গুপ্তিপাড়া
শেয়ার করেছেন : Pranab Kumar Kundu
ভোলা ময়রার জন্মভিটার সন্ধানে
মহানায়কের ১৫ তম জাতীয় চলচ্চিত্র উত্সবে (১৯৬৮) পুরস্কার পাওয়া সিনেমাটি দেখেছিলাম। সম্প্রতি দেখলাম পুনরুজ্জীবনের গল্পও। তবে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি হোক বা জাতিস্মর দুইটি চলচ্চিতেই যে পার্শ্বচরিত্রটি মনে বেশ দাগ কেটেছিল সে হল ভোলা ময়রা। পিতৃদত্ত নাম ভোলানাথ নায়েক। তৎকালীন বাংলার জনপ্রিয় কবিয়াল। পদবী নায়েক হলেও সম্ভবত পারিবারিক পেশার কারণেই নামকরণ হয়েছিল ভোলা ময়রা। নামজাদা এই কবিয়াল এক বিদেশি অ্যান্টনি সাহেবের কাছে কবিগানে পরাজিত হয়েছিলেন ঠিকই, তবে হার স্বীকার করে ভোলা সাহেবকে তাঁর কাছে টেনে নিয়েছিলেন। মাল্যদান করে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সমাজের মাথাদের ভোলা বোঝাতে সাহায্য করেছিলেন যে সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্ধে গিয়ে একজন প্রকৃত শিল্পীর গুণের কদর অবশ্যই করা উচিত।
ভোলা ময়রা সম্পর্কে আরও জানার জন্য সাহায্য নিলাম ইন্টারনেটের। অনেক খোঁজাখুজির পর জানতে পারলাম নদিয়া, হুগলি ও বর্ধমান এই তিন জেলার সম্মিলিত স্থলে অবস্থিত গুপ্তিপাড়া বলে এক জায়গায় জন্ম তাঁর। ভেবে দেখলাম বেরিয়ে পড়লে মন্দ হয় না।
হাওড়া থেকে ৭৫ কিমি দূরত্বে ব্যান্ডেল-কাটোয়া লাইনে অবস্থিত গুপ্তিপাড়া। হাওড়া থেকে ট্রেনে গুপ্তিপাড়া পৌঁছতে দুই ঘণ্টারও কম সময় লাগে। হুগলি নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকা ঘিরেই গড়ে উঠেছে গুপ্তিপাড়ার জনবসতি। পশ্চিমবাংলার সব থেকে উন্নতমানের ধানও পাওয়া যায় এই গুপ্তিপাড়া থেকেই। অন্যদিকে, ফলের রাজা আম বলতেই প্রথম যে জায়গাটার নাম মনে আসে তা মালদহ হলেও গুপ্তিপাড়ার হিমসাগর আমেরও কিন্তু জাতীয় জনপ্রিয়তা আছে।
স্টেশন থেকে বেরিয়েই প্রথমে চোখে পড়েছিল ইতি-উতি ছড়ানো বেশ কিছু মিষ্টির দোকান। ট্রেন যাত্রার ধকলে খিদেও পেয়েছিল। দোকানে ঢুকে জানতে পারলাম এক নতুন তথ্য। বাংলার মিষ্টি শিল্পেরও সূচনা হয়েছিল গুপ্তিপাড়াতেই। ভোলা ময়রার জন্মস্থানের ব্যাপারটা সবাই একবাক্যে স্বীকার করলেও বিস্তারিত সঠিক তথ্য কেউই দিতে পারল না। বরং গুপ্তিপাড়ার প্রাচীন ময়রাদের কাজ-কর্ম নিয়ে জানলাম অনেক ইতিহাস। এখানেই সবার প্রথম আবিষ্কার হয়েছিল মাখা সন্দেশ। আর সেই মিশ্রণকে আকার দিয়ে নামকরণ করা হয় গুপো সন্দেশ। গোঁফের নিচে স্ব-সম্মানেই জায়গা করে নিল গুপো সন্দেশ। এরপর রিক্সা করে রওনা দিলাম মন্দির চত্বরের উদ্দেশ্যে। বাংলার স্থাপত্য শিল্পের অদ্ভূত নিদর্শন আজও বহন করে চলেছে গুপ্তিপাড়ার ৪ বৈষ্ণব মন্দির।
চৈতন্য, বৃন্দাবনচন্দ্র, রামচন্দ্র এবং কৃষ্ণচন্দ্র। এই ৪ মন্দিরেরই নির্মাণকাল ভিন্ন। মধ্য ষোড়শ শতাব্দীতে বিশ্বর রায় কর্তক নির্মিত চৈতন্য মন্দিরটিই সর্বাধিক প্রাচীন। চৈতন্য মন্দিরের গায়ের টেরাকোটা শিল্প কালের নিয়মে আজ বিলুপ্তির পথে। ৬০ ফুট উচ্চতার বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরটিই অন্যান্য মন্দিরগুলোর তুলনায় আকারে ও উচ্চতায় সবচেয়ে বড়। ১৮১০ সালে নির্মিত এই মন্দিরে বাংলার ঐতিহ্যশালী টেরাকোটা শিল্প না থাকলেও বাইরের ও ভেতরের উভয় দেওয়ালেই আছে রং-বেরঙের ছবি আঁকা। বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরকে মাঝে রেখে দুই পাশে রয়েছে রামচন্দ্র মন্দির এবং কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির। অষ্টাদশ শতাব্দীতে শেওড়াফুলির রাজা হরিশচন্দ্র রায় নির্মাণ করেন একচালার রামচন্দ্র মন্দিরটি। এই মন্দিরের গায়ে অভূতপূর্ব টেরাকোটা শিল্পের নিদর্শন প্রত্যক্ষ করা যায়। রামায়ণের নানা ঘটনা থেকে শুরু করে তৎকালীন যুগের দৈনন্দিন জীবনেরও বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি তুলে ধরা হয়েছে টেরাকোটার মাধ্যমে।
১৭৪৫ সালে নবাব আলিবর্দি খাঁ-র শাসনকালে তৈরি হয় কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরটি। এই মন্দিরটি আটচালাবিশিষ্ট। গুপ্তিপাড়ার ঐতিহ্য শুধু মন্দিরেই সীমাবদ্ধ নয়। বৈষ্ণব সংস্কৃতি দ্বারা ভালভাবেই প্রভাবিত গুপ্তিপাড়া। স্থানীয় মানুষ আজও একই উদ্যমের সঙ্গে রাস, দোল এবং রথযাত্রা পালন করে চলেছে। গুপ্তিপাড়ার সব থেকে বড় উৎসব হল রথযাত্রা। পশ্চিমবাংলার সর্বাধিক প্রাচীন ও বৃহৎ রথগুলোর মধ্যে গুপ্তিপাড়ার রথ অন্যতম। দূরত্ব অতিক্রম করার দিকে সমগ্র ভারতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে গুপ্তিপাড়ার রথ। প্রথমটা অবশ্যই পুরীর রথের জন্য নির্দিষ্ট স্থান। ভগবান বৃন্দাবনচন্দ্রের ঘরে ফেরার আগের দিন অর্থাৎ উল্টোরথের প্রাক্কালে ভাণ্ডারলুট উৎসব খুব ধুমধাম করে পালিত হয় গুপ্তিপাড়ায়। পূর্ব ভারতের বহু দর্শনার্থী এদিন গুপ্তিপাড়ায় আসেন রথের দড়ি টানার সৌভাগ্য লাভ করতে।
গুপ্তিপাড়াতেই প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজোর প্রচলন হয়। ১৭৩০ সালে সেন রাজাদের বাড়ির দুর্গাপূজায় অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেন কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে ১২ জন মিলে একটি সংগঠন তৈরি করে ১৭৬১ সাল থেকে সূচনা করেন বারোয়ারি দুর্গাপূজার।
‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই
পাইলেও পাইতে পারো, অমূল্য রতন’
ভেবেছিলাম ভোলা ময়রার জীবন সম্বন্ধে আরও জানতে পারব। সেই উদ্দেশ্য সফল হল না ঠিকই, তবে জানতে পারলাম বাংলার মিষ্টির উৎসের কথা। জানলাম বারোয়ারি দুর্গাপূজার আদি ইতিহাস। জানলাম বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহনলালের জন্মস্থানও এই গুপ্তিপাড়া। গুপ্তিপাড়ায় আসার উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও কলকাতায় ফিরলাম একরাশ ইতিহাস, শিল্প ও সংস্কৃতির সাক্ষী হয়ে ।
সুজয় চক্রবর্তী
৩১ অক্টোবর ২০১৪
গুপ্তিপাড়া নিয়ে ইংরাজীতে একটা ভালো লেখা পড়েছিলাম, আগ্রহী পাঠকরা পড়ে দেখতে পারেন নিচের লিংক এ ক্লিক করে
শেয়ার করুন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন