কেরালার ওনাম উৎসব
উৎসবের নাম যখন “ওনাম”
সে অনেক কাল আগের কথা। ভগবান বেশ কিছুদিন হল পৃথিবী সৃষ্টি করে বিশ্রাম নিচ্ছেন। পৃথিবীর তখন প্রায় জলমগ্ন অবস্থা। খুবই সামান্যই ডাঙা। একবার ভয়ঙ্কর বৃষ্টিতে পৃথিবী ডুবে যায় যায়। বিশ্রাম নেওয়া হলনা, তিনি মৎস রূপ ধারন করলেন এবং রক্ষা করলেন পৃথিবীকে। তাতে তার দায়িত্ব বাড়ল বই কমলনা আবার অবর্তীন হতে হল। তিনি যুগে যুগে রূপ নিলেন কূর্ম, বরাহ (Is this the evolution of life?) রক্ষা করলেন এই সসাগরা পৃথিবী। আবারও রূপ নিতে হল এবার নৃসিংহের, অত্যাচারী হিরণ্যকশিপুর হাত থেকে পরম ভক্ত প্রহ্লাদকে রক্ষা করতে। নিহত হল হিরণ্যকশিপু। দৈত্যকুলের রাজা হলেন প্রহ্লাদ। ভগবানের পরম ভক্ত তিনি। তার আমলে সুশাসন প্রতিষ্টিত হল পৃথিবীতে। তার মৃত্যুর পর রাজা হলেন তার নাতি মহারাজ বলী (কোথাও কোথাও মহাবলীও বলা হয়েছে)।
মহবলী ছিলেন প্রচন্ড তেজস্বী। সর্বত্র তার শাসনের সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। সকলে বলেলেন তার মতো দানবীর পৃথিবীতে আসেনি। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল তার নাম। সর্বত্র তার জয়গান। প্রমাদ গুনলেন ভগবান নিজে। এভাবে মানুষ এক দৈত্যের জয়গান করলে। সকলে ঈশ্বরকেই ভুলে যাবে। এর মাঝে ব্রহ্মা আবার মহাবলীকে বর দিয়ে ফেলেছেন। মহাবলী অধিশ্বর হবেন স্বর্গ মর্ত্য এবং পাতালেন। সমকক্ষ হবেন ইন্দ্রের। তখন ইন্দ্রের আসন যায় যায় অবস্থা। দেবতারা আবার শরণাপন্ন হলেন ভগবানের। এবার বিষ্ণু রূপ নিলেন বামন দেবের (বামন অবতার) তিনি পরীক্ষা করতে চান তার শিষ্য ঠিক কত বড় দানবীর। উপস্থিত হলেন মহাবলীর রাজ সভায়।
দৈত্যরাজ বলী তখন তার ১০০ তম অশ্বমেধ যজ্ঞ করছেন। যজ্ঞ সম্পন্ন হলেই ইন্দ্রের থেকে বেশী হবে তার ক্ষমতা। এই সময় সেখানে প্রবেশ করলেন বামন দেব। ছোটখাটো মানুষ কিন্তু তাঁর জ্যোতিতে ম্লান হয়ে গেল চারদিক | মুগ্ধ বলীরাজ জানতে চাইলেন কী তাঁর প্রার্থনা? বললেন পূরণ করবেন সব।
বামন দেব প্রার্থনা করলে “তিন পাদ” জমি। এই সামান্য চাহিদায় বলী রাজ অবাক হলেও সন্মত হলেন।
এবার বামন দেব রূপ পরিবর্তন করে বড় হতে লাগলেন। প্রথম তিনি পা রাখলেন পৃথিবীতে ঢেকে গেল পুরো বিশ্ব। দ্বিতীয় পা দিয়ে ছেয়ে ফেলেলেন স্বর্গলোক। এবার হেসে জিজ্ঞাসা করলেন মহারাজ‚ কোথায় আমার তৃতীয় পা রাখব?
মহাবলীর আর বুঝতে বাকি রইল না কে এই মহামানব। পেতে দিলেন নিজের মাথা বললেন পা রাখুন এখানে। পায়ের চাপে সিংহাসন চ্যুত হয়ে মহাবলী প্রবেশ করলেন পাতালে। সুশাসন প্রতিষ্টিত হলেন সেখানে।
কিন্তু তিনি কি আরে পৃথিবীতে আসতে পারবেন না? যেখানে তার সাধের রাজত্ব। এবার মহবলী অনুরোধ করলেন ভগবানকে বছরে অন্তত একবার পৃথিবীতে আসার অনুমতি দেওয়া হোক। সন্মত হলেন ভগবান। অনুমতি মিলল। সেই থেকে মহারাজ মহাবলী প্রতি বছর “আত্তম” নক্ষত্র (আগষ্টের শেষ থেকে সেপ্টেমবরের মাঝামাঝি হয়, এবছর শুরু হয়েছে আজ থেকে ০২-০৯-২০১৯) অনুসারে দশদিনের জন্য তার প্রজাদের সাথে দেখা করে আর্শীবাদ করতে পৃথিবীতে আসেন। আর সেইথেকে প্রতি বছর এই সময় এই দশদিন ধরে পালিত হয় ওনাম উৎসবের।
ওনাম আমাদের দেশের সর্ব দক্ষিনে অবস্থিত রাজ্য কেরালার প্রধান উৎসব। এটা কেরালার কৃষি উৎসবও বটে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এক হয়ে যাওয়ার এক বিশেষ নির্দশন। গণেশ চতুর্থীর মতোই এই উৎসবও দশদিনের হয়। তবে এর প্রথম ও শেষ দিনটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
আত্তম (১ম দিন) :
ওনাম শুরু হয় “আত্তম” নক্ষত্র দেখে। স্থানীয়রা মন্দিরে পুজা দিয়ে এই উৎসবের সুচনা করেন। সরকারী মতে এবার কোচিনে কোচিনের রাজা আনুজান তাম্বুরান আজ সকালে উৎসবের শুরু করেছেন। এদিন সকালে প্রত্যেকে বাড়ির উঠোনে হলুদ ফুলের বৃত্তাকারের আপ্পনা এঁকে (স্থানীয় নাম পোক্কালম) এই উৎসবের শুভ সূচনা হয়। দিন যায় পোক্কালম একটি করে বৃত্তের সংখ্যা বাড়ে। অর্থাৎ শেষ ওনামের সকালে বৃত্তের সংখ্যা দাঁড়ায় দশটি।
মজার ব্যাপার এই উৎসব কেরলের প্রধান উৎসব হলেও ১৯৬০ সাল পর্যন্ত বর্তমান কেরলের রাজধানী তিরিঅনন্তপুরম বা ত্রিবান্দ্রাম হত না। কারন ত্রিবান্দ্রম ভগবান বিষ্ণুর বাসস্থান (সেই প্রসঙ্গে অন্যদিন বলব)। কেরল স্বাধীন ভারতের অংশ হওয়ার পর থেকে ত্রিবান্দ্রমে ওনাম হচ্ছে।
চিথিরা (২য় দিন) :
উৎসবের দ্বিতীয় দিন সকলে তাদের বড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নতুন আলো আল্পনা লাগানো হয়। রাস্তাতেও ঝোলানো হয় আলোর মালা।
চোধি (৩য় দিন) :
এই এইন দেওয়ালীর আগে ধনতেরাসের মত কেনা কাটার দিন। এই দিন সকলে কেনাকাঁটা করে তাদের নিজেদের সাধ্যমত। একে অপরকে উপহারও দেন।
ভিসাকাম (৪র্থ দিন):
এদিন ভুরিভোজের। পাত পেড়ে বসে কলাপাতার আগাতে নিরামিষ খাওয়া। ২৬ রকমের পদ থাকে তাতে। স্থানীয় মালয়ালম ভাষায় এই ভোজকে বলা হয় “সাদ্য (Sadhya)”। সেই খাবারের কি সব নাম থোরান, মেজহুক্কুপুরাত্তি, কালান, ওলান, আভিয়াল, সাম্বার, ভাত, ডাল, চার রকমের আচার, তিন রকমের কলা ভাজা, পাঁপড় দুই-তিন পদের পায়েস শেষ পাতে পাকা কলা - সে এক এলাহি ব্যাপার। স্থানীয়দের মুখে শুনেছি আগে এই সব খাবার সবাই বাড়িতেই বানাতেন। এখন ২৬ পদের ঝামেলায় কে যাবে হোটেলে “সাদ্য” হয়ে যায়। এবার দেখছি অনলাইনে অর্ডারের ব্যবস্থাও থাকছে। এই প্রসঙ্গে না বলে পারছি। এখান কার অধিক অংশ হোটেলে দুপুরে খেতে ঢুকে ঐতিহ্যবাহী কেরালিয়ান থালি চাইলে (বছরের বাকী সময়েও) কলাপাতার আগাতে খাবার বেড়ে খেতে দেয়। এমনকি Five Star Hotel ও এর ব্যতিক্রম নয়।
আনিঝাম (৫ম দিন):
এদিন নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার দিন। গত সপ্তাহে শচীন তেনন্ডুলকরের উপস্থিতিতে যে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা হয়ে গেল তার সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না (ওটা Nehru Trophy Boat Race ছিল)। এই নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার ওনামের নিজস্ব। হ্রদ, নদী, নালার দেশ কেরালায় এই দিন দিকে দিকে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা হয়। থাকে পুরস্কারের ব্যবস্থা। হ্রদ বা নদীর ধারে লোকেরা ভিড় করে নিজ নিজ গ্রামের দলকে উৎসাহ দেন।
থিরিকেটা (৬ষ্ঠ দিন):
থিরিকেটা ওনাম উৎসবের ষষ্ঠ দিন। এই দিন সকলে স্থানীয় আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যান। অনেকে আবার তাদের আদিবাড়িতে গিয়ে পূর্ব পুরুষদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আসেন।
মুলাম (৭ম দিন):
পুরান অনুসারে দৈত্যরাজ বলী এইদিন থেকে তার প্রজাদের বাড়িতে ঘুরতে বের হন। ঘোরেন দশম দিন পর্যন্ত। উৎসব আরও জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে ওঠে। মন্দিরগুলোতে বিশেষ প্রসাদ “সাদ্যর” আয়োজন করা হয়। অনেকটা পাঞ্জাবীদের “ভান্ডারার” মতো। বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান হয় সেই সব অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয় কায়কোট্টিকলির থিরুভাতিরাকলি, পুলিকলি, থুম্বি, থুল্লাল ও কথাকলির (প্রতিটি নৃত্যই একে অপরের চেয়ে আলাদা) সব কেরালার বিখ্যাত সব নৃত্যকলা। এতে নারী, পুরুষ, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলে অংশ গ্রহন করে।
পুরাদম (৮ম দিন):
এদিন সমস্ত রাজ্যবাসী মহাবলী ও বামন দেবতার মুর্তির পুজার মাধ্যমে তাদেরকে বাড়িতে আমন্ত্রন জানান। আরও সুন্দর করে সেজে ওঠে পোক্কালম।
উথরাদম (৯ম দিন):
ওনাম সন্ধ্যা হিসেবে পালিত হয় দিনটি। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, উৎসবের শেষ চারদিন রাজা মহাবলী রাজ্য ভ্রমণে বের হয়ে প্রজাদের আশীর্বাদ করেন। তাই উৎসবের শেষ দিনগুলো শুভদিন হিসেবে মানা হয়।
থিরুভুনাম (১০ম দিন):
“থিরুভুনাম” ওনাম উৎসবের শেষ দিন। এদিন স্নান সেরে সকলে নতুন কাপড় পরে। মহিলারা ঘরবাড়ি ভরিয়ে ফেলেন নতুন আল্পনায়। সরকারিভাবে সারা রাজ্যে আলোকসজ্জা ও আতশবাজির ব্যবস্থা করা হয়। শহরজুড়ে কেরালার ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত, নৃত্যকলা ও খেলাধুলা নিয়ে বের হয় নানা শোভাযাত্রা।
এদিন মহাবলী বিদায় নেন পৃথিবী থেকে। এক বছরের মতো। জাঁকজমকের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ওনামের। আবার এক বছরের প্রতিক্ষা, আবার অপেক্ষা কবে তিনি আসবেন।আসছে বছর আবার হবে।
প্রসঙ্গতঃ এই সময়ে কায়ানকলি, আত্তাকালাম, কুটুকুটু, আম্বেয়াল ও তালাপ্পনথুকলি নামের খেলাধুলারও আয়োজন করা হয়। কিন্তু সবকটিই খুব শারীরিক কসরতের। এসব খেলা এখন গ্রামঞ্চলে টিকে আছে। শহর এদিকে খুব একটা পা বাড়ায় না।
সাদা রঙের পোষাক কেরালার ঐতিহ্য। নারী পুরুষ নির্বিশেষে উৎসবের দিন গুলোতে সাদা রঙের ঐতিহ্যবাহী পোষাক পড়েন। মেয়েরা সাদা খোলের চওড়া পাড়ের শাড়ী পুরুষেরা পরেন সাদা খোলের ধুতি লুঙ্গির মতো করে। পোষাক আশাকের এমন সনাতনী ঐতিহ্য দেশের আর কোথাও দেখা যায় কিনা সন্দেহ আছে। এমন কি এই পোষাক যে কোন অনুষ্টানে অফিসে সাদর আমন্ত্রিত।
তথ্যসমর্থনঃ
১ কেরালা সৌন্দর্যের দেবী – ডঃ প্রভাস চন্দ্র রায়।
২ ভ্রমন পুজাবার্ষিকী ১৪২৬
৩ Times of India (Kochi Times, 02-Sep-2019)
৪ ইন্টারনেট
৫ ছবি ইন্টারনেট।
14আপনি এবং আরও 13 জন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন