্টা কি বৃথা নয় ?
এরপর একটি পদ্মফুল সরস্বতীর সাথে নাকি ব্রহ্মা ১০০ বছর ধরে মিলিত হয় এবং তাদের কয়েকটি ছেলে মেয়েও হয় এবং এখানে মুসলমানদের অভিযোগ হচ্ছে, তাদের ভাষায় পিতা ব্রহ্মার সাথে সরস্বতী এই যৌনক্রিয়া কখনোই করতে চায় নি, তাই এটা এক প্রকারের ধর্ষণ। যদিও এটা কাহিনীর স্বীকৃতি নয়, তবুও শুধু তর্কের খাতিরে বলছি, সরস্বতীর যদি ইচ্ছাই না থাকতো তাহলে সে ঐ গুহা থেকে বের হয়ে পদ্মফুলে হানিমুন করতে এলো কেনো ? আর এই পদ্মফুলটা কত বড় ছিলো আর কোনো সরোবরে ছিলো, যে তা ১০০ বছর ধরে জীবিত ছিলো আর কয়েকজন মানুষের সংসারকে ধারণ করে রাখতে পারলো ? নব্য হিন্দু ধর্মজ্ঞানীদেরকে বলছি, এই পোস্টে উল্লেখ করা আমার প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর মরদ হলে দিয়ে যাবেন, আর দিতে না পারলে বুঝবো, যারা হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে সব কিছু না জেনে পুরানের কিছু বিকৃত ও অতিরঞ্জিত কাহিনী নিয়ে হিন্দু ধর্মকে দোষারোপ করে তারা…………।
এক একজন দেব-দেবীকে নিয়ে যত পুরান লিখা হয়েছে তার প্রত্যেকেটিতে তাদেরকে আলাদা আলাদা ঘটনায় উপস্থাপিত করা হয়েছে। তাই কোনো পুরানের সাথে কোনো পুরানের গল্পের হান্ড্রেড পার্সেন্ট মিল নেই, যদিও দেব-দেবী সব এক, এটা কিভাবে সম্ভব ? সম্ভব এ্ই ভাবেই যে, হয়- পুরান রচয়িতারা বেদকে ঠিক ভাবে বুঝতে পারেনি, না হয় পরবর্তীতে লিপিকারদের হাতে পুরানগুলো বিকৃত হয়ে কাহিনীর নানা রূপ লাভ করেছে।
এখন হিন্দু ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্ব মতে, ব্রহ্মা ও সরস্বতীর আসল স্টোরিটা কী, দেখুন :
হিন্দুশাস্ত্র মতে, সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর হলো পরমব্রহ্ম, যাকে শুধু ব্রহ্মও বলা হয়। পরমাত্মারূপে এই ব্রহ্ম সবকিছুর মধ্যে বিরাজিত, এই জন্যই হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে,
“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”
এর অর্থ হলো- সকলের মধ্যে ব্রহ্ম বিদ্যমান। - (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৩/১৪/১, বেদান্ত দর্শন)
এই ব্রহ্ম, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, এই তিনটি রূপে তার কাজ সম্পন্ন করে থাকেন। ব্রহ্ম, যখন সৃষ্টি করেন, তখন তার নাম ব্রহ্মা; যখন তিনি পালন করেন, তখন তার নাম বিষ্ণু; যখন তিনি বিনাশ করেন, তখন তার নাম শিব বা মহেশ্বর। কিন্তু আমাদের পুরান রচয়িতারা বেদ এর সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলোকে বুঝতে না পেরে, ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরকে তিনটি আলাদা সত্ত্বা হিসেবে বিবেচনা করে নিয়ে তাদেরকে আলাদা আলাদা রূপ দিয়ে দিয়েছে, শুধু তাই নয় তাদের পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া ফ্যাসাদও লাগিয়ে দিয়েছে। তাদেরকে মানুষ রূপে কল্পনা করে তাদের দিয়ে আরো যা করিয়েছে তা তো উপরে করা বর্ণনায় কিছুটা বুঝতেই পারলেন।
ব্রহ্ম ও ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের ব্যাপারটা সহজে বোঝার জন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন, প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রীর হাতে তিনটি পৃথক মন্ত্রণালয় রয়েছে; তো যখন প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী যে মন্ত্রণালয়ের হয়ে কাজ করেন বা ফাইলে সই করেন, তখন তিনি কিন্তু সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, কিন্তু বাস্তবে তিনি প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী; ব্রহ্মও ঠিক সেরূপ, তিনি প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী, কিন্তু তিনি কাজ করেন সাধারণ মন্ত্রী হয়ে, সাধারণ মন্ত্রীর নামে।
এই ব্যাপারটা আর একটু পরিষ্কার করার জন্য বলছি, অনেকে বা সকলেই জানেন, বিষ্ণু পালন কর্তা। তাহলে বিষ্ণুর অবতারদের তো যুদ্ধ, ধ্বংস, বিনাশ এই সব করার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু রাম কী যুদ্ধ করে রাবনের বংশকে বিনাশ করে নি ? শ্রীকৃষ্ণ কি নিজে কংস, শিশুপাল, নরকাসুরকে হত্যা করে নি ? ভীমের মাধ্যমে জরাসন্ধ, দুর্যোধনকে হত্যা করায় নি ? পাণ্ডবদের মাধ্যমে কুরুবংশকে ধ্বংস করে নি ? বিষ্ণু যদি কোনো আলাদা সত্ত্বা হতো আর তার কাজ শুধু যদি পালন করা হতো, তাহলে কি সে এই যুদ্ধ, বিনাশগুলো করতো ? আসলে এগুলো করিয়েছেন ব্রহ্ম, আমাদের শাস্ত্রকারা তাদেরকে শুধু বিষ্ণুর অবতার হিসেবে কল্পনা করে ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করেছেন মাত্র। না হলেপৃথিবীতে এত বিষ্ণুর অবতার, সেই তুলনায় ব্রহ্মা ও শিবের কোনো অবতার নেই কেনো ? আসলে- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরতো আলাদাকেউ নয়।
যা হোক, ব্রহ্মের ব্রহ্মা রূপের কাজ হলো সৃষ্টি করা। তো সৃষ্টি করতে লাগে নারী ও পুরুষ সত্ত্বা। সরস্বতী হলো পুরুষরূপী ব্রহ্মার নারী শক্তি। যে কোনো কিছু সৃষ্টি করতে লাগে জ্ঞান, এজন্য সরস্বতীকে কল্পনা করা হয়েছে জ্ঞানের দেবী হিসেবে। কোনো কিছু সৃষ্টি করার সময় সবদিকে নজর রাখতে হয়, এই সবদিকে নজর রাখার প্রতীক হিসেবে ব্রহ্মার চারমাথা। উপরেই পড়েছেন, ব্রহ্মার কাছ থেকে বাঁচার জন্য সরস্বতী বিভিন্ন প্রাণীর রূপ ধরে পালাতে থাকে আর তার পিছু পিছু ঐ প্রাণীর পুরুষ রূপ ধরে ব্রহ্মা তার পিছু পিছু দৌড়াতে থাকে, এভাবেই সৃ্ষ্টি হয় জীবকূল; এটা আসলে বিজ্ঞানের বিবর্তনবাদের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। দৌড়াতে দৌড়াতে সরস্বতী গিয়ে আশ্রয় নেয় গুহার মধ্যে; এটা হলো, বিবর্তনের শেষ ধাপ মোটামুটি আধুনিক মানুষের গুহার জীবন এবং তারপর পদ্মফুলে ব্রহ্মা ও সরস্বতীর বাস এবং তাদের ছেলে মেয়ের জন্ম আসলে আধুনিক সভ্য মানুষের জীবন যাপনের প্রতীক।
এইভাবে হিন্দু শাস্ত্রের সৃষ্টিতত্ত্বের মধ্যে বিজ্ঞানের বিবর্তনবাদ খুবই প্রতীকী রূপে ও সংক্ষিপ্তভাবে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু এই ব্যাপারগুলোকে না বুঝে আমাদের পুরাণ রচয়িতারা যেন-তেন ভাবে সেগুলোকে ব্যাখা করতে গিয়ে যা-তা কাহিনী বানিয়ে ফেলেছে, আর পরবর্তী লিপিকারদের হাতে সেগুলো শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে নানা ভাবে পল্লবিত হয়ে উঠেছে। আর এই সব বিকৃত পুরানের বিকৃত গল্পগুলোর উপর ভিত্তি করে বর্তমানের যৌন উন্মাদ মুসলমান পুরাণ রচয়িতারা এর সাথে যুক্ত করেছে যৌনতার নানা গল্প। যৌনতায় মুসলমানদের যেমন কোনো নীতি নৈতিকতা নেই, তেমনি তাদের চিন্তারও ও কোনো নীতি নৈতিকতা নেই, তাই তারা সরস্বতীকে কখনো বানায় ব্রহ্মার মেয়ে, কখনো নাতনী, এই মেয়ের বা নাতনীর উপর কামলালসা চরিতার্থতা করার জন্য ব্রহ্মাকে নিজেদের মতো করে বানায় লম্পট, চরিত্রহীন, যে সুন্দরী নারী দেখে হস্তমৈথুন করে, কন্যার সাথে সেক্স করার জন্য তার পিছু দৌড়ায়, আরও কত কী ?
আসলে যার যে রকম মন, সে বা তারা তো সেরকমই চিন্তা করবে, মুসলমানরা করেছে ঠিক তাই। তাই সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মের ব্রহ্মারূপকে তারা বানিয়েছে নীচু শ্রেণীর মানুষ, আর তার নারীশক্তি সরস্বতী, তাদের কাছে ব্রহ্মার স্ত্রীও নয়, কন্যা-নাতনী! যেন গল্পটা আরো ভালো জমে আর তা দিয়ে প্রমান করা যায় যে হিন্দুধর্মের সৃষ্টিতত্ত্ব কত নোংরা, জঘন্য; কিন্তু এসব করতে গিয়ে তাদের নিজেদের পাছার কাপড় যে খুলে যাচ্ছে, যাবে, সেটা তারা বোধহয় কখনোই ভাবে নি। কারণ, ইসলামকে বড় করে তোলার জন্য জাকির নায়েক মার্কা মুসলমানদের এই যে বাড়াবাড়ি, সেই বাড়াবাড়ির জবাব দিতে গিয়েই নতুনভাবে জন্ম হয়েছে, আমার এবং আমার মতো আরো অনেকের, এজন্য হিন্দু ধর্মের প্রকৃত সত্য যে শুধু বের ই হয়ে আসছে, তাই নয়, উন্মোচন হচ্ছে ইসলামেরও অন্ধকার দিকগুলো এবং আরো হবে, এখন সময় শুধু অপেক্ষার, ইসলামের পতনকে দেখার।
জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন