কেরলের মোপলা
শেয়ার করেছেন : প্রণব কুমার কুণ্ডু
একটা ফিল্মের (Vaariyamkunnan) বিরুদ্ধে চলছে সারা কেরল জুড়ে প্রতিবাদ ।
একটি নতুন মালয়ালম ফিল্ম তৈরি হতে চলেছে। নাম Vaariyamkunnan, কেন্দ্রীয় চরিত্রে বিখ্যাত মালয়ালি অভিনেতা পৃথ্বীরাজ যিনি নায়ার সম্প্রদায়ের। একটি ঐতিহাসিক চরিত্র Variyam Kunnathu Kunjahammed Haji , তাঁর জীবন অবলম্বনে এই ফিল্মটি তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কে এই মহাপুরুষ যাঁকে নিয়ে নির্মিত হতে চলেছে এই ফিল্ম?
ইতিহাস বইতে লেখা আছে উনি একজন মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন যিনি 1921 সালের মোপলা বা মাপিলা বিদ্রোহের নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। খিলাফত আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে শুরু হয় এই বিদ্রোহ। কিন্তু এত প্রতিবাদ শুরু হল কেন এই মহান উদ্যোগকে কেন্দ্র করে?
একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী যিনি ব্রিটিশের হাতে প্রাণ দিলেন তাঁকে নিয়ে ফিল্ম তৈরি করা তো এক গৌরবোজ্বল কীর্তি !
কিন্তু এই উচ্চতর স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে অ্যানি বেসান্ত এর মতো একজন কংগ্রেসের নেত্রী এসব কি বললেন , তাঁর 1921 সালের 6th December এ New India তে প্রকাশিত একটি লেখায় !
তিনি মালাবার অঞ্চলে বা বর্তমান মামাল্লাপুরমের 'স্বাধীনতা সংগ্রামের পবিত্র স্থানগুলি' পরিদর্শনে যান। উল্লেখ্য যে সেই সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল 1921 সালের আগষ্ট। স্থানগুলি পরিদর্শন করে শ্রীমতি বেসান্ত 'অভিভূত' হয়ে পড়েন। তিনি বর্ণনা করেন, কিভাবে এক সম্ভ্রান্ত 'নায়ার 'পরিবারের গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে তাঁর স্বামী আর ভাইদের সামনে গণধর্ষণ করা হয়। স্বামী এবং ভাইদের বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে বাধ্য করা হয় সেই নির্মম দৃশ্য দেখতে। তিনি লেখেন, এক সাতমাসের গর্ভবতী নারীকে এমনভাবে হত্যা করা হয় যে তার মৃত ভ্রূণ দৃশ্যমান হয়। সর্বত্র যেন ধ্বংসলীলা। এক লক্ষ হিন্দু সর্বস্ব হারিয়ে রিলিফ ক্যাম্পের আশ্রয়ে জীবন্মৃত অবস্থায় দিন যাপন করছে। এ তাহলে কিরকম স্বাধীনতা সংগ্রাম? 'শোষক নাম্বুদ্রি, নায়ার', আর 'শোষিত অন্ত্যজ' - 'স্বাধীনতা সংগ্রামে'র আগুন সবাইকেই পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। উঁচু, নীচু, কোন হিন্দু বাঁচেনি।
অ্যানি বেসান্ত এর লেখায় আরো দুটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার কথা বর্ণিত আছে। এক মোপলা বিদ্রোহী পুলিশের হাতে গ্রেফতার হবার পরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়। সেখানে উপস্থিত চিকিৎসককে সে জিজ্ঞাসা করে যে তার বাঁচার সম্ভাবনা আছে কিনা। চিকিৎসক সন্দেহ প্রকাশ করলে মোপলাটি তাকে বলে যে সে চোদ্দ জন বিধর্মীকে হত্যা করেছে, এখন তার আর মৃত্যুভয় নেই। আর একটি ঘটনা ঘটে যেখানে মোপলারা দুজন অন্ত্যজ পুলাহাকে ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্মান্তরিত হতে বলে। কিন্তু দুই তথাকথিত অচ্ছুত হিন্দু প্রাণের বিনিময়েও স্বধর্ম ত্যাগে রাজী হয় নি।
আম্বেদকর তাঁর Pakistan or The Partition of India গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন ওই পেট চিরে ভ্রূণ দৃশ্যমান হওয়ার ঘটনা। এছাড়া ব্যাপক নারী নির্যাতন, হত্যা আর জবরদস্তি ধর্মান্তরিত করবার অসংখ্য ঘটনা যে ঘটেছিল, আম্বেদকরের বইতে তার সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে। আম্বেদকর প্রশ্ন তুলেছেন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সরকারী অফিস, সরকারী প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করবার পেছনে যুক্তি যদি মেনে নেওয়াও যায়, কিভাবে প্রতিবেশী হিন্দুদের উপর ওই পৈশাচিক অত্যাচার যুক্তিসঙ্গত হতে পারে?
নায়ার সম্প্রদায়ের নারীদের পক্ষে নীলাম্বুরের রাণী তখন ভাইসরয়ের স্ত্রী, অর্থাৎ লেডি রিডিংকে পিটিশন করেন তাঁদের তাদের উপর ঘটে যাওয়া বর্বরতম অত্যাচারের কথা জানিয়ে।
ইতিহাসের কি পরিহাস! আজ সেই নায়ার সম্প্রদায়ের একজন প্রতিনিধি অভিনয় করছেন এমন একজনের চরিত্রে যে সেই মোপলা বিদ্রোহের পুরোভাগে অবস্থান করা একজন মানুষ।
মালয়ালম ভাষায় মাপিলা মানে জামাই। মোপলা শব্দ এসেছে মাপিলা থেকে। আরব বণিক যারা বাণিজ্যের কাজে মালাবার অঞ্চলে আসা যাওয়া করত, তারাই একসময় স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে করে স্থায়ী বাসিন্দা হতে শুরু করে। তাদের মাপিলা বা জামাই বলা হত। সত্যিই তো, জামাই আদর না পেলে এরকম প্রতিদান কি দেওয়া যায় !
বাংলার মানুষেরা কি অবাক হচ্ছেন?
অবাক হবার কিচ্ছুটি নেই। বাংলার মাটিতেও কিন্তু এরকম স্বাধীনতা সংগ্রামী আবির্ভূত হয়েছেন। তিতুমীরের কথা মনে নেই ?
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখলে সুনির্দিষ্ট ছক সব ঘটনার পেছনে পাওয়া যায়, সে মালাবার হোক আর নারকেলবেড়িয়া। যেমন ধরুন Variyam Kunnathu Kunjahammed এর নামে মিউনিসিপ্যালিটি আছে, 'শহীদ' তিতুমীরের নামে বাসস্ট্যান্ড আছে। দুজনেই ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, কিন্তু সাথে সাথে হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণের কাজও করেছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে কথা।
কলমে -- সুমন দেবরায় Suman Debray
25th June 2020
লাইক করুন
কমেন্ট করুন
শেয়ার করুন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন