কিছুদিন আগে অতি দক্ষিণপন্থী সংগঠন হিন্দু সংহতির সভাপতি দেবতনু ভট্টাচার্য তার সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি পোস্ট করেন। তিনি লেখেন আগামী দীপাবলি রমনা কালীবাড়ি তে। অর্থাৎ হিন্দু সংহতি আগামী ২০২১ এর দীপাবলি বাংলাদেশের ঢাকার ধ্বংস হয়ে যাওয়া রমনা কালী বাড়িতে পালন করতে চায়। হিন্দু সংহতির এই ঘোষণার পরপরই চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পরে দুই বঙ্গ জুড়ে। এক পক্ষ এর সমর্থনে তো অন্য পক্ষ তীব্র বিরোধী। কিন্তু প্রশ্ন একটি পোস্ট নিয়ে এত বিরোধিতা এত চাঞ্চল্য কেনো? রমনা কালীবাড়ির মাহাত্ম কি ? কি তার ইতিহাস? আসুন দেখে নেওয়া যাক।

রমনা কালী মন্দির ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত হিন্দু মন্দিরসমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল। প্রায় এক হাজার বছরেরও পুরাতন বলে বিশ্বাস করা হয় কিন্তু ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি আবার নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল ।বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রমনা পার্কের (যার বর্তমান নাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বহির্ভাগে অবস্থিত।বর্তমানে বাংলার সংস্কৃতিতে এ মন্দিরের উল্লেখ্য ভূমিকা আছে।

জনশ্রুতি, প্রায় ৫০০ বছর আগে বদরীনাথের যোশীমঠ থেকে গোপালগিরি নামে এক উচ্চমার্গের সন্ন্যাসী প্রথমে ঢাকায় এসে সাধন-ভজনের জন্য উপযুক্ত একটি আখড়া গড়ে তোলেন। সেখানেই আরও ২০০ বছর পরে মূল রমনা কালীমন্দিরটি নির্মাণ করেন আর এক বড় সাধু হরিচরণ গিরি। তবে পরবর্তী সময়ে এই মন্দিরের প্রধান সংস্কারকার্য ভাওয়ালের ভক্তিমতী ও দানশীলা রানি বিলাসমণি দেবীর আমলেই হয়। মন্দিরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো কালীমন্দিরের চূড়া ছিল ১২০ ফুট, যা বহুদূর থেকে দেখা যেত।

এই মন্দিরের মূর্তির মাহাত্ম হলো এই যে তন্ত্রশাস্ত্রে মা কালীর নানাপ্রকারের মূর্তিভেদ বর্ণনা করা হয়েছে। তার মধ্যে রমনাকালী অন্যতম।পাথরের বেদির ওপর শ্রীশ্রীভদ্রকালীর সুউচ্চ প্রতিমা। চতুর্ভুজা মাতৃমূর্তি। মহাদেবের শয়ান মূর্তির ওপর দণ্ডায়মান। দু’পাশে ডাকিনী-যোগিনী। ভদ্রকালিকা দেবীর কণ্ঠে মুণ্ডমালা। লালজবার মালা। দেবী মা লাল বস্ত্র পরিহিতা। 

এইবার জানা যাক এই মন্দিরের করুণ ইতিহাস , রমনা কালী মন্দিরের চারপাশের গ্রামটি ছিল ঢাকা রেস কোর্সের কেন্দ্রস্থলে একটি প্রাচীন হিন্দু পল্লী। এই গ্রামে প্রায় ২০০০ হিন্দু পুরুষ, নারী ও শিশু বাস করত। ১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চ। এই দুটো দিন রমনা কালীমন্দিরের পবিত্র ভূমি ঘিরে পাকিস্তানি সেনারা যে বিভীষিকার রাজত্ব তৈরি করেছিল তার করুণ কাহিনি ইতিহাসের পাতায় চিরদিন লেখা থাকবে। এক তীর্থভূমি রাতারাতি পরিণত হয়েছিল বধ্যভূমিতে। রমনা কালীমন্দিরের অধ্যক্ষ স্বামী পরমানন্দ গিরি সহ সেখানে উপস্থিত প্রায় ১০০ জন নারী ও পুরুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাক সেনারা। শিশুরাও রেহাই পায়নি। এই হত্যাকাণ্ডের সময় রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম দাউ দাউ করে জ্বলেছিল। রমনা কালীমন্দিরের চূড়া ছিল ১২০ ফুট, যা বহুদূর থেকে দেখা যেত। সেটিও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় ওই বর্বর সেনারা। 
ইউএসএআইডি-এর ড. জন ই. রোহডি, যিনি ২৯ মার্চ স্থানটি পরিদর্শন করেন, সেখানে পুরুষ, নারী ও শিশুদের মর্মান্তিক মৃতদেহ দেখানো হয়েছে, যারা মেশিনগানের দ্বারা নিহত হয়েছে এবং তারপর আগুন লাগিয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পেট্রোল ও বারুদ গুঁড়ো দিয়ে মন্দিরটিতে ছিটিয়ে দেয় এবং প্রায় ৫০ টি গরুসহ আগুন লাগিয়ে দেয়। রমনা কালী মন্দিরের পুরোহিতসহ ১০১ জন হিন্দু নিহত হন। 

পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমান সেই মন্দিরের জায়গায় সুরবর্দী পার্ক নির্মাণ করেন।।আর এই সুরবর্দী হল ১৯৪৬ এর দ্যা গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং এর মাস্টারমাইন্ড।।

২০০৬ সালে রমনা কালীমন্দির এর নামে একটি সাধারণ মন্দির পুনরায় নির্মাণ করা হয়। পুজোর্চ্চনাও শুরু হয়। রমনা কালী মন্দির এ বর্তমানে কালী মূর্তি ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো, দুর্গা মন্দির, লোকনাথ মন্দির, রাধা গোবিন্দ মন্দির, মা আনন্দময়ীর মন্দির। 
অস্থায়ী মন্দিরের সামনে একটি স্মৃতিস্তম্ভ গণহত্যার ঘটনায় ৬৯ জন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে। ২৭ শে মার্চ, ২০১১ তারিখে, রমনা গণহত্যার শিকারদের সম্মানে রমনা কালী মন্দিরের মিলনায়তনে একটি স্মারক সেবা অনুষ্ঠিত হয়। 
তবে বর্তমানে সে দেশের মৌলবাদী রা সবসময় চেষ্টায় রয়েছে মন্দিরটি পুনরায় ধ্বংস করার। আর হিন্দুত্ববাদীরা মন্দিরের পুরাতন জায়গায় মন্দির পুনঃ প্রতিষ্ঠা করার।