শনিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২৩

তন্ত্র ( দুই )

 তন্ত্র ( দুই )

" তন্ত্র ( TANTRISM )! "

-------------------------------


"তন্ত্র" সুপ্রাচীন ,বিরাট একটি গুপ্ত বিষয় ৷

আমরা হিন্দুরা মনে করি এই মহাবিশ্ব হলো মহাদেব ও মহাশক্তির দিব্যলীলা ৷ আসলে সৃষ্টির পরিচালনার নিয়ম ৷আর তন্ত্র চর্চার কারণ মানুষকে অজ্ঞানতা ও পুনর্জন্মের হাত থেকে মুক্তি দান ৷এটি গুরু পরম্পরা একটি গুপ্ত বিদ্যা ৷ একটি আগম শাস্ত্র ৷আসলে অন্তর্জগতের প্রযুক্তি ৷যেখানে মানুষের দেহকে যন্ত্র স্বরূপ দেখা হয় ৷ আমাদের দেহ স্থূল শরীর (food body) , মনোজগত( mental body) এবং প্রাণ শরীর ( energy body) নিয়ে গড়া ৷এর বাইরে সবকিছু আমাদের ভৌত বা ইন্দ্রিয় চেতনার অতীত ৷তন্ত্র হলো স্থূল শরীর ও মনের অদম্য প্রবৃত্তির সীমারেখাকে অতিক্রম করার কৌশল ৷ জগদ্ধাত্রী , কালী , তারা , ত্রিপুরা , ভৈরবী ,ভুবনেশ্বরী ও অন্নপূর্ণার মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে তন্ত্রসাধনা করা হয় ৷মহানির্বাণ তন্ত্রে পূজারী বা সেবক ও ভগবান বা ভগবতীর ঐক্যকে পুজো বলা হয়েছে ৷নিত্য , নৈমিত্তিক ও কাম্য এই তিন ধরণের পুজো ৷ বিভিন্ন দেবতার বীজমন্ত্র আলাদা ৷ মা কালীর বীজ একাক্ষর , মা তারার ত্রক্ষর আবার বজ্রবৈরেচনীর একাদশাক্ষর ৷বীজমন্ত্রগুলি গোপন রাখার জন্য সাংকেতিক শব্দ ও অর্থ করা হয় ৷ পঞ্চমুন্ডির ( পাঁচ প্রকার মাথা - যারা মড়া পোড়ায় তাদের কারো , কেউটে জাতীয় তীব্র বিষধর সাপের , শেয়াল বা বেজির , হনুমানের ও অপঘাতে মৃত কারো মাথা ) আসনে তন্ত্র সাধনা করা হয় ৷ প্রথমে মদে তারপর পঞ্চামৃতে ( দুধ , দই , ঘি , মধু ও চিনি) শোধন করে অমাবস্যার গভীর রাতে তান্ত্রিক সাধনায় বসেন ৷ মহাবিশ্ব ব্রহ্মা , বিষ্ণু ও শিব এই তিন শক্তির পরিচালনার নিয়মকে প্রকাশ করে ৷এতে ভক্তের জীবন আনন্দময় ও কল্যাণময় হয়ে ওঠে ৷ চৈতন্যময়ী প্রকৃতির আরাধনা করে "শিবত্ব" লাভ বা শক্তিমান হওয়া ৷ হিন্দু ধর্মে ঈশ্বরের রূপ কল্পনা করা হয়েছে , তা সাধকের ও সমাজের হিতের জন্য ( "সাধকানাং হিতার্থায়ৈ ব্রহ্মণে রূপকল্পনা )৷ ঋগ্বেদের দশম সূক্তে ( ৭২-৯) -তে প্রথমএর উল্লেখ
আছে ৷ যার অর্থ ত্রাণ বা মুক্তি ৷ অনেকে একে পঞ্চম বেদ বলেছেন ৷ তবে , বেদ জ্ঞানী মানুষের সংখ্যা কমে গেলে দেখা যায় তান্ত্রিকদের প্রার্দুভাব বেড়েছে ৷ মধ্য যুগে যা বিশাল আকার নেয় ৷
তবে, তন্ত্র বা এ ধরনের পূজা পদ্ধতি পৃথিবীর নানা
প্রান্তে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে ৷ বৌদ্ধ, জৈন ,
তিব্বতি ধর্মে এর ব্যাপকতা রয়েছে৷ বৌদ্ধতান্ত্রিক
বজ্রযান ( নীল তারাকৃত)দের হল নির্ভরশীল উৎপত্তি তত্ব বিপতিচ্চসম্যুৎপাদ ৷ প্রথম ধর্ম সঙ্গীতিতে ৮৪জন তান্ত্রিক সিদ্ধাচার্য ছিলেন ৷ অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেছিলেন ৷ হিন্দু দেবী তারা আর বৌদ্ধ দেবী উগ্রতারা ও একজটা মূলতঃ এক ৷ বজ্রযানী বৌদ্ধদের কাছে বজ্র হলো শূন্য ৷ আমাদের হিন্দু তান্ত্রিকদের কাছে এই শূন্য পরমব্রহ্ম ৷ আর বজ্রযান মতে বজ্র হলো পরম শক্তিমান , অভেদ্য ও নিরাকার ৷তাদের আট ভৈরব অসিতাঙ্গ , রুরু , চন্ড , কপাল , ভীষণ , ক্রোধ , উন্মত্ত ও সংহার ৷ আর হিন্দু ভূত ডামোর তন্ত্রে শুধু ক্রোধ ভৈরবের স্তুতি ৷ ৪৩০০-১৭০০
খ্রিস্টপূর্বাব্দে সভ্যতা বিকাশেরও আগে যৌনতাকে ধর্মাচারের অঙ্গ ধরা হত ৷ সেক্সের সময় শরীর থেকে নির্গত এনার্জীকে পজিটিভ কাজে লাগানো হত ৷ তবে, পরে তান্ত্রিক যৌনতা যা শরীর- মনে নির্মল আনন্দ দেয় তা হারিয়ে যায় ৷ তন্ত্রে তান্ত্রিক ব্যবহারই প্রধান ক্রিয়া ও তা অনুষ্ঠান নির্ভর ৷ হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন সাধন পদ্ধতি , পূজা পার্বন , দেবদেবী , ধর্মগ্রন্থ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আমার লেখা "সনাতনী কৃষ্টিকথা " এবং "হিন্দু ধর্ম " বইদুটি পড়ুন ও পড়ান ৷ আমার ৯৭৩২২১৭৪৮৯ নম্বরে একেকটি বইয়ের জন্য তিনশো টাকা করে ছশো টাকা ফোন পে বা গুগুল পে করে হোয়াটস এপে নিজের নাম ঠিকানা ইত্যাদি পাঠালে ক্যুরিয়ারে আমার সহকারী পাঠিয়ে দেবে ৷
হিন্দু তন্ত্র শাস্ত্র হল শিব ও মহাশক্তির উপাসনার একটি পথ ৷ যা ভগবান শিব এবং ভগবতী পার্বতীর কথপোকথন থেকে এসেছে বলে একে বলে "শিবোক্ত শাস্ত্র "৷ আমাদের হিন্দু তন্ত্র শৈব ,শাক্ত ও কিয়ৎ পরিমানে বৈষ্ণবের মধ্যে দেখা যায় ৷ বৈষ্ণব তন্ত্রে বলা হয়েছে যা ভয় থেকে ত্রাণ করে ৷বৈষ্ণব তন্ত্র বা পঞ্চরাত্র চার রকম ৷ আগম , মন্ত্র , তন্ত্র , তন্ত্রান্তর সিদ্ধান্ত যথা কল্প , যামল , রহস্য ও সংহিতা ৷ হিন্দু তন্ত্র পরিশীলিত ৷ কিছু ভন্ড তান্ত্রিককে দেখে অনেকে মনে করে এর মধ্যে বোধ হয় যৌন বাসনা চরিতার্থ হয় ৷ জৈবিক প্রবৃত্তি নয়, তন্ত্র আসলে আধ্যাত্মিক আশ্রয় ৷তাই , মাদকাসক্ত কখনো খাঁটি তান্ত্রিক হতে পারেনা ৷ তন্ত্রের নামে ভন্ডামী শুধু অধর্ম নয় ৷ অপরাধ ৷ তন্ত্র বিশেষ নৈপুণ্য ৷তাই ,তন্ত্র দ্বারা জীব উন্নতস্তরে পৌঁছাতে পারে ৷সাধনায় সিদ্ধিলাভের উপযুক্ত সময় সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ ৷ এই কামনা শাস্ত্র
শুধু নিজের কামনা পূরণ করেনা ,মানব কল্যাণে কাজে লাগে ৷ নিজেকে অনুসন্ধান করে অন্তরের ভগবানকে খুঁজে পাওয়া যায়। তান্ত্রিক হতে চাই চূড়ান্ত শৃঙ্খলা ৷মন্ত্রের জন্য মনকে নির্দিষ্ট দিকে চালনা করতে হয় ৷ যা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না ৷ বিভিন্ন তান্ত্রিক তন্ত্রসাধনার ভিন্ন ভিন্ন স্তরে থাকলেও এসব স্তরকে তন্ত্র সম্বন্বয় করে ধরে রাখে ৷
তাই শিব -পার্বতীর তন্ত্র প্রবর্তন ৷ তন্ত্রে সাধনার সাথে বস্তু থাকে ৷ যা অসীম জ্ঞানের আধার ৷ আত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে পার্থিব বস্তুর সংযোগ হল তন্ত্র ৷ "তনোতি ত্রায়তি তন্ত্র" ৷"তন" ধাতু থেকে অর্থ বিস্তার ৷ "তন্যতে বিস্তার্যতে জ্ঞানম্ অনেন ইতি তন্ত্রম্ "৷ যা জ্ঞানের বিস্তার ঘটায় আবার রক্ষা করে ৷The word " tantra" is derived from the combination of two words " tattva" and "mantra" . " Tattva " means the science of cosmic principles , while " Mantra" refers to science of mystic sound and vibrations.Tanra also means the scripture by which the light of knowledge is spread. হিন্দু তন্ত্র হলো যোগিনীতন্ত্র ,সারদাতিলক ,রুদ্রযামল , তন্ত্রসার , সরস্বতী তন্ত্র , কামাখ্যাতন্ত্র প্রভৃতি ৷ বৌদ্ধতন্ত্রগুলি বজ্রসত্ব বুদ্ধ দ্বারা বর্ণিত ৷ সেগুলি হলো বারাহীকল্প , মঞ্জুশ্রীতন্ত্র , ক্রিয়াসার , কৌলজ্ঞাননির্ণয় , উড্ডামরতন্ত্র প্রভৃতি ৷আমরা হিন্দুরা মনে করি মহাদেবের সদাশিব রূপের পাঁচটি মুখ ৷ পাঁচ মুখ থেকে পাঁচটি তন্ত্রের উদ্ভব ৷ পূর্ব মুখ সদ্যোজাত থেকে পূর্বাম্নায় ৷ দক্ষিণ মুখ অঘোর থেকে দক্ষিণাম্নায় ৷ পশ্চিম মুখ তৎপুরুষ থেকে পশ্চিমম্নায় ৷ উত্তরমুখ বামদেব থেকে উত্তরাম্নায় আর ঊর্ধমুখ ঈশান থেকে ঊর্ধাম্নায় ৷ঋক্ , সাম , যজুঃ ও অথর্ব এই চার বেদ দেবাদিদেব তাঁর চার মুখে বলেন ৷ আর বেদের ক্রিয়াত্মক বা সাধন অংশ শিব বলেছেন পঞ্চম মুখ থেকে ৷ পঞ্চানন শিবের এই কথাগুলি হলো তন্ত্র বা পঞ্চম বেদ ৷ এই শাস্ত্রে যে অংশে দেবী বক্তা ,শিব শ্রোতা ও নারায়ণ অনুমোদন কর্তা ৷ তা 'নিগম" শাস্ত্র ৷নিগম তাই বেদাশ্রিত ৷ নিগম কল্পতরুর গলিত ফল ভাগবত ৷ আবার দক্ষিণাচারের সাধন শাস্ত্রকে আগম আর বামাচার সাধন শাস্ত্রকে নিগম বলে ৷ আবার সময়াচার , মিশ্রাচার ও কৌলাচার তত্বে প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী মা রূপে দেখা হয়েছে ৷ কলিযুগে তন্ত্রকে একমাত্র সাধনপন্থা বলেও অনেকে বলেছেন ৷স্বল্পায়ু মানবজীবনে দ্রুত সিদ্ধিলাভ হয় তন্ত্রে ৷কৌলমার্গের এই সাধনায় তাড়াতাড়ি মোক্ষ লাভ হতে পারে ৷আবার ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ না করে উন্মুক্ত করে ও গৃহত্যাগ না করেও ব্রহ্মলাভ করা যায় ৷এতে মন্ত্র পুরশ্চরণ করে দশ ভাগ হোমে আহুতি দিতে হয় ৷এতে হয় স্থায়ী সুখ ৷আসে ব্রহ্মোপলব্ধি বা আত্মোপলব্ধি ৷ তন্ত্রে সমগ্র ভারতবর্ষ তিন ভাগে বিভক্ত ৷ বিন্ধ্যপর্বত থেকে চট্টগ্রাম বিষ্ণুক্রান্তা ,বিন্ধ্য থেকে কন্যাকুমারী অশ্ব বা গজক্রান্তা ৷ বিন্ধ্যাচল থেকে নেপাল ও কাশ্মীর রথক্রান্তা ৷ প্রতিটি ক্রান্তার ৬৪ টি করে ১৯২টি তন্ত্র সমগ্র হিন্দু সমাজে প্রচলিত ৷ "অঘোরান্ন পরো মন্ত্রঃ" অঘোর তান্ত্রিকদের সাধনা ৷৫-৬ শতকের প্রথম অঘোরী ভৈরবাচার্য এবং ১৬ শতকের অঘোরেশ্বর কেনারামের নাম উল্লেখযোগ্য ৷ নবদ্বীপগৌরব সপ্তদশ শতকের কালীসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ এসব তন্ত্রের নাম লিখেছেন বৃহৎ তন্ত্রসার গ্রন্থে ৷জন্ম মাত্র দক্ষিণাচারী আর অভিষেক হলে বামাচারী ৷শাক্ত তন্ত্র সাধনায় কোন গ্রন্থে সাতটি আবার কোথাও নটি আচারের কথা বলা আছে ৷ বেদাচার , শৈবাচার ,বৈষ্ণবাচার , শাক্তাচার ও দক্ষিণাচার ৷ অন্যদিকে বামাচার , কৌলাচার , চীনাচার ও সিদ্ধান্তাচার হলো বামাচার ৷ তন্ত্রের অনেক পীঠ আছে ৷ যেমন বাংলার "তারাপীঠ" ৷ কামরূপ কামাখ্যাকে বলা হয়েছে "তীর্থ চূড়ামনি" বা প্রধান
তন্ত্র ক্ষেত্র ৷পশ্চাচারী ও বীরাচারী তান্ত্রিক দেখা যায় ৷ এরমধ্যে বীরাচারীরা পঞ্চ "ম" কারের সাধনা করেন ৷"পঞ্চ -ম কার "সাধনা নিবন্ধে আরো বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছি ৷সাধকরা ইষ্ট দেবীর মন্ত্র জপ করে ৷ কালী - "ক্রীং" , ভুবনেশ্বরী -" হ্রীং" , এভাবে ৷ তন্ত্রের সবচেয়ে বড় পন্ডিত ১৮ শতকের ভাস্কর রায় ৷ বাংলায় মূলতঃ তান্ত্রিকমতে দীক্ষাগ্রহণ হয় ৷ শীলভদ্র , শান্তিদেব , মৎসেন্দ্রনাথ , অভয়াঙ্কর গুপ্ত , , সর্বানন্দ , কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ , ব্রহ্মানন্দ গিরি , পূর্ণানন্দ পরমহংস প্রমুখ তন্ত্রশাস্ত্রের নানা বিষয়ে লিখে গেছেন ও তন্ত্রসাধনা করেছেন ৷ রামকৃষ্ণ পরমহংস থেকে বামাক্ষ্যাপা ছিলেন মূলতঃ তন্ত্র সাধক ৷তাই , তন্ত্রযোগীরা প্রণম্য ৷ তন্ত্রের বিস্তার কাম্য ৷

॰॰॰॰॰ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় ৷

৯৭৩২২১৭৪৮৯

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন