বুধবার, ১ নভেম্বর, ২০২৩

বিবাহে এবং নিয়োগ পদ্ধতিতে সন্তান উৎপাদনের শাস্ত্রীয় বিচার

 বিবাহে এবং নিয়োগ পদ্ধতিতে সন্তান উৎপাদনের শাস্ত্রীয় বিচার

[ বহু বিবাহ সম্বন্ধে বিচার ]

প্রশ্ন—স্ত্রী এবং পুরুষের বহু বিবাহ হওয়া উচিত কিনা ?
উত্তর—যুগপৎ নহে অর্থাৎ এক সময় নহে ৷
প্রশ্ন—তবে কি সময়ান্তরে বহুবিবাহ হওয়া উচিত ?
উত্তর—হাঁ, যেমন—
সা চেদক্ষতযোনিঃ স্যাদ্‌গতপ্রত্যাগতাপি বা।
পৌনর্ভবেন ভর্ত্র। সা পুনঃ সংস্কারমহতি ৷।
মনু•৯/১৭৬ ॥
[ অর্থ—] যে স্ত্রী বা পুরুষের পাণিগ্রহণ মাত্র সংস্কার
হইয়াছে, কিন্তু সংযোগ হয় নাই, অর্থাৎ স্ত্রী অক্ষতযোনি এবং পুরুষ অক্ষতবীর্য থাকিলে তাহাদের অন্য পুরুষ এবং স্ত্রীর সহিত পুনর্বিবাহ হওয়া উচিত। কিন্তু ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য বর্ণের মধ্যে ক্ষতযোনি স্ত্রী এবং ক্ষতবীর্য পুরুষের পুনর্বিবাহ হওয়া উচিত নহে ।
তবে কি কেবল শূদ্রবর্ণদের মধ্যে, ক্ষতযোনি স্ত্রী এবং ক্ষতবীর্য পুরুষের পুনর্বিবাহ হওয়া উচিত ?


[ পুনর্বিবাহে দোষ এবং উহা হইতে রক্ষার উপায় ]
প্রশ্ন—পুনর্বিবাহে দোষ কি?
উত্তর—প্রথমতঃ—স্ত্রী পুরুষের মধ্যে প্রেমের ন্যূনতা
ঘটে। কারণ যখন ইচ্ছা তখনই স্ত্রী পতিকে এবং পতি
স্ত্রীকে পরিত্যাগ করিয়া অন্যের সহিত সম্বন্ধ করিবে।
দ্বিতীয়তঃ—স্ত্রী বা পুরুষ পতি বা স্ত্রীর মৃত্যুর পর
দ্বিতীয়বার বিবাহ করিতে চাহিলে পূর্ব স্ত্রীর অথবা পূর্ব
পতির সম্পত্তি লইয়া যাইবে এবং তাহাদের কুটুম্বদিগের মধ্যে বিবাদ হইবে ।
তৃতীয়তঃ—বহু ভদ্র পরিবারের নাম চিহ্নও থাকিবে না
এবং তাহাদের সম্পত্তি ছিন্নভিন্ন হইয়া যাইবে।
চতুর্থতঃ—পতিব্রত এবং স্ত্রীব্রত ধর্ম নষ্ট হইয়া যাইবে।
এই সকল দোষের জন্য দ্বিজদিগের মধ্যে পূনর্বিবাহ বা বহু-বিবাহ কখনও হওয়া উচিত নহে।


প্রশ্ন—সন্তানোৎপত্তি না হইলে বংশনাশ ঘটিবে এবং
স্ত্রীপুরুষ ব্যভিচারাদি কর্ম করিয়া গর্ভপাতাদি বহু কুচেষ্টা
করিবে। এই কারণে পুনর্বিবাহ হাওয়া সঙ্গত ৷
উত্তর— না, না। যদি স্ত্রীপুরুষ ব্রহ্মচর্যে স্থির থাকিতে ইচ্ছা করে, তবে কোন উপদ্রব হইবে না। আর যদি বংশ-
পরম্পরা রক্ষার জন্য স্বজাতির কোন বালককে পোষ্যগ্রহণ করা হয়, তবে তাহাতে বংশরক্ষা হইবে এবং ব্যাভিচারও হইবে না। ব্রহ্মচর্য রক্ষা করিতে না পারিলে নিয়োগ দ্বারা সন্তানোৎপত্তি করিয়া লইবে।

[ পুনর্বিবাহ ও নিয়োগে পার্থক্য ]
প্রশ্ন—পুনর্বিবাহ এবং নিয়োগের মধ্যে প্রভেদ কি ?
উত্তর—প্রথমতঃ—বিবাহ হইলে যেমন কন্যা পিতৃগৃহ
ছাড়িয়া পতিগৃহে গমন করে, পিতার সহিত তাহার বিশেষ
সম্বন্ধ থাকে না । সেইরূপ বিধবা স্ত্রী বিবাহিত পতির গৃহেই
অবস্থান করে ।
দ্বিতীয়তঃ—সেই বিবাহিতা স্ত্রীর পুত্র সেই বিবাহিত
পতির উত্তরাধিকারী হইয়া থাকে কিন্তু বিধবা স্ত্রীর পুত্র
বীর্যদাতার পুত্র হয় না, তাহার গোত্রীয়ও হয়না, পুত্রের
উপর তাহার কোন স্বত্ব থাকে না। কিন্তু সে বিধবার মৃত পতিরই পুত্ররূপে পরিগণিত হয় এবং তাহারই গোত্রীয়
ও তাহারই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হইয়া তাহারই গৃহে
বাস করে।
তৃতীয়তঃ—বিবাহিত স্ত্রীপুরুষের পক্ষে পরস্পরের সেবা
এবং পালন করা অবশ্য কর্ত্তব্য। কিন্তু নিযুক্ত স্ত্রীপুরুষের
কোন সম্বন্ধই থাকেনা ।
চতুর্থতঃ—বিবাহিত স্ত্রীপুরুষের আমরণ সম্বন্ধ থাকে,
কিন্তু নিযুক্ত স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধ কার্যান্তে ছিন্ন হইয়া যায় ।
পঞ্চমতঃ—বিবাহিত স্ত্রীপুরুষ পরস্পর মিলিত হইয়া
গৃহকর্ম সম্পাদনে পরস্পর যত্নবান্ হইয়া থাকে কিন্তু নিযুক্ত স্ত্রী-পুরুষ নিজ নিজ গৃহকর্ম করিতে থাকে ।

[ বিবাহ ও নিয়োগের নিয়মে পার্থক্য ]
প্রশ্ন—বিবাহ এবং নিয়োগের নিয়ম কি একই প্রকার,
না, — পৃথক পৃথক্ ?
উত্তর—কিঞ্চিৎ প্রভেদ আছে, তাহা পূর্বে বলা হইয়াছে।
তদ্ব্যতীত বিবাহিত স্ত্রীপুরুষ একপতি এবং এক স্ত্রী মিলিত
হইয়া দশটি সন্তান উৎপন্ন করিতে পারে। কিন্তু নিযুক্ত
স্ত্রীপুরুষ দুই বা চারিটির অধিক সন্তান উৎপন্ন করিতে পারে না। অর্থাৎ যেরূপ কুমার ও কুমারীর বিবাহ হইয়া থাকে,তদ্রূপ যাহার স্ত্রী অথবা পতির বিয়োগ হইয়াছে তাহাদেরই নিয়োগ হইয়া থাকে, কুমার বা কুমারীর নহে।
যেরূপ বিবাহিত স্ত্রীপুরুষ সর্বদা সঙ্গে থাকে কিন্তু নিযুক্ত
স্ত্রীপুরুষের ব্যবহার সেইরূপ নহে। কিন্তু ঋতুদানের সময়
ব্যতীত (অন্য সময়ে ) তাহারা একত্র হইবে না। যদি স্ত্রী নিজ প্রয়োজনে নিয়োগ করে, তবে দ্বিতীয় গর্ভস্থিতির দিন হইতে তাহার সহিত নিযুক্ত পুরুষের সম্বন্ধ ছিন্ন হইয়া যায়। পুরুষ নিজের জন্য নিয়োগ করিলেও দ্বিতীয় গর্ভস্থিতির পর হইতে সম্বন্ধ থাকেনা। কিন্তু সেই নিযুক্ত স্ত্রী দুই তিন
বৎসর পর্যন্ত সন্তানগুলিকে পালন করিয়া নিযুক্ত পুরুষকে
দিবে। এইরূপে এককালে বিধবা স্ত্রী নিজের জন্য দুইটি এবং অন্য চারিজন নিযুক্ত পুরুষের প্রত্যেকের জন্য দুইটি দুইটি করিয়া সন্তান উৎপন্ন করিতে পারে। একজন বিপত্নীক পুরুষও নিজের জন্য দুইটি এবং অন্য চারি বিধবার জন্য দুইটি করিয়া পুত্র উৎপন্ন করিতে পারে। এইরূপে মোট দশটি সন্তান উৎপত্তির আজ্ঞা বেদে আছে, যথা—
[ দশটি সন্তান—বেদ আজ্ঞা ]
ইমাং তুমিন্দ্ৰ মীঢ়ঃ সুপুত্ৰাং সুভগাং ক্লণু
দশা্যাং পুত্রানা ধেহি পতিমেকাদশং রুধি ॥
।ঋঃ। মং ১০। সূঃ ৮৫। মং ৪৫ ॥
[ অর্থ :– ] হে ‘মীঢ়, ইন্দ্ৰ' =বীর্যসিঞ্চনে সমর্থ ঐশ্বর্য-
শালী পুরুষ! তুমি এই বিবাহিতা স্ত্রী বা বিধবা স্ত্রীকে শ্রেষ্ঠ
পুত্রের মাতা এবং সৌভাগ্যবতী কর। . বিবাহিত স্ত্রীতে দশ পুত্র উৎপন্ন কর এবং স্ত্রীকে একাদশ বলিয়া মনে কর।
স্ত্রী ! তুমিও বিবাহিত বা নিযুক্ত পুরুষ কর্তৃক দশটি সন্তান
উৎপন্ন কর এবং পতিকে একাদশ বলিয়া মনে কর ৷
পুত্ৰ বেদের এই আজ্ঞানুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য বর্ণের স্ত্রীপুরুষ দশ দশটির অধিক সন্তান উৎপন্ন করিবেনা। কারণ অধিক সন্তান হইলে সন্তানগুলি দুর্বল নির্বুদ্ধি অল্পায়ু হয় এবং স্ত্রীপুরুষও অল্পায়ু এবং রুগ্ন হইয়া বৃদ্ধাবস্থায় বহু দুঃখ ভোগ করে ।

[ নিয়োগ ব্যভিচারবৎ নহে ]
প্রশ্ন—এই নিয়োগের কথা ব্যভিচারের ন্যায় দেখাইতেছে।
উত্তর—যেমন অবিবাহিতদিগের (সংসর্গ) ব্যভিচার,
সেইরূপ নিয়োগ ব্যতীতও সংসর্গ করাকে ব্যভিচার বলা যাইতে পারে। ইহাতে সিদ্ধ হইল যে, যেমন বিধিসঙ্গত বিবাহকে ব্যভিচার বলা যায় না, সেইরূপ বিধিসঙ্গত নিয়োগকেও ব্যভিচার বলা যাইবে না । যেমন শাস্ত্রোক্ত বিধি অনুসারে একজনের কন্যার সহিত অপর একজনের পুত্রের বিবাহের পর সমাগমে ব্যভিচার, পাপ এবং লজ্জা হয় না, সেইরূপ বেদশাস্ত্রোক্ত নিয়োগেরও ব্যভিচার, পাপ [ বা ] লজ্জা মনে করা উচিত নহে।
প্রশ্ন—যথার্থই বটে, কিন্তু ইহা বেশ্যাবৃত্তির ন্যায় দেখাইতেছে।
উত্তর—না, কারণ বেশ্যাসমাগমে কোন পুরুষ বা
নিয়মের নিশ্চয়তা নাই। কিন্তু নিয়োগে বিবাহের ন্যায়
নিয়ম আছে ৷ যেমন একজনের কন্য| অপরকে সম্প্রদান
করা হইলে বিবাহের পর সমাগমে লজ্জা হয় না, সেইরূপ
: নিয়োগেও লজ্জা না হওয়া উচিত। ব্যভিচারী পুরুষ বা
ব্যভিচারিণী নারী কি বিবাহের পরেও কুকর্ম হইতে রক্ষা
পায়?
প্রশ্ন—নিয়োগের কথা আমার নিকট পাপ বলিয়াই মনে হইতেছে।
উত্তর—যদি নিয়োগকে পাপ বলিয়া মনে কর, তবে
বিবাহকে পাপ বলিয়া মনে কর না কেন? নিয়োগে বাধাদান
করিলেই ত পাপ হয়। কারণ বৈরাগ্যবান্ পূর্ণ বিদ্বান্
যোগী ব্যতীত ঈশ্বরের সৃষ্টির ক্রম অনুসারে স্ত্রী পুরুষের
স্বাভাবিক ব্যবহার রুদ্ধ করিতে পারে না। গর্ভপাতরূপ
ভ্রূণহত্যা এবং বিধবা স্ত্রী ও বিপত্নীক পুরুষের মহাদুঃখকে কি পাপের মধ্যে গণ্য কর না? যতদিন তাহাদের যৌবন থাকে,ততদিন তাহারা মনে মনে সন্তানকামী এবং বিষয়ভোগ-বিলাসী থাকে। যদি কোন রাজ্য বা সমাজ ব্যবস্থা দ্বারা তাহাদিগকে বাধা দেওয়া হয় তবে গোপনে বহু কুকর্ম হইতে থাকে। এই সকল ব্যভিচার ও কুকর্মকে রোধ করিবার একটিই শ্রেষ্ঠ উপায় আছে, যদি সে জিতেন্দ্রিয় হইতে পারে তাহা হইলে তাহার পক্ষে বিবাহ ও নিয়োগ না করাই ভাল ৷ কিন্তু যে এরূপ করিতে পারিবে না তাহার পক্ষে বিবাহ এবং আপৎকালে নিয়োগ অবশ্য কৰ্ত্তব্য। ইহাতে ব্যভিচার হ্রাস পায় এবং প্রেম বশতঃ উত্তম সন্তান উৎপন্ন হওয়ায় মনুষ্য-জাতির উন্নতি হওয়া সম্ভব হয়। গর্ভপাতও সর্বপ্রকারে নিবারিত হয় । নীচ পুরুষের সহিত উত্তম স্ত্রীর এবং বেশ্যাদি নীচ স্ত্রীর সহিত উত্তম পুরুষের ব্যভিচার রূপ কুকর্ম সৎকুলের কলঙ্ক,বংশোচ্ছেদ, স্ত্রী, পুরুষের সন্তাপ এবং গর্ভ-হত্যাদি কুকর্ম বিবাহ ও নিয়োগ দ্বারা নিবারিত হয়। এইজন্য নিয়োগ করা কর্ত্তব্য।

[ নিয়োগের নিয়ম ]
প্রশ্ন—নিয়োগে কি কি নিয়ম থাক৷ আবশ্যক?
উত্তর–বিবাহ যেরূপ প্রসিদ্ধির সহিত হয় তদ্রূপ প্রসিদ্ধির সহিত নিয়োগও। যেরূপ বিবাহের জন্য ভদ্র পুরুষদিগের অনুমতি এবং বর-কন্যার প্রসন্নতা থাকা আবশ্যক।
তদ্রূপ নিয়োগ। অর্থাৎ যখন স্ত্রীপুরুষের নিয়োগ হয়, তখন
তাহারা স্বীয় আত্মীয় কুটুম্ব স্ত্রী পুরুষদিগের সমক্ষে [ প্রকাশ করিবে ] “আমরা উভয়ে সন্তানোৎপত্তির জন্য নিয়োগ করিতেছি, নিয়োগের নিয়ম পূর্ণ হইলে আমরা আর সংযুক্ত হইব না।
যদি ইহার বিরুদ্ধ কার্য করি, তবে পাপী এবং জাতি বা রাষ্ট্রের নিকট দণ্ডনীয় হইব ৷ প্রতিমাসে একবার
গর্ভাধানকৃত্য করিব এবং গর্ভস্থিতির পর এক বৎসর পর্যন্ত
পৃথক্ থাকিব।”
( প্রশ্ন) – নিয়োগ কি সবর্ণে হওয়া উচিত না ভিন্ন বর্ণের সহিতও।
(উত্তর)—সবর্ণে অথবা সবর্ণ অপেক্ষা উত্তম বর্ণের
পুরুষের সহিত। অর্থাৎ বৈশ্যাস্ত্রীর বৈশ্য ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণের
সহিত, ক্ষত্রিয়ার ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণের সহিত এবং ব্রাহ্মণীর
ব্রাহ্মণের সহিত নিয়োগ হইতে পারে। ইহার তাৎপর্য এই
যে, বীৰ্য সমান অথবা উত্তম বর্ণের হওয়া উচিত, নিজ
অপেক্ষা নিম্ন বর্ণের হওয়া উচিত নহে। ধর্ম অর্থাৎ
বেদোক্ত রীতি অনুসারে বিবাহ অথবা নিয়োগ দ্বারা
সন্তানোৎপত্তি করা সৃষ্টিতে স্ত্রীপুরুষের ইহাই প্রয়োজন ।
[ নিয়োগের আবশ্যকতা ]
প্রশ্ন— পুরুষ যখন দ্বিতীয়বার বিবাহ করিতে পারে, তখন
তাহার নিয়োগ করিবার আবশ্যকতা কি ?
উত্তর–পূর্বে লিখিয়াছি যে, দ্বিজগণের মধ্যে স্ত্রী
পুরুষের একবার মাত্রই বিবাহ হওয়া সঙ্গত, দ্বিতীয়বার নহে,বেদাদি শাস্ত্রে ইহার উল্লেখ আছে । কুমারের সহিত কুমারীর বিবাহ সঙ্গত। বিধবার সহিত কুমারের এবং কুমারীর সহিত বিপত্নীকের বিবাহ ন্যায়বিরুদ্ধ অর্থাৎ অধর্ম। বিবাহিত পুরুষ যেমন বিধবাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে না, সেইরূপ যে পুরুষ স্ত্রী সমাগম করিয়াছে তাহাকেও কুমারী বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে না। কুমারী, কন্য। বিবাহিতা পুরুষকে এবং কুমার বিধবা স্ত্রীকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা না করিলে স্ত্রী পুরুষের নিয়োগের প্রয়োজন হইবে। যে ব্যক্তি যেমন তাহার সহিত তেমন ব্যক্তিরই সম্বন্ধ হওয়া উচিত এবং তাহাই ধর্ম।
[ নিয়োগ বিষয়ে প্রমাণ ]
প্রশ্ন—বিবাহ বিষয়ে বেদাদি শাস্ত্রে যেরূপ প্রমাণ আছে, নিয়োগ বিষয়েও কি সেইরূপ প্রমাণ আছে,–না নাই ?
উত্তর—এ বিষয়ে বহু প্রমাণ আছে। দ্যাখো-শোন—
কুহস্বিদ্দোষা কুহু বস্তোরশ্বিনা কুহাভিপিত্বং করতঃ
কুহোতুঃ ৷ কো বাং শয়ুত্রা ৷ বিধ্ৰবের দেবরং মর্যংঃন ঘোষা ক্বণুতে সধস্থ আ॥ ১
ঋ০-ম০ ১০ । সূ০ ৪০।ম০ ২।
উদীর্ঘ নার্যভি জীবলোকং গতাসুমেতমুপ 'শেষ এহি'।
হস্তগ্রাভ্যস্য দিপ্রিষোস্তবেদং পত্যুর্জনিত্বমভি সং বৰ্ভুথ ॥২॥
ঋ০-ম০ ১০। সূ০ ১৮। ম০৮॥
[ অর্থ ঃ– ] হে (অশ্বিনা) স্ত্রীপুরুষ ! যেমন ( দেবরং বিধবেব) বিধবা দেবরের সহিত এবং (যোষা মর্যং ন)
বিবাহিতা স্ত্রী স্বীয় পতির সহিত ( সঞ্চস্থে ) এক স্থান ও
শয্যায় একত্র হইয়া সন্তান ( আক্বণুতে ) সর্বপ্রকারে উৎপন্ন
করে, সেইরূপ তোমরা উভয়ে স্ত্রী পুরুষ (কুহখিদ্দোষা)
কোথায় রাত্রিতে এবং (কুহ বস্তঃ ) কোথায় দিবসে একত্র
বাস করিতেছিলে ? (কুহভিপিত্বম্ ) কোথায় পদার্থ লাভ
( করতঃ ) করিয়াছিলে? এবং ( কুহোতুঃ ) কোন সময়ে
কোথায় বাস করিতেছিলে? (কো বাং শযুত্রা) তোমাদিগের
শয়নস্থান কোথায়? তোমরা কে এবং কোন দেশবাসী ? [॥১॥]
এতদ্দ্বারা সিদ্ধ হইল যে, দেশে বিদেশে স্ত্রী পুরুষ সঙ্গেই
থাকিবে এবং বিধবা স্ত্রীও নিযুক্ত পতিকে বিবাহিতা পতির
ন্যায় গ্রহণ করিয়া সন্তানোৎপত্তি করিবে।।
[ দেবর শব্দের অর্থ
প্রশ্ন—যদি কাহারও কনিষ্ঠ ভ্রাতা না থাকে, তবে বিধবা কাহার সহিত নিয়োগ করিবে ?
উত্তর—দেবরের সহিত। কিন্তু ‘দেবর' শব্দের অর্থ
তুমি যাহা বুঝিতেছ তাহা নহে। দেখ নিরুক্তে—
‘দেবরঃ কস্মাদ দ্বিতীয়ে৷ বরঃ উচ্যতে'
নিরু অ• ৩। খণ্ড● ১৫।
. বিধবার দ্বিতীয় পতিকে ‘দেবর' বলে। সে পতির কনিষ্ঠ
বা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাই হউক অথবা স্ববর্ণ বা নিজ অপেক্ষা উত্তম
'বর্ণের হউক, যাহার সহিত নিয়োগ হইবে তাহারই নাম
‘দেবর’ ।
[ অর্থ ঃ– ] হে (নারি) বিধবে! তুমি ( এবং
গতাহুম্ ) এই মৃত পতির আশা পরিত্যাগ করিয়া (শেষে )
অবিশিষ্ট পুরুষদিগের মধ্যে (অভিজীবলোকম্ ) জীবিত
দ্বিতীয় পতিকে ( উপৈহি) প্রাপ্ত হও। এবং (উদীর্ঘ ) ইহা
বিচার করিবে এবং নিশ্চয় জানিবে যে, (হস্তগ্রাভ্য
দিধিষোঃ) তোমার [ বিধবার ] পুনঃ পাণিগ্রহণকারী নিযুক্ত
পতির সন্বন্ধের জন্য যদি নিয়োগ হয় তবে (ইদম্ ) এই
( জনিত্বম্ ) উৎপন্ন পুত্র, উক্ত নিযুক্ত (পত্যুঃ ) পতির হইবে। আর তোমার প্রয়োজনে নিয়োগ করিলে এই সন্তান
(তব) তোমার হইবে। তুমি এইরূপ স্থিরনিশ্চয়।( অভি সম্ বভূথ ) হও। নিযুক্ত পুরুষও এই নিয়ম পালন করিবে ৷৷২৷৷
১৩৭। অয়্যেপতিঘ্নীহৈধি শিবা পশুভঃ সুষমা সুবৰ্চাঃ।
প্রজাবতী বীরসূর্তেরকামা স্থোনেমমগ্নিং গার্হপত্যং
সপৰ্য ॥ ৩ ॥
অথর্ব কা• ১৪। অম্বু০ ২। ম০১৮ ৷৷
হে নারি! ( অপতিঘ্ন্যদেবৃঘ্নি) তুমি পতি এবং দেবরের দুঃখদায়িনী নহ। তুমি (ইহ) এই গৃহাশ্রমে (পশুভ্যঃ) পশুদের জন্য (শিবা) কল্যাণকারিণী, (স্থযমা:)
উত্তমরূপে ধর্মের নিয়মপালনকারিণী, (সুবৰ্চাঃ) রূপবতী
এবং সর্বশাস্ত্রে বিদুষী, ( প্রজাবতী) উত্তম পুত্রপৌত্রাদিযুক্তা, (বীরসূঃ) শূর বীর পুত্রের জননী, (দেবৃকামা) দেবরের কামনাকারিণী, (স্থোনা) সুখদায়িনী, পতি বা দেবরকে (এধি ) প্রাপ্ত হইয়া (ইমম্‌) এই (গার্হপত্যম্) গৃহস্থ সম্বন্ধীয় (অগ্নিম্ ) অগ্নিহোত্র (সপর্য) ) সেবন করিতে থাক ।
‘তামনেন বিধানেন নিজো বিন্দেত দেবরঃ'।।
মনু-৯/৬১।।
যদি অক্ষতযোনি স্ত্রী বিধবা হয়, তবে পতির কনিষ্ঠ
সহোদরও তাহাকে বিবাহ করিতে পারে।
[ নিয়োগের সীমা ]
প্রশ্ন—এক স্ত্রী বা পুরুষ কত নিয়োগ করিতে পারে ?
এবং বিবাহিত ও নিযুক্ত পতিগণ কি কি নামে অভিহিত হয় ?
উত্তর—সোমঃ প্রথমো বিবিদে গন্ধর্বো বিবিদ উত্তরঃ।
তৃতীয়ো অগ্নিণ্ঠে পতিস্তুরীয়স্তে মনুষ্যজাঃ ॥
ঋ০ম ১০ । সূ० ৮৫ । ৪।
[ অর্থ :- ] হে থ্রি। (তে) তোমার যে (প্রথমঃ) প্রথম বিবাহিত (পতিঃ ) পতি তোমাকে (বিবিদে) প্রাপ্ত হয়, তাহার নাম (সোমঃ) সুকুমারতা প্রভৃতি গুণযুক্ত বলিয়া ‘সোম'। যে দ্বিতীয়বার নিয়োগ দ্বারা তোমাকে (বিবিদে) প্রাপ্ত হয় সে (গন্ধর্বঃ) এক স্ত্রীর সহিত সম্ভোগ করিয়াছে বলিয়া ‘গন্ধৰ’ । যে ( তৃতীয় উত্তরঃ) দুই পতির পরবর্তী তৃতীয় পতি, সে (অগ্নিঃ ) অতি উষ্ণতাযুক্ত হওয়ায় ‘অগ্নিসংজ্ঞক,’ এবং যাহারা (তে ) তোমার (তুরীয়ঃ) চতুৰ্থ হইতে একাদশ পর্যন্ত নিযুক্ত পতি অহারা (মনুষ্যজাঃ) 'মনুষ্য' নামে অভিহিত হয়।
যেমন (ইমাং তুমিন্দ্ৰ ) এই মন্ত্র দ্বারা স্ত্রী একাদশ পুরুষ পর্যন্ত নিয়োগ করিতে পারে, সেইরূপ পুরুষও একাদশ স্ত্রী পর্যন্ত নিয়োগ করিতে পারে।
প্রশ্ন—একাদশ শব্দদ্বারা দশ পুত্র এবং পতিকে একাদশ
গণনা করা হইবে না কেন?
উত্তর—যদি এইরূপ অর্থ করা হয় তবে ‘বিধবের
দেবরম্'; ‘দেবরঃ কল্মাদ দ্বিতীয়ো বর উচ্যতে,'; ‘অদেবৃদ্ধি’ ; এবং “গন্ধর্বোবিবিদ উত্তরঃ' ইত্যাদি বৈদিক প্রমাণ সমূহের বিরুদ্ধ অর্থ হইবে। কারণ তোমার অর্থ অনুসারে দ্বিতীয় পতিও প্রাপ্ত হওয়া যায় না।
[ আপদ্ধর্ম রূপে নিয়োগ ]
১৪• । দেবরাদ্বা সপিণ্ডাদ্বা থ্রিয়া সম্যঙ নিযুক্তয়া।
প্রজেপ্সিতাধিগন্তব্য৷ সন্তান্য পরিক্ষয়ে ৷৷ ১॥
জ্যেষ্ঠে৷ যবীয়সে৷ ভার্যাং যবীয়ান্বাগ্রজস্ক্রিয়ম্ ৷
পতিতৌ ভবতো গত্বা নিযুক্তাবপ্যনাপদি ॥ ২ ॥
ঔৱসঃ ক্ষেত্ৰজশ্চৈব• ॥ ৩॥১
মনু০ ৯/৫৯,৫৮,১৫৯।।
মনু এইসব লিখিয়াছেন যে “সপিণ্ড” অর্থাৎ পতির ছয়
পুরুষের মধ্যে, পতির কনিষ্ঠ বা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, অথবা
স্বজাতীয় এবং নিজ অপেক্ষা উচ্চ জাতিস্থ পুরুষের সহিত
বিধবা স্ত্রীর নিয়োগ হওয়া উচিত। যদি বিপত্নীক পুরুষ
এবং বিধবা স্ত্রী সন্তান কামনা করে, তবে তাহার নিয়োগ
হওয়া উচিত। সর্বথা সন্তানের অভাব হইলে নিয়োগ হইবে।
আপৎকাল অর্থাৎ সন্তান কামনা ব্যতীত, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীর
১.মনু, ৯.৫৯. ৫৮, ১৫৯ ৷৷
[ ২. স্ব স্বজাতীয় শব্দ স্ববর্ণ এবং উচ্চজাতিস্থ অর্থে উচ্চবর্ণস্থ অভিপ্রেত ]।
সহিত কনিষ্ঠ ভ্রাতার অথবা কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীর সহিত জেষ্ঠ ভ্রাতার নিয়োগ হইলে এবং সন্তানোৎপত্তির পরেও নিযুক্তগণ সমাগম করিলে পতিত হইয়া থাকে। অর্থাৎ এক নিয়োগের সীমা-দ্বিতীয় সন্তানের গর্ভধারণ পর্যন্ত। তাহার পর সমাগম করিবে না। যদি উভয়ের প্রয়োজনে নিয়োগ হয়, তবে চতুর্থ গর্ভ পর্যন্ত অর্থাৎ পূর্বোক্ত রীতি অনুসারে দশ সন্তান পর্যন্ত হইতে পারে। তদন্তর তাহা বিষয়াসক্তি বলিয়া গণ্য করা হয়। তাহাতে তাহারা পতিত বলিয়া গণ্য হয়। বিবাহিত স্ত্রীপুরুষও দশম গর্ভের পরে সমাগম করিলে কামুক বলিয়া নিন্দিত হয়। অর্থাৎ বিবাহ বা নিয়োগ সন্তানের জন্য; পশুবৎ বাম ক্রীড়ার জন্য নহে ।
[ পতির জীবিত কালেও নিয়োগ হইতে পারে ]
প্রশ্ন—কেবল পতির মৃত্যু হইলে নিয়োগ হয়, অথবা
পতির জীবদ্দশাতেও নিয়োগ হইতে পারে ?
উত্তর—পতির জীবদ্দশাতেও হইতে পারে।
‘অন্যমিচ্ছৰ সুভগে পতিং মৎ’ ॥১
ঋ০-ম০ ১০। সূ০১০। ম০. ১০ ॥
পতি সন্তানোৎপাদনে অসমর্থ হইলে স্বীয় স্ত্রীকে আজ্ঞা
দিবে, সুভগে। সৌভাগ্যেচ্ছু! তুমি (মৎ) আমা ভিন্ন (অন্যম্ ) অন্য পতি (ইচ্ছস্ব ) ইচ্ছা কর, কারণ এখন আমার দ্বারা সন্তানোৎপত্তির আশা করিও না। (তখন স্ত্রী অন্যের সহিত নিয়োগ করিয়া সন্তানোৎপত্তি করিবে) কিন্তু সেই বিবাহিত মহাশয়পতির সেবায়— তৎপর থাকিবে। স্ত্রীও রোগাদি দোষগ্রস্ত হইয়া সন্তানোৎপাদনে অসমর্থা হইলে নিজ পতিকে আজ্ঞা দিবে, 'হে স্বামিন্ ! আপনি আমাতে সন্তানোৎপত্তির ইচ্ছা পরিত্যাগ করিয়া অন্য কোন
বিধবার সহিত নিয়োগ করিয়া সন্তান উৎপন্ন করুন।
[ ১. মহাশয় পতি অর্থাৎ সদাশয় পতি ]।
[ নিয়োগ সম্বন্ধে ইতিহাসের প্রমাণ ]
পাণ্ডু, রাজার স্ত্রী কুন্তী ও মাদ্রী প্রভৃতি এইরূপ
করিয়াছিলেন । চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর পর
ব্যাসদেবের তাঁহার ভ্রাতৃবধূ অম্বিকা ও আম্বালিকার সহিত
নিয়োগ করিয়া যথাক্রমে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর এবং দাসীগর্ভে
বিদুরের জন্মদান করিয়াছিলেন। এই সব ইতিহাসও এ
বিষয়ে প্রমাণ।১
প্রোষিতে৷ ধর্মকাৰ্যার্থং প্রতীক্ষ্যোহৗে নরঃ সমাঃ।
বিদ্যার্থং ষড়, যশোর্থং বা কামার্থং ক্রীংজ্ঞ বৎসৱান্ ॥১॥
মহাভারত আদিপর্ব অধ্যায়-১০৬।।
বন্ধ্যাঃমেঽধিবেদ্যাব্দে দশমে তু মৃতপ্রজা।
একাদশে স্ত্রীজননী সভ্যত্ত্বপ্ৰিয়বাদিনী৷৷ ২ ৷৷
মনু০ ৯/৭-৬||
বিবাহিত পতি ধর্মার্থে বিদেশ গমন করিলে বিবাহিতা-
স্ত্রী আট বৎসর, বিদ্যা ও কীর্ত্তির জন্য গমন করিয়া থাকিলে ছয় বৎসর এবং ধনাদি কামনায় গমন করিয়া থাকিলে তিন বৎসর পর্যন্ত প্রতীক্ষা করিয়া পরে নিয়োগ দ্বারা সন্তানোৎ-পত্তি করিবে। বিবাহিত পতি ফিরিয়া আসিলে নিযুক্ত পতির সহিত আর কোন সম্বন্ধ থাকিবে না ৷৷ ১ ॥
সেইরূপ পুরুষের পক্ষেও নিয়ম এই যে, স্ত্রী বন্ধ্যা হইলে
আট বৎসর ( বিবাহের পর আট বৎসর পর্যন্ত তাঁহার গর্ভ
না হইলে ), সন্তান হইয়া মরিয়া গেলে দশ বৎসর এবং
গর্ভবতী হইয়া প্রত্যেক বার পুত্র প্রসব না করিয়া কন্যা প্রসব
করিলে একাদশ বৎসর অপেক্ষা করিবে। কিন্তু স্ত্রী অপ্রিয়-
বাদিনী হইলে তাহাকে সদ্য পরিত্যাগ করিয়া অন্য স্ত্রীর সহিত নিয়োগ দ্বারা সন্তানোৎপাদন করিবে ॥ ২॥
সেইরূপ, পতি অত্যন্ত দুঃখদায়ক হইলে স্ত্রী তাহাকে
পরিত্যাগ করিয়া অন্য পুরুষের সহিত নিয়োগ দ্বারা সেই
বিবাহিত পতির উত্তরাধিকারী সন্তান উৎপন্ন করিয়া
লইবে। এই সকল প্রমাণ এবং যুক্তি অনুসারে স্বয়ম্বর বিবাহ ও নিয়োগ দ্বারা স্ব স্ব কুলের উন্নতিসাধন করা কর্তব্য। ‘ঔরস’ অর্থাৎ বিবাহিত পতি দ্বারা উৎপন্ন পুত্র যেমন পিতৃ-সম্পত্তির অধিকারী হইয়া থাকে, সেইরূপ ‘ক্ষেত্রজ অর্থাৎ নিয়োগজাত পুত্রও মৃত পিতার সম্পত্তির অধিকারী হয়।
সত্যার্থ প্রকাশ হইতে সংগৃহীত
ও৩ম্ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।
সব প্রতিক্রিয়া:
আপনি এবং আরও 1 জন
লাইক করুন
কমেন্ট করুন
শেয়ার করুন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন