রবিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২০

রোমহর্ষক





বহু পুরাতন ঘটনা, আমার কিশোর মনে দাগ কেটেছিল কি মর্মান্তিক ঘটনা আমি বি বাড়িয়ার পাশে আছি। সময় থাকলে পড়বেন। তথ্যসূত্র নিচে দেওয়া হলো:
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিদারাবাদ গ্রামের শশাঙ্ক দেবনাথের পরিবার ছিল একেবারেই নিরীহ। তিনি মুড়ির মোয়া বিক্রি করতেন। তবে তাঁর ছিল অনেক সম্পত্তি। সেই সম্পত্তির প্রতি পাশের গ্রামের তাজুল ইসলামের দৃষ্টি পড়ে। সে কারণেই প্রথমে অপহরণ করে শশাঙ্ককে হত্যা করে সে। দুই বছর পর তাঁর স্ত্রী-সন্তানসহ ছয়জনকে হত্যা করে ড্রামে চুন মিশিয়ে তাতে লাশ ভরে বিলে ফেলে দেওয়া হয়। খুনিরা সে সময় দুই বছরের শিশুকেও হত্যা করে।
১৯৮৭ সালে শশাঙ্ক দেবনাথ যেদিন অপহৃত হন, সেদিনই তাঁর স্ত্রী বিরজাবালার ঘরে জন্ম নেয় এক পুত্রসন্তান। নাম রাখা হয় সুজন দেবনাথ। দুই বছর পর ১৯৮৯ সালে সেই দুর্বৃত্তরাই শশাঙ্ক দেবনাথের স্ত্রী-সন্তানসহ পুরো পরিবারের ছয়জনকে রাতের অন্ধকারে অপহরণ করে নিয়ে যায়। সেই সদস্যদের মধ্যে ছিল সুজন দেবনাথও। তখন তার বয়স হয়েছিল মাত্র দুই বছর। এই শিশুকে হত্যা করতেও হাত কাঁপেনি ঘাতকদের। বরং হত্যার পর ড্রামে ভরে পরিবারের অন্য সবার সঙ্গে তার লাশও চুন দিয়ে ডুবিয়ে রেখেছিল খুনিরা।
১৯৮৭ সালের ১৬ অক্টোবর। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার (বর্তমান বিজয়নগর উপজেলা) নিদারাবাদ গ্রাম। কুয়াচ্ছন্ন ভোর। শশাঙ্ক দেবনাথকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায় পূর্ব পরিচিত তাজুল ইসলাম। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে গুড় নিয়ে ফিরে আসার কথা বলে বের হন মুড়ির মোয়া বিক্রেতা শশাঙ্ক দেবনাথ।
এরপর কয়েক দিন চলে গেলেও তিনি আর ফিরে আসেননি। তাঁর স্ত্রী বিরজাবালা দেবনাথ তাঁর আত্মীয়স্বজনসহ অনেকের বাড়িতে খোঁজ নিয়েও কোনো সন্ধান পাননি। এরপর তিনি তাজুল ইসলামসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা করেন। এরই মধ্যে শশাঙ্ক দেবনাথকে অপহরণের পর মেরে ফেলার বিষয়টি স্পষ্ট হতে থাকে। মামলায় সাজা হয়ে যেতে পারে_এমন শঙ্কায় ঘৃণ্যতম পরিকল্পনা নেয় তাজুল ইসলামরা। তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি দুই বছরের শিশুও।
১৯৮৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাতে ৩০ থেকে ৪০ দুর্বৃত্ত হামলা চালায় শশাঙ্কের পরিবারের ওপর। তারা অপহরণ করে নিয়ে যায় শশাঙ্কের স্ত্রী বিরজাবালা (৪৫), মেয়ে নিয়তি বালা (১৭), প্রণতি বালা (১০), ছেলে সুভাস দেবনাথ (১৪), সুপ্রসন্ন দেবনাথ সুমন ও সুজন দেবনাথকে (২)।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনামতে, রাতে শশাঙ্কের পরিবারের সদস্যরা ঘুমিয়ে ছিলেন। জানালার লোহার রড ভেঙে ঘর ঢুকে দুর্বৃত্তরা তাঁদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফেলে। বাঁচার জন্য তাঁরা গগনবিদারী চিৎকার শুরু করেন। তাঁদের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলেও সংঘবদ্ধ দলের সামনে দাঁড়াতে সাহস পায়নি। গ্রামবাসীর সামনে দিয়েই অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের।
অপহরণের ঘটনার ১০ দিন পর ১৬ সেপ্টেম্বর অপহৃত ছয়জনের লাশ মেলে তাঁদের বাড়ি থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে ধুপাজুরি বিলে। বিলে ভেসে ওঠা দুটি ড্রাম থেকে তাঁদের লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রতিটি লাশই ছিল কয়েক টুকরো। লাশে দ্রুত পচন ধরায় ঘাতকরা ড্রামের ভেতর চুন দিয়ে রাখে। শ্বশুরবাড়িতে থাকায় বেঁচে যান শশাঙ্কের আরেক মেয়ে সুনীতি।
নৌকায় করে ধুপাজুরি বিল দিয়ে প্রতিদিনই বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা ছিল ওই গ্রামের শিক্ষক আবুল মোবারকের। কিছু উড়ো কথা তাঁর কানে আসছিল। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে তিনি নৌকার গতিপথটা একটু ঘুরিয়ে নেন। হঠাৎ নৌকার তলদেশে কী একটা আটকে যাওয়ার শব্দ হয়। আবারও মাঝির বৈঠায় খটখট শব্দে সবারই একটু সন্দেহ হয়। খোঁচাখুঁচি করতেই ভেসে ওঠে ড্রাম। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের খবর দেওয়া হয়।
ড্রাম খুলতেই স্তব্ধ সবাই। এটিতে তিনজনের লাশ। সাধারণ ধারণা থেকেই আরেক ড্রামের সন্ধান চালানো হয়। মিলেও যায়। আরেকটি ড্রামেও টুকরো টুকরো করে রাখা আরো তিনজনের লাশ! গ্রামবাসী রাতভর পাহারা দিয়ে রাখে ড্রাম। পরদিন পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
আবুল মোবারক বলেন, 'প্রথমে ড্রামের মুখ খুলতেই তৈলাক্ত কিছু বের হতে থাকে। আমরা তখনো ধারণা করতে পারিনি এমন একটি লোমহর্ষক ঘটনার চিত্র দেখতে পাব। লাশ দেখে আমরা নিশ্চিত হই, এটা সম্পত্তিলোভী নরপশুদের কাণ্ড। আজও এসব কথা মনে হলে কূল-কিনারা পাই না। সম্পত্তির জন্য মানুষ এমন পিশাচ হতে পারে, তা ভাবতেও অবাক লাগে।'
১৯৮৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বিল থেকে ছয়জনের লাশ উদ্ধারের পর এই খবর ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গ্রামে। হাজার হাজার মানুষ মর্মান্তিক সে ঘটনা জানতে ও লাশ দেখতে ঘটনাস্থলে ভিড় জমায়। আসে খুনের সঙ্গে জড়িতদের একজনও। সে হত্যাকাণ্ডের হোতা তাজুল ইসলামের বোনজামাই হাবিবুর রহমান। সে একা বড় একটি নৌকা নিয়ে লাশ দেখতে এলে এলাকাবাসী তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কথাবার্তায় সন্দেহ হলে তাকে পুলিশে দেওয়া হয়।
হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী কেউ মামলার সাক্ষী ছিল না। প্রথম গ্রেপ্তার হওয়া হাবিবুর রহমানের দেওয়া স্বীকারোক্তি মতেই পুলিশ একে একে হত্যাকারীদের আটক করে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে আসামি করা হয় তাজুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান, এনু মিয়া, ফিরোজ মিয়া, ফিরোজ মিয়া (২), হাবিব মিয়া, আবুল হোসেন, জজ মিয়া, বাদশা মিয়া, মো. কাজল, ফারুক মিয়া, আবুল কাশেমকে।
এ ঘটনায় ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন সদস্য (মেম্বার) মো. ধন মিয়া চৌধুরী বাদী হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানায় মামলা করেন। পুলিশ এ ঘটনায় ৩৮ জনকে দায়ী করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়।
১৯৯০ সালের জুন মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জজ আদালত এক রায়ে ৯ জনের ফাঁসি, ২৭ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও দুজনকে বেকসুর খালাস দেন। পরে উচ্চ আদালত খুনি তাজুল ইসলাম, বাদশা মিয়ার ফাঁসি ও আটজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ বহাল রাখেন। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে আবুল হোসেন নামে একজন এখনো পলাতক। তাজুল ইসলাম ও বাদশা মিয়ার ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে।
তাজুল ইসলামকে গ্রেপ্তার নিয়ে একটি মজার ঘটনা আছে। তাজুল ইসলাম ভোল পাল্টে তাবলীগ জামাতের সাথে মিশে যায়। একদিন তাবলীগের মিছিল ঢাকার পুলিশ হেড কোয়াটারের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। তাজুল ও ছিল। ঐ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তার সামনে সে পরে যায় এবং গ্রেপ্তার হয়।
সেই খুনিদের মধ্যে তাজুল ইসলাম ও বাদশা মিয়ার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এক আসামি এখনো পলাতক। অন্যরা কেউ খালাস পেয়ে এলাকায় আছে। তাদের ভয়ে আজও ওই ঘটনা নিয়ে অনেকেই কথা বলতে ভয় পান। তাঁদের আশঙ্কা, বাড়াবাড়ি করলে তাঁদের অবস্থাও হতে পারে শশাঙ্কের মতো।
তথ্যসূত্র: দৈনিক কালের কণ্ঠ ও দৈনিক আমারদেশ।

শেয়ার করেছেন : প্রণব কুমার কুণ্ডু।


.


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন