রবিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২২

মেঘনাদ সাহা

 

শেয়ার করেছেন : প্রণব কুমার কুণ্ডু


1 জন এবং যে টেক্সটে 'মেঘনাদ সাহা' লেখা আছে-এর একটি ছবি হতে পারে
ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত....... ‌......

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরের সেই গ্রাম তখন সভ্যতার আলো থেকে বহু দূরে। সেখানেই ১৮৯৩ সালের ৬ই অক্টোবর জন্ম নেন মেঘনাদ সাহা। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে দশ কিলোমিটার দূরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। যাওয়া-আসার দুস্তর সমস্যা। তাই স্কুলের কাছাকাছি থাকা এক ডাক্তারের বাড়িতে আশ্রয় নেয় সেই কিশোর। বাড়ির গোয়ালঘর দেখাশোনা, বাসন মাজার মতো কাজ তাকে করতে হত। তবেই জুটত খাবার, মাথা গোঁজার ঠাঁই। যদিও কাজগুলো মনের আনন্দেই করতো মেঘনাদ, বদলে মিলত পড়াশোনার সুযোগ।
সেই ডাক্তারবাবুর বাড়িতে ছিল জাতপাত নিয়ে বেজায় বাড়াবাড়ি। ‘নিচু জাত’-এর ছেলে এই কিশোর তাই বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ নিষেধ। তার ওপরে হুকুম ছিল, নিজের বাসনপত্র গ্রামের পুকুর থেকে নিজেকেই ধুয়ে মেজে আনতে হবে। বাড়ির বাসনের সঙ্গে মিশিয়ে ফেললেই কেলেঙ্কারি। পড়াশোনার জন্য সব মুখ বুজে মেনে নিলেও মেধাবী ছেলেটির মনে গ্রামের দিনগুলি দাগ কেটে গিয়েছিল।
কৈশোরের অভিজ্ঞতা দিয়েই তিনি বুঝেছিলেন, জাতিভেদ, অসাম্য, আসলে সমাজের এক গভীর অসুখ। জাতিভেদ প্রথার কদর্য দিকটা আরও ভাল ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে এসে। তিনি তখন শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত সাইকেলে চড়ে গৃহশিক্ষকতা করে বেড়ান। বাকি সময়টা ডুবে থাকেন গণিতে। মেধা বৃত্তি পাওয়ায় তখন কলেজ হোস্টেলে সহপাঠীদের সম্ভ্রমের পাত্র সেদিনের কিশোর।
কিন্তু এক বার সরস্বতী পুজোর দিন বদলে গেলো সব কিছু। পুজোমণ্ডপে অঞ্জলি দিতে আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল ব্রাহ্মণ ছাত্ররা। মুখের ওপর বলেছিল, "তুমি যতই মেধাবৃত্তি পাও, আসলে তো ছোট জাত। তাই আমাদের সাথে এক আসনে বসার যোগ্যতা তোমার নেই।" এই ঘটনাই জাতিভেদের বিরূদ্ধে আজীবন লড়াই করার বারুদ ভরে দিয়েছিল সেদিনের কিশোরের বুকে, যার ছাপ পড়েছিল তাঁর বিজ্ঞান গবেষণা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মতাদর্শে।
যে দিন তাঁর জন্ম হয়েছিল, সে দিন ছিল প্রচণ্ড ঝড়-জলের তাণ্ডব। আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। পুরাণ অনুযায়ী ঝড়-জলের দেবতা হলো মেঘরাজ ইন্দ্র। তাই বাবা মা নবাগত শিশুর নাম রেখেছিলেন মেঘনাথ। কিন্তু হোস্টেলের ঐ ঘটনার পর উচ্চ বর্ণের মানুষদের গোঁড়ামি মেঘনাথকে এতটাই বিরক্ত করে তুলেছিল যে, তিনি নিজের নাম পাল্টে রেখেছিলেন মেঘনাদ অর্থাৎ ইন্দ্রজিৎ। দেবতা নন, রাক্ষসদের প্রতিনিধি। সেদিন থেকে গোটা বিশ্বের কাছে তিনি মেঘনাথ নন, মেঘনাদ সাহা নামে পরিচিত হন। তাঁর চোখে মেঘনাদ ইন্দ্রজিৎ সমাজের অপমানিত অংশের প্রতিনিধি, যাঁকে অন্যায় ভাবে বধ করেছিল ব্রাহ্মণ সমর্থিত এক ক্ষত্রিয় রাজপুত্র। নিজের নাম বদলে মেঘনাদ প্রমাণ করেছিলেন তিনি আসলে ডেমোক্র্যাটিক ক্লাসের প্রতিনিধি, যাদের পিছিয়ে পড়া বলা হয়, জোর করে পিছিয়ে রাখা হয়।
এতোকিছুর পরেও কি প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হওয়াটা আটকাতে পেরেছিলেন ?
পদার্থ বিদ্যায় ১৯২৫ সালে নোবেল পুরস্কারের জন্য প্রথম তাঁর নাম সুপারিশ করেছিলেন নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী আর্থার কম্পটন। তাঁর আবিষ্কারের বিষয় ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের তাপীয় আয়নীকরণ তত্ব। যা এককথায় আকাশের নক্ষত্রদের বর্ণালীর তাপীয় আয়নতত্বের মাধ্যমে গবেষণা। এককথায়, এর ফলে আকাশের নক্ষত্রদের অনেক অজানা খবর আবিষ্কৃত হয়েছিল। কিন্তু কয়েকজন দেশীয় ও বিদেশী বিজ্ঞানীদের বিরোধিতায় তাঁকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়নি। এরপরেও তাঁর নাম আরো চারবার প্রস্তাব হয়েছিল, যা নোবেল পদকের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। প্রতিবারই তাঁর নাম নানা অজুহাতে বাতিল করে দেওয়া হয়।দেশের লোক বলল নীচু জাত আর বিদেশিরা বলল কালা আদমী। জাতপাত আর বর্ণবিদ্বেষের শিকার হলেন পরাধীন দেশের এক কৃতি বিজ্ঞানী।
আর শুধু বিজ্ঞানীই বা বলছি কেন, মেঘনাদ সাহার আরও একটি পরিচয় ছিল। সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনে ছিল তাঁর গোপন ভূমিকা। ছিলেন নেতাজি অনুরাগী আর বাঘা যতীনের সহযোগী । যোগাযোগ রেখে চলতেন অনুশীলন সমিতির সাথেও। জন্মের একশো পঁচিশ বছর পরেও ব্রাত্য রয়ে গেলেন এই ক্ষণজন্মা পুরুষ! ‌আজ মেঘনাদ সাহার জন্মদিবসে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি৷

সংকলনে ✍🏻 স্বপন সেন
©ভালবাসি বাংলা

মেঘনাদ সাহা

Pranab Kumar Kundu
লাইক করুন
কমেন্ট করুন
শেয়ার করুন
0টি কমেন্ট


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন