বুধবার, ১০ আগস্ট, ২০২২

কমিউনিস্টদের দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ

 

কমিউনিস্টদের দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ


শেয়ার করেছেন ঃ প্রণব কুমার কুণ্ডু



1 জন এবং যে টেক্সটে 'বামপল্থীদের দৃষ্টিতে ভারতীয় মনীষী প্রথম পর্ব: রবীন্দ্বনাথ ঠাকুর ও ভবানী সেন আমাং আসিল আসিলে 父 তথ্যসুত্র: 'মার্ক্সবাদী সাহিত্য: বিতর্ক'; প্রথম খন্ড, ধনঞ্জয় দাশ "রবীন্দ্র দর্শনই ভারতীয় শাসকশ্রেণীর দর্শন। রবীন্দ্র দর্শনকে আক্রমণ করতে হবে শাসকশ্রেণীকে পরাস্ত করার জন্য। রবীন্র সাহিত্যের সঙ্গে মার্ক্রবাদের বিরোধ এত প্রচন্ড যে প্রগতির শিবিরে তার স্থান হতে পারে না।" -কমরেড় ভবানী সেন্' লেখা আছে-এর একটি ছবি হতে পারে
বামপন্থীদের দৃষ্টিতে ভারতীয় মনীষী
প্রথম পর্ব: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ভবানী সেন
***
“...রবীন্দ্র দর্শনই ভারতীয় শাসকশ্রেণীর দর্শন। রবীন্দ্র দর্শনকে আক্রমণ করতে হবে শাসকশ্রেণীকে পরাস্ত করার জন্য। রবীন্দ্র সাহিত্যের সঙ্গে মার্কসবাদের বিরােধ এত প্রচণ্ড যে প্রগতির শিবিরে তার স্থান হতে পারে না। রবীন্দ্র সাহিত্য হল প্রগতির শিবির থেকে মানুষ ভুলিয়ে বের করে নিয়ে যাবার মােহিনী মায়া।…”
―কমরেড ভবানী সেন।
১৯৪৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য এবং ১৯৬২ সালের কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড ভবানী সেনের লেখনী যেমন ক্ষুরধার ছিল, তার চেয়েও বেশি বিদ্বেষ ছিল ভারতীয় মনীষীদের ওপর; বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর। এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধুই ‘তাঁর ব্যক্তিগত’ ছিল না। পার্টির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদত ছিল এতে। আজ তাঁকে ও 'মার্ক্সবাদী' পত্রিকাকে নিয়েই আলোচনা হোক। কারণ, এতেই বর্তমানের বাম তাত্ত্বিকদের রবীন্দ্রনাথ, স্বামীজী, শ্যামাপ্রসাদ প্রমুখের প্রতি ক্রমাগত বিষদগারের বীজ নিহিত রয়েছে।
কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের প্রস্তুতি হিসেবে একটি রাজ্য-সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের কাজকর্ম পরিচালনার জন্য নতুনভাবে 'প্রাদেশিক সাংস্কৃতিক সাব-কমিটি' গঠিত হয়। সেই কমিটিতে ছিলেন গােপাল হালদার, নীরেন্দ্রনাথ রায়, হীরেন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, স্নেহাংশু আচার্য, বিনয় রায়, চারুপ্রকাশ ঘােষ, সুভাষ মুখােপাধ্যায়, ভবানী সেন ও সােমনাথ লাহিড়ী প্রমুখ।
১৯৪৮-এর পুনরুজ্জীবিত 'মার্ক্সবাদী' পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ভবানী সেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সােমনাথ লাহিড়ীও ছিলেন এর সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। এই দুই নেতা অন্যান্য পার্টি-সদস্যদের সহযােগিতায় ‘মার্ক্সবাদী'কে প্রকৃতই একটি তাত্ত্বিক পত্রিকায় রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। “বুর্জোয়া ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে মতবাদের সংগ্রাম পরিচালনা করার জন্য”ই যে 'মার্ক্সবাদী'র আত্মপ্রকাশ—একথা প্রথম সংকলনে 'সম্পাদকের ভূমিকা'য় স্পষ্টভাবেই ঘােষণা করা হয়।
কোনো ‘আতি-পাতি নেতা’ ছিলেন না কমরেড ভবানী সেন। সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসনের জন্য ভবানী সেনেরই হস্তক্ষেপ যাচনা করতেন নেতারা। কমরেড হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়-এর 'তরী হতে তীর' গ্রন্থে এর স্বীকৃতি আছে। তিনি লিখেছেন, "পার্টি মহলে... বিনয় ঘোষ প্রভৃতি বেশ কয়েক জনের মনে তার ( বিষ্ণু দে) সম্বন্ধে নানান নালিশ জমা থাকত, মাঝে মাঝে প্রকাশও হয়ে পড়ত, এবং দুই তরফের লোক হয়ে আমার ঘটত অস্বস্তি, একাধিকবার পার্টি-সেক্রেটারী ভবানী সেন-এর সঙ্গে বসে ফয়সালার চেষ্টা হত― ভবানীবাবু অন্তত এসব ব্যাপারে অন্য পার্টিনেতার তুলনায় ছিলেন সাহিত্যিক সমস্যার সমঝদার।”
চলুন দেখে নেওয়া যাক এই বিখ্যাত নেতার রবীন্দ্রদূষণের উদাহরণ।
কমরেড ভবানী সেন মার্ক্সবাদী পত্রিকায় (পঞ্চম সংকলন, ১৯৪৯, পৃ. ১২৫-১৭২) “প্রগতি সাহিত্যের আত্মসমালোচনা” শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে যে 'বক্তব্য রেখেছিলেন' তার বিশেষ কিছু অংশ দেখে নেওয়া যাক:–
📌১) ...রবীন্দ্রনাথের সুদীর্ঘ জীবনে এই রাজনৈতিক ধারণার কোন মৌলিক পরিবর্তন হয় নি। রাষ্ট্রীয় গণসংগ্রাম মাঝে মাঝে তার মনের উপর রেখাপাত করেছে, বৃটিশ শাসনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি মাঝে মাঝে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেছেন, কিন্তু রাজনীতিক্ষেত্রে তাঁর দর্শন ছিল ‛গঠনমূলক কাজ’, তাই সবসময়ই তিনি ছিলেন কংগ্রেসের বামপন্থীদের বিরােধী।…
📌২) ...উপনিষদের মায়াবাদ হল রবীন্দ্র দর্শনের সারমর্ম। এই দর্শনই শ্রেণীসংগ্রামে বুর্জোয়াশ্রেণীর সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হাতিয়ার। মজুরশ্রেণীকে শ্রেণীসংগ্রাম ভুলিয়ে দেবার মত এত বড় শক্তিশালী হাতিয়ার ধনিকশ্রেণীও আবিষ্কার করতে পারেনি।…
📌৩) তিনি (রবীন্দ্রনাথ) বিশুদ্ধ বুর্জোয়া ধর্মমতাবলম্বী।
📌৪) ...সােজা কথায় তিনি হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যে বিশ্বাসী ছিলেন না। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার মধ্যে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত না দেখে তিনি দেখেছিলেন এই যে মুসলমানেরা মারতে পারে এবং হিন্দুরা শুধু পড়ে পড়ে মার খায়। তাই হিন্দু-মুসলমানের মিলন হয় না।...
📌৫) ...হিন্দু মহাসভা এবং রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের মতের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই মতের কোন পার্থক্য নেই।…
📌৬) ...রবীন্দ্রনাথের এ মতটা তাকে গান্ধীর চেয়েও প্রতিক্রিয়াশীল করে তুলেছে, একেবারে তাকে সাভারকরের দীক্ষাগুরুতে পরিণত করেছে।…
📌৭) ...সামাজিক, রাজনৈতিক ও দার্শনিক মতবাদে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতপক্ষে বিবেকানন্দেরই উত্তরাধিকারী।..
📌৮) ...সমাজতন্ত্র রবীন্দ্রনাথের দর্শনের বিরোধী…
📌৯) ...রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন ধরে যে সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন তার মূল কথা হােল এই “প্রাণের সম্পূর্ণতা”। শোষিত জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বিরুদ্ধে এযে কত শক্তিশালী হাতিয়ার তা বােঝা যায় এই উজ্জ্বল দার্শনিক তত্ত্বকে শ্রেণী সমস্যার সমাধানে যে কাজে তিনি লাগিয়েছেন তাই দেখে। রবীন্দ্র দর্শন এবং রবীন্দ্র সাহিত্যের ভিতরকার কথাই হােল এই—সংসারের দুঃখ কষ্ট জালা যন্ত্রণা শােষণ অবিচার অত্যাচার এ সমস্তের বিরুদ্ধে নিস্ফল প্রতিবাদ করে লাভ নেই, প্রাণের সম্পূর্ণতা ছাড়া শোষিত মানুষের মুক্তির কোন উপায় নেই,। এই দার্শনিক মতই কাব্যরস আকারে তিনি বুদ্ধিজীবীদের কাছে পরিবেশন করেছেন। এই প্রতিক্রিয়াশীল মতবাদের সঙ্গে টলস্টয়ের মতবাদের তুলনা করা মন্ত ভুল।…
📌১০) ...১৮৭৫ সালের পর থেকে ভারতে যে নবীন বুর্জোয়া শ্রেণীর উদয় হল, রবীন্দ্রনাথ তাদের প্রতিনিধি। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের যতখানি দ্বেষ ছিল, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষায় তা ফুটে বেরিয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গে এই তরুণ বুর্জোয়া শ্রেণীর সমস্ত দুর্বলতাই প্রতিফলিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষায়। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপসে অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ, গণসংগ্রামের প্রতি বিমুখতা, সমাজের গণতান্ত্রিক পরিবর্তনে অক্ষমতা এমন কি জমিদারি প্রথা বাঁচিয়ে রেখে ফিউডালিজম-এর সঙ্গে আপস এবং সর্বোপরি হিন্দু-রিভাইভালিজম।…
📌১১) ...রবীন্দ্র দর্শনই ভারতীয় শাসকশ্রেণীর দর্শন। রবীন্দ্র দর্শনকে আক্রমণ করতে হবে শাসকশ্রেণীকে পরাস্ত করার জন্য। রবীন্দ্র সাহিত্যের সঙ্গে মার্কসবাদের বিরােধ এত প্রচণ্ড যে প্রগতির শিবিরে তার স্থান হতে পারে না। রবীন্দ্র সাহিত্য হােল প্রগতির শিবির থেকে মানুষ ভুলিয়ে বের করে নিয়ে যাবার মােহিনী মায়া।
এরপর প্রশ্ন উঠতেই পারে, এইসব বক্তব্য কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থন করেনি? ভবানী সেন পরে ক্ষমা চেয়ে প্রবন্ধটি প্রত্যাহার করেন?
না। উনি এই প্রবন্ধ 'প্রত্যাহার' করেননি। পার্টিও করেনি। 'মার্কসবাদী' পত্রিকার শেষ-সংকলনে প্রকাশকের বক্তব্য রূপে একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশিত হয়। এটি একটি মামুলী ঘােষণা মাত্র নয়। 'মার্কসবাদী' সংকলনের প্রকাশক প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও বাম সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা সুশীল জানা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, 'প্রকাশকের বক্তব্য রূপে সেদিন কমিউনিস্ট পার্টির গৃহীত সিদ্ধান্তই ঘােষিত হয়েছিল।' ঐ সিদ্ধান্ত অনুসারে মার্কসবাদী-তে প্রকাশিত ১২টি প্রবন্ধকে 'মার্কসবাদ-লেনিনবাদ' বিরােধী হওয়ায় 'বিনাশর্তে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় কিন্তু সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কে বিভিন্ন সংকলনে যে সমস্ত প্রবন্ধ বেরিয়েছিল (ইনক্লুডিং ভবানী সেনের ওই বিতর্কিত প্রবন্ধ) সেগুলি সম্বন্ধে বলা হয়, “...এখনো আলােচনা ও বিতর্কের অবকাশ আছে। তাই এই অবস্থায় সেগুলির উপর কোন সুস্পষ্ট মতামত দেওয়া সম্ভব নয়।”
এছাড়া দিল্লীর অজয়-ভবনের মহাফেজখানায় সংরক্ষিত ভবানী সেন-এর আত্মসমালোচনামূলক প্রতিবেদন পুনর্বার পরীক্ষা করে প্রগতি-সংস্কৃতি আন্দোলনের প্রখ্যাত নেতা চিন্মোহন সেহানবীশ জানিয়েছেন যে, ঐ প্রতিবেদনে তাঁর রচনা প্রত্যাহার সম্বন্ধে ভবানীবাবু একটি কথাও উচ্চারণ করেন নি। সুতরাং ‘ভবানী সেন প্রবন্ধ প্রত্যাহার করেছেন’ মর্মে বাজার-চালু 'গুজব'-এর সত্যই কোনাে বাস্তব ভিত্তি নেই।
তবে এটা নিশ্চিত যে আজকের এই নব্য বামেদের হঠাৎ এই কুমিরের কান্নার মতো রবীন্দ্রপ্রেম দেখলে কমরেড ভবানী সেন আরেকবার লজ্জায় মুখ ঢাকতেন। তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন বটে, তবে এতটাও হিপোক্রিট ছিলেন না। তিনি মার্ক্সিয় তত্ত্ব অনুসারে যা মেনে নিয়েছিলেন, তাই স্পষ্টভাবে লিখেছিলেন। মনে এক, লেখায় আরেক করে নিজের আইডিওলজির সঙ্গে বেইমানি করেননি বর্তমান বামেদের মতো।
তথ্যসূত্র:
১) 'মার্ক্সবাদী সাহিত্য: বিতর্ক'; প্রথম খন্ড, ধনঞ্জয় দাশ
২) 'মার্ক্সবাদী' পত্রিকা; পঞ্চম সংকলন।
৩) 'বাংলা প্রগতি সাহিত্যের আত্মসমালোচনা', ভবানী সেন (রবীন্দ্র গুপ্ত ছদ্মনামে)
বিশেষ কৃতজ্ঞতা:
১)'কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া'র অফিসিয়াল ওয়েবসাইট
২) অজয় ভবন মহাফেজখানা।
৩) আনন্দবাজার পত্রিকা
Pranab Kumar Kundu
1টি কমেন্ট
লাইক করুন
কমেন্ট করুন
শেয়ার করুন
1টি কমেন্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন